চার
মিটে গেল। শ্রাদ্ধও হল। অনাথ সকলের নাথ। ওর মতো আমি হতে পারব না। আমি একটা প্যানপ্যানে, ঘ্যানঘ্যানে ছেলে। নিজের কথা ভাবতেও ঘেন্না করে। কোনও ব্যক্তিত্ব নেই। একবার ভাবছি এই হব, একবার ভাবছি ওই হব। দুপুরবেলা। আমি, অনাথ, আরতি বসে আছি ওদের ঘরে। হনুমানের একটা দল মাঝে মাঝে এদিক ওদিক আসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে। আজ এসেছে। দাপাদাপি করছে ছাতে। আরতি আলমারি খুলেছিল। ভাঁজ ভাঁজ কাপড়ের তলা থেকে ছোট্ট একটা নোটবুক বেরোল।
‘এই দ্যাখো, মায়ের লেখা।’
অনাথ বললে, ‘পড় না! কী লেখা আছে পড়।’
‘আরতির বাবার মাথা ক্রমশ খারাপ হয়ে আসছে। আমাকেই আর চিনতে পারে না। নিজের মেয়েকে দেখে মাঝে মাঝে বলে ওঠে, এটা কে—কোথা থেকে এল? ও পাগল হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে ওর ওপরে কোনও প্রেত ভর করে। তখন দুহাতে নিজের চুল ছেঁড়ে। শক্ত জিনিস কামড়াতে থাকে। তালা, চেয়ারের হাতল, হাতা, খুন্তি। সেই সময় ছুরি দিয়ে আঙুল কেটে নিজের রক্ত চুষে খায়। আরতিকে মেরে ফেলবে না তো। আমার শ্বশুরমশাই উইল করে এই সম্পত্তি দান করে গেছেন। সাক্ষী ডাক্তার সরকার। খাটের তলায় একটা গুপ্তবাক্স লাগানো আছে, কেউ জানে না। তার ভেতর আরতি জন্যে অনেক গয়না, আর সেই দানপত্রটা আছে। চাবিটা আছে মা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে। আরতি সাবধানে থাকিস। আমি আর বেশিদিন নেই। আমি তোকে মুখে না বলে কেন লিখছি? শোনা কথা পেটে থাকে না। তা ছাড়া লেখা একটা প্রমাণ, একরকমের উইল। সব তোর, সব তোর। একা থাকিস না। ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে করিস।’
গুপ্তধন নয়, লুকিয়ে থাকা ধন বেরোল। মোটামোটা গহনা। হার, বালা, বাজু, হিরের আংটি, দানপত্র, একেবারে ছেলেবেলায় তোলা আরতির ছবি। দৌলত বেরিয়ে পড়েছে। আর আমি এখানে থাকব না। এরপর কী হবে কে বলতে পারে। অনেক ভরি সোনা, হিরে। আমি বললুম, ‘অনাথদা। একটা জরুরি কাজ আছে, ঝট করে সেরে আসি।’
‘আমারও একটা খুব খুব জরুরি কাজ আছে। স্টেশানে যেতে হবে।’
আরতি বললে, ‘বাঃ আমার কাছে কে থাকবে? এখন যখের ধন নিয়ে ভূতের বাড়িতে আমি একা কী করে থাকব?’
‘মনে করো এগুলো নেই। যেখানে ছিল সেইখানেই রেখে দে।’
‘একবার জেনে ফেললে আর ভুলে থাকা যায়? তোমাদের কারো কোনও কাজ নেই। তোমরা ভয়ে পালাচ্ছ। এইবার কেউ না কেউ আমাকে খুন করবে, তোমরা ভাবছ সেই খুনের দায় তোমাদের ওপর পড়বে। কাজের কাজ তোমরা কিছুই করলে না, এখন আমাকে ফেলে রেখে পালাতে চাইছ? এই তোমাদের বিচার? কেউ কারো নয়। এই তোমাদের ভালোবাসা।’
‘তোর অসাধারণ বুদ্ধি। ধরেছিস ঠিক। অর্থই অনর্থ। তুই এখন প্রকৃত বড়লোক। আমরা গরিব, অসহায়ের বন্ধু হতে চাই।’
‘আমি বন্ধুত্ব চাই, ধনদৌলত চাই না। এই সব তোমরা নিয়ে যাও, দান করে দাও।’
চালাকি ধরা পড়ে গেলে মানুষকেও কীরকম বোকা দেখায়। আমাদের ঠিক সেই রকম দেখাচ্ছে। মেয়েদের দিকে এক নজরে বেশিক্ষণ তাকাতে নেই, তায় আরতি যথেষ্ট সুন্দরী। ভগবান যাকে যেমন করবেন। অনাথ জমিদার বংশের ছেলে। সে তো সুন্দর হবেই।
অনাথ বললে, ‘আমরা একটা জায়গায় বিশ্রী ভাবে আটকে গেছি। আজ রাতে যখনই হোক একটা মিটিং করব। বড়মামা থাকবেন, ডাক্তার সরকার আর মেমসাহেব।’
‘শেষের দুজন কেন?’
‘ডাক্তার সরকারের মাথায় বেশ কিছু আইডিয়া আছে। ওই কথাটা আমার খুব ভালো লেগেছে—’আশার আলো’। ওই শব্দটাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আর মেমসাহেব? স্কটল্যান্ডের বাড়ি। সিস্টার নিবেদিতার কথা ভাব। স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড। বীরের দেশ, স্বাধীনতার দেশ।’
‘পণ্ডিতমশাইয়ের চতুষ্পাঠী?’
‘ওঁকে ওঁর মতো এগোতে দে।’
‘বড়মামাকে বলতে হবে তো?’
