পাঁচ
একেবারে সামনের সারিতে আসন। প্রথমে বড়মামা, তারপর মাসিমা, সুধা, মাইমা, চুমকি, আমি আর হরিদা। প্রতাপ এল না। চারজনকে খুব খাতির করে বসানো হয়েছে। বেশ গম্ভীর গম্ভীর মুখ। হতে পারে। কম বড়লোক। টাকা ওঁদের কাছে বাসের টিকিট। ‘ডলার-টলার দ্যান রুপি’। চারজনেই আগরওয়ালার গেস্ট। আমেরিকায় এঁরা ‘ফেমাস ফোর’ নামে পরিচিত।
সুধা মাইমার একটা হাত মাসিমার হাতে। আঙুলে আঙুলে জড়ানো। চুমকি বললে, ‘হরিদার সাজটা তুই একবার দ্যাখ। পাঞ্জাবিতে একটাও বোতাম নেই।’
‘ওসব গ্রাহ্যই করে না। হরিদার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।’
‘আংটিটা আঙুল থেকে খুলে পাতকোয় পড়ে গেল। বললে, ‘বাঁচা গেল! কানে তুলো লাগিয়েছে কেন?’
‘আতর! হাতে ছোট্ট একটা থলি দেখছিস?’
‘হ্যাঁ রে। কী আছে রে?’
‘একটা, একটা করে পঞ্চাশটা টাকা। মেজোমামা যখন ‘ক্ল্যাপ’ পাবেন। তখন ওই থলিটা ছুড়ে দেবেন। সেকালের জমিদারদের মতো।’
মেজোমামার সাজ কমপ্লিট। ধবধবে সাদা মহাদেব। পিঙ্গল জটাজাল। সভাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বড়মামাকে প্রণাম করলেন। সত্যিই চেনা যাচ্ছে না। হরিদা বললে, ‘যাও, কর্তার নাম করে ফাটিয়ে দাও ভোলা মহেশ্বর।’
ড্রপসিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আগরওয়াল মাইক্রোফোনে বলছেন, ‘এই সেই বিখ্যাত নাটক। গিরিশচন্দ্র ঘোষ স্টার থিয়েটারে নামিয়েছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ দেখেছিলেন। এ নাটক নয়—ইতিহাস। আজ আমাদের শিবপূজার রাত। বলুন, বলুন,জয় বাবা বিশ্বনাথ।’
চতুর্দিকে ডুগুডুগু ডমরু বেজে উঠল। গম্ভীর গলায়, ব্যোম, ব্যোম। পরদা ধীরে ধীরে দুপাশে সরে গেল। বাগান। তপস্বিনী ধ্যানে বসে আছেন। মহামায়ার আবির্ভাবে। ধোঁয়ার কুণ্ডলি।
মহামায়া।। বর নে রে, পূর্ণ মনষ্কাম তোর।
তপস্বিনী।। মা, মা আমার কোথা ছিলে ভুলে।
শুরু হল আলো আর শব্দের খেলা। চুমকি ফিসফিস করে বললে, ‘বুঝলি, মহামায়া সতীকে ভর করলেন, মহাদেবকে প্যাঁচে ফেলার জন্যে। ওই শোন কী বলছেন?
মায়াপাশে বাঁধিবে মহেশে
এ বেশে এ লীলা মম।
হঠাৎ স্টেজের ওপর একটা কুকুর। হরিদার ভোলা। কী কাণ্ড! ডায়ালগ বন্ধ।
হরিদার হাঁক, ‘চলে আয় ভোলা, মাকে প্রণাম করে নেমে আয়, নেমে আয়। মায়াপাশে হোস না আবদ্ধ। আমরা মুক্ত। কেহ নাহি পারিবে তোরে বাঁধিতে।’
পটাপট তালি আর তালি। ‘এনকোর, এনকোর। আর একটু হোক।’
হরিদা উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে,
‘আর নাহি হবে রে এখন
রাত্রি শেষে তৈরি হবে নতুন পালা
পশু আর মানুষের প্রেম বন্ধন।’
আবার ক্ল্যাপ। প্যান্ডেল মুখর। ভোলা এক লাফে নেমে এসে হরিদার পায়ের কাছে শুয়ে পড়ল। হরিদা হিরো। আবার শুরু হল আসল পালা। বেশ জমে উঠেছে। দক্ষ ঘুরে গেছেন। মহাদেব ঢুকেছেন। কী দেখাচ্ছে। সবাই হাঁ হয়ে গেছে। মহাদেব আর সতী মুখোমুখি। নীল আলোর ঘুরপাক।
মহাদেব।। আছে কি জগতে শক্তি সতী,
মহাশক্তি বিরোধিতে?
সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধানো চড়া আলোয় স্টেজ ঝলসে উঠল।
ওঁ ওঁ ওঁ। চাপা মেঘ গর্জনের শব্দ। সাঁ সাঁ সাঁ।
সতী।। বিশ্বনাথ, বিশ্বনাথ।
মেজোমামার কি অভিনয়, একেবারে অন্য মানুষ—
মহাদেব।। তুরীয় তোমার লীলা/সতী, তুমি অন্তরে বাহিরে।
বড়মামা হঠাৎ বললেন, ‘ও কী? উইংসের পাশে।
‘কই?’
‘ওই তো, ওই তো! দেখতে পাচ্ছিস না তোরা? ওই তো প্রতাপের মা, কি সুন্দর সেজেছে!’
বড়মামা উঠে পড়লেন। বেরিয়ে যাচ্ছেন। পেছন, পেছন আমরা। ঘরের সমস্ত জানালা খোলা। মাঠের দিকে জানলার বাইরে হুহু আকাশ। শরতের বাতাসে শিউলির গন্ধ। মৃদু আলো। মায়ের পাশে ক্লান্ত প্রতাপ ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথার বালিশে প্রতাপের মায়ের মুখটি যেন পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। চোখদুটো খোলা। কিছু একটা দেখছেন, ভালো কিছু, ভীষণ আনন্দের কিছু।
বড়মামা চাপা স্বরে বললেন, ‘চলে গেছে। প্রতাপকে আমি জাগাতে পারব না, তোমরা যা পারো করো।
খাটের পাশে এক সার মানুষ অবাক হয়ে দেখছে—নিদ্রা আর চিরনিদ্রা।
খোলা জানলায় শেষ শরতের আকাশ। শিউলি আর ফুটবে না।