» » » একদা এক বাঘের গলায়

বর্ণাকার

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

মামা সমগ্র
উপন্যাস

একদা এক বাঘের গলায়

দুই

বড়মামার গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে বাঁক নিল। রাস্তাটা তেমন চওড়া না হলেও, পাকা। নতুন পিচ পড়েছে। দু’পাশে বিশাল দুই কারখানার জেলখানার মতো পাঁচিল। বাঁ পাশের দেয়ালে একটা সাইনবোর্ড। আমরা যেদিকে চলেছি সেই দিকে তীর-চিহ্ন। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ফুলবাগানের ঝিল। উদয়াস্ত মাছ ধরার ব্যবস্থা। পাশের জন্যে যোগাযোগের ঠিকানা, বোকুবাবু, ছোকোন ঘোষের চায়ের দোকান, কুলতুলি। দশটা-পাঁচটা। পাশের হার, দশ টাকা।

স্টিয়ারিং নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে, বড়মামার নজরে সাইনবোর্ডটা পড়ে গেল। গাড়ি আড় হয়ে ঢুকেছিল। স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। বাঁ দিকে হেলে, আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বড়মামা বললেন, ‘পড় তো, পড় তো। কী লেখা আছে পড় তো!’

গাড়ির পেছন দিকে দুম করে কী একটা ধাক্কা মারল। সামান্য একটু দুলে উঠলুম আমরা। দুমদাম করে নানা রকমের জিনিস পড়ে যাবার শব্দ হল। শুধু, পড়ল না, পড়ে ছড়াতে শুরু করল। মাছ ধরার নোটিশ আর পড়া হল না। সব কটা মাথা ঘুরে গেল পেছন দিকে। একটা সাইকেল-রিকশা। পেছনের কাঁচে ভাসছে রিকশা-চালকের মুখ। আরোহী আসছিলেন একগাদা বিভিন্ন মাপের অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো নিয়ে। ধাক্কার ঝাঁকুনিতে সব ছিটকে পড়েছে। গড়গড়িয়ে কিছু চলে গেছে নর্দমায়। কালো জলের ওপর ভাসছে সাদা চকচকে কৌটো।

বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে নেমে পড়লেন। গাড়ির গায়ে চোট লেগেছে, আর রক্ষা আছে? গাড়ি হল বড়মামার প্রাণ। বড়মামা নামার সঙ্গে সঙ্গে আমিও নামলুম। পেছন দিকে তাকিয়ে মাসিমা আর মেজোমামা বসে রইলেন।

বড়মামা ঝুঁকে পড়ে পেছনের বাম্পারটা দেখে বললেন, ‘এটা কী হল?’

রিকশাচালক বললেন, ‘আমার কী দোষ, আপনি হঠাৎ থামলেন কেন?’

‘সামনের গাড়ি থামলে পেছনের গাড়িকেও থামতে হয়। গাড়ি চালাবার ব্যাকরণ না শিখেই সিটে উঠে বসেছ?’

‘আপনিও ব্যাকরণ তেমন জানেন বলে মনে হচ্ছে না। জানলে এমন দুম করে মোড়ের মাথায় থেমে পড়তেন না।’

রিকশার আরোহী নামার জন্যে হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করছেন। পারছেন না। অ্যালুমিনিয়ামের হাজার হাজার কৌটো নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে কৌটো-মানব। মুখটি শুধু জেগে আছে। কৌটো-মানব বললেন, ‘আপনার আর কী হয়েছে! রিকশার ধাক্কায় মোটর-গাড়ির কিছু হয় না। ক্ষতি হল আমার। নর্দমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমার এত দামের কৌটো খানায় ভাসছে।’

বড়মামা ঢুলুঢুলু চোখে খানার দিকে তাকালেন। কারুর ক্ষতি হলে বড়মামার বুক মুচড়ে ওঠে। মেজোমামা নেমে এসেছেন। অবাক হয়ে আরোহীকে দেখেছেন। থাকতে না পেরে প্রশ্ন করলেন, ‘কী করে আপনি অমন হলেন?’

‘কী রকম?’

‘অমন কৌটোময়, কৌটোসমৃদ্ধ! কে আগে উঠেছে! আপনি আগে, না কৌটো আগে?’

‘এটা একটা প্রশ্ন হল? দেখলেই তো বোঝা যায়। আগে আমি, তারপর কৌটো।’

‘কী করে নামবেন?’

‘হ্যাঁ, এটা একটা প্রশ্ন। সে এক সমস্যা মশাই। আমাকে না নামালে, আমার ক্ষমতা নেই নামার।’

‘কেউ যদি না নামায়, সারা জীবন ওইভাবে বসে থাকতে হবে? আপনার তো মশাই আচ্ছা লোভ!’

‘লোভের কী দেখলেন?’

‘কৌটোর লোভ অবশ্য আমারও আছে, তবে আপনার চেয়ে অনেক কম। আপনি একেবারে গোটা একটা কৌটো-কারখানা কিনে এনেছেন!’

