চার
উঃ, বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পর পাড়াটায় থাকা যায় না। মা যেন সব নিয়ে চলে গেছেন। শীতকালের পাখিরা উড়ে এসে ঝিলের জলে ডানা মেলে ভাসছে। পাড়ার হাঁসেরা খুব বকাবকি করছে। মাঝে মাঝে এক-একটা রুপোলি মাছ, কীসের আনন্দে কে জানে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠছে। প্রতাপকে দেখে এলুম, কলতলায় বসে মায়ের জামাকাপড় কাচছে। খুব রোগা হয়ে গেছে। কোনওভাবেই তার কিছু করা যাচ্ছে না।
কাল বারোয়ারিতলায় সেই পালা হবে দক্ষযজ্ঞ। দারুণ একটা স্টেজ হচ্ছে। সারাক্ষণ ঠকাস ঠকাস শব্দ। আলো আর শব্দের খুব খেলা হবে। পিলে চমকানো শব্দ হবে। মেঘের তর্জনগর্জন। ভূত-প্রেত আসবে অনেক। মেজোমামার কোমরে বাঘছাল থাকবে কি না—এই ভয়। একটা হাফ-প্যান্ট তলায় রাখবেন। নিজে নিজেই রিহার্সাল চালাচ্ছেন। একপাতার একটা ডায়ালগ আছে। সতী দে, সতী দে। কাঁধে তুলবেন সতীকে। তুলোর পুতুল—মানুষের মাপে। দশমহাবিদ্যা বেডিং স্টোরস তৈরি করে দিয়েছে। ল্যাত ল্যাতে। সমস্যা দেখা দিয়েছে—মহাদেবের কাঁধে সতী উপুড় হয়ে থাকবে? না, চিৎ হয়ে। সে যা হয় হবে। পণ্ডিতমশাই ভালো বলেছেন, ‘কাঁধে একটি কলদীকাণ্ড স্থাপন করিতে পারো। কদলীই তো সতী। খণ্ড খণ্ড করিতে সুবিধা হইবে।’
এই নাটকের সুদূর ভবিষ্যৎ। আমেরিকা থেকে আমন্ত্রণ আসতে পারে। বঙ্গ সম্মেলনে মঞ্চস্থ হবে। শোনা যাচ্ছে। একটা চোঙা লাগানো গাড়ি। কান ফাটানো চিৎকার—হ্যালো, হ্যালো, দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ। নট ও নাট্যকার শিরিস চন্দ্রের—আর একটা গলা। গালাগাল, শিরিস নয়, গিরিশ। ছাড় তো, আমাকে দে। বন্ধুগণ, আজ রাত্রি নয় ঘটিকায়। বারোয়ারি তলা প্রাঙ্গণে মঞ্চস্থ হবে অবিস্মরণীয় পালা—গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘দক্ষযজ্ঞ’। নাম ভূমিকায় যাত্রাখ্যাত জলদবরণ। মহাদেবের ভূমিকায় অধ্যাপক সুধাকান্ত। সতীর ভূমিকায় মীরাট প্রবাসী অভিনেত্রী অনিন্দিতা, অনিন্দিতা, অনিন্দিতা। সুর ও সঙ্গীত আয়োজনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন—প্রিন্স কাকাতুয়া। দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ। গান,
নাচে বাহু তুলে, ভোলা ভাবে ভুলে
বব বম বব বম্ গালে বাজে।
হ্যালো, হ্যালো বন্ধুগণ—দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ। বিশেষ আকর্ষণ, যুগান্তকারী আমেরিকান সুদর্শন চক্র চোখের সামনে সতীদেহ খণ্ড খণ্ড করবে। সব শেষে দশমহাবিদ্যার পূজা। বাচ্চা ও কোলের বাচ্চাদের প্রবেশ নিষেধ। যাঁদের বুকে পেসমেকার বসানো আছে, তাঁরা অনুগ্রহ করে পেছনের সংরক্ষিত আসনে বসবেন। সঙ্গে জলের বোতল, খাবারের প্যাকেট আনলে বাজেয়াপ্ত করা হবে। সমগ্র অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনায়—আগরওয়াল ইন্টারন্যাশনাল। ছাতের জলপড়া বন্ধ করতে লাগান—আগরওয়াল ম্যাজিক কোট। আলসারে খান আগরওয়াল ছাতু। দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ।
সতী তোর আনন্দ মূরতি
নয়নের ভাতি মোর; সত্যি, সত্যি
বাংলার ঘরে ঘরে আগরওয়াল গুঁড়ো মশলা, ফোল্ডিং ছাতা। দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ।
চুমকি বললে, ‘মানে ইচ্ছে হচ্ছে—গলাটা টিপে দি।’
‘ওদিকে কান দিচ্ছিস কেন?’
