তিন
পুজো তো এসে গেল। কিছু করার নেই। প্রতাপের মনটা খুব খারাপ। প্রতাপের মা খুব অসুস্থ। বড়মামা খুব চেষ্টা করছেন। কি যে ছাই হয়েছে। প্রতাপ বলেই রেখেছে, মা যদি মারা যায়, আমি হিমালয়ে চলে যাব। তার তো এক-একদিন এক-একরকম হতে ইচ্ছে করে, শেষ ইচ্ছেটা ছিল পাইলট হবে। চুমকিকে সেদিন বোঝাচ্ছিল, আমার বাবা সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। কোথায় আছেন কেউ জানে না। তার মানে আমার রক্তেও সন্ন্যাসীর বীজ। আমগাছের ছেলে আমগাছ হবে। বাঘের ছেলে বাঘ। তা হলে আমাকে সন্ন্যাসী হতেই হবে।
‘কী ভাবে হবি?’
‘খুব সহজ। প্রথমে হরিদ্বারে যাব। সেখান থেকে হৃষীকেশ। গঙ্গার ধারে ঝুপড়িতে সার সার সাধু।’
‘দোকানে না কি?’
‘দূর বোকা। সাধুরা সব চোখ বুজিয়ে দম বন্ধ করে বসে আছেন।’
‘তার মানে মরে গেছেন।’
‘ধূর! একে বলে কুম্ভক। আলো দেখছেন, গান শুনছেন।’
‘সে তো চোখ চেয়ে রেডিয়ো শুনলেই হয়।’
‘তোকে বোঝাতে পারব না রে। সে আলাদা আলো, আলাদা গান।’
‘তুই তো বাড়িতেই চোখ বুজিয়ে, দম বন্ধ করে বসে থাকতে পারিস।’
‘বাড়িতে খুব ঝামেলা রে।’
‘আমাদের বাড়িতে চলে আয়। ছাদের ঘরে বসে থাকবি।
‘ভগবান হৃষীকেশ পর্যন্ত আসেন। মাঝে মাঝে কাশীতে যান। তার নীচে আর নামেন না। আমি যদি না-ই থাকি কার কি এসে যায়?’
‘ধ্যাৎ! তুই খুব অসভ্য। তোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তুই একটা ছুঁচো, বেজি, ভাম, বিটকেল।’
প্রতাপের চুল খামচে ধরে মাথাটাকে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে, ‘তোকে আমি মেরেই ফেলব। গর্ত করে পুঁতে দেব। চুরি করে তোকে তেঁতুলের আচার খাইয়ে এই আমার ফল হল। তুই একটা গাধা, বনমানুষ, উদবেড়াল, ভুঁড়ো শেয়াল, ঝাকড়দা মাকড়দা। সাধু হবি সাধু! তোকে আমি কচুকাটা করব। বুকে বসে দাড়ি ছিঁড়ব। আজই তোর শেষ দিন। কিল, চড়। শেষে প্রতাপ চিৎ, বুকের ওপর চুমকি। ‘একটা একটা করে তোর দাঁত খুলে নেব।’
হরিদা ছুটে এসেছে। ‘করিস কী, করিস কী?’
চুমকি তীরবেগে ছুটল। সেই একেবারে ঝিলের ধারে। কাশফুলের মাথা দুলিয়ে বাতাসের হাত ধরে নাচ। চশমা চোখে শালিক। পানকৌড়ির চুপুক চুপুক ডুব।
প্রতাপের ভয়। খেয়ালি মেয়ে কখন কী করে বসে। সেও ছুটে এসেছে—’শোন না, আমি সাধু হব না।’
‘তাহলে কি হবে? ছাগল, রামছাগল।’
‘আমি মরুভূমির উটচালক হব।’
‘উটের পিঠে আমি। পানিফল খাবি? ওই দেখ জলে ভাসছে।’
এই ঝিলটা সরকারবাবুদের। শঙ্করের বাবা ইজারা নিয়েছেন। মানুষটার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। মাঠে-ঘাটে আখড়ায় নেচে নেচে বাউল গান গায়। প্রতাপ তাকে গুরু করেছে। প্রতাপ সাধু না হয়ে বাউলও হতে পারে। শঙ্করের নৌকা ঝিলের মাঝখানে। মাছ ধরেছে। এদের দেখে চেঁচাচ্ছে—’আসবি? শরতের মেঘের ছায়া জলে কেমন পড়েছে দ্যাখ। আকাশের তলায় আকাশ।’
পুজোর আনন্দে প্রতাপ নেই। আমি আর চুমকি ঠিক করেছি, নতুন জামাকাপড় পরব না। ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখব না। মৃত্যুকে ভীষণ ভয় করে। প্রতাপের মা যে-ঘরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন—একতলার ঘর। মাঠের দিকে খোলা জানলা। সেই জানলায় গিয়ে আমরা দুজনে দাঁড়াই। চোখ বুজিয়ে খুব প্রার্থনা করি—জগতের মা প্রতাপের মাকে ভালো করে দাও না। একটা কথাও কি শুনতে নেই!
জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরেটায় কিছু ইটপাটকেল পড়ে আছে। আগাছা জন্মেছে। চুমকির পায়ের পাতার ওপর দিয়ে আস্ত একটা সাপ চলে গেল, যেন বেড়াতে বেরিয়েছে।
চুমকির তো ভয়ডর নেই। বললে, ‘কী রকম অসভ্যের মতো চলে গেল। কামড়াতেও ভুলে গেছে শয়তানটা।’
‘কামড়ালে তো মরে যেতিস।’
‘আমি তো মরতেই চাই। আমি মরলে মাসিমা বেঁচে উঠত।’
‘আবার তুই মরলে আমাকে মরতে হত।’
‘থাক, ন্যাকা ন্যাকা কথা আর বলিস না। তোদের সবক’টাকেই আমার চেনা হয়ে গেছে। একজন বলছে সন্ন্যাসী হবে। তোর বড়মামা আমার মাকে কেন বিয়ে করল না। আমার মাকে কেন অপমান করল। বিয়ে করলে তো আমার বাবা হত। মামা হয়ে বসে রইল। স্বার্থপর লেপার্ড।’
‘তা তুই আমার সঙ্গে কেন ঝগড়া করছিস? আমি কি জানি?’
‘চুপ! মামার ভাগনে মামার মতোই হবে। স্বার্থপর ওরাংওটাং।’
‘কাঁদছিস কেন?’
‘বেশ করেছি। গায়ে হাত দিবি না। কামড়ে দেব।’
বড়মামা খুব চেষ্টা করছেন। রোজই স্পেশালিস্টরা আসছেন। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার চুমকির মা, যাঁকে আমি মাইমা বলছি, সে সব সময় বড়মামার পাশে, হেলপিং হ্যান্ড। ‘সুধা, হট ওয়াটার ব্যাগ। পায়ের তলায় পাউডার ঘষো। স্যালাইনটা একবার দ্যাখ, টেমপারেচার?’ যাক বাবা, দুজনের ভাব হয়ে গেছে। মাসিমা নিয়েছেন রান্নাঘরের দায়িত্ব। আমি বেশ বুঝেছি—চুমকি তার বাবার চেয়ে আমার বড়মামাকে বেশি পছন্দ করে।
পুজো যেমন হয় সেইরকমই হল। ঢাকঢোল। ঘোষপাড়ায় জমিদার বাড়ির সানাই ঘরে সানাই যেমন বাজে, সেইরকমই বাজল রকম রকম সুরে। কলাবউরা নাচতে নাচতে চান সেরে এলেন নদী থেকে। ঢাকঢোল, চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি। মায়েদের সিঁদুর মাখা মুখ। নতুন শাড়ি। জামাপ্যান্ট। নারকোল ছাপা। কিছু বাকি রইল না। ঝিলের ধারে শীত এসে গেছে। চুমকি বললে, ‘যাঃ পুজো চলে গেল।’ প্রত্যেক বছর পুজোয় হাত ভর্তি কাচের চুড়ি পরে। মেলায় ফকিরকাকু চুড়ির দোকান দেয়। বাপরে! সে যেন রঙের ঝিলিক, স্বপ্নের পাহাড়। চুমকিকে ভীষণ ভালোবাসে। দুজনের কত ঝগড়া। এবারে কত ডাকল। চুমকি গেল; কিন্তু চুড়ি পরল না। ফকিরকাকু আপেল, আঙুর ব্যাগে ভরে চুমকির হাতে দিয়ে বললে, ‘দিদিমণি মাকে দিয়ে এসো। আমি নামাজের সময় আল্লাকে বলব, দোয়া দোয়া।’ ফৈজাবাদের ফকিরকাকু বাংলার অনেক মায়ের এক মায়ের জন্যে প্রার্থনা করছে।