‘উঁহু, উঁহু, বর্তমান কাল নয়, অতীত কাল হবে। কিনেছিলুম, এখন চলেছি ফেরত দিতে।’

‘এত কৌটো কিনে সব আবার ফেরত দেবেন? বড় দুঃখ হচ্ছে।’

‘দুঃখ! আপনি একটা কৌটোরও ঢাকনা খুলতে পারবেন না। যদি পারেন, আমার কান কেটে ফেলে দোব।’

‘সে কী? কোথা থেকে কিনেছিলেন?’

‘কে এক মশাই, ডাক্তার সুধাংশু মুখোপাধ্যায়, কুলতুলিতে দুঃস্থ মহিলা সমিতি খুলেছেন, এ হল সেই সমিতির কারখানায় তৈরি ডিফেকটিভ মাল। মহিলা সমিতির নামে চালাতে চেয়েছিল। কৌটোর ধর্ম কী?’

‘আজ্ঞে টানলেই ঢাকনা খুলবে।’

‘এ সব হল বিধর্মী কৌটো।’

‘ডাক্তার সুধাংশু মুখোপাধ্যায় এই মুহূর্তে আপনার সামনে দণ্ডায়মান।’

‘অ্যাঁ, তাই নাকি? আপনিই সেই পরোপকারী ডাক্তারবাবু?’

বড়মামা লাজুক-লাজুক মুখে বললেন, ‘নমস্কার, নমস্কার।’

‘আমাকে নমস্কার করে আর লজ্জা দেবেন না, আপনাকে আমার শত কোটি প্রণাম করা উচিত। কী জিনিস বানিয়েছেন ডাক্তারবাবু, মানুষের প্রাণ ভরে রাখলে, যমেও ছুঁতে পারবে না। দেখা হয়ে ভালোই হয়েছে। রিকশাটাকে ছেড়েই দি। মাল সব গাড়ির পেছনে ভরে দেওয়া যাক। নর্দমায় যে কটা ভাসছে, নিজেই গুনে নিন। আমার এদিককার হিসেব ঠিক আছে।’

মোটাসোটা চৌকো ধরনের ভদ্রলোক কৌটোর স্তূপ ঠেলে রিকশা থেকে নেমে এলেন। মালকোঁচা মারা ধুতি। গায়ে শার্ট। বুক-পকেটে অ্যাতো কাগজপত্র ঠেসেছেন, ফেটে বেরিয়ে না যায়। গায়ের রঙ মিশকালো। দু’পাটি ঝকঝকে সাদা নিম-দাঁতন করা দাঁত। হাসিটা সেই কারণেই বড় স্পষ্ট।

বড়মামার গাড়ির বুটে একে একে সব ঢুকে গেল। ভদ্রলোক পিছনের আসনে জাঁকিয়ে বসলেন। এমন ভাবে বসেছেন, যেন নিজের গাড়ি। মেজোমামা মাঝখানে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ বিরক্ত হয়েছেন।

ভদ্রলোক হাত জোড় করে মাসিমা আর মেজোমামার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমার নাম শ্রীআশুতোষ দাস। মোল্লারচকে আমার মিষ্টির দোকান। এই রিসেণ্টলি বেলের মোরব্বার কারবারে নেমেছি। ভেরি গুড মার্কেট। মিডল ইস্ট, জাপান, হংকং, হনলুলু, কামস্কাটকা, ফ্রানস, আমেরিকা, জার্মানি, কোথায় না, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, এ দাসস বেঙ্গলকুইন ইন থিক সিরাপ।’

কথা শেষ করে হাত খুললেন। মেজোমামার মুখের চেহারা পাল্টে গেল ভদ্রলোকের মুখে পরিষ্কার ইংরেজি শুনে। বেশ শিক্ষিত বলেই মনে হচ্ছে, অথচ মিষ্টির কারবারি! বড়মামার গাড়ি চলেছে ফুরফুর করে। ইঞ্জিনের শব্দ শুনলে মন হবে বড়দাদু ভুড়ুক ভুড়ুক করে তামাক খাচ্ছেন।

মেজোমামা সুদ্ধ বাংলায় জিগ্যেস করলেন, ‘মশায়ের শিক্ষাদীক্ষা?’

আশুবাবু খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘যৎসামান্য। বায়ো-কেমিস্ট্রিতে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট করার পর কিছুকাল একটা ফার্মে চাকরি। ভালো লাগল না দাসত্ব। কী করি, কী করি? পিতার মৃত্যুর পর বসে পড়লুম দোকানে। ইনস্টিট্যুট অব কেটারিং টেকনোলজি থেকে একটা ডিপ্লোমা বাগিয়ে আনলুম। শিক্ষার কি শেষ আছে। মিষ্টির জগতেও যে কত কী দেবার আছে!’

‘মিষ্টির জগৎকে কী আর দেবেন? সবই তো দেওয়া হয়ে গেছে। রসগোল্লা, সন্দেশ, ক্ষীরমোহন, রাজভোগ, লেডিকেনি, সীতাভোগ, মিহিদানা, চমচম, দধি, পয়োধি। নতুন আর কী দেবার আছে?’

‘আছে, আছে মুকুজ্যেমশাই। সব বিভাগেই রিসার্চের প্রয়োজন আছে। দুব্বোঘাসের কচুরি খেয়েছেন?’

