এরপর যা হবার তাই হল—অর্থাৎ রণধীর চোপরা চালান গেল। এখন ওসব ব্যাপার কানুনের এক্তিয়ারে। তা সব দেখার জন্য এবং তদারক করার জন্য সরকার যথেষ্ট লোকজন রেখেছেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সেখানে কোনও ভূমিকা অবান্তর এবং উনি ওতে নাক গলাবেনও না। বাংলোয় আমাদের ঘরে, অর্থাৎ যে ঘরে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে, আমি কর্নেল, সোনালী এবং তার বাবা অনিরুদ্ধ ব্যানার্জি ও জয়ন্তী দেবী বিকেলের চায়ের মজলিশ জমাচ্ছিলুম। দিব্য এল না। রত্না এসে বলল-দাদা চুপচাপ শুয়ে আছে।
সেটা স্বাভাবিক। বেচারা ভীষণ আঘাত পেয়েছে মনে।
সবার চোখে মুখে কৌতূহল ফুটে উঠেছিল। সুতরাং মুখপাত্র হয়ে আমিই প্রথম তুললুম— কর্নেল, চোপরা সবুজ পাঞ্জাবিতে কী খুঁজতে গিয়েছিল?
কর্নেল একটু হেসে জবাব দিলেন দীপ্তির হাতের মুঠোয় একটুকরো কাগজ ছিল। খুন করার পর চোপরা সম্ভবত তাড়তাড়িতে সেটা পকেটে ঢুকিয়েছিল। তখন তো ওর নার্ভাস অবস্থা। কে দেখে ফেলবে এই আতঙ্কে রয়েছে। তাই পাঞ্জাবি রেখে পালাবার সময় কাগজটা বের করে নেয়নি। ভেবেছিল, পরে এসে নেবে। এমন না হলে পাঞ্জাবিটা সে প্রকাশ্যে কোথাও ফেলে রাখত। কারণ তার উদ্দেশ্য দিব্যের কাঁধে দায়টা চাপানো। আসলে খুন করার পর খুনীর খানিকটা হতবুদ্ধি অবস্থা থাকে বলেই তাদের ধরা সম্ভব হয়। কোনও না কোনও ক্ষেত্রে একটু ভুল করবেই। আজ পর্যন্ত আমি খুনী দেখিনি, যে কোনও ভুল করেনি, অর্থাৎ কোনও ক্লু রাখেনি।
অনিরুদ্ধ বললেন কাগজটাতে কী ছিল? দীপ্তি তা পেল কোথায়?
বিশেষ কিছুই ছিল না। ছিল তিনটে জিরো লেখা। এটা একটা বিদেশী শত্রুরাষ্ট্রের দেশীয় গুপ্তচর এজেন্সির সাংকেতিক নাম। চোপরাকে তারাই মিঃ ব্যানার্জির পি. এ. করে পাঠাতে পেরেছিল।
অনিরুদ্ধবাবু কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করলেন। কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন জানি, আপনার দোষ নেই। আপনি কী করতে পারেন? যাক গে, যা বলছিলুম। হতভাগিনী দীপ্তি তার বোকামির জন্যই কিন্তু খুন হলো। ও যেভাবেই হোক জানতে পেরেছিল যে চোপরা থ্রি জিরো দলের মেম্বার। কিন্তু কথাটা সরাসরি অনিরুদ্ধবাবুর কানে তুলতে পারত। তা না করে সে সম্ভবত চোপরাকে নিয়ে একটু মজা করতে চেয়েছিল। সে বোঝেইনি চোপরা যে দলের মেম্বার, তাদের সঙ্গে রসিকতা করার পরিণাম বড় সাংঘাতিক।
রত্না বলে উঠল—আমার মনে পড়েছে! দীপ্তি চোপরাকে দেখলেই বলত কী মশাই, তিন শূন্যের অঙ্ক মিলল? চোপরার মুখটা কেমন সাদা হয়ে যেত যেন।
তা শুনে সোনালীও বলে উঠল—হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি। ভাবতুম, নিছক, জোক করছে।
কর্নেল বললেন—চোপরা ভেবেছিল, দীপ্তির মুঠোর কাগজটা সত্যি সত্যি কোনও সাংঘাতিক দলিল—হয়তো কোনও সুত্রে দীপ্তির হাতে এসেছে। অদৃশ্য কালিতে নিশ্চয় কিছু লেখাটেখা আছে। কারণ তিনটে জিরো কোনও কাগজে দেখলেই তাকে সতর্ক হতে হবে। দীপ্তি সত্যি বড় বোকামি করেছে। তবে একটা কথা ঠিক যে ও হাতের মুঠোয় কাগজটা না রাখলেও তাকে খুন করত। কারণ হত্যার পরিকল্পনাটা সেই মন্দিরে যাবার দিনই সে করে নিয়েছে। কাজেই দীপ্তিকে একদিন না একদিন খুন হতেই হতো।
সোনালী বলল কলকাতায় ট্যাক্সির ব্যাপারটা কী হলো, কর্নেল?
