তিন

পণ্ডিতমশাই যেন শিবঠাকুরটি। বোমভোলা। ফর্সা। ভুঁড়ি আছে। খাড়া নাক। টানাটানা চোখ। হাসিহাসি মুখ। তিনি বলেন, সকালে আমি চাষা। ঠিক তাই। বাগানে খুরপি হাতে ঘুরছেন। মাচায় দোল খাচ্ছে শশা, করলা, সিম। লাউ হয়েছে। কুমড়ো। একপাশে একটা কোদাল, একতাল গোবর, কিছু খড়। পণ্ডিতমশাই কখনও গান গাইছেন, কখনও দু-হাত তুলে নাচছেন। কখনও লাউ, কুমড়োর সঙ্গে কথা বলছেন। চতুর্দিকে নানা রঙের ফুল। বাহারি প্রজাপতি কাগজের টুকরোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। পণ্ডিতমশাইয়ের বাগানে যেন উৎসব হচ্ছে। মাথার ওপর রোদ ঝলমলে শরতের নীল আকাশ। টিয়াদের শরীরে নতুন পালক এসেছে। এ-গাছে, ও-গাছে ভীষণ চেঁচামেচি। আমরা তিনজন হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি, পণ্ডিতমশাই মানুষ না দেবতা। শরীরে অদ্ভুত একটা জ্যোতি। আমাকে প্রায়ই বলেন, ‘এই বয়েসটা খুব সাবধান, ব্রহ্মচর্য, ব্রহ্মচর্য। মেয়েদের পায়ের দিকে তাকাবে। দূরে থাকবে। আত্মীয়স্বজন হলেও সাবধান। অশিক্ষিত মন শত্রু, শিক্ষিত মন চিরবন্ধু।’

এই কথা মনে হতেই দেখলুম, আরতিদি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বেশ দূরে সরে যেতেই অরিতিদি বললে, ‘আমি গরিব বলে সরে গেলি। বেশ করেছিস।’

‘এ কী কথা। আরতিদি! তুমি তো আগে এরকম ছিলে না। এ তুমি কী বললে? আমি যে তোমার কথা সব্বাইকে বলি। মনে মনে ভাবি, যদি কোনও দিন লেখক হই তোমাকে নিয়েই লিখব আমার প্রথম গল্প। তুমি আমাকে এ কী বললে! তোমার চেয়ে আমি গরিব। তোমার মা আছেন, আমার বাবা-মা কেউই নেই। মামারা ভীষণ ভালো, তাই আমাকে রেখেছেন। মামিমা-রা থাকলে কী হত বলতে পারব না। দূর করে দিত। আমি ছাড়া কে আছে আমার এই পৃথিবীতে।’

আরতিদি ঝটিতে আমার কাছে সরে এসে বললে, ‘আমি আছি। আমি আছি।’

পণ্ডিতমশাই কুমড়োগাছের সঙ্গে কথা বলছেন, ‘মা! কেবলই ফুলই দেবে? ফল দেবে কবে? তোমার ফুলে তো পুজো হবে না মা?’

এতক্ষণে দেখতে পেয়েছেন, ‘এ কী রে? তোরা তিনজন কোথা থেকে এলি? চল চল, মন্দিরের দাওয়ায় চল। আরতি এসেছিস? তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। কিন্তু, কিন্তু…।’

অনাথ বললে, ‘এত কিন্তু, কিন্তু করছেন কেন? আরতিকে যা বলার বলুন না, আমরা সরে যাচ্ছি।’

‘আরে না রে, এ কিন্তু সে কিন্তু নয়। মনে হচ্ছে খিদে পেয়েছে। অনেকটা মাটি কুপিয়েছি তো।’

‘কী খাবেন বলুন। কিনে আনি।’

‘আরে খাব কী রে? পুজো হয়নি তো!’

‘তা হলে?’

‘আরে না। জল খাব। ঢকঢক করে জল খাব। আচ্ছা অনাথ। তুই কেন এলি?’

