» » » একদা এক বাঘের গলায়

বর্ণাকার

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

মামা সমগ্র
উপন্যাস

একদা এক বাঘের গলায়

তিন

বিরাট সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। কুলতলি দুঃস্থা মহিলা সমিতি। হলদের ওপর কালো অক্ষরে লেখা। তলায় ছোট ছোট করে লেখা, ‘প্রতিষ্ঠাতা : ডাক্তার সুধাংশু মুখোপাধ্যায়’। ফুল দিয়ে সাজানো গেট। মোটা মোটা গাঁদার মালা ঝুলছে। একপাশে একটা বাছুর, আর একপাশে একটা ছাগল মনের সুখে চিবিয়ে যাচ্ছে। মাইকে স্তোত্র পাঠ হচ্ছে, যা দেবী সর্বভূতেষু। কিছুই তেমন বোঝা যাচ্ছে না। ক্যাড়ক্যাড় শব্দ হচ্ছে। গেটের ভেতরে মাঠে একদল মহিলা লালপাড় সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকের হাতে শাঁখ।

বেশ স্বাস্থ্যবান এক ভদ্রলোক গাড়ি দেখে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এসে গেছেন, এসে গেছেন। স্টার্ট।’

সঙ্গে সঙ্গে শাঁখ বেজে উঠল। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। ভদ্রলোক দু’হাত তুলে বড়মামাকে জানালেন, ‘এইখানে স্যার, এইখানে স্যার। পার্ক করুন।’

সামনে থেকে বোঝার উপায় নেই, গাড়ি নিজের জোরে আসছে না, আসছে ঠেলার জোরে। গলদঘর্ম দুটি মানুষ লেগে আছে পেছনে।

বড়মামা চিৎকার করছেন, ‘স্টপ, স্টপ, নো মোর, নো মোর।’

ভদ্রলোক চিৎকার করছেন, ‘ব্রেক মারুন, ব্রেক মারুন।’

মেজোমামাদের ঠেলার নেশায় পেয়ে গেছে। মাথা নিচু। ঠেলছেন তো ঠেলছেন। গেট ছেঁচড়ে, মালাফালা ছিঁড়ে গাড়ি ভেতরে ঢুকে গেল। তবু থামার নাম নেই। মহিলারা দৌড়ে সমিতির রকে। শাঁখ কিন্তু থামেনি, সমানে বেজে চলেছ। আরও জোরে। যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হচ্ছে।

মাসিমা বলছেন, ‘ও মেজদা, থামো থামো।’

মেজোমামা বললেন, ‘আমি কি আর ঠেলছি। আমি তো শুরু থেকেই থেমে আছি। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চলেছি। ঠেলছেন আশুবাবু।’

মাসিমা বললেন, ‘আশুবাবুকে থামতে বলো।’

‘নিজের ইচ্ছেয় আর থামেন কী করে! উনি তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। নাক ডাকছে আর গাড়ি না থামলে আমি সোজা হই কী করে! মুখ থুবড়ে পড়ে যাব যে!’

সমিতির উঁচু রকে গাড়ি গিয়ে ঠেকল। মেয়েরা চিৎকার করে উঠল, ‘যাঃ, রকটা বোধহয় ভেঙে গেল!’ ভাঙল না, একটা কোণ শুধু থেঁতলে গেল। গাড়ি থেমেছে। মেজোমামা সোজা হলেন। আশুবাবু গাড়ির গায়ে ঢলে পড়লেন। গভীর ঘুম। ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকছে। বড়মামা হাসিমুখে নেমে এলেন, ‘এই যে আমার মেজোভাই। অধ্যাপক শান্তি মুখোপাধ্যায়। আপনাদের স্প্রে পেন্ট করা সভাপতি। আশুবাবু কোথায় গেলেন? আমাদের এক নম্বর পেট্রন। কোথায় তিনি?’

‘তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।’

‘সে কী, বিছানা পেলেন কোথায়?’