‘দুব্বোঘাসের কচুরি? জীবনে শুনিনি।’

‘দয়া করে আমার দোকানে একদিন পায়ের ধুলো দেবেন। দুব্বোর মতো খাদ্যগুণে ভরপুর জিনিস আর দুটো নেই। গোরুরা জানে। সেই দুব্বোকে আমি বাঙালির নোলায় ফেলেছি।’

‘নোলা শব্দটা পাল্টানো যায় না আশুবাবু?’

‘কেন বলুন তো? নোলা কি খুব খারাপ শব্দ। নোলা শব্দটা মনে হয় ইংরেজি নলেজ থেকে এসেছে।’

‘প্লিজ, আপনি আর ভাষাতত্ত্ব নাড়াচাড়া করবেন না। মিষ্টান্নতত্ত্বেই আপনার নলেজকে ধরে রাখুন। আজেবাজে কথা শুনলে আমার ভীষণ ইরিটেশন হয়। সারা গা লাল-লাল চাকা হয়ে ফুটে ওঠে।’

‘অ্যাঁ, সে কী? অ্যালারজি! ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে এক দাগ ওষুধ খেয়ে নিলেই তো সেরে যায়!’

‘খেয়ে দেখেছি। কিস্যু হয় না।’

‘কিসে সারে তা হলে?’

‘গোটা-দুই চড় কষাতে পারলেই সেরে যায়।’

‘তা হলে থাক, ভাষাতত্ত্ব না আলোচনা করাই ভালো। গায়ে লাল-লাল চাকা-চাকা হয়েছে।’

‘না, এখনও তেমন হয়নি।’

‘জয় গুরু!’

‘হ্যাঁ, জয় গুরু। আপনার ওই খাবার নিয়ে রিসার্চের কথা বলুন। শুনতে বেশ ভালো লাগছে।’

‘খেতে আরও ভালো লাগবে। কচুরিপানা দিয়ে একটা আইটেম বানিয়েছি। ক্ষীরকচুরি, অসাধারণ জিনিস। এক সপ্তাহ খেলে তিন কেজি ওজন বাড়বে। বাড়বেই বাড়বে। কেউ ঠেকাতে পারবে না।’

‘ওজন কমাবার কিছু নেই?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, কাগজের সন্দেশ।’

‘সে আবার কী?’

‘উঃ, সে এক অসাধারণ জিনিস। ছানার কোনও ব্যপার নেই। কাগজের মণ্ড চিনি দিয়ে ভালো করে পাক করে ছাঁচে ফেলে সন্দেশ। একটা খেয়ে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল চালিয়ে দিন। ধীরে ধীরে পেট ফুলতে শুরু করবে। এক সময় জয়ঢাক। বুকে আর পেট এক হয়ে যাবে। কম-সে-কম দু’দিন আর হাঁ করতে হবে না।’

‘বাঃ, বেশ ভালো জিনিস বানিয়েছেন তো!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। একেবারে আমাদের দেশের উপযোগী। এই আক্রা-গণ্ডার বাজারে সংসার চালাতে প্রাণান্ত। যে বাড়ির দশ-বিশটা মুখ কেবল হাঁ-হাঁ করছে, সেখানে একটি করে এই সন্দেশ আর এক গেলাস কলের জল। দু-দিন সব ঠাণ্ডা।’

‘খেতে কেমন হয়েছে?’

‘অতি সুস্বাদু। একটা খেলে আর একটা খেতে ইচ্ছে করবে, তবে দুটো না খাওয়াই ভালো।’

‘এক-একটার দাম কত?’

‘মাত্র এক টাকা।’

বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন আর সেই হাসিই হল সর্বনাশের কারণ। স্টিয়ারিং বাঁ দিকে বেমক্কা মোচড় খেল। গাড়ির সামনের বাঁ দিকের চাকা গোঁত করে পড়ে গেল পথের পাশের খানায়। স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। বেশ বড় রকমের ম্যাজিক দেখাবার পর ম্যাজিশিয়ান দুটো হাত যেভাবে আকাশের দিকে তোলেন, বড়মামা সেই ভাবে হাত দুটো ওপরের দিকে তুলে চুপ করে বসে রইলেন।

আশুবাবু জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিয়ে বললেন, ‘কী হল স্যার?’

বড়মামা হালকা সুরে বললেন, ‘অধঃপতন, পদস্খলনও বলা চলে।’

মাসিমা বললেন, ‘এবার তা হলে কী হবে?’

বড়মামা বললেন, ‘কিছুই না। কী আবার হবে। স্টার্ট তো অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেছে। আমার গাড়ি কত ভদ্র দেখেছিস কুসি! যেই দেখলে ভুল পা পড়েছে, অমনি চলা বন্ধ হয়ে গেল। একেই বলে জেণ্টলম্যান।’

মেজোমামা বললেন, ‘তোমার লেকচার বন্ধ করে গাড়িটা ব্যাক করে তোলার চেষ্টা করো।’

‘অতই যদি সোজা হত ব্রাদার! এ তো আর মানুষ নয়, এ হল গাড়ি। পতন আছে, উত্থান নেই।’

‘তুমি এখন তা হলে কী করবে?’

‘তোমাদের সকলকে নামাব। তারপর ঠেলে তোলাব।’

‘আমরা একটা সভা করতে যাচ্ছি। আমি হলুম গিয়ে সেই সভার সভাপতি। সভাপতি গাড়ি ঠেলবে?’

