» » » একদা এক বাঘের গলায়

বর্ণাকার

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

মামা সমগ্র
উপন্যাস

একদা এক বাঘের গলায়

পাঁচ

পেছনে ঝোপঝাড়, জঙ্গল, দেবদারু, ইউক্যালিপটাস, জোড়া পুকুর। ভাগ্য ভালো, সূর্য অনেক আগেই ডুবে গেছে। আকাশে যেন ঘোর লেগে গেছে। কোথা দিয়ে কোথায় যাচ্ছি কে জানে! চোরের মতো। ছোট চোর, বড় চোর। আমার তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। ঝোপেঝাড়ে বল খোঁজার অভ্যাস আছে। অসুবিধে হচ্ছে মেজোমামা আর মাসিমার। মাসিমার শাড়ির আঁচল। মেজোমামার চাদর। কেবলই জড়িয়ে যাচ্ছে ডালপালায়। ওদিকে খুব হইচই হচ্ছে। ভাগ্যিস দাঁতভাঙা বৃদ্ধ এসেছিলেন।

বড়মামা ফিসফিস করে বললেন, ‘টাকা তো আমাকে দিতেই হবে আশুবাবু! ক্ষতি যখন হয়েছে!’

‘কারুর কিস্যু ক্ষতি হয়নি। সব হল ধান্দাবাজ। বেড়ালের জাত মশাই। নরম মাটি দেখেছে কি অমনি আচড়াও।’

মাসিমা বললেন, ‘দেখেশুনে মনে হল, কম-সে-কম হাজার-দশেক টাকার ধাক্কা।

মেজোমামা বললেন, ‘আজ তোমার মহিলা সমিতি আর পরোপকারের শেষ দিন। আজ ওরা সব একখানা একখানা করে ইট খুলে নিয়ে যাবে।’

আশুবাবু বললেন, ‘আপনার সেক্রেটারি সুহাসবাবু কোথায় গেলেন বলুন তো?’

আমগাছের মোটা গুঁড়ির আড়াল থেকে উত্তর এল, ‘আজ্ঞে আমি এখানেই আছি। মশাই সর্ব অঙ্গ জ্বলিয়ে দিয়েছে ডাক্তারবাবু।’

‘তুমি আমাদের ফেলে রেখে পালিয়ে এলে সুহাস?’

‘আর যে কোনও পথ ছিল না দাদা! জানেনই তো কথায় আছে—চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।’

বড়মামা বললেন, ‘এ জায়গাটা তোমার কী রকম মনে হয়, বেশ নিরাপদ? এক কাপ চা পেলে হত।’

‘চা? চা এখানে পাবেন কোথায়। সাপখোপ পেতে পারেন।’

‘আমরা এখন তাহলে যাই কোথায়?’

‘আমি একটা ভালো কাজ করেছি স্যার। কাজের কাজ। ওই ধোবিডাঙার মাঠে আপনার গাড়িটা এনে রেখেছি।’

‘সে কী হে! আমার গাড়ি তো বিগড়ে বসে অছে। স্টার্ট নিচ্ছে না।’

‘সে আমি ঠিক করে এনেছি। এক ফুঁয়ে সব ঠিক হয়ে গেছে। কারবুরেটারে ময়লা জমেছিল।’

‘লক্ষ্মী ছেলে, সোনা ছেলে। একবার গাড়িতে উঠে বসতে পারলে আর আমাদের পায় কে! চলো চলো, তাড়াতাড়ি পা চালাও।’

ঝোপঝাড় ভেঙে আমরা ধোবিডাঙার মাঠে এসে উঠলুম। একফালি চাঁদ মুচকি হাসছে আকাশে। গোটাকতক তারা এলোমেলো ছড়িয়ে আছে। আমার তেমন কোনও ভয় লাগছে না। মাঝে-মাঝে আমার কেবল হাসি পাচ্ছে। কী থেকে কী হয়ে গেল! এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ।

সুহাসবাবু বললেন, ‘এ হল ওই ঘোষালের কাজ। ভালো কিছু হতে দেখলেই লোক লাগিয়ে সব পণ্ড করে দেয়!’

‘অ, তাই বলো, ঘোষাল কলকাঠি নেড়েছে! ওকে আর কিছুতেই ঢিট করা গেল না!’

‘যাবে না কেন? সহজেই যায়। ওকে যদি প্রেসিডেন্ট করে দেন!’

