দুই
বড়মামাকে নিয়ে আমি একটা পাঁচশো কি হাজার পাতার বই লিখব। আমি আমার পয়সাতেই ছাপব। কোনও প্রকাশক ছাপবেন না। আমি কি নামকরা লেখক? লেখক হওয়ার ইচ্ছেও নেই। আমি নাবিক হব। জাহাজের ক্যাপ্টেন। সাগরে সাগরে ভেসে বেড়াব। সুধাকে আমি সেদিন বলে দিয়েছি, আর কয়েকটা বছর। তারপর আমি নেই। ইতালি আমি ভালোবাসি, হয়তো সেইখানেই থেকে যাব। ফ্রোরেনস। মাঝে মাঝে তোকে পিকচার পোস্টকার্ড পাঠাব। এই নয় যে, আমি তোকে ভুলে যাব। তবে বুঝতে পারছিস তো জাহাজের কাপতেনের কত বড় দায়িত্ব। ঝড়, জল, জলদস্যু। ভয় পেয়ে তো চলবে না। সাহস চাই, তবেই জীবনে বড় হওয়া যায়।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
সুধা আমার নামে থানায় ডায়েরি করবে। জেলে আটকে রাখবে। আইনকানুন কিস্যু জানে না। পাগলের মতো কথা। ক’টা বাজল। আমি এখন মাস্টারমশায়ের কাছে পড়তে যাব। আমাকে নিয়ে সবাই হাটি-ঠাট্টা করে, কারণ আমি সংস্কৃত পড়ি। আদ্য, মধ্য, বৃত্তি। স্মৃতি, শ্রুতি, ন্যায়। পরীক্ষায় প্রথম হব। বৃত্তি পাব। সংস্কৃত কলেজে পড়ব। তারপরে জার্মানিতে চলে যাব। অক্সফোর্ডেও যেতে পারি। বিরাট ব্যাপার। আমি আমার মতো পড়ব, তোমাদের তাতে কী? বটতলায় ক’টা চ্যাংড়া বসে থাকে। যেই যাব, অমনি চেল্লাবে, ‘পণ্ডিতমশাই। আপনার ছাতা কোথায়? টিকি কোথায়? আমি ওদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। কিছু বলি না। কেবল হাসি। সময় থাকলে পাশে বসে পড়ি। তখন ওদের খুব অস্বস্তি হয়। বুঝতে পারে না, কী করবে। ওদের একজন নেতা আছে—অনাথ। মুখার্জি বাড়ির ছেলে। প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি, কিন্তু ভায়ে ভায়ে মামলা। অনাথ জিগ্যেস করে, ‘তোর পেছনে এত লাগি, তুই রাগ করিস না কেন?’ তখনও আমি হাসি। অনাথ আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমি তখন তার চোখে দেখতে পাই গভীর দুঃখ। ঘন হয়ে আছে।
‘জানিস তো, পাড়ায় আমাদের খুব বদনাম। আমরা খারাপ ছেলে। বিজয়দশমীর দিন কারো বাড়িতে গেলে, তাড়াতাড়ি ভাগাতে পারলে বাঁচে। তুই আমাদের পাশে বসে পড়লি?’
তবুও আমি হাসি, মনের আনন্দে হাসি।
‘আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না?’
‘পাচ্ছি।’
‘তাহলে হাসছিস কেন?’