‘হবেই তো।’
অনাথ আরতিকে বললে, ‘তুই কেন এত ভীতু। তুই কি জঙ্গলে বাস করছিস? সাহসী হ। ওই মেমসায়েবকে দেখ। একেবারে একটা নির্জন জায়গায় একা একটা বাংলোয় থাকেন।’
বড়মামা প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না, ‘আমি একটা খামখেয়ালি। যখন যা ইচ্ছে হয় তাই করি। উত্তর ভারত, হিমালয় আমাকে টানে। তবে এটাও ঠিক, কিছু একটা করা উচিত। আমাদের দারিদ্র ঘুচবে না। আমাদের স্বভাব অন্যরকম। খেতে পেলে শুতে চাই। পণ্ডিতমশাইকে বলতে হবে। খুব দুঃখ পেয়েছেন। আশার মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়নি। বলেছেন, ওরা আমাকে জোচ্চর ভেবেছে। লোভী ভেবেছে। আমরা সন্ধে সাতটার সময় মেমসায়েবের বাংলোতেই বসব। সুন্দর জায়গা।’
অনাথ সামান্য কিছু বাজার করে আরতির বাড়িতেই ঢুকল। রান্না করবে। খুব ভালো রাঁধে। ছেলেটার অনেক গুণ। এই ক’দিনে বাড়িটার হাল ফিরিয়ে দিয়েছে। সন্ধে সাতটা। আজ পূর্ণিমা। বাংলোর সব ক’টা আলো আজ জ্বলছে। বাগানও আলোকিত। গাছের ফাঁকে নিঃশব্দ পূর্ণিমার চাঁদ। গঙ্গা আজ আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সাদা একটা স্টিমার চলেছে জল কাটতে কাটতে। আশ্রমে হরি নাম হচ্ছে। মেমসাহেব আজ নতুন একটা গাউন পরেছেন। কী তাঁর উৎসাহ! নীচের বড় হল ঘরে মিটিং হবে। ঘরটা কী সুন্দর, যেন কোনও গির্জার প্রেয়ার হল। এমন আলোর ব্যবস্থা, সারা ঘরটা নরম আলোয় ভাসছে। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, ‘আজ কি কোনও উৎসব আছে?’
‘হ্যাঁ আছে, আলোর উৎসব। আশার আলো।’
অনাথ আর আরতি আসছে। আরতিকে আজ কী সুন্দরী দেখাচ্ছে। একটা সাদা শাড়ি পরেছে। চাঁদের আলোয়, দেবদারু আর ঝাউ গাছের ঝিলিমিলি ছায়ায় মনে হচ্ছে পরি। অনাথ পরেছে সাদা পাঞ্জাবি। দুজনকে বেশ মানিয়েছে। আলো-ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে দেখতে পায়নি। রঙ্গনগাছের ঝোপের পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। মাথার ওপর দেবদারু গাছের ডালপালা।
আমি ঈর্ষা করছি না। কেন করব? যার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। এই তো ক’দিন আগে আরতি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পিঠে মুখ গুঁজে কাঁদছিল। জানি, জানি, আমি সকলের দুঃখের দিনের বন্ধু। সুখের আসরে আমার স্থান নেই। সকলের জন্যে আশার আলো, আমার জন্যে অন্ধকার কালো। ওরা দুজনে আলোকিত সভাঘরের দিকে চলে গেল। মোরাম বিছানো পথে পায়ের শব্দ তুলে। রাজপুত্র আর রাজকন্যা। একবার ডানপাশে তাকালেই আমাকে দেখতে পেত। কেন দেখবে? ওরা আমার আশার আলো জ্বালাতে যাচ্ছে। পণ্ডিতমশাই যাচ্ছেন। ডাক্তার সরকার। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি। বড় বড় মানুষগুলো কীরকম ছোট ছোট হয়ে যাচ্ছে! উঠছে, বসছে, হাত নাড়ছে, মাথা ঘোরাচ্ছে। এদিকে যাচ্ছে, ওদিকে যাচ্ছে। অনাথ আর আরতি বড় দরজার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মাথার ওপরে জোরালো আলো। আলোর ঝরনাধারায় নায়ক আর নায়িকা! যেন বিয়েবাড়ি! বউভাত।
সবাই এসে গেছেন। লম্বা টেবিলের দুপাশে সবাই বসেছেন। আমি যে নেই—কেউই লক্ষ করছেন না। ‘আশার আলো’র প্রতিষ্ঠা দিবসে একটা আলোকহীন আলো—এই আমি। আমার চারপাশে ফুটে আছে থোকা থোকা রঙ্গন। দেবদারুর ঝালোর ঝালোর পাতায় ঝুলছে শরতের পূর্ণচন্দ্র। কেউ বেরিয়ে এসে এদিকে-ওদিকে আমাকে খুঁজছে না। আমি দাঁড়িয়েই আছি। ওদিকে মালির ঘর। দরজা খোলা। উনুনে আগুন। মালির বউ রান্না করছে।
সরু একটা পথ ঢালু হয়ে গঙ্গার দিকে নেমে গেছে। আজ চাঁদের আলোর নদী। আমাকে ডাকছে, যারা সভা করছে তারা নয়। কেউ একজন ডাকছে, আমি দেখতে পাচ্ছি না। ‘খোকা-খোকা’। আমার মা।
‘তুমি কোথায় কত দূরে?’
‘এই বোকা; তুই তো আমার কোলে।’
এই ঘাটটার নাম ‘শিলাঘাট’। মহাবীরের মন্দির। না চাইতেই এক মা এসে আমার হাতে লুচি আর হালুয়া দিলেন। চাঁদের আলোয় তাঁর চোখ দুটো জ্বলছে।