‘বেশ তো! এ আর এমন শক্ত কী! আজই করে দাও না।’

‘আজ কী করে করবেন। প্রথমে টাকা দিয়ে ওকে সভ্য হতে হবে। তারপর নির্বাচন। সব ব্যাপারেরই তো একটা ইয়ে আছে। অজ ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করুক। আপনি দিনকতক বরং গা-ঢাকা দিয়ে থাকুন।’

‘গা-ঢাকা দোব কেন? আমি কি কাপুরুষ? তা ছাড়া আমার কোনও শত্রু নেই।’

‘এখন আপনার অনেক শত্রু। সমাজসেবা অত সহজ নয় ডাক্তারবাবু! বেড অব রোজেস।’

‘ভুল বললে। বেড অব থর্ন।’

‘আজ্ঞে কাঁটা ছাড়া কি গোলাপ হয়!’

কথায় কথায় আমরা গাড়ির কথায় এসে পড়েছি। ফিকে চাঁদের আলোয় চকচক করছে। আমরা উঠে বসলুম। আশুবাবুও উঠলেন। বড়মামা বললেন ‘সুহাস, তুমি?’

‘আজ্ঞে, আমি বেশ আছি।’

‘বেশ আছি মানে! এই বললে, চাচা আপনা প্রাণ বাঁচা। ওরা তোমাকে একা পেলে তো ঠেঙিয়ে শেষ করে দেবে।’

‘এই তো পাশের আমার দিদির বাড়ি। সেইখানেই গা-ঢাকা দোব।’

‘দেখো মার খেয়ে মোরো না। তুমি আমার রাইট-হ্যান্ড।’

স্টার্ট দিতেই গাড়ি স্টার্ট নিয়ে নিল। গোল একটা বৃত্ত তৈরি করে, সোজা রাস্তায় গিয়ে উঠল। আশুবাবু জিগ্যেস করলেন, ‘সুহাসবাবু আপনার কত দিনের চেনা স্যার?’

বড়মামা স্টিয়ারিং-এ পাক মারতে মারতে বললেন, ‘এই বছরখানেক হবে।’

‘লোক মোটেই সুবিধের নয়, বুঝলেন বড়বাবু? এ হল গিয়ে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘোষালের নিজের লোক। ভেতর থেকে সব চুরমার করতে চাইছে।

‘কী আশ্চর্য। আমি তো খারাপ কিছু করতে চাইনি। আমি তো সকলের উপকার করতেই চেয়েছি।’

‘সেই অপরাধেই তো আপনার বাঘের পেটে যাওয়া উচিত। মনে নেই নবকুমারের কী হয়েছিল।’

‘এবার আমি সব ছেড়ে দোব। এমনকি ডাক্তারিও। এ দেশেই আর থাকব না।’

ফাঁকা রাস্তা ধরে বড়মামার গাড়ি ফরফর করে চলেছে। এটা আবার কোন রাস্তা কে জানে। মেজোমামা বললেন, ‘আজ যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলুম। মনে হয় কুসির মুখ দেখে।’

মাসিমা বললেন, ‘আমি যে তোমার মুখ দেখে উঠেছিলুম সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’

বড়মামা বললেন, ‘আমি তাহলে কার মুখ দেখে উঠেছিলুম?’

‘রোজ যা করো। নিজের মুখ দেখেই উঠেছিলে।’

আমি বললুম, ‘আমি তাহলে কার মুখ দেখে উঠেছিলুম?’

মেজোমামা বললেন, ‘তুমি উঠেছিলে বড়মামার মুখ দেখে। ও মুখ দেখলে সারাদিন বড় আনন্দে কাটে।’

আশুবাবু হইহই করে উঠলেন, ‘ডানদিক, ডানদিকে চলুন। বাড়ি যাবেন তো।’

‘বাড়ি যাব কেন? বাড়ি গেলে আর গা-ঢাকা দেওয়া হল কী?’

মেজোমামা বললেন, ‘সে কী! তুমি তাহলে কোথায় চললে?’

‘সোজা মধুপুর।’

মাসিমা বললেন, ‘মধুপুরে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল বড়দা?’

‘কবে আর ভালো ছিল বোন?’

আশুবাবু বললেন, ‘সত্যি মধুপুর?’

