» » জিরো জিরো জিরো

বর্ণাকার

রত্না সাদা মুখে এল। যন্ত্রের মতো হাত তুলে নমস্কার করল। দেখলুম ওর পায়ের কাছে শাড়ির পাড় থরথর করে কাঁপছে।

—আপনি রত্না চ্যাটার্জি?

—হুঁ।

বাবার নাম, ঠিকানা, পেশা এসব কিছুই ওকে জিজ্ঞেস করা হলো না, এতে অবাক হলুম। কিষাণ সিংয়ের কাছে একটা ফাইল ছিল। ফাইলটা খুলে আধ মিনিট কী দেখার পর উনি মুখ তুললেন। তারপর বললেন-দীপ্তির সঙ্গে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর সকালে আপনি পাতালকালীর মন্দিরে গিয়েছিলেন কি?

রত্না মাথা দোলাল।

—কেন?

রত্না একটু ইতস্তত করে আস্তে বলল—যে জন্যে সবাই যায়!

মন্দিরে যাবার কথা কে তুলেছিল? আপনিনা দীপ্তি?

—দীপ্তি।

দীপ্তি ভক্তিমতী মেয়ে ছিল—এমন কথা আমরা এখনও কারো কাছে শুনিনি। ওর মামা-মামী এবং মামাতো ভাই-বোন বরং বলেছেন, দীপ্তির ওসব বিশ্বাস ছিল না। আপনি কী বলেন?

—হ্যাঁ। ও নাস্তিকটাইপ ছিল। বরাবর ধর্মটর্ম নিয়ে ঠাট্টা করত।

—তাহলে বলুন দীপ্তি পাতালকালীর মন্দিরে নিছক বেড়াতে গিয়েছিল?

—আমাকে তাই বলেছিল। পরে অবশ্য…

—হুঁ, বলুন।

—পরে আমার সন্দেহ হয়েছিল, ওর যেন অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে।

—সেটা কী?

—কারও সঙ্গে দেখা করা।

—কেন এমন মনে হলো আপনার?

—ওর চোখমুখের ভাব দেখে। খুব খুঁজছিল—মানে ভিড়ের সব মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। তা লক্ষ্য করে আমি ওকে বলেছিলুম, কাকেও খুঁজছিস নাকি রে? ও জবাব দিয়েছিল, না, এমনি। চেনা কেউ আছে নাকি দেখছি। কিন্তু কারও সঙ্গে ও কথা বলেনি শেষ পর্যন্ত। অবশ্য, আমার খটকাটা থেকেই গিয়েছিল। ফেরার পথে যখন ওকে চেপে ধরলুম, ও কবুল করল না। আগের মতোই নিছক বেড়াতে আসার কৈফিয়ত দিল। তখন বললুম— তোর কি হঠাৎ দেবদেবতায় বিশ্বাস ফিরে এসেছে? দীপ্তি হাসল শুধু। ভাবলুম, দাদার সঙ্গে একটা কিছু গণ্ডগোল হয়েছে, তাই হয়তো। মনে অশান্তি চলছে বড্ড। পাতালেশ্বরীর কাছে মনে মনে তাই প্রার্থনা করে গেল। অবশ্য খটকাটা আমার থেকেই গেল।

একটু ভেবে ও ফাইলটা দেখে কিষাণ সিং বললেন বাড়ি থেকে মন্দির এবং মন্দির বাড়ি সারাক্ষণ আপনি ওর সঙ্গে ছিলেন?

—হ্যাঁ।

—যাবার সময় কিসে গেলেন?

—রিকশোয়।

 —ফিরলেন কিসে?

—রণধীরদার গাড়িতে। হঠাৎ পেয়ে গেলুম। ও স্টেশন থেকে আসছিল।

—আমরা সেটা জানি। রণধীর চোপরার গাড়িটা আপনাকে আগে নামিয়ে দিয়ে পরে দীপ্তিকে পৌঁছে দিতে যায়। অথচ আগেই দীপ্তির মামার বাসাটা পড়ে। তাই না?

—হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমার খারাপ লেগেছিল নিশ্চয়। চোপরার সঙ্গে ইদানীং ওর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। দাদার জন্যে আমার কষ্ট হত। কিন্তু এসব তো দীপ্তিকে বলা যায় না।

—যাকগে, এবার বলুন, গাড়িতে আপনারা কী আলোচনা করেছিলেন?

—সোনালীর জন্মদিনের কথা। রণধীরদা বরাবর সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেয়। ন্যাচারালি ওর সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল।

—আপনারা  কলকাতা গিয়ে কর্নেল সরকারকে নেমন্তন্ন করবেন, একথাও নিশ্চয় উঠেছিল?

—হুঁ।

—চোপরা কর্নেল সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেছিলেন?

—না। মানে জিগ্যেস করল যে ভদ্রলোক কে? আমরা ওঁর পরিচয় দিলে ও খুব উৎসাহ দেখিয়ে বলল, দারুণ জমবে! গোয়েন্দাদের কখনও দেখিনি। তারপর কথায় কথায় ফাংশানের ডিটেলস এসে পড়ল। তখন রণধীরদা বলল, এক কাজ করা যায়। অ্যাজ ইউ লাইক ইট খেলার বদলে অন্য কোনও ফান হোক না? মার্ডার ফান! গোয়েন্দা ভদ্রলোককে নিয়ে মজা করা যাক।

ঘরের সবাই নড়ে বসলেন। আমরা কজন, সোফায় বসে আছি যারা, তারাও ঘুরে টেবিলের দিকে তাকালাম। আড়চোখে দেখি, চোপরা শুকনো হাসছে, কর্নেল হেসে উঠলে ওই ভাবটা ঘুচে গেল।

কর্নেল বললেন—তাহলে দীপ্তির মাথায় মার্ডার ফানের প্রস্তাবটা প্রথম ওঠেনি, বোঝা গেল।

আমাদের পাশ থেকে চোপরা বলে উঠল—দ্যাটস ন্যাচারাল! আমি আগাথা ক্রিস্টি প্রচুর পড়েছি। তা থেকেই ওটা মাথায় এসেছিল। নিশ্চয় এটা কোনও ক্রাইম নয়!

কিষাণ সিং হাত তুলে বললেন—আপনি কোনও কথা বলবেন না, প্লীজ।

রত্না ক্রমশ আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠেছে। সে বলল—কিন্তু এটা সত্যি যে দীপ্তি নিজেই ভিকটিম হতে চেয়েছিল।

—ওই গাড়িতে বসেই কি ভিকটিম হবার প্রস্তাব দীপ্তি দিয়েছিল?

 রত্না জোরে ঘাড় নাড়ল। না, না। ও তখন জোর আপত্তি করেছিল। এসব বাজে খেলা—অন্য কিছু ভাবো। দীপ্তি বলেছিল। পরে বাসায় ফিরে সোনালীকে মার্ডার ফানের কথা বললে সোনালীও আপত্তি করেছিল। কিন্তু শেষে দেখি, দীপ্তিই মার্ডার ফানের ব্যাপারে জেদ ধরেছে।

—আপনি যে প্রথমে সোনালীকে মার্ডার ফানের কথা বলেছিলেন, তা সোনালী কিন্তু আমাদের বলেনি।

আমার পাশ থেকে সোনালী বলল, ভুলে গিয়েছিলুম। এখন মনে পড়ছে, রত্না বাইরে থেকে ফিরে ওই প্রোপোজালটা দিয়েছিল।

কিষাণ সিং ফের হাত তুলে বললেন কথা বলবেন না, প্লীজ।

হঠাৎ কর্নেল একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করলেন—ইয়ে রত্না, তোমার দাদা দিব্যেন্দুর কি কোনও সবুজ পাঞ্জাবি আছে?

রত্না বলল—হ্যাঁ। কেন?