‘আমি একটা বদ, তাই তো?’

‘তোর মতো উত্তম এই পাড়ায় ক’জন আছে? তুই তো শিবের ভৈরব রূপ। কম বয়েসে কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল হতে পারে, কিন্তু সদ্বংশের ছেলে একসময় নিজেকে খুঁজে পাবেই। তখন সে আর ভৈরব থাকবে না, শিব হয়ে যাবে। সদাশিব। তুই কি জানিস, এই টোল তোর পূর্বপুরুষরা স্থাপন করেছিলেন। তখন নবদ্বীপ হয়ে উঠেছিল পণ্ডিতদের জায়গা সংস্কৃত চর্চার প্রাণকেন্দ্র। নবদ্বীপের একজন বালকও তখন পণ্ডিতদের সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে তর্ক করতে পারত।’

দাওয়ায় মাদুর পেতে আমরা সবাই বসলুম। পণ্ডিতমশাই ভেতরে গেছেন, এখুনি আসবেন। ওদের দুজনের কী মনে হচ্ছে জানি না, আমার মনে হচ্ছে স্বর্গে বসে আছি। আলো, বাতাস, ফুল, ফল, পাখির ডাক। আকাশ। অনাথ বললে, ‘কী ভালো লাগছে, তোকে বলে বোঝাতে পারব না। তুই আমাকে স্বর্গে এনেছিস!’

আরতি বললে, ‘এমন মনে হচ্ছে, আমি আর বাড়ি যাব না।’

পণ্ডিতমশাই সাজ বদলে আমাদের মাঝে এসে বসলেন। আরতিকে বললেন, ‘তুই এসে খুব ভালো করেছিস। তুই না এলে আমাকেই যেতে হত। তুই কিছু জানিস?’

‘কী জানার কথা বলছেন?’

‘জানিস না। পরে বলছি, আগে বল, চলছে কীভাবে?’

‘না খেয়ে, এই অনাথদার সাহায্যে।’

‘তাহলে শোন, তোদের বাড়ির দলিল আমার কাছে।’

‘সে কী, আপনার কাছে?’

‘হ্যাঁ আমার কাছে। তোর বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী তোর ছোটমামা, পরোক্ষে দায়ী তোর মা। শুনতে খুব খারাপ লাগলেও ব্যাপারটা খুব সত্যি। তোকে বাঁচাবার জন্যে তোর বাবা দলিলটা আমার কাছে রেখে গেছে। শুধু রেখে গেলে কী হবে? দলিল হারালে কপি বের করতে কতক্ষণ? তাই আর একটা চালাকি করা হয়েছে, তোর বাবা বাড়িটা আমার কাছে বাঁধা রেখে গেছে, আমি যেন তাকে অনেক টাকা ধার দিয়েছি। এসবই তোর জন্যে—আরতি, আরতি, আরতি। ওই বাড়িটা এখন আমার। মানে তোর। তোর মা চিরকালই বাপের বাড়ির ভক্ত। তোর ছোটমামা নয়নের মণি। আরতি! আমি আছি।’

আমরা তিনজনে হাঁ করে শুনছি।

অনাথ বললে, ‘পণ্ডিতমশাই, ওর মামা যদি ওই বাড়িতে এসে ঢুকে পড়ে, তাহলে কী হবে!’

‘হ্যাঁ, সে সম্ভাবনা ছিল, এখন আর নেই। পা ভেঙে হাসপাতালে পড়ে আছে। ফুসফুসে সর্দি জমেছে। অনাথ তোর তো কোনওভাবেই এখানে আসার কথা নয়, কেন এসেছিস? ভগবান টেনে এনেছেন। কাল আমার কাছে সরকারের অনুমোদন এসেছে। আমি আবেদন করেছিলুম, ‘ভরদ্বাজ চতুষ্পাঠী’ স্থাপন করব। ছেলে আর মেয়েরা গুরুকুল পদ্ধতিতে সংস্কৃত শিখবে। উপাধি পাবে। তারা বৃত্তি পাবে। সরকার অর্থ মঞ্জুর করেছেন। আমার এতদিনের লড়াই সফল হল। এই চতুষ্পাঠী হবে আরতিদের বাড়িতে। ওর বাবারও খুব ইচ্ছা ছিল। একটা দলিল করে দিয়ে গেছে। পাঁচ কাঠা জমি সমেত দোতলা বাড়িটা দান করে গেছে। ও যে চলে যাওয়ার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিল, আমি বুঝতে পারিনি, আমি বুঝতে পারিনি।’

