» » » মহাপ্রস্থান

বর্ণাকার

দুই

ভোরবেলা হরিদা এসে হাজির। আমাদের পুরনো কাজের লোক। কী কারণে যেন অনেকদিনের জন্যে দেশে চলে গিয়েছিলেন। আমরা তাঁর আসার আশা ছেড়ে দিয়েছিলুম। হঠাৎ বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে হাসতে হাসতে প্রভাতসূর্যের মতো উদয়। তাঁকে দেখে বড়মামা আর মেজোমামার কি উল্লাস। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে দু’জনের ধেই ধেই নৃত্য। সঙ্গে অসাধারণ গান।

In you catch a chinchilla in chile

And then cuto-ff its beard, willynilly.

With a small rajor blade,

You can say that youv’e made

A chilean chinchila’s chinchilly.

এক রাউণ্ড নাচের পর বড়মামা হরিদাকে জড়িয়ে ধরলেন।

‘হরিদা! বাবা কেদারনাথ তোমাকে পাঠিয়েছেন। তুমি কোনও স্বপ্ন পেয়েছ?’

‘স্বপ্ন নয়, আদেশ পেয়েছি। আমাদের বুড়োশিবতলার বেলগাছের মাথা থেকে ভর সন্ধেবেলা কে যেন গম্ভীরগলায় হেঁকে বললেন, ‘হরে, ওরা বিপদে পড়েছে, শিগগির ছুটে যা ছেলে দুটোকে সেভ কর।’

‘বাবা মহাদেবের আদেশ। তবে ইংরিজিটা না বললেই পারতেন।’

‘উনি ইংরিজিটা বলেনিনি, ইংরিজিটা আমার।’

‘হ্যাঁ, তাই বলো।’

বেলার দিকে মেজোমামা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, রেল অফিস। টিকিট কাটতে। দুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বার। হরিদ্বার থেকে ঋষিকেশ হয়ে হিমালয়। রুদ্রপ্রয়াগ, দেবপ্রয়াগ। রুট আমাদের তৈরি। দু’জনেই ঠিক করেছেন, মহাপ্রস্থানের পথ ধরেই এগোবেন। যতদূর যাওয়া যায়। পথের শেষে সত্যিই যদি দুর্গ থাকে, তাহলে দরজাটা ঠেলে দেখে আসবেন, ভেতরে কতবড় বাগান, ফোয়ারা, ইন্দ্রপুরী! স্বর্গে মানুষ কী খায়। বড়মামার ধারণা, সবাই সেখানে রকম রকম আইসক্রিম খায়, ট্রবোর, ভ্যানিলা, চকোলেট। বরফে গর্ত করে কামধেনুর দুধ আর চিনি ঢেলে দিলেই কুলফি মালাই।

সাতদিন পরেই আমরা তিনজন হরিদ্বার। হর-কি-পৌরিতে গঙ্গার ধারে ধারে তোফা বসে আছি। গঙ্গা বহে চলেছেন হর হর শব্দে। সত্যি কি জায়গা! বড়মামা প্রায় ধ্যানস্থ অবস্থায় ঘোষণা করলেন, ‘আমি আর মর্ত্যে ফিরব না।’

মেজোমামা বললেন, ‘এইটা তোমার স্বর্গ?’

‘এই-ই হল স্বর্গের চৌকাঠ। কাল আমার আরও আনন্দের দিন। লছমনঝুলা পেরিয়ে সোজা চলে যাব সেই জায়গায় যেখানে মৃত্যু নেই, দুঃখ নেই, ভোট নেই, বোমা নেই, হিন্দি সিনেমা নেই। সেখানে অনন্ত যৌবন। জলে জন্ডিস নেই, আন্ত্রিক নেই, অ্যান্টিবায়োটিক নেই।’

মেজোমামা বললেন, ‘ওখানে কাটলেট নেই, চিলি চিকেন নেই, ফ্রায়েড প্রন নেই।’

‘মেজো! তোর এখনো ভোগে এত মতি! ভোগই দুর্ভোগের কারণ। বিচার কর। কাটলেটে কী আছে! এক টুকরো মাংস। সেটা কি মাংস, কেউ জানে না, কুকুর হতে পারে, ধেড়ে ইঁদুর হতে পারে, সেটাকে কিমা করে, ময়দা দিয়ে বেঁধে, ডিম গোলায় চুবিয়ে লেড়ো বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে শূকরের চর্বিতে ভাজা। ভাবলেই পেটগুলোয়। চিলি চিকেনে কী আছে। দীন-হীন-অসহায় এটা মুরগিকে শুধু হত্যা করেনি, নৃশংস এক রাঁধুনী তাকে নুন আর লঙ্কায় চুবিয়েছে। আর ফ্রায়েড প্রন! চিংড়ি হল জলের পোকা। পচা চিংড়ির গন্ধে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তাহলে বুঝলে ব্যাপারটা! ভোজ মানে হিংসা, হত্যা, বদহজম, দুর্ভোগ। আমাদের এই বয়েসে দুটো জিনিসের প্রয়োজন, ত্যাগ আর সংযম।’

মেজোমামা আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি তো তোমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট।’

‘আরে তাতে কী হয়েছে, যাঁহা বাহান্না, তাঁহা তিপান্না। পঁয়তাল্লিশ আর পঞ্চান্ন একই ব্যাপার। ফর্টি তো ক্রশ করেছে।’