দিব্যেন্দুর প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষ হবার পর যথারীতি জেরা শুরু হলো। আমি ও সোনালী দুজনেই তাকিয়ে রইলুম দিব্যের দিকে।
কিষাণ সিং বললেন—মার্ডার ফানের কথা কখন কোথায় প্রথম কার কাছে শোনেন?
—কাল রাত্রে সোনালী রত্না আর দীপ্তি তিন জনের কাছেই।
—তিনজনের কাছে? দিস ইজ অ্যাবসার্ড। নিশ্চয় প্রথমে একজনই বলেছিল। কে?
দিব্য ভড়কে গিয়ে বলল—হ্যাঁ, মানে তখন বারান্দায় তিনজনই ছিল। প্রথমে অবশ্য সোনালীই বলল।
—শুনে আপনি কী বললেন?
বাধা দিলুম। বললুম— এ বড্ড বাজে ব্যাপার। অন্য কোনও ফানের প্ল্যান করা যাক। ওরা শুনল না। অগত্যা আমি মত দিলুম।
—কেন বাধা দিয়েছিলেন?
—ব্যাপারটা…ব্যাপারটা আমার কাছে উদ্ভট মনে হয়েছিল।
—ফান মানেই উদ্ভট কিছু।
—তাহলেও দীপ্তিকে আমি ডেডবডি করাটা পছন্দ করিনি।
কর্নেল বলে উঠলেন দীপ্তিকে তো তুমি ভালবাসতে দিব্য? না—না, লজ্জার কারণ নেই। আমরা আধুনিক যুগের মানুষ।
দিব্য মাথাটা একটু দোলাল।
—তোমার সঙ্গে তো ওর বিয়ের কথা ছিল?
—হ্যাঁ। কিন্তু…
—বলো, বলো!
ইদানিং দীপ্তি আমাকে এড়িয়ে থাকতে চাইত যেন। আমি অবশ্য তাতে কিছু মাইণ্ড করিনি। ও বড্ড খামখেয়ালি মেয়ে ছিল। আমার ধারণা, শিল্পীরাই খামখেয়ালী।
দীপ্তি ইদানিং চোপরার সঙ্গে মেলামেশা করত কি?
দিব্য মুখ নামিয়ে বলল—হ্যাঁ। আজ ভোরেও চোপরা ওকে গাড়ি করে এখানে পৌঁছে দেয়। অথচ কথা ছিল, আমিই ওকে নিয়ে আসব। তাই বেরুতে যাচ্ছি, দেখি চোপরার গাড়িতে ও আসছে। মানে গাড়িটা তখন গেটে ঢুকছিল।
কিষাণ সিং বললেন—মিঃ চ্যাটার্জি! গত আগস্টে রানীডিহির ইভনিং লজ নামে একটা বাড়ি থেকে আপনাকে জুয়াখেলার জন্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখন আপনি মাতাল অবস্থায় ছিলেন। খবর পেয়ে মিঃ ব্যানার্জি—মানে আপনার মেসোমশাই আপনাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। শুধু এই নয়—আরও দুবার আপনাকে মারামারির অভিযোগে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল এবং আপনার মেসোমশাইয়ের হস্তক্ষেপে ছাড়া পান। এসব কারণেই রিফাইনারিতে আপনার চাকরি পাবার অসুবিধা হচ্ছে। দিস ইজ দা রেকর্ড। এবার বলুন, ঠিক এসবের জন্যেই কি দীপ্তির সঙ্গে আপনার ছাড়াছাড়ি হয়েছিল?
সোনালী মুখ ফিরিয়েছে। আমি অবাক। কর্নেল দিব্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘরটা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল। কিষাণ সিং আবার বললেন—জবাব দিন মিঃ চ্যাটার্জি।
দিব্য ঠোঁট কামড়ে বলল—না।
—আপনার বাবা মা কলকাতায় থাকেন। তাই তো?