অমনি একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। দিব্যেন্দু আমাদের কাছ থেকে তড়াক করে এক লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে এগোল। একজন পুলিশ অফিসার ওর কলার ধরে ফেললেন। দিব্য ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছিল। পারল না।

এই সময় কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—মিঃ সিং! আমার মনে হচ্ছে আপাতত এ পর্যায় এখানেই শেষ। অবশ্য আপনার ইচ্ছে করলে এগোতে পারেন। আমি একটু বাইরে যেতে চাই।

 কিষাণ সিং একটু হেসে বললেন—ক্ষমা করবেন কর্নেল। দিস ইজ দা অফিসিয়াল প্রসিডিওর। আমরা এখানেই থামতে পারি না। বাড়ির সারভ্যান্টদের প্রশ্ন করা বাকি আছে।

কর্নেল জিভ কেটে বললেন—সরি, ভেরি সরি মিঃ সিং। দ্যাটস কারেক্ট। বলে টেবিল থেকে উঠে এসে আমার দিকে তাকালেন। তারপর কিষাণ সিং-এর দিকে ঘুরে বললেন মিঃ সিং! আমার এই হতভাগ্য বন্ধুটিকে কি বাইরে যাবার অনুমতি দেবেন?

কিষাণ সিং হেসে বললেন—অবশ্যই।

—এস জয়ন্ত, আমরা একবার বাইরে খোলা হাওয়ার গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করি।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। বাইরে লনে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে বললুম—কর্নেল, তাহলে দিব্যকে মনে হচ্ছে গ্রেফতার করা হলো।

কর্নেল আনমনে জবাব দিলেন তাই মনে হচ্ছে। দিব্যেন্দুর ওই সবুজ জামাটাই ভাইটাল এ কেসে। অবশ্য যদি চোপরার কথাটা সত্যি হয়, তবেই। যাক গে, এস— আমরা একবার নদীর ধারটা ঘুরে আসি।

নদীর ধারে যেতে হলে এই ছোট রাস্তা ধরে যেতে হবে, কিন্তু কর্নেল ওদিকে গেলেন না। সোজা অকুস্থলের পাথরটার কাছ দিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে চললেন। দেখলুম, দীপ্তির লাশটা সরানো হয়েছে। পাথরের একধারে কিছু রক্ত লেগে আছে। ঘাসে ও মাটিতেও আছে। সেটা সত্যিকার রক্ত হতেও পারে, আবার সোনালীর পেন্টও হতে পারে। কিন্তু একবার তাকিয়েই চোখ ফেরালুম। যেন দীপ্তিকে দেখতে পাচ্ছিলুম—একটু ঝুঁকে পাথরে গাল রেখে শুয়েছে। তাজা ফুলের মতো একটা মেয়ে—স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিল এই কুৎসিত পৃথিবীতে। খুব কষ্ট নিয়েই পা বাড়ালুম। জানতুম কর্নেল বিস্তর পাহাড়ে চড়েছে। তাই এই ঢালু দুর্গম জায়গায় ওঁর কোনও কষ্ট না হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আমার মতো আনাড়ির পক্ষে মারাত্মক। একখানে পাথরে পা স্লিপ করে গড়িয়ে পড়লুম এবং গড়াতে গড়াতে প্রায় পনের কুড়ি ফুট নীচে একটা গর্তে গিয়ে আছাড় খেলুম। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি, শুনি কর্নেল ওপরে দাঁড়িয়ে হাসছে।

রেগে বললুম—আর কখনও কোথাও যাব না আপনার সঙ্গে। গেলেই খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ব এবং বিদঘুটে কাণ্ড ঘটবে! ভ্যাট!