‘কান ধরে টানছে যে।’
পেপার পাল্পের তৈরি বিশাল একটা শিবলিঙ্গ চলেছে মঞ্চের দিকে। পেছনে বিজয় আগরওয়াল সঙ্গে আরও কয়েকজন। বড়মামার চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
বড়মামা বললেন, ‘হাঁটু কি বলছে?’
‘হাঁটলে ঠিক আছে, বসলেই বিপদ।’
‘দেখছি কী করা যায়?’
‘আরে, আমি জানি আমার দোস্ত আছে।’
আগরওয়াল বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ।
‘কী হল?’
‘সতীকে তিন জায়গায় ফুটো করে দিয়েছে।’
‘কে সতী?’
‘ওই যে মেজদার কাঁধের সতী।’
‘ও সব জিনিস ওর কাঁধে দিতে আছে। কী দিয়ে ফুটো করল? স্টিচ করতে হবে। পুলিশ কেস না হয়ে যায়!’
‘মেজদা করেননি। ধেড়ে ইঁদুরে করেছে।’
‘আমি বারবার সকলকে বলি, মশারি ফেলে শোও। সবার আগে টেট ভ্যাক দিতে হবে। তারপর অ্যান্টি র্যাবিজ।’
অনেক কষ্টে বড়মামাকে বোঝানো গেল। মাসিমার কাজ বাড়ল—সতীদেহের তিন জায়গায় তাপ্পি মারতে হবে। মেজোমামা কাঁধে ফেলে বললেন, ‘সুন্দর ফিট করেছে।’
‘করবেই তো স্যার। কাঁধের মাপ নিয়ে করেছে যে।’
‘আর একটু ভারী হলে ভালো হত!’
‘সে জলে ভেজালেই হবে।’
‘ইঁদুরটা ভেতরে ঢুকে নেই তো! কি যেন একটা নড়ছে!’
‘ও তাপ্পি মেরে দিলেই তুলোর মধ্যে ঘুমিয়ে পবে।’
‘ধ্যুৎ মশাই। ইঁদুরের দাঁতের ধার জানেন?’
বড়মামা বললেন, ‘একটা ফুল বডি এক্স-রে করালেই তো হয়।’
বেলা পড়ে এল। আঃ, কি আলো লাগিয়েছে। জ্বলছে নিবছে। চাকা ঘুরছে। মাইকে হর হর ব্যোম ব্যোম, ভোলেবাবা পার করে গা। স্টেজটা একেবারে জম্পেশ। পেছনে বিশাল শিবলিঙ্গ নাটকে শিবপূজার সিন আছে। বাদ্য বাজানোর দল এসে গেছে। নানা রকমের শব্দ। চ্যাঁক চো, গুড়ুগুড়ু। শেষবেলা ভারি ভালো একটা খবর এল। খবরটা নিয়ে এলেন সুধা মাইমা। এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলেন। খবরটা এল, প্রতাপের মা হঠাৎ বিছানায় উঠে বসেছেন। হাসি মুখে সকলের সঙ্গে পরিষ্কার কথা বলছেন। জ্বর নেই। চুমুক দিয়ে এক কাপ ফলের রস খেয়েছেন। চিরুনি দিয়ে প্রতাপের চুল আঁচড়ে দিয়েছেন।
বড়মামা বললেন, ‘মিরাক্যাল। এ ভগবানের খেলা।’
সুধা মাইমা আমাকে নিয়ে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কোথায় কী আছে। মাঝে মাঝে বলছেন, ‘দারুণ বাড়ি। প্যালেস, প্যালেস!’ মাসিমা প্যান্ডেলে। সতী রিপেয়ার করতে গেছেন। সুধা মাইমা জিগ্যেস করলেন, ‘বড়মামার ঘর কোনটা?’
‘এইটা।’
‘বাঃ, পুব দিকে একটা বারান্দা আছে। ঝিলটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।’ দরজাটা বন্ধ করে বড়মামার বালিশে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলেন।
‘কী রকম দেখাচ্ছে রে আমাকে?’
‘ঠিক মাইমার মতো।’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘চল, চল। অনেক কাজ পড়ে আছে।’ বালিশের যে জায়গায় মাথা রেখেছিলেন, সেই জায়গাটা দেবে রইল। ব্যাপারটা কী হল বুঝতে পারলুম না।