এদিকে অনন্ত মিশ্র রূপনগর হইতে যাত্রা করার পরেই রূপনগরে মহাধূম পড়িয়াছিল। মোগল বাদশাহের দুই অশ্বারোহী সেনা রূপনগরের গড়ে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহারা চঞ্চলকুমারীকে লইতে আসিয়াছে।
নির্মিলের মুখ শুকাইল; দ্রুতবেগে সে চঞ্চলকুমারীর কাছে গিয়া বলিল, “কি হইবে সখি?”
চঞ্চলকুমারী মৃদু হাসি হাসিয়া বলিলেন, “কিসের কি হইবে?”
নির্মকল। তোমাকে ত লইতে আসিয়াছে। কিন্তু এই ত ঠাকুরজী উদয়পুর গিয়াছেন–এখনও তাঁর পৌঁছিবার বিলম্ব আছে। রাজসিংহের উত্তর আসিতে না আসিতেই তোমায় লইয়া যাইবে–কি হইবে সখি?
চঞ্চল। তার আর উপায় নাই–কেবল আমার সেই শেষ উপায় আছে। দিল্লীর পথে বিষভোজনে প্রাণত্যাগ–সে বিষয়ে আমি চিত্ত স্থির করিয়াছি। সুতরাং আমার আর উদ্বেগ নাই। একবার কেবল আমি পিতাকে অনুরোধ করিব–যদি মোগলসেনাপতি সাত দিনের অবসর দেন।
চঞ্চলকুমারী সময়মত পিতৃপদে নিবেদন করিলেন যে, “আমি জন্মের মত রূপনগর হইতে চলিলাম। আমি আর কখন যে আপনাদিগের শ্রীচরণ দর্শন করিতে পাইব, আর কখন যে বাল্যসখীগণের সঙ্গে আমোদ করিতে পাইব, এমত সম্ভাবনা নাই। আমি আর সাত দিনের অবসর ভিক্ষা করি–সাত দিন মোগলসেনা এইখানে অবস্থিতি করুক। আর সাত দিন আমি আপনাদিগকে দেখিয়া শুনিয়া জন্মের মত বিদায় হইব।”
রাজা একটু কাঁদিলেন। বলিলেন, “দেখি, সেনাপতিকে অনুরোধ করিব, কিন্তু তিনি অপেক্ষা করিবেন কি না, বলিতে পারি না।”
রাজা অঙ্গীকারমত মোগলসেনাপতির কাছে নিবেদন জানাইলেন। সেনাপতি ভাবিয়া দেখিলেন, বাদশাহ কোন সময় নিরুপিত করিয়া দেন নাই–বলিয়া দেন নাই যে, এত দিনের মধ্যে ফিরিয়া আসিবে। কিন্তু সাত দিন বিলম্ব করিতে তাঁহার সাহস হইল না; ভবিষ্যৎ বেগমের অনুরোধ একেবারে অগ্রাহ্য করিতেও পারিলেন না। আর পাঁচ দিন অবস্থিতি করিতে স্বীকৃত হইলেন। চঞ্চলকুমারীর বড় একটা ভরসা জন্মিল না।
এদিকে উদয়পুর হইতে কোন সংবাদ আসিল না–মিশ্র ঠাকুর ফিরিলেন না। তখন চঞ্চলকুমারী ঊর্ধ্বিমুখে, যুক্তকরে বলিল, “হে অনাথনাথ দেবাদিদেব! অবলাকে বধ করিও না।”
রজনীতে নির্মুল আসিয়া তাঁহার কাছে শয়ন করিল। সমস্ত রাত্রি দুই জনে দুই জনকে বক্ষে রাখিয়া রোদন করিয়া কাটাইল। নির্মিল বলিল, “আমি তোমার সঙ্গে যাইব।” কয় দিন ধরিয়া সে এই কথাই বলিতেছিল। চঞ্চল বলিল, “তুমি আমার সঙ্গে কোথায় যাইবে? আমি মরিতে যাইতেছি।” নির্মচল বলিল, “আমিও মরিব। তুমি আমায় ফেলিয়া গেলেই কি আমি বাঁচিব?” চঞ্চল বলিল, “ছি! অমন কথা বলিও না–আমার দুঃখের উপর কেন দুঃখ বাড়াও?” নির্মাল বলিল, “তুমি আমাকে লইয়া যাও বা না যাও, আমি নিশ্চয় তোমার সঙ্গে যাইব–কেহ রাখিতে পারিবে না।”
দুই জনে কাঁদিয়া রাত্রি কাটাইল।