‘তোমাদের আমার খুব ভালো লাগে। তোমরা এই পাড়ার প্রাণ।’
‘যেমন এই পাড়ার পাঁচটা কুকুর।’
কী হল জানি না। রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। অনাথের গালে সপাটে এক চড়। তোমাকে আজি আমি মেরেই ফেলব। তুমি আমার দাদা। তোমরা ছাড়া এই পাড়াটা শ্মশান।’
এদের কাছে ছোরাছুরি থাকে। পৃথিবীতে আমার শেষদিন হলেও হতে পারত; অনাথ হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসল, আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ‘আজ থেকে তুমি আমার গরু।’ অনাথের চোখে জল। জমিদারের ছেলে। সুন্দর চেহারা। ভাবুক ভাবুক দুটো চোখ।
‘আমি গুরু কেন হতে যাব? আমরা দুটো ভাই। আমি তো তোমাকে অনেক অনেক দিন থেকে ভালোবাসি। সেই যবে প্রথম আমি এখানে আসি। তখন তোমাদের চণ্ডীমণ্ডপে কত ঘটা করে দুর্গাপুজো হত। জন্মাষ্টমী, ঝুলন, দোল, রাস। সেইসব দিন। তুমি ঘুড়ি ওড়াতে। তোমাদের ব্যয়ামাগারে ব্যায়াম করতে। শীতকালে সাদা পোশাক পরে ক্রিকেট খেলতে। তোমাদের লাইব্রেরিতে কত বই।’
‘সিনিয়াররা মারা গেলেন। সব শেষ। আমার বড় ভাই আমাকে বাড়ি ঢুকতে দেয় না। ইচ্ছে করলে ওর পেটটা আমি ফাঁসিয়ে দিতে পারি। যতই হোক আমার ভাই। আমার মাকে খেতে দেয় না।’
‘অনাথদা! দেখবে, তুমি ঠিক হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘জানিস তো, আমার খুব লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে।’
‘আমি বড়মামাকে বলে তোমাকে ডাক্তার করব।’
‘না, ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি ঐতিহাসিক হব।’
‘বাঃ, আমিও তো তাই হব। তাহলে মেজোমামা।’
‘তোমাদের বাড়িতে আমাকে ঢুকতেই দেবে না। সবাই জানে তো, আমি একটা থার্ডক্লাস, বাজে ছেলে।’
‘আবার নিজেকে ছোট করছ। স্বামীজি এই ভাব-ভাবনা একদম পছন্দ করতেন না।’
‘স্বামী বিবেকানন্দের কথা বলছ? কোথায়? তিনি কোথায় আর আমি কোথায়? তিনি আকাশে আর আমি পাতালে।’
‘আমি তা মনে করি না. আমার চোখে তুমি হিরো। তোমার মতো সাহস কজনের আছে? তুমি মা কালীর ভক্ত।’
‘কে বলল?’
‘অনাথদা তুমি মনে করো, তুমিই সকলের সব কিছু জানো, তাই না? আমিও জানি। আমিও একটা সাংঘাতিক ছেলে। আমি তো এখানে থাকব না। ভূপর্যটক হয়ে বেরিয়ে যাব। আমার বাবাও নেই, মা-ও নেই। আমার জন্যে কেউ কাঁদবে না।’
‘ওকথা বলিস না। কেউ না কাঁদুক, এই অনাথ কাঁদবে। আজকের এই সকালটা আমার জীবনের এক নতুন সকাল। তোকে ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। আমিও ভূপর্যটক হব। চল না, স্বামীজির হাত ধরে দুজনে বেরিয়ে পড়ি। স্বামীজির ভারতবর্ষটাকে ভালো করে দেখে আসি। বয়েস বেড়ে গেলে আর পারা যাবে না।’
‘স্বামীজির মতো কষ্ট করতে পারবে?’