‘বিছানার দরকার হয়নি। গাড়ির পেছনে শুয়ে পড়ছেন।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। পরিশ্রম হয়েছে। একটু বিশ্রাম করে নিক।’

আশুবাবু ঠিক এই সময় স্বপ্ন দেখে ডুকরে উঠলেন, ‘মা মা, আমি কোথায়।’

মাসিমা বললেন, ‘খুব হয়েছে, এবার উঠে পড়ুন।’

‘অ্যাঁ, ভোর হয়ে গেছে! চা হয়ে গেছে!’ ভদ্রলোক তড়বড় করে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলেন।

‘আরে মশাই, ওদিকে চললেন কোথায়?’

‘যাই, দাঁতটা মেজে আসি।’

বড়মামা হাত চেপে ধরলেন, ‘ধ্যাত মশাই, চোখ মেলে দেখুন কোথায় আছেন।’

কথা শেষ হতে না-হতেই শাঁখ বেজে উঠল।

ফট ফট করে গোটা দশ-বারো পটকা ফাটল। আশুবাবু বললেন, ‘কী রে বাবা, কালীপুজো শুরু হয়ে গেল নাকি?’

রকের একধারে মঞ্চ তৈরি হয়েছে। বড় বড় চেয়ার। লম্বা একটি টেবিল। সাদা টেবিল ক্লথ। বড় দুটো ফুলদানি। নানা রঙের ফুল। পেছনে সাদা কাপড় ঝুলছে। তার ওপর বাসন্তী-রঙে সমিতির নাম। তার তলায় লেখা, প্রথম প্রতিষ্ঠা-বার্ষিকী। বড়মামা বলতে লাগলেন, ‘আহা, কী আয়োজন! একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে। সুহাস একেবারে সুযোগ্য সেক্রেটারি…।’

বাকি কথা আর শোনা গেল না। মাইক ঘ্যাড়ঘ্যাড় করে উঠল, ‘হ্যালো, হ্যালো টেস্টিং। ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর।’

সুহাসবাবু বড়মামার কানে কানে কী বললেন। বড়মামা বললেন, ‘কোথায় সে, কোথায় সে?’

‘আজ্ঞে পেছন দিকের ঘরে বসে আছে।’

‘চলো, চলো, কী বিপদ, কী বিপদ!’

পেছনের ঘরে এক মহিলাকে ঘিরে আরও অনেক মহিলা বসে আছেন। সকলেই বলছেন, ‘একটু খোলার চেষ্টা করো। নীচেরটা নীচের দিকে ওপরেরটা ওপরের দিকে, জোরে ঠেলো না। অমন করে বসে থাকলে চলে!’

মাসিমা দু’পা সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘কী হয়েচে, কী হয়েচে?’

‘দাঁতে দাঁত লেগে গেছে।’

‘মৃগী আছে বুঝি?’

সুহাস বললেন, ‘আজ্ঞে মৃগী নয় দিদিমনি। ক্যাণ্ডি-ফ্লস টেস্ট করতে গিয়ে দাঁতকপাটি লেগে গেছে।’

‘সে আবার কী? ক্যাণ্ডি-ফ্লস জিনিসটা কী?’

‘দেখবেন? আমাদের তৈরি।’ কাঁচের বয়াম থেকে ভদ্রলোক পাতলা কাগজে মোড়া চৌকোমতে কী একটা বের করে মাসিমার হাতে দিলেন।

‘এ তো লজেনসি দেখছি।’

‘আজ্ঞে ঠিক লজেনস নয়। লজেনস কড়মড় করে চিবিয়ে খাওয়া যায়। এ জিনিস আঠা-আঠা, চটচটে। সর্বক্ষণ চুষতে হবে। দাঁত দিয়ে কেরামতি করতে গেলেই ওপর পাটি, নীচের পাটি জুড়ে যাবে, ওই সীমার যেমন হয়েছে।’

‘ট্রাই করে দেখব?’