‘কেন, যে রাঁধে সে চুল বাঁধে না! তুমিই না থেকে থেকে বলো, সেলফ হেলপ ইজ বেস্ট হেলপ। নাও, মেজাজ খারাপ না করে লক্ষ্মী ছেলের মতো আশুবাবুকে নিয়ে নেমে পড়ো। কিছুই না, একটু পেছন দিকে ঠেলে দিলেই রাস্তা উঠে পড়বে।’

‘আর তুমি কী করবে?’

‘আমাকে তো স্টিয়ারিং-এ বসতেই হবে ভাই। আমি যে কাণ্ডারী।’

‘এমন জানলে তোমার গাড়িতে কে উঠত বড়দা! তোমার মতো এমন ব্যাড ড্রাইভার কী করে লাইসেন্স পেল কে জানে! ঘুষের খেলা।’

‘আমি খুব একটা খারাপ ড্রাইভার নই ব্রাদার। আশুবাবুর হাজারখানেক কৌটো গাড়িকে বেটাল করেছে। গাড়ি কাত হওয়ামাত্রই গড়িয়ে ডান দিকে বাঁ দিকে চলে গেছে। দোষ আমার নয়, দোষ গাড়ির নয়, দোষ হল কৌটোর। আর দোষ হল তাদের, যারা পথের পাশে গাড়ি ধরার জন্যে নর্দমা পেতে রাখে।’

পেছনের আসন থেকে মেজোমামা, আশুবাবু নেমে পড়লেন। মেজোমামা সমানে গজগজ করে চলেছেন। আশুবাবুর মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। এমন মুখ দেখলে তবেই মনে হয়, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।

মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘আমি ঠেলব বড়দা?’

‘না, তোকে আর ঠেলতে হবে না, তুই নেমে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা পরিচালনা কর। তোর ভূমিকা হল, ডিরেকটার অপারেশন।’

সামনের আসন থেকে আমিও নেমে পড়লুম। আমাকেও তো একটা কিছু করতে হয়। সামনের দিক থেকে ঠেলেঠুলে গাড়িটাকে পেছোতে হবে। একটা পাশ নর্দমায় ভেতরে গেছে। ডানপাশ উঁচু হয়ে আছে। মেজোমামা দেখেশুনে বললেন, ‘অসম্ভর ব্যাপার। ইমপসিবল। সামনে দাঁড়াবার জায়গা নেই। ঠেলব কী করে?

আশুবাবু বললেন, ‘অসম্ভব বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। সবই সম্ভব। ইচ্ছে থাকলেই উপায় বেরোবে।’

‘আমার ইচ্ছেও নেই, উপায়ও দেখতে পাচ্ছি না। আপনি তাহলে একাই ঠেলুন। অনেক রকম মিষ্টির ফিরিস্তি তো শোনালেন, সে সব নিজেও নিশ্চয় খেয়েছেন। ভেতরে অনেক হর্স-পাওয়ার জমা হয়েছে। আজ তার পরীক্ষা হয়ে যাক।’

আশুবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘তবে তাই হোক। আমি এক হাতে পেছনের বাম্পার ধরে টেনে তুলে দোব। এটা গাড়ির ওজন আর কত হবে? বিশ-বাইশ মণ!’

‘আমি আমার ওজন জানি মশাই। গাড়ির ওজন জানা নেই।’

‘ওই বিশ-বাইশ মণই হবে।’

আশুবাবু ঘুরে পেছনের দিকে চলে গেলেন। আজ আশুবাবুর কপালে গভীর দুঃখ লেখা আছে। ব্যায়ামবীরের কাজ কী সাধারণ মানুষে পারে? হেরে ভূত হয়ে যাবেন। আর মেজোমামা তালি বাজাবেন।

আশুবাবু প্রথমে মালকোঁচা মেরে নিলেন। তারপর চোখ বুজে হাত জোড় করে নমস্কার করতে করতে বললেন, ‘জয় মহাবীরজি কি জয়!’

চোখ খুলে বললেন, ‘আপনার সেই মন্ত্রটা সমস্বরে, তালে তালে, সুর করে পড়তে পারবেন?’

মেজোমামা বললেন, ‘কোনটা?’

‘ওই যে, সেই শক্তিসঞ্চারী মন্ত্র, ঘাস-বিচুলি হেঁইও, আউর থোড়া হেঁইও, বয়লট ফাটে হেঁইও।’

‘ওসব আমার দ্বারা হবে না।’

‘খোকাবাবু, তুমি পারবে?’

খোকাবাবু বলায় ভীষণ রাগ হলেও বললুম, ‘হ্যাঁ পারব!’