‘আমি বড় একটা মিথ্যে বলি না আশুবাবু। আমার মন্ত্রই হল করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।’

মেজোমামা বললেন, ‘এতে তোমার মরার মতো কী করা হল? তুমি যেখানে খুশি যাও, আমাদের নামিয়ে দাও।’

‘এক যাত্রায় পৃথক ফল কি হয় ভাই! আমরা সদলে মধুপুর যাব।’

আশুবাবু বললেন, ‘কোথায় থাকবেন?’

‘সেখানে আমাদের ফাস্টক্লাস বাগানবাড়ি আছে। বড় বড় গোলাপ।

‘কী মজা।’ আশুবাবু আনন্দে আটখানা।’

মাসিমা বললেন, ‘গাড়ি থামাও। আমরা নেমে যাই।’

আশুবাবু বললেন, ‘মাঈজি আপনাদের আনন্দ হচ্ছে না? কী সুন্দর আমরা চেঞ্জে যাচ্ছি!’

মেজোমামা বললেন, ‘বাড়ির কথা ভেবেছ?’

‘খুব ভেবেছি, দশ দশটা কুকুর পাহারা দেবে। কাকাতুয়া ধমকাবে।’

‘ওদের দেখবে কে?’

‘লক্ষ্মী আছে, জনার্দন আছে, শামুকাকা আছে।’

‘না ফিরলে ওরা ভাববে না?’

‘সখি ভাবনা কাহারে বলে, সখি যাতনা কাহারে বলে…।’ বড়মামা গান ধরলেন। গাড়ির গতি বাড়ল।

আশুবাবুও হুঁ-হুঁ করছেন। খুব ফুর্তি! হুঁ-হুঁর মাঝেই সুরে বললেন, ‘এইবার একটু চা হলে ভালো হত। ওই দেখা যায় দোকান দূরে।’

বড়মামা গানের সুরে উত্তর দিলেন, ‘গাড়ি থামলেই। গাড়ি থামলেই। ওরা নেমে পালাবে। পালাবে, পালাবে, পালাবে। গাড়ি থামালেই।’

মেজোমামা বললেন, ‘আমরা চেঁচাব। চিল চেল্লান চিল্লে লোক জড়ো করে তোমাকে ছেলেধরার ধোলাই খাওয়াব। তোমাদের আহ্লাদ তখন বেরোবে।’

‘ছেলেধরা?’ বড়মামা অট্টহাসি। ‘বল বুড়োধরা। তোরা নিজেদের এখনও ছেলে ভাবিস?’

আশুবাবু বললেন, ‘ছোড়দা, কেন বাগড়া দিচ্ছেন? কী মজা করে কেমন কোথায় চলেছি। এখন একটু বেশ ছেলেমানুষ হয়ে যান না। একেবারে শিশু।’

‘হ্যাঁ মশাই। শিশু হব বললেই শিশু হওয়া যায়? খুব তো লাফাচ্ছেন। ওদিকে আপনার দোকানের সব মিষ্টি তো পচে ভ্যাট হয়ে যাবে।’

‘সেই আনন্দেই থাকুন মেজোবাবু। আমার মিষ্টি পচে না। সবই তো কাগজের তৈরি।’

হুহু করে গাড়ি ছুটছে। বড়মামা বলেন, ‘ব্যাণ্ডেল ছাড়ালাম। বুঝলি মেজো। শান্ত হয়ে বোস। বেশি ছটরফটর করিসনি। দুর্গাপুর আসার আগে দুর্গানাম জপ কর। ডাকাতের হাতে না পড়ে যাই। তার আগে শক্তিগড়ে পেট ভরে ল্যাংচা খাব। জয় বাবা তারকেশ্বর।’

মেজোমামা বললেন, ‘তাহলে আমরা চেল্লাই।’

‘চেল্লাও বসে। আমিও গান ছেড়ে দিচ্ছি।’

বড়মামা টোপ ছাড়লেন, ‘প্রেমদাতা নিতাই বলে গৌর হরি হরি বোল।’

সঙ্গে আশুবাবু চটাস চটাস হাততালির। ভোঁ ভোঁ গাড়ি ছুটছে। বড়মামার হাত খুলেছে। গাড়িটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। ভটাস করে একটা শব্দ।

‘যাঃ, টায়ার গেল।’

গাড়ি ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পথের বাঁ পাশে একটা বটগাছের তলায়। আশুবাবু গেয়ে উঠলেন, ‘বল মা তারা দাঁড়াই কোথা!’

এরপর যা হল সে আর এক গল্প।