পণ্ডিতমশাই কাঁদছেন। ধরাধরা গলায় বললেন, ‘বলতে পারিস, মানুষ কেন মানুষকে বাঁচতে দেয় না। কই একটা ফুল তো আর এটা ফুলকে মেরে ফেলে না। আকাশে কত তারা, কই একটা তারা তো আর একটা তারার মৃত্যুর কারণ হয় না।’

অনাথ বললে, ‘আরতির কী হবে? কী হবে আরতির মায়ের?’

‘এই দেখ, আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। আরতিই তো সব। এই আবাসিকে যে-সব ছাত্র-ছাত্রীরা আসবে, তাদের সব দায়িত্ব আরতির। রান্নাঘর, ঠাকুরঘর আরতির, হোস্টেল আরতির। আরতি মাইনে পাবে, থাকার জায়গা পাবে। আরতি পড়বে, পরীক্ষায় বসবে, উপাধি পাবে।’

‘আর আমি কী করব?’

‘তুই তো আমার ডান হাত।’

‘একটা মূর্খ আপনার ডান হাত হবে? চতুষ্পাঠীর বদনাম। সমালোচনা হবে।’

‘ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে। প্রচুর কাজ। বাড়িটার অদলবদল করতে হবে, একটা অংশ বাড়াতে হবে। সবার আগে, দু-তিন দিনের মধ্যে তুই একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দে, ‘ভরদ্বাজ চতুষ্পাঠী’। কাশী থেকে আর একজন পণ্ডিত আসবেন মহামহোপাধ্যায়। আমার বন্ধু। আমরা এখানে সেই অতীত নবদ্বীপকে ফিরিয়ে আনব। এই চতুষ্পাঠীর ছাত্র-ছাত্রীরা ইউরোপ আমেরিকায় যাবে। গবেষণা করবে।’

পণ্ডিতমশাইয়ের টোল থেকে বেরিয়ে এসে আমরা গঙ্গার ধারের বটতলায় গিয়ে বসলুম। অনাথ বললে, ‘ব্যাপারটা বেশ ঘোলাটে হয়ে গেল। এই পরিকল্পনায় আরতির ভবিষ্যৎ তেমন স্পষ্ট হল না। আইন আমি কিছুটা জানি, কারণ পরিবারে মামলা লেগেই আছে। পিতার সম্পত্তিতে মেয়েদের কতটুকু অধিকার? বিয়ের পর আরতি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। তখন? পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে দলিল। ভবিষ্যৎ ঝুলেই রইল। এত বড় একটা পরিকল্পনা একা সামলাতে পারবেন? কোথা থেকে কে এসে যাবে কে জানে? আমরা তো লেখাপড়া করতে চাই। আরতির ছোটমামা কৃষ্ণেন্দু সত্যিই কি এতটা খারাপ?’ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ

আরতি বললে, ‘অনাথদা, পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে ভীষণ ঘোলাটে। এটা ঠিক, বাবার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক থেকে থেকেই খুব খারাপ হয়ে যেত। কথা বন্ধ। খাওয়া বন্ধ। কীভাবে যে আমার দিন কেটেছে। আর ভাবতে পারছি না।’