ওপর থেকে নেমে এসে কর্নেল একটু হেসে বললেন—ডার্লিং, মাঝে মাঝে আছাড় খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। ছেলেবেলায় মানুষ প্রায়ই আছাড় খায়। এতেই বোঝা যায় প্রকৃতি ওইভাবে তাকে স্বাস্থ্য আয়ু সাহস ও সহ্যশক্তি যোগান দেন। বড় হয়ে আছাড় খাবার ব্যাপারে সতর্ক হয় মানুষ। এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধতা। এ জন্যেই তো প্রকৃতি সুযোগ পেলেই মনে করিয়ে দেন যে… ।

কর্নেল প্রায়ই উদাত্তকণ্ঠে লেকচার দিচ্ছিলেন, হঠাৎ থেমে কি যেন দেখতে থাকলেন কুঞ্চিত ভুরু। তারপর বাইনোকুলারটি চোখে তুললেন। কিন্তু সর্বনাশ! নির্ঘাৎ বাতিকগ্রস্ত প্রকৃতিবিদ কোনও বিরল প্রজাপতি অথবা পাখি দেখতে পেয়েছেন এবং তার মানে এবার নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে হয়তো গোটা দিনটাই পাখিটার পিছনে বনবাদাড় নালা ডিঙিয়ে ঘোরাঘুরি করবেন—আমাকেও হন্যে করবেন!

কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে সম্মোহিত মানুষের মতো—নিশির ডাকে মানুষ যেমন যায়, এগোতে থাকলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলুম। বাংলোয় ফিরব। শরীর ক্লান্ত। মনও ভাল নেই। সেই ঢাল জায়গা বেয়ে অনায়াসে লেজে ভর করে দাঁড়ানো গিরগিটির মতো কর্নেল ফাঁকা বরাবর অন্তত একশো ফুট এগোলেন। তারপর একটা প্রকাণ্ড পাথরের সামনে হাঁটু ভাজ করলেন। ওই অবস্থায় ওঁকে প্রায় তিন মিনিট চুপচাপ থাকতে দেখলুম। তারপর ঘুরে আমার দিক হাত নেড়ে বললেন—জয়ন্ত, দেখে যাও।

পৌঁছানো আমার পক্ষে বেশ কষ্টকরই হলো। কিন্তু কৌতূহল আমাকে টেনে নিয়ে গেল। গিয়েই যা দেখলুম, অবাক হয়ে গেলুম। রণধীর চোপরার কথা মিথ্যে নয়—একটা সবুজ পাঞ্জাবি সাবধানে পাথরের ফাটলে রাখা হয়েছে।

কর্নেল বললেন—দিব্যের বাঁচা কঠিন হয়ে গেল। চোপরা বলেছে একটা বেঁটে মোটাসোটা নোক দেখেছিল। আসলে একটা জামা পরা অবস্থায় এই পাঞ্জাবি পরলে দূর থেকে তাই-ই দেখাবে। জয়ন্ত, দেখতে পাচ্ছ। পাঞ্জাবিতে রক্তের ছোপ লেগে আছে।

দেখে আঁতকে উঠলুম। বললুম—দিব্য এমন বোকার মতো কাজ করে ফেলল?

কর্নেল বললেন—সবুজ পাঞ্জাবি পরে খুন করার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছ? সবুজ ঝোপঝাড় বা গাছের মধ্যে ক্যামোফ্লেজের কাজ করবে। কারো হঠাৎ নজরে পড়বে না। দ্বিতীয়ত…বলে উনি থেমে গেলেন। সাবধানে পাঞ্জাবিটার পকেটের দিকটায় আঙুলের চাপ দিলেন।

বললুম—কী?

—সিগ্রেটের প্যাকেট। মার্ডার ফানের ক্লু হিসেবে একটা টুকরো ফেলা হয়েছিল। কিন্তু দুটো পাওয়া গেছে। তার মানে পকেটে সিগ্রেট থাকায় আরেকটা সিগ্রেটের টুকরো ফেলে রাখা সম্ভব হয়েছে। খুনী যেন একটা খেলার ক্লু রেখে দিতে চেয়েছে। কেন?