চারপাশ থেকে সমস্বরে আর্তনাদের মতো শোনা গেল, ‘না, না, খবরদার না। এখুনি আটকে যাবে।’

‘কী এমন জিনিস মশাই, দাঁতে ভাঙা যায় না!’ আশুবাবু মাসিমার হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। ‘এ কী গীতার সেই আত্মপুরুষ। অস্ত্রে ছেদন করা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না, জলে গলে না! কী করে বানালেন এমন জিনিস?’

‘করতে, করতে হয়ে গেছে। তেমন কিছু চেষ্টার দরকার হয়নি। এটা মুখে ফেললে এক মাস কেন, মনে হয় সারা জীবন চলে যাবে!’

‘ভালো করে প্রচার করুন। এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার!’

সুহাসবাবু সবিনয়ে বললেন, ‘সবই তাঁর ইচ্ছা। মানুষ নিমিত্তমাত্র।’

বড়মামা হাঁটু মুড়ে মহিলার পাশে বসেছেন। চামচ এসেছে নানা মাপের। সাহায্য করার জন্যে তিন-চার জন হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। বড়, ছোট সব চামচেই ব্যর্থ হল। দাঁতকপাটি খোলা গেল না। বড়মামার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। চারপাশে তাকিয়ে বললেন, খুন্তি লে আও।’

‘খুন্তি। যে খুন্তি দিয়ে বেগুন ভাজে?’

চারজন চার দিকে ছুটলেন। বড় ছোট চার-পাঁচ রকমের খুন্তি এসে গেল। বড়মামা বললেন, ‘শুইয়ে দাও।’

আশুবাবু বললেন, ‘এখানে সবই দেখছি না-খোলার কেস। কৌটোর ঢাকনা খোলে না, দাঁত থেকে দাঁত খোলে না।’

‘আপনি চুপ করুন।’ মেজোমামা ধমকে উঠলেন।

রুগিকে চার-পাঁচজনে শুইয়ে ফেললেন। মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘এবার তোমার কায়দাটা কী হবে শুনি বড়দা?’

‘ভেরি সিম্পল। ঝিনুকের মুখ ফাঁক করে যেভাবে মুক্তো বের করে আনে সেই কায়দায়…।’

‘সেই কায়দায়? ইনি মানুষ। সামুদ্রিক ঝিনুক নন। ঠোঁট দুটো আস্ত থাকবে?’

‘তা হলে কী করব? এমন কেস তো জীবনে আমার হাতে আসেনি!’

মাসিমা বললেন, ‘একটু মোটা সুতো আর মোম আছে।’

সুহাসবাবু বললেন, ‘অবশ্য আছে, অবশ্য আছে।’

মোম আর সুতো এসে গেল। বড়মামাকে সরিয়ে দিয়ে মাসিমা চিকিৎসায় লেগে গেলেন। প্রথমে মোটা সুতো জলে ভিজিয়ে দু’সার দাঁতের ফাঁকে ধরে ধীরে ধীরে ঘষতে লাগলেন। সকলে হাঁ করে দেখছেন। বড়মামা বলছেন, ‘জয় বাবা বিশ্বনাথ, খুলে দাও বাবা। হ্যাঁ রে, চিচিং ফাঁক বললে কোনও কাজ হবে?’

মাসিমা বললেন, ‘তুমি চুপ করো।’

বেশ কিছুক্ষণ কেরামতি চলার পর ভদ্রমহিলার দাঁত খুলে গেল। সকলে আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, ‘খুল গিয়া, খুল গিয়া।’

মাসিমা দ্রুত হাতে মোমের টুকরোটা দু দাঁতের ফাঁকে গুঁজে দিলেন।

বড়মামা বললেন, ‘ও আবার কী হল?’