‘দেন স্টার্ট।’

‘ঘাস-বিচুলি হেঁইও, আউর থোড়া হেঁইও, বয়লট ফাটে হেঁইও।’

আশুবাবু ডান হাত বাম্পারে, বাঁ হাত কোমরে। ধীরে ধীরে টানছেন। গাড়ি দুলছে ‘আউর থোড়া হেঁইও, বয়লট ফাটে হেঁইও।’ ভদ্রলোকের মুখ জবাফুলের মতো লাল হয়ে উঠেছে। গলার শিরা ফুটে উঠেছে।

হঠাৎ কী হল কে জানে! বড়মামার গাড়ি ঘোঁত ঘোঁত করে দু’বার শব্দ করে উঠল। সামনের চাকা দুটো ফরর ফরর করে দুবার ঘুরে গেল অকারণে। একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটে গেল। চরকির মতো নর্দমার থকথকে কাদা ছিটকে উঠে মেজোমামাকে স্প্রে-পেণ্ট করে দিলে। সাদা-জামা কাপড় আর সাদা রইল না। হরিণের মতো চাকা-চাকা কালো দাগ সারা শরীরে। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। ফর্সা মুখে খাড়া উঁচু নাক। চোখে ব্রহ্মতেজ। পারলে গাড়িটাকে ভস্ম করে দেন। ওদিকে গাড়িটা ঝিঁকি মেরে হাতখানেক পেছিয়ে গেছে। আচমকা। আশুবাবু উলটে পড়ে আছেন মাটিতে। করুণ সুরে বলছেন, ‘আর করব না কক্ষনো করব না। দোহাই মহাবীর, মাপ করো মহাবীর।’ মাসিমা গাড়ির আড়ালে ছিলেন বলে বেঁচে গেছেন ছেটকানো কাদার হাত থেকে। মাসিমা ছুটে গিয়ে আশুবাবুকে ভূমিশয্যা থেকে টেনে তুললেন। গাড়ি অবশ্য দুধাপ পেছিয়ে থেমে পড়েছে। নর্দমা থেকে চাকাও উঠে পড়েছে।

‘জয় মহাবীরের জয়’ বলতে বলতে আশুবাবু উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঠেকিয়ে আবার প্রণাম করলেন। মেজোমামা ধীরে ধীরে বড়মামার দিকে এগোতে লাগলেন। দাঁত কিড়িমিড়ি করছে।

‘এটা কী হল বড়দা?’

বড়মামা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোকে অসাধারণ দেখাচ্ছে রে! অনেকটা ভালমেশিয়ানের মতো, সাদার ওপর কালোর স্পষ্ট।’

‘তোমার রসিকতা রাখো। এটা কী করলে তুমি?’

‘আমি কেন করব রে বোকা। করেছে আমার গাড়ি।’

সাইকেলে রাগী-রাগী চেহারার এক ভদ্রলোক আসছিলেন। হঠাৎ থেমে পড়ে বললেন, ‘কী হল, কী? ভিড়িয়ে দিয়েছে বুঝি! বেশ ভালো করে চাবকে দিন মশাই। হাতে স্টিয়ারিং পড়লে কাপ্তেনদের আর জ্ঞান থাকে না।’

আশুবাবু বললেন, ‘আরে না না, এ আমাদের নিজেদের ব্যাপার। আপনি যেখানে যাচ্ছেন যান। মাথা গরম করবেন না।’

‘অ; তাই নাকি, সেমসাইড হয়ে গেছে!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বড় ভাই আর মেজো ভাইয়ে হচ্ছে। এখুনি মিটমাট হয়ে যাবে।’

‘অ, ভাইয়ে ভাইয়ে হচ্ছে। সহজে মিটমাট হয়ে যাবে ভেবেছেন? কোথায় আছেন আপনি? কোর্ট অবদি গড়াবে। বছরের পর বছর চলবে। ভিটেতে পাঁচিল পড়বে। গাড়ির নাট-বল্টু খুলে খুলে ভাগাভাগি হবে। আছেন কোথায় মশাই? শোনেননি, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই।’

মেজোমামা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ধ্যার মশাই। বাজে কথা না বলে যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যান। বাঙালির স্বভাবই হল সব ব্যাপারে না গলানো।’

ভদ্রলোক তড়াক করে সাইকেল থেকে নেমে পড়লেন, ‘কী হল? কথাটা কী হল? খুব মেজাজ লিচ্ছেন মনে হচ্ছে। প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে খুব বড়ছোট কথা হচ্ছে? জানেন আমি কে?’

মেজোমামা রাগের মাথায় বলে ফেললেন, ‘জানি জানি, লাটসাহেবের নাতি।’

‘মুখ সামলে। খুব সাবধান।’

‘আরে মশাই যান, সব করবেন আপনি!’

‘দেখবেন তা হলে?’

‘হ্যাঁ দেখব।’

বড়মামা নেমে এলেন, ‘কী হচ্ছে কী? তিল থেকে তাল।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘তিল মানে? এটা তাল। তালকে আমি তাল-তাল করে ছাড়ব।’

আশুবাবু দু’ধাপ এগিয়ে এসে বললেন, ‘নাঃ, আর সহ্য হচ্ছে না। এবার একটু হাত লাগাতে ইচ্ছে করছে।’

বড়মামা বুদ্ধদেবের মতো হাত তুলে আশুবাবুকে থামিয়ে বললেন, ‘মুখটা খুব চেনা-চেনা মনে হচ্ছে! হ্যাঁ, চেনাই তো! তোমার নাম সরোজ মাইতি না! আজ থেকে বছর-তিনেক আগে মাঝরাতে তোমার অ্যাপেনডিক্স ফাটো-ফাটো হয়েছিল, মনে পড়ে? তোমার মা এসে কেঁদে পড়েছিলেন। সেই রাতেই তোমাকে অপারেশান করেছিলুম। অপারেশান না করলে মরে ভূত হয়ে যেতে এত দিনে! অপারেশনের ফি-টা অবশ্য এখনও বাকি আছে! তোমার বোলচাল তো বেশ ফুটেছে কার্তিক!’