প্রশ্নটা কর্নেল আপন মনেই করলেন। বিরক্ত হয়ে বললুম—খুনী-খুনী করছে কেন এখনও? দিব্য বললেই আমার কাছে আপনার জটিল কথাবার্তার মানে বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।

কর্নেল ঘুরে বললেন—দ্যাট ডিপেণ্ডস্ ডার্লিং!

—অন হোয়াট?

—আরও সাক্ষ্য-প্রমাণ।

—যেমন?

—দিব্য এই পাঞ্জাবিটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, নাকি পরে পশ্চিমের দিকে ঘুরতে যাবার সুযোগে বাংলোয় ঢুকে নিয়ে এসেছিল?

ভেবে বললুম—পশ্চিমেই তো বাংলো বাড়ির সদর গেট। কারো চোখে পড়া স্বাভাবিক।

কর্নেল বললেন—ঠিক আছে। এটা এখানেই থাক। আমরা আপাতত বাংলোয় ফিরি। একটা কথা জয়ন্ত, তুমি ঘুণাক্ষরে একথা কারো কাছে প্রকাশ করবে না।

—নিশ্চয় নয়।

 হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল একটু হেসে বললেন—আমার ভয় হয় জয়ন্ত! যুবতী, স্ত্রীলোকদের প্রতি তুমি সময়ে খুবই পক্ষপাতিত্ব দেখাও।

হো হো করে হেসে বললুম—দ্যাটস ন্যাচারাল!

—ওটা চোপরার মুদ্রাদোষ, তাই না জয়ন্ত?

কী কথায় কী! বললুম—হ্যাঁ। এবং আমার ক্ষেত্রে সঙ্গদোষ। চোপরার কাছে শুনে এই হয়েছে।…

আন্দাজ ফুট বিশেক ওপরে উঠেছি, হঠাৎ কর্নেল দাঁড়ালেন। তারপর ফিস ফিস করে বললেন—উঁহু, হয়তো খুবই ভুল করছি। তুমি এক কাজ কোরো জয়ন্ত। এখানে ঝোপের আড়ালে বসলে পাঞ্জাবিটার ওপর লক্ষ্য রাখা যায়। তোমার রিভলভারটা কি কাছে আছে?

—না। ওসব নিয়ে ঘোরাঘুরি করি নাকি? কী দরকার?

—ঠিক আছে। কোনও দরকার নেই। তুমি প্লীজ একটু সাহায্য করো আমাকে। এখানে বসে চুপচাপ লক্ষ্য রাখো। কেউ এসে যদি দেখ পাঞ্জাবিটা সরাচ্ছে— কিংবা কিছু করছে—তুমি কিছু করবে না। সে যাই করুক, শুধু তাকে চিনে রাখবে। ব্যস!

—বেশ।

—ভয়ের কোনও কারণ নেই ডার্লিং! যথাসময়ে আমি ফিরে আসব।

—অত বলার কী আছে? আজ তো নতুন আপনার চেলাগিরি করছি নে। বলে একটু হাসলুম। অবশ্য আমার বুকে কাঁপুনি শুরু হয়েছে ঠিকই।

কর্নেল কাঁধে থাপ্পড় মেরে স্নেহ প্রকাশ করে চলে গেলেন। আমি ওৎ পেতে বসলুম। কর্নেল না বলে দিলেও বুঝেছি, সিগ্রেট খাওয়া চলবে না। সকালের রোদ বেয়াড়া রকম বেশি তাপ ছড়াচ্ছে। ছায়ায় বসে আছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে মন দিতেও পারছি না—এ এক অদ্ভুত অবস্থা। প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে গেল।

হঠাৎ দেখি নীচরে একটা ঝোপের মধ্যে রত্না দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ চমকে উঠলুম। ভুল দেখছি না তো?

