» » জিরো জিরো জিরো

বর্ণাকার

কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে থেকে অনেক হত্যাকাণ্ড দেখেছি আমি এযাবৎ। কিন্তু এটি সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত। পনের মিনিটের মধ্যে রানীডিহির পুলিশ এসে গিয়েছিল। এখানে একটা অয়েল রিফাইনারি থাকায় কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর লোকজনও ছিল। আর ছিল রাজ্যের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের কুশলী অফিসারগোষ্ঠী। পরবর্তী আধঘণ্টায় তারা সবাই এসে পড়লেন। কর্নেল এই হত্যাকাণ্ডকে সাধারণ খুন বলে গণ্য করেননি, তা বোঝা যাচ্ছিল।

যেখানে মানুষ খুন হয়, সেখানে অফিসাররা কী পদ্ধতিতে রুটিন তদন্ত করেন— আমার দেখা আছে। এখানে তার ব্যতিক্রম ঘটল না। নীচের উপত্যকাটাও একদল অফিসার ঘুরে দেখলেন। অকুস্থলের তদন্তে যা দেখা গেল তা অদ্ভুত। সোনালী থিয়েটার ক্লাবের যে ছোরাটা দীপ্তির পিঠে আটকে দিয়েছিল, তা পাওয়া গেল দীপ্তির বুকের তলায়। সেই লাল রঙ আর সত্যিকার রক্ত একাকার হয়ে গেছে। সত্যিকার ছোরাটার বাঁটের গড়ন দেখেই অবাক হতে হয়—একেবারে হুবহু নকল ছোরাটার মতন। নকল ছোরাটা ছিল ফলার দুভাগ করা…ভেতরে ফাঁপা এবং স্প্রিং আছে। ডগাটা একেবারে ভোঁতা ভিজে মাটিতেও ঢোকানো যায় না। বাঁট ধরে কোথাও রেখে চাপ দিলে ডগাটা ভেতরে ঢুকে যায় এবং ভাগকরা জায়গা থেকে একটা ক্লিপ বেরিয়ে শরীরে আটকে যায়! তখন দেখে মনে হয়, আধখানা শরীরে ঢুকে গেছে। ভেতরে স্পঞ্জে রং থাকে। স্পঞ্জে চাপ পড়ামাত্র ছিটকে রঙটা বেরিয়ে আসে। থিয়েটারের খুনখারাপিতে ভারি চমৎকার কাজ দেয়। এক্ষেত্রে খুনী ওটা দীপ্তির পিঠ থেকে খুলেছে। খোলার পর আসল ছোরাটা মেরেছে এবং নকলটা বুকের তলায় লুকিয়ে রেখেছে।

কর্নেলের সঙ্গে ডিটেকটিভ অফিসার কিষাণ সিংয়ের কথাবার্তা আমি শুনেছি। দুজনেই একমত যে খুনী আমাদের দলেরই কেউ। দীপ্তিকে ফেলে রেখে সরে যাওয়ার পর সে ওর কাছে ফের যায় এবং সম্ভবত বলে যে ছোরাটা খুলে যাবে মনে হচ্ছে। তাই ওটা ভালভাবে আটকানো দরকার। এই অছিলায় সে হত্যার কাজটি সেরে ফেলেছে। কর্নেলের মতে—খুবই যুক্তিসিদ্ধ এটা। অপরিচিত লোক হলে অমনটা সম্ভব হতো না।

আমরা ক্লু রেখেছিলুম : পলিমাটি, দিব্যেন্দুর ব্রাণ্ডের সিগ্রেটের টুকরো এবং চোপরার লাইটার। এসবই আছে। কিন্তু সবটা শোনার পর ডিটেকটিভ অফিসাররা এসব আর আমল দেননি। শুধু কর্নেল সেগুলো সযত্নে কাগজে মুড়ে পকেটে রেখেছেন। ও দিয়ে কী হবে কে জানে!

অকুস্থল থেকে ফিরে ব্যানার্জি সায়েবের বাংলোয় আমাদের ডাকা হলো। দীপ্তির মা বাবা কেউ নেই—মামার কাছে মানুষ হচ্ছিল। মামা ভবেশ চক্রবর্তী রিফাইনারি অফিসের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট। দীপ্তির মামা-মামী সবাই এসেছেন। ওঁরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। সোনালীর মা সোনালী ও রত্নাকে ক্রমাগত ভর্ৎসনা করে যাচ্ছেন। অনিরুদ্ধ স্তম্ভিত। খুব ভয় পেয়েছেন মনে হলো। সোনালীর জন্মদিনের আনন্দটাও মাঠে মারা গেল!

ড্রয়িং রুমে কর্নেল ও একদঙ্গল অফিসার বসার পর প্রথমে ডাক পড়ল আমার। স্মার্ট হয়ে ঢোকার চেষ্টা করলুম। কিন্তু বুক কাঁপছিল। চেয়ারে বসার পর প্রশ্ন শুরু হলো। কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানছেন।

আমার নাম-ধাম, কর্নেলের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি শেষ হলো। তারপর গত রাতের ঘটনা নিয়ে জেরা চলল। আমি যা যা জানি, জবাব দিয়ে গেলুম। ওঁরা নোট করে নিলেন। তারপর কর্নেলের কাশির শব্দ হলো—এক মিনিট। উইথ ইওর কাইণ্ড পারমিশান প্লিজ!