লোকটি কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। মুখে আর কথা সরছে না। নাকি সুরে বললে, ‘কে, ডাক্তারবাবু? চিনতে পারিনি স্যার। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আছেন তো, চেহারাটা কেমন যেন পালটে গেছে। ক্ষমা করবেন স্যার। বড় কষ্টে আছি।’

‘কষ্টে কেন?’

‘ব্যবসাটা লাটে উঠে গেল স্যার।’

‘কী ব্যবসা ছিল তোমার?’

‘আজ্ঞে, তেলেভাজার দোকান।’

‘তেলেভাজা! আহা, বড় ভালো জিনিস। একেবারে উঠে গেল! একটুও নেই?’

‘আজ্ঞে না। এমনকি উনুনটাও ভেঙে গেছে।’

‘উনুনটা ভাঙলে কী করে?’

‘পাওনাদারে লাথি মেরে ভেঙে দিয়ে গেছে।’

‘দোকানঘরটা আছে?’

‘তা আছে। তালাবন্ধ পড়ে আছে।’

‘কী কী তেলেভাজা হত? আলুর চপ হত?’

‘ওইটাই তো আমার স্পেশাল আইটেম ছিল স্যার। বনগাঁ, বসিরহাট থেকেও খদ্দের আসত গাড়ি চেপে কার্তিকের লড়াইয়ের চপ খেতে!’

‘লড়াইয়ের চপ! বলো কী? লড়াইয়ের চপ! কত টাকা হলে আবার দোকানটা চালু করা যায়?’

মাসিমা বড়মামার হাত খামচে ধরলেন। বড়মামা ঝটকা মেরে মাসিমার হাত সরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘বেড়ালের মতো আঁচড়াচ্ছিস কেন কুসি? খিদে পেয়েছে?’

মাসিমা ফিসফিস করে বললেন, ‘আবার টাকা পয়সার মধ্যে ঢুকছে কেন বড়দা?’

কার্তিকবাবু শুনতে পেয়েছেন ঠিক, বললেন, ‘ওঁর যে দয়ার শরীর দিদি। দু’হাতে যেমন রোজগার করছেন, দু’হাতে তেমনি গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়েও যাচ্ছেন। জানেন যে, যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।’

আশুবাবু বললেন, ‘আরে মূর্খ, সেটা টাকা নয়, বিদ্যে। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে।’

‘মূর্খ আপনি।’

‘আবার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। এ দেখি ধরলে চিঁ চিঁ করে। ছেড়ে দিলে তুড়ি লাফ মারে!’

বড়মামা বললেন, ‘আহা বেচারার মাথার ঠিক নেই। হ্যাঁ, কত টাকা হলে দোকান আবার চালু করা যায়?’

‘সে অনেক টাকা বড়বাবু। অত টাকা কি আপনি দিতে পারবেন? আপনি দিতে চাইলেও এঁরা কি দিতে দেবেন? হাত চেপে ধরবেন।’

ইলেকট্রিক শখ খেলে যেমন হয়, বড়মামা চমকে উঠলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমার টাকা, আমি তোমাকে দোব, কে তাতে বাধা দেবে! হু আর দে! তুমি, আমি আর আমাদের তেলেভাজার দোকান। বলো কত টাকা?’

‘আজ্ঞে তা প্রায় হাজার-তিনেক টাকা। হাজার খানেকের মতো দেনা আছে। একটা বড় কড়াই কিনতে হবে। উনুনটাকে ফের বানাতে হবে। তারপর তেল, ব্যাসন, আলু, বেগুন।’

‘বেগুন? বেগুন কী হবে? তুমি তো বানাবে আলুর চপ!’

‘আজ্ঞে স্যার, বেগুনী ছাড়া তেলেভাজার দোকান জমে না।’

‘না, না, বেগুন-ফেগুন চলবে না। বেগুনে আমার অ্যালার্জি আছে।’

‘আপনার অ্যালার্জি থাকলে কী হবে স্যার। চিরকাল লোকে চেয়ে আসছে, আলুর চপ, বেগুনি।’

আশুবাবু বললেন, ‘লাইই ব্রেড অ্যাণ্ড বাটার, মিল্ক অ্যাণ্ড হানি, রো অ্যাণ্ড থর্ন, সাবজেক্ট অ্যাণ্ড প্রেডিকেট।’

বড়মামা বুদ্ধদেবের মতো হাত তুলে বললেন, ‘ব্যাস, ব্যাস, হয়েছে, হয়েছে। বেগুনি হলে আমি একটা ফার্দিংও দোব না। আমি হলুম গিয়ে এক কথার মানুষ। বেগুনের গুণ নেই।’

‘তা হলে স্যার পটুলি কি কুমড়ি?’