অনাথ বললে, ‘পণ্ডিতমশাই ভালো মানুষ। তাঁর মাথায় টুপি পরানো খুব সহজ। পণ্ডিতমশাই বেশির ভাগ সময় স্বপ্নে থাকেন। থেকে থেকে কাশীতে চলে যান। টাকা সামলানো, হিসেব—এসব কিছু ওঁর ধাতে নেই। আমার বাড়ির অবস্থা ভয়ঙ্কর। বাবা আর কাকা পারলে একজন আর একজনকে এখনই খুন করেন। দুজনেরই শেষজীবন জেলে কাটবে। আমার বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করে না। আরতির বাড়িটা একটা কফিন। ওদের ওই সম্পত্তিটার এখন অনেক দাম। দলিল-টলিল যেখানে যাই থাক, সম্পত্তির মালিক আরতির মা—কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাপার; কিন্তু বাড়ি তো টাকা পাড়বে না, উপোস করে মর।’

‘আচ্ছা, তোমরা একটা কথা ভাবছ না কেন? একটা ফ্লোর তো ভাড়া দেওয়া যায়। ভালো ভাড়াটে।’

‘পরে আর তোলা যাবে না, কে মামলা করবে বছরের পর বছর। লাভের গুড় পিঁপড়ে খাবে।’

‘তা হলে এই দাঁড়াল, সমস্যার সমাধান নেই।’

‘আছে। বড়মামা। নির্মল এক মানুষ। সবাই বলে পাগলা দেবতা। আজ রাতে বড়মামার কাছে যাব।’

‘রাত্তিরে কেন? এখনি চলো, চেম্বারে এসে গেছেন।’

‘সব কিছুর একটা সময় আছে।’

আরতি বললে, ‘ওই বাড়িটায় থাকতে আমার ভীষণ ভয় করে।’

‘দিনের বেলা কীসের ভয়?’

‘থাকলে বুঝতে পারতে। কত রকমের শব্দ। এটা পড়ে যাচ্ছে, ওটা পড়ে যাচ্ছে। তিন তলার ছাতে উঠে দেখছি কেউ আগুনে জ্বেলে কী সব পুড়িয়েছে। কাক মরে পড়ে আছে। আমি একা একটা মেয়ে। এই সব দেখলে ভয় করবে না। একজনও কাজের লোক নেই, সারা বাড়িটা ধুলো আর ঝুলে ভরে গেছে। আমি একা কত করব। আর একটা ঘরে মা পড়ে আছে। সব জানালা বন্ধ। দিনের বেলাও অন্ধকার। উঠতে পারে কিন্তু উঠবে না। বারান্দায় গিয়ে বসবে না। আমার কী শাস্তি। মাঝে মাঝে মনে হয়, মাকে ভূতে ধরেছে। মেয়ে হয়ে মায়ের নিন্দা করা উচিত নয়, তবু বলছি, বাবাকে একটা দিনের জন্যেও শান্তি দেয়নি। দিনের পর দিন বাবা না খেয়ে থেকেছে। অমন মায়ের পরিচয় দিতে লজ্জা করে। এই তোমরা চলে যাবে, আমার সারাটা দিন কী ভাবে কাটবে? কেউ আসে না, কেউ আসেন মায়ের দুর্ব্যবহারের জন্যে। কে ইলেকট্রিক বিল দেবে, কে দেবে বাড়ির ট্যাক্স।’

অনাথ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এটা তো ভাবা হয়নি—ইলেকট্রিক বিল, ট্যাক্স!’

সংসার ভেঙে গেলে মানুষের কী অবস্থা হয়! কে কার খবর রাখে। আরতিদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কত মানুষ সারাদিন এদিকে যাচ্ছে ওদিকে যাচ্ছে, কে খবর রাখে ইটের খাঁচায় কী হচ্ছে। খাঁচায়-খাঁচায় জীবনের নাটক।

সকালটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। একটুও পড়া হল না। আরতির কী হবে? যা হওয়ার তাই হবে। এক একজনর এক এক রকম হয় কেন? ভাগ্য। নাঃ, আমি কাশীতেই চলে যাব। বড়মামা রাজি হয়েছেন। বয়েস বেড়ে যাচ্ছে। গোঁপ-দাড়ি বেরোল বলে। লজ্জাও করছে। আর কয়েক মাস পরেই আমি বড়দের দলে ঢুকে পড়ব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গালে সাবানের ফ্যানা। কিশোর এখন যুবক। এইবার ভাবতে হবে চাকরির কথা। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা। তারপর ভারিক্কি চেহারার ভোঁদকা একটা লোক। ভগবান! আমি বড় হতে চাই না।

পেছন থেকে কে ডাকছে—’অনাথদা। অনাথদা।’ আরতির গলা।

শিবমন্দিরের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছি। আরতির খালি পা। বাতাসে চুল উড়ছে।

অনাথ জিগ্যেস করল, ‘কী হল? অমন করছিস কেন?’

‘মা বোধহয় মারা গেছে।’

‘কী বলছিস তুই?’

‘খাট থেকে মেঝেতে পড়ে গেছে। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা।’

খাট আর টেবিলের মাঝের দূরত্ব হাত দশেক। মাঝখানে আরতির মা মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন। একটা খালি জলের ‘জাগ’ একপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

অনাথ বললে, ‘জল তেষ্টা পেয়েছিল, জলের জাগটার কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন। হয়তো ধরেও ফেলেছিলেন; কিন্তু খালি, হালকা ফঙফঙে। ভার সামলাতে পারেননি। এক ফোঁটা জলের জন্যে জীবন চলে গেল। কোনও দিনই কেউ দেখল না। কেউ না। স্বামী তো নয়ই, মেয়েটাও না। জাগটা দেখেই বুঝতে পারছি, অনেকদিন কেউ জল ভরেনি এতে। শুধু নিন্দা, নিন্দা, নিন্দা। কেউ এতটুকু সেবা করেনি। সবাই ‘আমার আমার’ করে এই সুন্দর মানুষটাকে মেরে ফেলল। খুন, খুন। সবাই খুনি।’ অনাথ কাঁদছে। ‘কেন তুই মায়ের সেবা করিসনি? কার বুকের দুধ খেয়ে তুই বড় হয়েছিস? তোর বাবা একটা চিট। রেস খেলত, আর লোকের কাছে বউ-এর নামে বলত। মিথ্যে মিথ্যে বলত। যদ্দিন তোর ঠাকুর্দা বেঁচে ছিলেন তদ্দিন সুবিধে করতে পারেনি শয়তানটা। আর ওই পণ্ডিত। ফুলের বাগানে প্রজাপতি ওড়াচ্ছে। এদিনে বুঝেছি, লোকটা বন্ধকি কারবার করে। ধোঁকাবাজ, ধাপ্পাবাজ। চতুষ্পাঠী করবে? নবদ্বীপে করবে। করাচ্ছি।’

আরতি আমাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আমার পিঠে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমাদের দুজনের মনে হয়, একই বয়েস। এই বাড়ির পেছন দিকের মাঠে খেলা করেছি। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন। আরতির মাকে আমরা সবাই বলতুম, আশা বউদি। হাহা করে হাসতেন, গান গাইতেন। খুব ভালো গান। সুন্দর, সুন্দর গান। বৃদ্ধ শ্বশুরমশাইকে নিয়ে গঙ্গার ধারে বেড়াতে যেতেন। অপূর্ব দৃশ্য। ফর্সা ধবধবে এক বৃদ্ধ। সাদা পাঞ্জাবি ধুতি, একমাথা রুপালি চুল, হাতে ছড়ি, পায়ে চটি, পাশে সুন্দরী, হাসিখুশি একটি মেয়ে। দুজনে হাসছেন, গল্প করছেন। মাঝে মাঝে নৌকাভ্রমণ। অনেকের হিংসে হত। কেন এত সুখ। কত কী খাওয়াতেন। কখনও ঘুগনি, কচুরি, আলুর দম। নারকোল নাড়ু, নানারকম পিঠে। বাড়িটাকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন। বৃদ্ধের মৃত্যুর পর সব শেষ।