—হ্যাঁ।
—আপনাকে মিঃ অনিরুদ্ধ ব্যানার্জি কাছে এনে রেখেছেন আপনার স্বভাব শোধরাতে। অস্বীকার করে লাভ নেই। অনিরুদ্ধবাবুর কাছেই আমরা সব শুনেছি।
—না। মেসোমশাই আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে ডেকেছিলেন। আমার বোন রত্নার কাছে জানতে পারেন।
—আপনার বোন রত্নার নামেও কিছু রেকর্ড আছে দিব্যবাবু।
দিব্য মুখ তুলল। সাদা হয়ে গেছে মুখটা।
রত্না একসময় নকশালপন্থীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। তাই ওকেও আপনার বাবা এখানে পাঠিয়ে দেন। আমাদের ধারণা, আপনারা ভাইবোন দুজনেই সেই দলের সঙ্গে এখনও যুক্ত। অস্বীকার করতে পারেন?
দিব্য হাঁফাতে হাঁফাতে বলল—মিথ্যা। একেবারে মিথ্যা। কে বলল এসব?
রেকর্ড। আচ্ছা, এবার বলুন, গত সপ্তাহে মিঃ চোপরা আর আপনি সান ভিউ রেস্তোঁরায় ঘুষোঘুষি করেছিলেন। আপনাদের সঙ্গে আরও একজন ছিল। তাই না?
—হ্যাঁ। চোপরা আমাকে জাত তুলে গাল দিয়েছিল।
—আপনাদের তৃতীয় লোকটির নাম বলুন।
ও আমার বন্ধু। দিল্লিতে থাকত। নাম রাজীব শেরগিল। এখানে বেড়াতে এসেছিল। ওর কথাতেই তর্ক বাধে। শেষে ঝগড়া হয় চোপরার সঙ্গে। প্রভিন্সিয়ালিজম নিয়ে।
—আমরা জানি রাজীব শেরগিলের বয়স চল্লিশের ওপারে। আপনি তিরিশের নীচে। বন্ধুতার অবলম্বনটা কী?
দিল্লিতে আলাপ হয়েছিল। আলাপ থেকেই বন্ধুতা। কেন? ওই জয়ন্তবাবু যদি এই বৃদ্ধ কর্নেলসায়েবের বন্ধু হতে পারেন—আমার বেলা দোষ হবে কেন?
কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন। কিষাণ সিং বললেন—আপনি নিশ্চয় জানেন, ওয়াটারট্যাংকের কাছে যে লোকটির লাশ পাওয়া গেছে—সে লোকটাই সেই রাজীব শেরগিল?
দিব্য মুখ নামিয়ে বলল—হ্যাঁ।
—আমরা আপনাকে ওই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেফতার করতে পারি।
দিব্য হাঁফাতে হাঁফাতে বলল—কেন? আমি ওকে খুন করিনি। কেন ওকে খুন করব?
কিষাণ সিং একটু হেসে বললেন ঠিক আছে। এবার বলুন, এই সিগ্রেটের টুকরো দুটো মার্ডার ফানের ক্লু হিসেবে আপনিই কি ফেলে রেখেছিলেন ওখানে?
কাগজের মোড়ক খুললে দিব্য দেখে নিয়ে বলল—আমি তো মোটে একটা টুকরো ফেলেছিলুম। আর…এ কী! দুটোই যে আমার ব্রাণ্ডের!
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন—বোঝা যাচ্ছে, খুনী ক্লুর ওপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছে।
কিষাণ সিং বললেন—ছোরার বাঁটে আঙুলের ছাপ থাকবে।
দিব্য বলে উঠল—হাতে দস্তানা পরলে?
অমনি কিষাণ সিং একটু ঝুঁকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন—আপনি বলছেন! মাই গুডনেস! কীভাবে জানলেন? পরেছিলেন তাই না?
দিব্য থতমত খেয়ে বললে-জাস্ট কমনসেন্স!
এনা! আপনি ওখানে গিয়ে বসুন। অ্যাণ্ড নেক্সট মিঃ রণধীর চোপরা।