‘অনাথ পারে না এমন কাজ নেই। রাত্তিরে আমি কোথায় থাকি জানিস? শ্মশানে। চিতার পাশে। আমি মাকে চাই।’
‘আমিও চাই। তুমি জানো, আমি যাঁর কাছে সংস্কৃত পড়তে যাচ্ছি, তিনি একজন মস্ত বড় তান্ত্রিক। প্রতি অমাবস্যায় পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসেন। তুমি তাঁর চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। তিনি যে কোনও মানুষকে একেবারে বদলে দিতে পারেন। আমাকে বলেছেন, সংস্কৃত ভাষাটা ভালো করে শেখ। বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, তন্ত্র মূল সংস্কৃত পড়, অর তখনই বুঝতে পারবি তুই কে? এই ভারতবর্ষ কত মহান। তুমি আজই চলো। যত দেরি করবে, তত দেরি হয়ে যাবে।’
‘বিশ্বাস কর আমার খুব ভয় করছে। নিজেকে নামাতে নামাতে এতটা নীচে নামিয়েছি—একেবারে নর্দমা হয়ে গেছি।’
‘শোনো অনাথদা, স্বামীজি কী বলেছেন জানো, যে নিজেকে ছোট করে, সে-ই সবচেয়ে বড় পাপী।’
‘তুই বার বার স্বামীজির কথা বলছিস কেন? আমি সহ্য করতে পারছি না। ভূত যেমন রাম নাম সহ্য করতে পারে না।’
‘বাজে না বকে তুমি চলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
পণ্ডিমশাইয়ের বাড়ির সামনের দিকে টোল, পেছন দিকে অনেকটা জায়গা। বাগান, তারা মায়ের মন্দির, পঞ্চমুণ্ডীর আসন। তারপরে ছোট্ট একটা খাল গঙ্গায় মিশেছে। অনেক অনেক দিন আগে এই সব জায়গায় ছিল গভীর জঙ্গল। এই খাল দিয়ে ঢুকত ডাকাতদের ছিপ নৌকো। কালো কালো ডাকাত, লাল লাল চোখ। মাথায় ফেট্টি। হাতে রামদা, বল্লম। খালটার নাম ছিল দেঁতোর খাল। এখন যা আছে, তাকে আর খাল বলা যায় না। একবার এটা মস্ত কুমির ঢুকেছিল। ডাকাতরা জানত না। লেজের ঝাপটায় একটা ছিপ নৌকো উলটে দিয়ে একজন ডাকাতকে চিবিয়ে খেয়েছিল। জঙ্গলে কাপালিক ছিল। প্রায়ই নরবলি হত। মানুষ যে কীভাবে থাকত এখানে! অনাথদের জমিদার বংশ। দুবার ডাকাত পড়েছিল।
অনাথ বেশ যাচ্ছিল। হঠাৎ মায়াদের বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘কী হল?’
‘একটা উপকার করবি?’
‘কী উপকার?’
‘ভেতরে গিয়ে মায়াকে ডেকে আনবি।’
‘যে আমার সঙ্গে কোনওদিন কথা বলেনি, অহংকারে মট মট করে, তাকে ডাকতে গিয়ে মার খেয়ে মরি আর কী? কেন, ডাকব কেন?’
‘শীতলা পুজোর দিন ভোগের লাইনে ওর সঙ্গে আমি অসভ্যতা করেছিলুম। ও কেঁদে ফেলেছিল। আজ আমি সেই অপারধের প্রায়শ্চিত্ত করব। পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইব। বলব, পা থেকে জুতো খুলে আমার গালে মারো। মেয়েরা মায়ের জাত। আমি কত বড় বংশের ছেলে, অথচ আমি কী ছোটলোক! আমার আত্মহত্যা করা উচিত।’
‘শোনো অনাথদা, এই যে বললে এতেই তোমার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেল।’
ঠিক এই সময় মায়া কোথায় যাওয়ার জন্য হুটহাট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। পেছনে তার রাশভারী বাবা। নিজেকে মনে করেন বিরাট ‘কেউ কেটা’। পাড়ার অনেকেই বলেন, একটি কেউটে সাপ। পয়সা আছে। শিক্ষাদীক্ষা তেমন কিছু নেই। মায়ার বাবা আমাদের দুজনকে দেখে, আমাকে খুব তাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘এই ডাক্তারের ভাগনে, তুমিও এইটার দলে ভিড়েছ?’