ও এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। মনে হলো, কিছু খুঁজছে। তারপর পা বাড়াল। বুঝলুম, ওদের জেরা শেষ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো দিব্যকেই শুধু আটকে রেখেছে। রত্না কি পাঞ্জাবিটা খুঁজতেই এসেছে? ও কীভাবে জানল যে পাঞ্জাবিটা এখানেই লুকানো আছে? একটু পরেই বুঝলুম, পাঞ্জাবিটা কোথায় আছে, রত্না জানে না। কারণ সে ওটার পাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করল। তারপর আরও নীচে নামতে থাকল। মিনিট পাঁচেক পরে সে ঘুরল এবং সোজা আমার দিকে ওঠা শুরু করল। আমি একটু সরে বসলুম। কিন্তু সে সোজাসুজি উঠে এসে যেই ডানদিকে ঘুরেছে, আমার মধ্যে হঠকারী ঝোঁক এসে গেল। কর্নেলের নিষেধ ভুলে গেলুম। আসলে আমার মধ্যে গোয়েন্দাসুলভ কৌতূহলের তাগিদ চাগিয়ে উঠেছিল সম্ভবত। আমি গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলুম-মিস চ্যাটার্জি।

রত্না ভীষণ চমকে গেল। তারপর অপ্রস্তুত হেসে বলল—এই মানে…একটু ঘু ঘুরতে বেরিয়েছি। আপনি কী করছেন? নিশ্চয় আমার মতো ঘুরতে?

খুবই গোমড়ামুখে বললুম—মোটেও না। অন ডিউটিতে আছি।

রত্না হাসবার চেষ্টা করে বলল—তাই বুঝি? আচ্ছা চলি।

—মিস চ্যাটার্জি, শুনুন!

রত্না দাঁড়াল। সে ভীষণ ঘামছে। ঠোঁট কাঁপছে। মনে হলো, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবে এক্ষুণি। তারপর অতিকষ্টে বলল-বলুন।

—কী খুঁজতে এসেছেন?

—দাদার পাঞ্জাবিটা।

—কীভাবে জানলেন যে আপনার দাদার পাঞ্জাবিটা এখানে লুকোনো আছে?

—আমি পাঞ্জাবি-পরা দাদাকে দেখতে পেয়েছিলুম দীপ্তির কাছে।

—চোপরাও দেখেছিল। যাক গে, ওটা দিয়ে কী হবে এখন? আপনার দাদার বিরুদ্ধে তো অন্য সব প্রমাণ আছে।

—না কিছু নেই। শুধু এটা ছাড়া। …বলে রত্না হু হু করে কেঁদে উঠল।

একটু পরে বললুম—আপনি এত সহজে ভেঙে পড়তে পারেন। অথচ পুলিশের রেকর্ডে আছে, আপনি নাকি নকশালপন্থী ছিলেন?

রত্না ফোঁস করে উঠল—একসময় ছিলুম। এখন আর নেই।

এই সময় চোখে পড়ল ওপরের দিকে ঝোপের কাছ থেকে কর্নেলের টুপিপরা মুণ্ডুটা দেখা যাচ্ছে। তখনি রত্নাকে চুপ করতে এবং সরে যেতে ইশারা করলুম। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে ততক্ষণে। কর্নেল গুম হয়ে গুঁরি মেরে এগোচ্ছেন— রত্নাও দেখতে পেল। কাছে এসে কর্নেল হঠাৎ দুজনকে টেনে বসিয়ে দিলেন এবং ফিস ফিস করে বললেন—চুপ!

পাঞ্জাবির কথা ভুলেই গিয়েছিলুম, অর্থাৎ ওদিকে এতক্ষণ চোখ ছিল না। এবার দেখি, ওখানে রণধীর চোপরা বসে রয়েছে। হতভম্ব হয়ে গেলুম। সে ব্যস্তভাবে পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াচ্ছিল রত্না হিস হিস করে উঠল বাস্টার্ড!

মেয়েদের মুখে বাস্টার্ড শুনে আমার হাসি পেল।

তারপর কর্নেল আচমকা উঠে বিকট গর্জন করলেন—চোপরা! নড়ো না! নড়লেই গুলি করব।

চোপরার দুপাশের ঝোপ ও পাথরের আড়াল থেকে ততক্ষণে কয়েকজন পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়িয়েছেন।