কর্নেল হাসলেন। বললেন—শুধু দীপ্তিকে ফলো করা হচ্ছিল সারাক্ষণ। চোপরার দলের লোকেরা কত তৎপর, তারই প্রমাণ ওটা। আজকালের মধ্যেই সেই ট্যাক্সি চালক ধরা পড়ে যাবে। আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে পড়বে। দীপ্তি মন্দিরে যাবার দিনও যথারীতি চোপরার দলের লোক ওকে ফলো করেছিল। তা না হলে চোপরা হঠাৎ গাড়ি নিয়ে মন্দিরের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত না।
রত্না বলল কিন্তু মন্দিরে তো দীপ্তি কারও সঙ্গে দেখা করেনি।
—ওটা সম্ভব হয়নি। কারণ, রাজীব শেরগিল তখন অলরেডি নিহত।
আমি চমকে ওঠে বললুম— বুঝতে পারছিনে কর্নেল। রাজীব শেরগিলের সঙ্গে দীপ্তির আলাপ হলো কীভাবে? রাজীব কেন তাকে ওখানে যেতে বলবে?
কর্নেল জবাব দিলেন—সবটা দিব্যের মুখেই শোনা ভাল। কিন্তু সে কি এখন আসবে?
রত্না মাথা দুলিয়ে বলল—মনে হয় না। আপনিই বলুন কর্নেল।
—দিব্য পরে পুলিশকে একটা লং স্টেটমেন্ট দিয়েছে। হয়তো চেপেই যেত সব। কিন্তু তারই পাঞ্জাবি চুরি করে চোপরা তার ঘাড়ে খুনের দায় চাপাতে চেয়েছিল। এতে ওর ভীষণ রাগ হয়ে গেছে। তাই সব বলে দিয়েছে। সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলি।…চোপরার সঙ্গে যেদিন একটা রেস্তোরাঁয় তার মারামারি হয়না, ভুল বলছি, প্রকৃতপক্ষে মারামারি হয়নি—হবার উপক্রম হয়েছিল এবং রাজীব সেটা থামিয়ে দেয়, সেদিন কিন্তু দীপ্তিও সেখানে উপস্থিত ছিল। চোপরার সঙ্গে আগে থেকেই দীপ্তি ওখানে গিয়েছিল। ইদানিং ওরা ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, তোমরা তা জানো। যাই হোক, স্টেশন থেকে রাজীবকে নিয়ে দিব্য দৈবাৎ ওখানে ঢোকে। বলাবাহুল্য, দীপ্তিকে চোপরার সঙ্গে দেখে মনে মনে জ্বলে ওঠে। সুযোগ খোঁজে চোপরাকে পিটুনি দেবার।
চোপরার ভঙ্গিতে আমি গম্ভীর মুখে বলে উঠলুম—দ্যাটস ন্যাচারাল।
কেউ তাতে হাসল না। কর্নেল ছাড়া। কর্নেল বললেন—দ্যাটস রাইট। তা, দিব্যও ঠিক রত্না বা সোনালীর মতো দীপ্তিকে, কী মশাই, জিরো জিরোর অঙ্ক মিলল?—চোপরার উদ্দেশ্যে এই জোক করতে শুনেছে। সেদিন ওখানে দীপ্তি, মারামারি থামাতে বলে ওঠে—এই থ্রি জিরোটিকে নিয়ে আর পারা যায় না। দিব্য লক্ষ্য করেনি কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি রাজীব শেরগিল খুবই চমকে উঠেছিল। সে থ্রি জিরো দলের লোক। কিন্তু কোনও কারণে সম্ভবত দলের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েই হোক, অথবা নিছক অর্থের লোভে রানীডিহি এসেছিল। অর্থাৎ চোপরাকে ব্ল্যাকমেল করতে অথবা প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে অয়েল ডিরেক্টরের কানে সব তুলে দিতে। আমার