আরতি বললে, ‘অনাথদা, আমি মাকে এতটুকু অযত্ন করিনি। সবসময় এই ঘরে ওই দেয়ালটায় পিঠ দিয়ে বসে থাকতুম। কখন কী দরকার হয়। তোমরা ডাকলে, জোর করে নিয়ে গেলে। ওই জাগটায় বাবা জল খেত। অনেকদিন ওটাতে আর জল রাখা হত না।’

অনাথ বললে, ‘এখন কী হবে? প্রথমে ডাক্তার। মাকে, তার আগে বিছানায় তুলতে হবে। পড়ে গিয়ে মৃত্যু মানে অস্বাভাবিক মৃত্যু, পুলিশ কেস, পোস্টমর্টেম।

‘পোস্টমর্টেম কেন? খুন না কি?’

‘কেউ যদি ফেলে দিয়ে থাকে, বিষয় সম্পত্তির লোভে।’

অনাথ আর আরতি ধরাধরি করে তুলল। এরই মধ্যে দেহ শক্ত হতে শুরু করেছে। এখন বড়মামার কাছে যেতেই হবে।

ডক্টর এস মুখার্জি। সবাই বলেন, ‘হ্যাঁ, একজন ডাক্তার বটে। মরা মানুষকে জ্যান্ত করতে পারেন; কিন্তু ভীষণ খেয়ালি।’

বড়মামার চেম্বারটা ভীষণ সুন্দর জায়গায়। জমিদারদের এলাকা। এক সময় বিদেশিরা এদিকে থাকতেন। এদিকটায় এলেই মনে হয় আমি বিলেতে এসেছি। একটা বাগান ঘেরা কাঠের বাড়ি আছে। এক বৃদ্ধা মেম আজও আছেন। আশ্চর্য নীল চোখ।

বড়মামার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব। বাংলোর দোতলার বারান্দায় বসে হাতে সময় থাকলে দুজনে কফিপান করেন। খুব গল্প হয়। তারপর ‘রুটিন চেকআপ’। মেমসায়েবের স্বামী ছিলেন এক বিখ্যাত জীব-বিজ্ঞানী। কীট-পতঙ্গ নিয়ে গবেষণার জন্যে এসেছিলেন। শেষ জায়গাটাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছেন দেশে আর ফেরা হল না।

বড়মামা বাংলোর দোতলায় বারান্দায়। কফির আসরে। আমাদের দেখে একটু আশ্চর্য হলেন। নেমে এসে জিগ্যেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোদের? মুখচোখের এই অবস্থা কেন?’

অনাথ গোছগাছ করে সব বললে। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে দলিল, চতুষ্পাঠী—এই সবই বড়মামাকে জানিয়ে দিল, কারণ পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে আরতির বাবার যোগাযোগের কোনও কারণ নেই। বড়মামাও বেশ আশ্চর্য হলেন। আরতির বাবা স্নায়ুর অসুখে ভুগছিলেন। মানুষটা খারাপ ছিলেন না। ডিপ্রেশানের শিকার। ব্যাঙ্কের ভালো চাকরিটা ছাড়তে হল শরীরের কারণে; কিছুই মনে রাখতে পারছিলেন না। মাঝে মাঝে এমনও হত নিজের বাড়ি ভুলে যেতেন। নিজের নাম—ঠিকানা নিজের পরিচিতজনদের চিনতে পারতেন না। আরতির মাকে হঠাৎ বললেন, ‘তুমি কে? কী চাই?’ অনেকেই মনে করত, এসব বদমাইশি।

বড়মামা বললেন, ‘এই ধরনের মৃত্যু নিয়ে গোলমাল করলে করা যায়; তবে কে করবে, কার বিরুদ্ধে করবে?’

অনাথ বললে, ‘আমার সঙ্গে আরতিকে জড়িয়ে আমার ভাইরা!’