‘হ্যাঁ, তা চলতে পারে। এমনকি ফুলুরিও অ্যালাউড।’

আশুবাবু বললেন, ‘ফুলুরি খুব টেস্টফুল, তবে কিনা উচ্চারণটা বড় গোলমেলে। মাঝে মাঝে ফুরুলি বেরিয়ে যায়। যেমন বাতাসটা মাঝে মাঝেই বাতাসা হয়ে যায়। যেমন পুঁটি মাছ। সেদিনও বাজারে গিয়ে কিছুতেই আর মুখ দিয়ে বেরোল না, কেবলই বলি পুঁচি মাট। যেমন ফুলে ঢোল। হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় ঢুলে ফোন! যেমন হাউসফুল আর হাউল ফুস। কী যে সব ডেনজারাস ডেনজারাস মুশকিলের ব্যাপার।’

মেজোমামা এতক্ষণ ধৈর্য ধরে ছিলেন। এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ধ্যাত তেরি কা। পাগলের পাল্লায় পড়ে জীবনটা গেল। চল কুসি, আমরা চলে যাই।’

‘আমি তো যাবার জন্যে পা বাড়িয়েই আছি। শুনলে না, একটু আগেই বলেছে, হু আর দে।’

‘ঠিক ঠিক। আমরা হলুম গিয়ে ঠ্যালার লোক। নর্দমায় গাড়ি পড়লে ঠেলে তুলে দিতে হবে।’

বড়মামা একগাল হেসে দু’জনের দিকে তাকালেন। ‘কেন রাগ করছিস পাগল? ইউনাইটেড উই স্ট্যাণ্ড। দেখলি না সকলের চেষ্টায় গাড়ি কেমন গাড্ডা থেকে উঠে পড়ল। গাড়ির শিক্ষা আমাদের জীবনের শিক্ষা। ঐকতান মাস্টার, ঐকতান। অনৈকতানে বাঙালি জাতটাই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে।’

‘তোমার লজ্জা করে না বড়দা, এই কাদামাখা অবস্থায় আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছো! লোকে কী ভাবছে?’

‘লোকভয়! এখনও এই বয়েসে তোর লোকভয়! অশ্বিনী দত্ত মশাইয়ের লেখাটা আর-একবার পড়িস। জীবনে জ্ঞানের আলো ফেল পাগলা, জ্ঞানের আলো ফেল। নে, গাড়িতে উঠে পড়। ওখানে গিয়ে তোর জামাকাপড় পালটে দোব। তোরটা আমি পরব, আমারটা তুই পরবি।’

‘আহা! কী কথাই বললে! তুমি আমার চেয়ে আধহাত লম্বা। তোমার পাঞ্জাবি তো আমার গায়ে লটরপটর করবে।’

‘হাতার বাড়তি অংশটা কাঁচি দিয়ে ছেঁটে দেব। লোকে বলে হাতে পাঁজি মঙ্গলবার, আমি বলি হাতে কাঁচি হাতা লটরপটর। নে, উঠে পড়। অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেল। টাইম ইজ মানি।’

‘তোমাকে দেখে তা মনে হয় না বড়দা। তোমার কাছে টাইম ইজ গানি।’

‘তার মানে? গানি মানে কী?’

‘গানি হল চট। তোমার কাছে সময় হল চটের মতোই মূল্যহীন।’

‘ওরে পাগলা, চটের দাম জানিস? জানলে আর মানির সঙ্গে গানি মেলাতিস না। চট সায়েবদের দেশে চালান যায়।’

বড়মামা বীরের মতো স্টিয়ারিং-এ বসলেন। আমরা সুড়সুড় করে যে যার আসনে। মাসিমা সিঁটিয়ে বসেছেন মেজোমামার স্পর্শ বাঁচিয়ে।

মেজোমামা বললেন, ‘তুই অমন সিঁটিয়ে আছিস কেন কুসি?’

‘তুমি নর্দমা ছুঁয়েছ মেজদা। গায়ে গঙ্গাজল না ছিটোলে শুদ্ধ হবে না।’

‘অ, তাই নাকি? অদ্ভুত বিচার!’

‘ছোঁয়াছুঁয়ি মানতে হয় মেজদা। তুমি এখন অপবিত্র।’

‘আমি না তোর মেজদা!’

‘হতে পারো মেজদা, তবে অপবিত্র মেজদা।’

বড়মামা গাড়িতে স্টার্ট দেবার চেষ্টা করছেন। ঘুরর ঘুরর আওয়াজ হচ্ছে, গাড়ি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে স্টার্ট কিন্তু ধরছে না। বড়মামা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন।

আশুবাবু বললেন, ‘কী হল, গড়বড় করছে মনে হচ্ছে?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে। সেলফটা কাজ করছে না। আমাদের মধ্যে কেউ একজন অপয়া আছে।’

পেছনের আসন থেকে তিনজনে সমস্বরে বললেন, ‘কে, কে, কে অপয়া?’

‘সেইটাই তো বুঝতে পারা যাচ্ছে না।’

আশুবাবু বললেন, ‘আমি অপয়া নই তো?’

মাসিমা বললেন, ‘অপয়াদের চেনার কোনও উপায় আছে? চেহারা দিয়ে বোঝা যায়?’

আশুবাবু বললেন, ‘যেমন ধরুন, আমি দৈর্ঘ্যে সামান্য খাটো, প্রস্থে একটু বিশাল, মুখটা কেমন?’