অনাথদা চাবুকের মতো চমকে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি নীচু গলায় বললুম, ‘একদম না। এর উত্তর আমরা অন্যভাবে দেব, আর কিছু দিন পরে। এখন কোনওরকম বায়নাক্কা না করে চলো।’
আমরা বাঁ-দিকের রাস্তায় ঢুকলুম। শেষ হয়েছে গঙ্গার ধারে। শ্মশান। শিবমন্দির, কালীমন্দির। বাঁ-দিকে অনেক কালের পুরনো একটা বনেদি বাড়ি। নীচের ঘরের জানলায় একটি মেয়ে মুখ। বিষণ্ণ, রক্তশূন্য। মেয়েটি অনাথকে ডাকছে, ‘অনাথদা দশটা টাকা দেবে গো। তাহলে আজ আমরা কিছু খাব।’
অনাথ আমার দিকে তাকাল। দু-চোখে জল। জানলার বাইরে উঁচু রক। জানলার সামনে গিয়ে বললে, ‘আরতি, আমি তোকে কতদিন বলেছি, এইভাবে টাকা চাইবি না, তুই কি ভিকিরি! এই যে এখন পঞ্চাশটা টাকা রাখ। আমি সন্ধ্যেবেলা এসে বাজার করে দেব।’
দু-চারখানা বাড়ির পরেই একটা গয়নার দোকান। তার পাশেই শাঁখা, সিঁদুর, শোলার জিনিসপত্র, তার পরে জিলিপি। অনাথদা সোনার দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘কী হল আবার?’
‘ভাবছি, এই সোনার আংটিটা বিক্রি করে দিই?’
‘কেন?’
‘ওই আরতির মুখটা দেখলে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে? একটা ব্রিলিয়েন্ট মেয়ে, লেখাপড়া বন্ধ। ওর দাদা বউ নিয়ে বিদেশে। মা-বোনের খবর নেয় না। আরতির অ্যানিমিয়া। আরতির মা বাতে শয্যাশায়ী। আরতির বাবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, ওই মর্কটটার জন্যে—মায়ার বাবা। শেয়ারের ফাটকাবাজিতে সর্বস্বান্ত করে দিল। বাড়িটা কোনওরকম বেঁচে গেছে। শোন, মেয়েদের কষ্ট দেখলে আমার বুকটা ফেটে যায়!’
‘তা হলে মেয়েদের টিজ করতে কেন?’
‘কে বলেছে?’
‘এই তো তুমিই বললে, মায়ার কাছে ক্ষমা চাইবে!’
‘টিজ নয়, আমি ওকে সেদিন মেরে ফেলতুম। শীতলাতলায় সেদিন ও একটা বাচ্চাকে ধাক্কা মেরে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল। বাচ্চাটার মা প্রতিবাদ করায় এমন যাচ্ছেতাই সব কথা বলতে লাগল, কে রে তুই? অনাথ কি মরে গেছে? ওর বাপ তোকে আজ যা বললে, আমার আদালতে তোলা রইল, ঠিক সময়ে বিচার হবে। অনাথ মারতে আর মরতে ভয় পায় না। মানুষ জন্মায় একবার, মরেও একবার।’
‘অনাথদা, এখন এসব থাক। তোমার মতো আমিও সব দেখছি। সবাই কীভাবে বসে বসে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। বুড়ো হয়ে যাওয়া ছাড়া আর যেন কিছুই করার নেই। ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলুম। হাই তুলতে তুলতে উঠলুম। কী হল, কী হল করতে করতে মরে গেলুম।’
‘তুই আমাকে স্বামী বিবেকানন্দের কথা বলছিলিস। তুই কি জানিস অমি বিবেকানন্দ মুখস্থ করি। আমার ‘আমি’ গাড়িটা বিবেকানন্দ পেট্রলে চলে। এই দেখ, আমার পকেটে একটা কার্ড। লেখা আছে বিবেকবাণী—When I asked God for wealth, he showed me how to work hard! When I asked God for favours, he showed me opportunities to work hard.
‘পকেটে রাখলেই হবে? কাজে করো কি?’