‘এতে তাদের কী লাভ হবে?’

‘ওরা চায় আমি মরে যাই। যাবজ্জীবন হলেও মন্দ হবে না।’

‘ছাড়তো এসব। আজেবাজে ভাবনা। তোরা ডাক্তার সরকারকে নিয়ে যা। ওদের ফ্যামিলি ডাক্তার। ভালো মানুষ, বয়েস হয়েছে। সাতে-পাঁচে থাকেন না।’ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ

আমি বললুম, ‘তুমি একবার যাবে না।’

‘না, ইচ্ছে করেই যাব না। আমি কিছুই জানি না। কেউ জানে না। স্বাভাবিক একটা মৃত্যু।’

‘পণ্ডিতমশাইকে বলা হবে?’

‘কেন বলা হবে? তিনি কে?’

‘না, তা নয়, তবে সকালবেলা কথা হল। চতুষ্পাঠী হবে।’

‘ছাড় তো! বললেই হবে।’

‘তুমি কি সরে যেতে চাইছ?’

‘আজেবাজে কথা না বলে এখন কাজের কাজ কর।’

ডাক্তার সরকার হুসহুস করে শব্দ করে চা খাচ্ছিলাম। শুনেই বললেন, ‘জানতুম, রিউমাটিক হার্ট। কেউ দেখার ছিল না। ওষুধও বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার আর যাওয়ার দরকার নেই। এখানে বসেই লিখে দিচ্ছি।’

অনাথ বললে, ‘সেটা ঠিক হবে না। একবার চলুন। দিনকাল ভালো নয়। স্বামী বেঁচে নেই।’

‘কথাটা খুব ঠিক। তা চলো। ওই বাড়িটায় যেতে ইচ্ছে করে না। অপয়া বাড়ি। ভিটেটা বাজে।’

এসব কথার কোনও মানে হয় না। যা করতে হবে তা করতে হবে। অনেকটা সময় চলে গেছে। আরতি একা। তার মায়ের মরদেহ পাহারা দিচ্ছে। তার কেমন লাগছে আমি অনুভব করতে পারছি। উঃ। এই মৃত্যু! অসহ্য, অসহ্য।

ডাক্তার সরকার কিছুতেই পরীক্ষা করলেন না। ঝুঁকে পড়ে একবার দেখলেন। খসখস করে সার্টিফিকেট দিলেন। ভিজিট নিলেন না। শুধু বললেন, ‘মেয়েটা ভীষণ ভালো ছিল। আমাকে একটা সুন্দর সোয়েটার বুনে দিয়েছিল। প্রত্যেক শীতে আমি পরি। আমার মায়ের অসুখে কী সেবাই না করেছিল। এই রকম একটা মেয়ে হয় না। সে চলে গেল। আর আমরা স্টেথিসকোপ গলায় ঝুলিয়ে ঘুরছি। আশা! আমি তোমাকে কোনও দিন ভুলব না। তুমি অভাবী মানুষের চিকিৎসার কথা বলেছিলে। আমি ভুলিনি আশা। আমি সেই কাজ শুরু করে দিয়েছি। তুমি আমার আলো—আশার আলো।’

ডাক্তারবাবু পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। একটা আয়না। তার নীচে মেয়েদের সাজবার জিনিসপত্তর। চিরুনি, সিঁদুর, সেফটি পিন, চুলের কাঁটা, ক্লিপ। ডাক্তারবাবু চিরুনিটা হাতে তুলে নিয়ে নিজের মনেই বলতে লাগলেন, ‘থাকে না, কিছুতেই থাকে না। তা হলে তুমিই জিতলে, ডেথ সার্টিফিকেটটা আমাকে দিয়েই লেখালে।’

ডাক্তার সরকার আরতির মাথাটা নিজের চওড়া বুকে ধরে বললেন, ‘ভাবিস না, ভাবিস না। আমি আছি, আমিই তোর বাবা।’