মেজোমামা বললেন, ‘গোল আলুর মতো। একটু লালচে রঙ।’

‘লালচে? বলেন কী, লালচে? তা হলে রক্ত। শরীরে রক্ত বেড়েছে।’

বড়মামা বললেন, ‘আনন্দের কিছু নেই। এই বয়েসে বেশি রক্ত ভালো নয়। হাই প্রেশারে মরবেন। মাথার মাঝখানে টাক আছে?’

মেজোমামা বললেন, ‘হ্যাঁ আছে। চিকচিক করছে।’

‘আমি কি তাহলে অপয়া?’

‘সকালে আপনার নাম করলে হাঁড়ি চড়া বন্ধ হয়? শুনেছেন কিছু?’

না, তেমনি অভিযোগ তো কানে আসেনি।

‘আচ্ছা আপনি একবার নেমে দাঁড়ান তো, দেখি স্টার্ট নেয় কি না!’

আশুবাবু নেমে দাঁড়ালেন। বড়মামার কেরামতি শুরু হ’ল সেলফ নিয়ে। কোথায় কী গাড়ি স্টার্ট নিল না। আশুবাবু বড়মামার পাশে সরে এসে বললেন, ‘কী মনে হচ্ছে, আমি কি তাহলে অপয়া?’

বড়মামা বললেন, মনে হচ্ছে না।’

‘তা হলে উঠে বসি ডাক্তারবাবু?’

‘আর উঠে কী হবে! এবার ঠেলতে হবে। ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে হবে। কতটাই বা পথ। বড় জোর এক মাইল!’

মেজোমামা বললেন, ‘আমি ঠেলতে পারব না। আমার ক্ষমতা নেই।’

‘ছিঃ মেজো। সবে মিলে করি কাজ, হারিজিতি নাহি লাজ। এটু হাত লাগাও ভাই। মানুষ তো চিরকালই গাড়ি চেপে এল, গাড়ির যদি একদিন মানুষ চাপার শখ হয় তাতে মেজাজ খারাপ করলে চলে? একদিনের তো মামলা রে ভাই। ইংরেজ হলে হাসিমুখে নেমে আসত, আমায় কিছু বলতে হত না।

‘আমি বাঙালি, ইংরেজ নই।’

‘তা বললে চলে? সব সময় ইংরেজির খই ফুটছে মুখে। নাও, নেমে পড়ো। দুর্গা বলে যাত্রা শুরু করা যাক। অনেক দেরি হয়ে গেল রে পাগলা!’

‘পাগলা বলে যতই আদর করো, গাড়ি আমি ঠেলছি না। দিস ইজ টু মাচ।’

‘এই তো ইংরিজি এসেছে, তার মানে ইংরেজ ভর করেছে। নাও, নেমে পড়ো। ঠেলতে শুরু করলেই দেখতে কী মজা! গাড়ি-ঠেলার যে কত আনন্দ! তখন থামতে বললেও আর থামতে ইচ্ছে করবে না। ঠেলে দ্যাখ, বয়েস তিরিশ বছর কমে যাবে।’

‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি বড়দা, জীবনে আর কোনও দিন তোমার গাড়িতে মরে গেলেও পা দেব না।’

‘ছিঃ, প্রতিজ্ঞা করতে নেই মেজো। বাঙালির প্রতিজ্ঞা জানিস তো মেজো, এই করে এই ভাঙে। কাচের বাসনের মতো। তিন দিন পরেই তোমার গাড়ির দরকার হবে ভাই। মনে নেই, হাওড়ায় যাবে। প্রফেসার চিদাম্বরম আসছেন সকাল আটটা দশ মিনিটে। নাও, নেমে পড়ো। একটু ব্যায়ামও হবে। শরীরটা দিন-দিন বেঢপ হয়ে যাচ্ছে।’

দু’পাশের দরজা খুলে পেছনের আসন থেকে তিনজন নেমে পড়লেন। তেলেভাজার-দোকান-ফেলে সরোজবাবু এগিয়ে এলেন, ‘আমিও একটু হাত লাগাই স্যার!’

মেজোমামা খ্যাঁক করে উঠলেন, ‘তুমি হাত না লাগালেও টাকা পাবে। এখন বুঝছি অপয়া কে? কাল সকালে উঠেই তোমার নাম করে দেখব, কপালে অন্ন জোটে কি না!’

‘ঠিক ধরেছেন স্যার। এতক্ষণ বলিনি কিছু, চুপচাপ ছিলুম। সবাই আমাকে অপয়া বলে। নাম করলে হাঁড়ি ফেটে যায়।’

বড়মামা সামনের আসন থেকে বললেন, ‘তুমি তাহলে ত্রিসীমানায় আর দয়া করে থেকো না। সরে পড়ো। আর সকালের দিকে দয়া করে বাড়িতে যেও না।’

সরোজ মাইতি সাইকেল নিয়ে সরে পড়লেন। ধীরে গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। আশুবাবু আর মেজোমামা প্রাণপণে ঠেলছেন। মাসিমা আসছেন পায়ে পায়ে ইন্দিরা গান্ধীর মতো গম্ভীর চালে। বড়মামা গান ধরেছেন :

মুক্তির মন্দির সোপান-তলে

কত প্রাণ হল বলিদান

লেখা আছে অশ্রুজলে।

আমি বনেটে টুকুস টুকুস করে তাল বাজাচ্ছি। বেশ জমে গেছে ব্যাপারটা।