‘দাঁতে দাঁত ঠেকলেই আবার জুড়ে যাবে। যে সাংঘাতিক জিনিস তৈরি করেছ! যে কটা আছে সব গঙ্গাজলে ফেলে দিয়ে এসো।’

সুহাসবাবু বললেন, ‘এঁকে সারা জীবনই কি তাহলে মোমের টুকরো দাঁতে দিয়ে ঘুরতে হবে?’

‘তা কেন? এইবার বেশ করে ছাই দিয়ে দাঁত মেজে আসুন। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

বড়মামা বললেন, ‘কুসি, তোর এই চিকিৎসাটা মেডিকেল জার্নালে প্রকাশ করতে হবে।’

‘থাক, এমন ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার ঘটবে বলে মনে হয় না।’

মেজোমামা বললেন, ‘এইবার আমার একটা ব্যবস্থা করো। এই কাদামাখা জামা পরে সভাসমিতি করা যায়?’

বড়মামা চনমন করে উঠলেন, ‘ঠিক ঠিক। এক কাজ কর, তুই আমার এই ধুতি-পাঞ্জাবিটা পর।’

‘আবার তোমার সেই এক কথা। তোমার জামা আমার গায়ে বড় হবে।’

বড়মামা সুহাসবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চুন আছে, চুন?’

‘চুন কী করবেন ডাক্তারবাবু?’

‘হোয়াইট ওয়াশ। দেয়াল যদি চুনকাম করা যায়, ধুতি-পাঞ্জাবি কেন করা যাবে না। আলবাদ যাবে।’

মেজোমামা বললেন, ‘থাক বড়দা, খুব হয়েছে। তোমার চিকিৎসা যেমন উদ্ভট, পরিকল্পনাও তেমনি উদ্ভট। আমি আর সভাপতি হতে চাই না। যা পারো তাই করো।’

বড়মামা বললেন, ‘তা বললে চলে রে পাগলা! এই সভার প্রধান আকর্ষণ তো তুই। তোর ওই কাতলা মাছের মতো মাথা থেকেই তো পথের নির্দেশ বেরোবে। তোর যা মাথা, একদিন তুই এম.এল.এ. হবি। এম.এল.এ. থেকে মন্ত্রী। তখন আমাদের জোর কত বেড়ে যাবে।’

মেজোমামা বললেন, ‘আমার মাথায় সাংঘাতিক এক আইডিয়া এসেছে বড়দা।’

‘আসবেই তো, আসবেই তো, তুই যে আমারই ভাই। আমার মাথাটা দেখেছিস, আইডিয়ার পিন-কুশন। বল তোর কী আইডিয়া?’

‘কাপড়ের কাদামাখা অংশটা তো টেবিলের তলায় থাকবে, কেউ দেখতে পাবে না। সমস্যা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিটা উলটে পরলেই সব সমস্যার সমাধান। কী বলো?’

‘বাহা, বাহা, একেই বলে মাথা। কার মাথা দেখতে হবে তো! আমার ভাইয়ের মাথা। এ-সব মাথা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখতে হয়।’

‘তা হলে পরে ফেলি সেইভাবে?’

‘অবশ্যই, অবশ্যই। আর দেরি নয়।’

মেজোমামা সমস্যা সমাধানের আনন্দে গান গেয়ে উঠলেন, ‘আমার আর হবে না দেরি, আমি শুনেছি ওই ভেরি।’

মাসিমা বললেন, ‘পাগলামির একটা সীমা আছে, বুঝলে? যা বাড়িতে চলে, তা সভায় চলে না। উলটো পাঞ্জাবির পকেট দুটো দু’পাশে জপের মালার ঝুলির মতো ঝুলবে, কী সুন্দর দেখাবে, তাই না!’

বড়মামা দরাজ হেসে বললেন, ‘ডাক্তারের কাছে ওটা কোনও সমস্যাই নয়। অ্যাম্পুটেট করে দোব। পরিষ্কার অস্ত্রোপচার। কাঁচি দিয়ে কুচকুচ করে ছেঁটে ফেলে দোব।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ছেঁটে ফেলে দাও। ও তো একটা কাঁচির ব্যাপার।’ কথা বলতে বলতে মেজোমামা পাঞ্জাবিটা উলটো করে পেরে ফেললেন। তারপর বোতাম আটকাতে গিয়ে গভীর চিন্তায় মাথা নিচু হয়ে গেল, ‘দাদা বোতাম!’