ধারণা, চোপরাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সে অনিরুদ্ধবাবুর কাছে সব ফাঁস করতে চেয়েছিল। যাইহোক, রাজীব বা দীপ্তি এখন বেঁচে নেই। কিন্তু দীপ্তির ঘরে একটা চিঠি পুলিশ আবিষ্কার করেছে। রাজীব শেরগিলের হাতের লেখার সঙ্গে মিলে যায়। নীচে নামের বদলে তিনটে জিরো নেই অনিরুদ্ধবাবুকে লেখা সেই চিঠির মতো। সোজা নামসই রয়েছে চিঠিতে। বলাবাহুল্য ইংরাজিীতে লেখা : …থ্রি জিরোর রহস্য কি জানেন? না জানা থাকলে ১৩ তারিখে সকাল নটায় পাতালকালীর মন্দিরে আসুন। কিন্তু দীপ্তি একা যেতে সাহস করে নি। রত্নার বুদ্ধি ও সাহসে তার আস্থা ছিল স্বাভাবিক। তাই রত্নাকেই সঙ্গে নেয়। দীপ্তি জানত না যে ট্যাঙ্কের কাছে পাওয়া লাশটা রাজীবের।
সোনালী বলল—ওদিন আমার একটু জ্বর মতো হয়েছিল।
আনলাকি থার্টিন নিহত রাজীবের কাছে ওই দিনকার দিল্লীর রিজার্ভেশন টিকিট পাওয়া গেছে। তার মানে, দীপ্তির সঙ্গে দেখা করে এবং সম্ভবত সদুপদেশ দিয়ে সে নিরাপদে দিল্লী চলে যাবে ভেবেছিল। সদুপদেশ দেবার কারণ, দিব্য তাকে বলেছিল যে দীপ্তির সঙ্গে তার বিয়ের কথা ছিল। কিন্তু বিয়েটা আর করা যাবে না। তখন রাজীব বলে, আমি বুঝিয়ে বলব। তুমি ভেবো না। চোপরাকে আমি চিনি। ও খুব খারাপ লোক। দীপ্তিকে সতর্ক করা দরকার। চোপরার হালহদিশ সব ওকে বাতলে দিয়ে যাবো।
এতক্ষণে জয়ন্তীদেবী মুখ খুলে বললেন—এত সব কাণ্ড ভেতর-ভেতর!
কর্নেল বললেন—হ্যাঁ। এ খুব জটিল কেস। কিন্তু খুনের প্রসঙ্গে এলে বলব, এত সহজ এমন চমৎকার মোডস অফ অপারেণ্ডি খুব কমই দেখেছি। আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, চোপরা পুবের রাস্তায় গিয়ে বাগান হয়ে এই বাংলোর পূর্ব-উত্তর কোণে দিব্যের ঘরে ঢোকে এবং সবুজ পাঞ্জাবিটা নিয়ে চলে যায়। চোখে পড়ে শুধু পরিচারিকার। তার চোখে না পড়লেও চোপরাকে আমরা ধরে ফেলতুম। সে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। তারপর কী ঘটেছে, তাও দেখতে পাচ্ছি। সে দীপ্তিকে বলছে—তোমার ছুরিটা খসে যাচ্ছে যে! ঠিক করে দিই। তারপর…থাক। বড় বীভৎস ঘটনা।
রত্না আস্তে বলল—আমি ওকে দেখে দাদা ভেবেছিলুম!
কর্নেল বললেন—দিব্যও দেখেতে পেয়েছিল। সবুজ পাঞ্জাবিটা তার মনে কিছুটা সন্দেহ জাগিয়াছিল কিন্তু জড়িয়ে পড়ার ভয়ে সে চুপ করে গিয়েছিল।
বললুম—সব তো বুঝলুম! কিন্তু লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া?
কর্নেল চুরুট বের করে বললেন—ওই পাতায় একটা সাবোটাজের বিবরণ আছে। অনিরুদ্ধবাবুকে সাবোটাজের ভয়াবহতা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল রাজীব।
অনিরুদ্ধ শিউরে উঠে শুধু বললেন— হ্যাঁ।