‘করি কি করি না, পরে বুঝবি। নাঃ, আংটি বিক্রিই করে দিই। শুধু তো আরতি নয়, অরুণা, অনিমা, গঙ্গা। আঙুলে শুধু শুধু কয়েক হাজার টাকা আটকে রাখার কোনও মানে হয় কি? আংটিটা আমার মায়ের স্মৃতি। তাতে কী হয়েছে? মায়ের টাকায় মায়ের সেবা হবে।’
‘তুমি একটা দিন অপেক্ষা করো। আমি বড়মামার সঙ্গে কথা বলি।’
‘বড়দা কী করবেন? তিনি আদ্দেক লোককে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করছেনই। এরা তো সব বাড়ির লোকের বাঁদরামিতে না খেয়ে মরতে বসেছে। কেউ মদ গিলছে, কেউ রেস খেলছে। এদের জামাই আদর না করে মেরে ফেলা উচিত। স্রেফ খোঁটায় বেঁধে শঙ্কর মাছের চাবুক দিয়ে পেটাও। তুই বল, এগুলো মানুষ।’
‘শোনো শোনো, তোমার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। আমার কথাটা শোনো, বড়মামা আমাকে বলেছিলেন, নিজেরা ভালোমন্দ অনেক খেয়েছি, এখন অন্যের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু অনাথদা, তুমি একটা কথা ভেবে দেখো, কেউ যদি রোজগারের চেষ্টা না করে, তুমি কত দেবে! দিতে দিতে ফতুর হয়ে যাবে।’
‘ঠিক বলেছিস। দান আর কিছু হবে না। কাজ চাই। নেতারা কী করছে?’
‘বক্তৃতা দিচ্ছে। দড়ি পাকানোর মতো দল পাকাচ্ছে।’
‘কী জিনিস, আরতির করুণ মুখটা দেখলেই কান্না পায়। কী ভালো মেয়ে জানিস না।’
‘দাঁড়াও, আমি ওর জন্যে বড়মামার সঙ্গে কথা বলব।’
‘কী কথা বলবি? ও আমার মতো থার্ডক্লাস ছেলেকে কেন ভালোবাসে? আমি ওর জন্যে কী করতে পারব? মাঝখান থেকে ওর বদনাম হবে। ভদ্রঘরে জন্মালেও তো একটা ছোটলোক।’
অর্থাৎ একটা আইডিয়া এল মাথায়, ‘আচ্ছা, একটা কাজ করবে অনাথদা?’
‘কী কাজ?’
‘আরতিকে আমরা আজই পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে নিয়ে যাই চলো। মেয়েরা আজকাল সংস্কৃত পড়ছে, ভালো রেজাল্ট করছে। বিদেশে যাচ্ছে অধ্যাপনা করছে। ওই তো দক্ষিণপাড়ার প্রীতিদি ইংল্যান্ডে চলে গেলেও দেশে-বিদেশে সংস্কৃতের খুব সম্মান। আরতি ভালো ছাত্রী। ও যদি আচার্য হয়, আমাদের জেলার কত সম্মান বাড়বে। অনাথদা ভালো ভালো লোকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শুধু বাড়িঘর রাস্তা পার্ক মল—এই সব কোনও একটা জায়গার একমাত্র পরিচয় হতে পারে না।
‘তা হলে কী বলছিস?’
‘আরতিকে ডাকো।’
‘কী রকম একটা ভয়ভয় করছে।’
‘কীসের ভয়?’
‘আমার তো খুব বদনাম। যেই আরতি আমার ডাকে বাইরে আসবে, আর পথে নামবে, আপনি সব বাড়ির জানলা খুলে যাবে। হে রে রে রে করে তেড়ে আসবে। অনাথ আরতিকে নিয়ে পালাচ্ছে।’
‘তুমি কেন এত ভীতু হয়ে গেছ। ডাকো আরতিকে। লোক, লোক, লোক না পোক। সব পোকামাকড়।’
‘বাবা, তোর মধ্যে এত আগুন, এত আগুন।’
‘হ্যাঁ, ছোরা-ছুরি-বোমা-পিস্তল নেই আমার কাছে, আমার ভেতরে আছেন গৌতমবুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, মা সারদা, মা কালী, মা দুর্গা। আমার কীসের ভয়, কাকে ভয়? আমি আজ এখানে, কাল সেখানে, আমি নিজেকে ভাবি বিরাট একটা পাখি।’
‘তোর মাথাটা?’