‘বোতাম?’

‘হ্যাঁ গো, বোতাম লাগাব কী করে?’

‘কেন? যেভাবে সবাই লাগায়! বোতাম ঘরের মধ্যে খুস করে বোতাম ঢুকিয়ে দিবি।’

‘তুমি একেবারে গবেট হয়ে গেছ দাদা।’

‘কেন, কেন? জানিস আমি ডাক্তার, তোর মতো ছেলেঠ্যাঙানো অধ্যাপক নই!’

‘ওই রুগি-মারা ডাক্তারিটাই জানো, উলটো জামায় বোতাম লাগাবার কিস্যুই জানো না। বোতাম আর ঘর দুটোই যে ভেতর দিকে চলে গেছে। বুকে খোঁচা মারছে।’

‘মারছে মারুক। সহ্য করো। সবই কি আর সুখের হয় ভাই রে! জীবন দুঃখময়। যে কারণে রাজার ছেলে গৌতম সংসার ছেড়ে বুদ্ধ হলেন।’

আমি গৌতমও নই, বুদ্ধও নই, বোতাম না লাগিয়ে বুক খোলা অবস্থায় অসভ্য ইয়ারের মতো সভায় যেতে পারব না। আমার এক মানসম্মান আছে।’

‘ওরে মূর্খ, সংস্কৃত জানিস! বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য, নির্বোধেস্তু কুতঃ বলং! চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়। ভাগ্নে আমার হামা দিয়ে পাঞ্জাবির ভেতর ঢুকে বোতাম লাগিয়ে দিক। ভেরি সিম্পল, ভেরি সিম্পল।’

‘তা কী করে হয়?’

‘খুব হয় রে ভাই, খুব হয়। গাড়ি কী করে মেরামত হয় দ্যাখোনি? মিস্ত্রি তলায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ে, তারপর ওপর দিকে তাকিয়ে খুটুস খুটুস করে তারমার জুড়েজাড়ে দেয়।’

মেজোমামা একটু চিন্তা করে বললেন, ‘তা হলে শুয়েই পড়ি।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুয়েই পড়ো। একেবারে চিত হয়ে শুয়ে পড়ো।’

মাসিমা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এইবার বললেন, ‘তোমরা বাড়ি চলো, বাড়ি চলো, তোমাদের আর সভা করে দরকার নেই, খুব হয়েছে।’

দু’জনে সমস্বরে বললেন, ‘বাড়ি চলে যাব? এ তুই কী বসছিস কুসি?’

সুহাসবাবু বললেন, ‘আমার একটা বিনীত নিবেদন আছে।’

‘বলে ফেলো, বলে ফেলো।’

‘খুব সহজ সমাধান আমার মাথায় এসেছে।’

‘এসেছে? এসেছে নাকি? নিবেদন করো, নিবেদন করো। নিবেদনমিদং।’

‘আমাদের তাঁত বিভাগ থেকে একটা সাদা চাদর নিয়ে আসি, সেইটি গায়ে দিয়ে…’

বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘সুহাস, তোমার আইনস্টাইন হওয়া উচিত ছিল। তুমি আলেকজেণ্ডার দি গ্রেট। তুমি চেঙ্গিজ খান।’

মেজোমামা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আঃ, উচ্চারণটা ঠিক করো বড়দা। চেঙ্গিজ নয়, জিঙ্গিজ।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সারা জীবন চেঙ্গিজ বলে এলুম। ম্যাট্রিক ইতিহাসে লেটার পেলুম। তুই এখন উচ্চারণ শেখাতে এলি! জানিস সায়েবরা আমার নাম কী ভাবে উচ্চারণ করে, সু-ড্যাংশু।’

‘করো, তাহলে ভুল উচ্চারণই করো। শেখালে যখন শিখবে না, অশিক্ষিতই থেকে যাও।’

দু’জনের ঝগড়া আর তেমন এগোল না। পাড় বসানো সুন্দর একটা সাদা চাদর এসে গেল। উলটো করে পরা পাঞ্জাবির ওপর চাদর ফেলে মেজোমামা হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘চলুন তাহলে শুরু করে দেওয়া যাক। এদিকে যত রাত হবে ওদিকে তত দিন হবে।’

মাসিমা বললেন, ‘তোমারও মাথাটা গেছে। কী বলতে কী যে বলছ? বলো, এদিকে যত দেরি হবে ওদিকে তত রাত হবে।’

বড়মামা বললেন, ‘তা হলে একটা গল্প শোন।’

‘এখন আর গল্প শোনার সময় নেই। তোমার গল্প ভীষণ বড় বড় হয়।’

‘এটা খুব ছোট। সত্যি ঘটনা কি না!’

‘কাল শোনা যাবে।’

‘না, আজই শুনতে হবে। তা না হলে এই সভা আমি হতে দোব না।’

মেজোমামা বললেন, ‘যাঃ-ব্বাবা। বেশ মজার লোক তো! নিজের সভা নিজেই পণ্ড করবে?’

‘আমার পাঁঠা আমি যেদিকে খুশি কাটতে পারি। ন্যাজেও পারি, মুণ্ডুতেও পারি।’

সহাসবাবু বললেন, ছোট্ট যখন শুনেই নিন না!’ ঝামেলা চুকে যাক।’

‘বেশ, বলো তাহলে।’

‘এক দিন সকালে চেম্বার বসে আছি।’

‘কত সকালে?’

সহাসবাবু মুচকি হেসে বললেন, ‘কেন বাগড়া দিচ্ছেন মেজোবাবু!’

‘আচ্ছা, আচ্ছা। তুমি বলে যাও।’

‘একটি ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললে, ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু, শিগগির চলুন, মা আবার ঢুলে ফোল হয়ে গেছে। বলেই বেরিয়ে চলে গেল। আমি হাঁ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটি ফিরে এল। সেই একই ভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে, ডাক্তারবাবু, ঢুলে ফোল নয়, ফুলে ঢোল! ছুটতে ছুটতে চলে গেল।’

বড়মামা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘কই, তোমরা হাসলে না?’

‘হাসব কেন? এটা একটা গল্প হল?’

‘গল্প হল না! তা হলে কী হল?’

‘ঘোড়ার ডিম হল।’

‘এটা গল্পের মতো সত্য।’

‘সে আবার কী? বলো সত্যের মতো গল্প।’

‘দাঁড়া, দাঁড়া, সব গুলিয়ে গেল। গল্পের মতো সত্য, সত্যের মতো গল্প। ট্রু স্টোরির ইংরেজি কী হবে?’

সুহাসবাবু বললেন, ‘সত্য গল্প।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্য গল্প। সত্য হাসির গল্প।’

মেজোমামা বললেন, ‘ভেরি সরি। আমাদের কিন্তু হাসি পেল না।’

‘তার মানে তোমরা সমঝদার নও। তোমাদের মন তেমন সরল নয়। শিশুর মতো সরল মন না হলে প্রাণ খুলে হাসা যায় না রে পাগলা!’

সুহাসবাবু বললেন, ‘আপনি লক্ষ করেননি, আমি কিন্তু ফিকফিক করে হেসেছি।’

‘লক্ষ্মী ছেলে। লক্ষ্মী ছেলে।’ বড়মামা পিঠ চাপড়ালেন।

‘তবে আর বোধহয় দেরি করা ঠিক হবে না বড়বাবু। অনেক সব প্রবলেম আছে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার স্টার্ট।’