‘কোনও চিন্তা নেই। ঠিক আছে। ডাকো আরতিকে।’
আরতি বাইরের ঘরেই ছিল। জানালায় এসে দাঁড়াল। শুনতে পাচ্ছি, অনাথ তাকে বোঝাচ্ছে। কানে এল, আরতি বলছে, ‘যাঁদের হাঁড়ি চড়ছে না, তাদের মেয়ের আবার লেখাপড়া। আমি এখন আয়ার কাজ খুঁজতে বেরোব। লেখাপড়া করার বরাত করে জন্মাইনি অনাথদা। তোমাদের পরিকল্পনা খুবই ভালো। সংস্কৃত আমার প্রিয় সাবজেক্ট। কী করব? এই বাড়িটাও কি থাকবে? মাথার ওপর কেউ নেই।’
প্রথমে খুব রাগ হচ্ছিল, তারপর ভাবলুম—সত্যিই তো। পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। কী করা যায়? এই সমস্যার কী সমাধান?
একমাত্র বড়মামা আর মেজোমামাই এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন। আরতিদি যদি বড়মামার মেয়ে হত। তাহলে? ভগবানের দয়ায় টাকার তো অভাব নেই। গুচ্ছের বাজে খরচ। অনাথদা হতাশ হয়ে রকে বসে পড়েছে। সাংঘাতিক একটা তেজী ছেলে, কিন্তু সমস্যাটা এমন মার-দাঙ্গা করে কিছু হবে না। বাড়িটা যদি কারো কাছে বাঁধা থাকে, তাহলে তো হয়েই গেল। এদের কোনও আত্মীয়-স্বজন নেই না কি?
‘ঠিক আছে। অনাথদা। এখন চলো। যেখানে যাওয়ার যাই। পরে কী করলে এই সমস্যার সমাধান হয়, সবাই মিলে বসে ভাবতে হবে।’
‘ঠিক বলেছিস, ভাবতে হবে। দিনের পর দিন শুধু ভাবতে হবে। ভাবনা ছাড়া আমাদের আর কী আছে? সাধু ভাবছে, শয়তান ভাবছে। আর সাধারণ মানুষ ভুগে মরছে। ধ্যাত তেরিকার জগৎ।’
‘তা তুমি কী করতে চাও?’
‘তুই বল আমি কী করব? আত্মহত্যা? যা আছে, যেমন আছে সব থাক, আমি চলে যাই।’
‘তুমি পালিয়ে যাবে? হেরে যাবে?’
‘যুদ্ধটা কার বিরুদ্ধে? বলতে পারিস?’
‘ভাগ্যের বিরুদ্ধে।’
‘ওই তোদের একটা অদৃশ্য শত্রু আছে—ভাগ্য। ভাগ্য আমি বিশ্বাস করি না। ভাগ্য, ভাগ্য, ভাগ্য। মানুষ, সব মানুষের কেরামতি।’
‘আরতিদি, তুমি কিছু বলো।’
‘তোমাদের একটা সুখবর দিই—এই বাড়ির দলিলটা কোত্থাও খুঁজে পাচ্ছি না।’
‘সে কী?’
অনাথ বললে, ‘তোমার বাবা তো একটা চাকরি করতেন?’
‘আমাদের বলেনি, সে চাকরি অনেকদিন চলে গিয়েছিল।’
‘কী আশ্চর্য মানুষ। কোনও দায়দায়িত্ব ছিল না।’
আমি বললুম, ‘আরতিদি, তুমি ওই খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসো তো। আমাদের সঙ্গে চলো। বাইরে না বেরোলে কিছু হবে না। বেরিয়ে এসো। চলো আমরা পণ্ডিতমশাইয়ের টোলে যাব। দেখাই যাক না, কী হয়।’