কিষাণ সিং বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন কর্নেল।

—আমি জয়ন্তকে কিছু প্রশ্ন করব।

—অবশ্যই করবেন।

জয়ন্ত! তাহলে তুমি বলছ যে সোনালীর মুখেই তুমি শুনেছ মার্ডার ফানের প্রস্তাবটা দীপ্তিই তুলেছিল?

—হ্যাঁ।

—তুমি বলছ যে গত রাতে দীপ্তির মুখে খুব নার্ভাসনেস দেখেছিলে!

—হ্যাঁ।

—এবং আজ তার উল্টো অর্থাৎ মরীয়া মনে হচ্ছিল ওকে?

—হ্যাঁ

—দীপ্তিই তাহলে মার্ডার ফানের মোটিভ হিসেবে…

বিরক্ত হয়ে বললুম—বলেছি তো! রিফাইনারির সাবোটাজের কথা বলেছিল।

—ওক্কে। এবং দীপ্তিই বলেছিল, মোটিভের ক্লু হিসেবে একটুকরো কাগজ হাতে ধরে থাকবে—তাতে সংকেত বাক্যে সাবোটাজের উল্লেখ পাওয়া যাবে?

—সবই তো বলেছি।

—কিন্তু আমরা ওর হাতে তেমন কোনও কাগজের টুকরো পাইনি!

—সেজন্য কী আমি দায়ী?

সবাই হেসে উঠলেন আমার জবাব শুনে। কর্নেল বললেন—আচ্ছা, আচ্ছা! মাত্র আর একটা প্রশ্ন! তুমি যখন নদীর ধারে যাও, কিংবা সেখান থেকে ফিরে আসো, তখন কোনও শব্দ শুনেছিলে?

—হুঁ। অনেক শব্দ।

অফিসাররা নড়ে উঠলেন। কর্নেল ব্যর্থ হয়ে বললেন—অনেক শব্দ? কিসের?

—পাখিটাখির।

সবাই হাসলেন। কর্নেল বললেন—কাকেও দেখেছিলে, জঙ্গলে অথবা খুনের জায়গায়?

—হুঁউ। তবে খুনের জায়গায় নয়। পশ্চিমের একটা টিলায়।

ফের সবাই নড়ে বসলেন। কর্নেল বললেন—দেখেছিলে? চিনতে পেরেছিলে?

—হুঁউ

কিষাণ সিং বললেন—কে সে? চোপরা না দিব্যেন্দু?

—কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বায়ুসেবনে বেরিয়েছিলেন।

কর্নেল গোমড়ামুখে কী অস্ফুট বললেন। কিষাণ সিং দরজার দিকে ইশারা করে কাকে বললেন—সোনালী ব্যানার্জি! জয়ন্তবাবু, আপনি প্লীজ ওখানটায় বসুন।

কোণের সোফায় গিয়ে বসলুম। বুঝলুম, এখন বেরুনো যাবে না। সিগ্রেট ধরিয়ে টানতে থাকলুম। সোনালী পাথরের মূর্তির মতো ঘরে ঢুকল এবং নমস্কার করে ওঁদের সামনের চেয়ারে বসল।

নামধাম পরিচয় পর্ব হলো। তারপর জেরা চলতে থাকল।

মিস ব্যানার্জি, ঠিক কখন প্রথমে আপনারা মার্ডার ফানের কথাটা ভেবেছিলেন এবং প্রথম কে ভেবেছিল?

দীপ্তি। কদিন আগে কর্নেলকে বাবা আমার জন্মদিনে নেমন্তন্ন করতে পাঠালেন। রত্না আমার সঙ্গে যেতে চাইল। দীপ্তিও তা শুনে যাবে বলল। কর্নেলের বাড়ি থেকে ফেরার সময় রাস্তায় ট্যাক্সিতে দীপ্তি বলল—এই ভদ্রলোক তাহলে গোয়েন্দা? ওকে নিয়ে তোর জন্মদিনে একটা ফান করলে কেমন হয়? তারপর …

—ডেডবডি সাজতে কি দীপ্তিই চেয়েছিল?

—হ্যাঁ। ট্যাক্সিতে বসেই সব ঠিক হয়ে যায়।

হঠাৎ কর্নেল বললেন—ট্যাক্সির নাম্বারটা কি লক্ষ্য করেছিলে সোনালী?

—আমি করিনি। ওসব কেই বা লক্ষ্য করে? কেন বলুন তো?

—জাস্ট এ চান্স! যদি দৈবাৎ করে থাকো।

—করিনি।… বলেই সোনালী নড়ে উঠল। হ্যাঁ, আমি করিনি। কিন্তু …।

—কিন্তু দীপ্তি…।

—দীপ্তি করেছিল?

—হ্যাঁ ব্যাপারটা এখন মনে হচ্ছে, ভারি অদ্ভুত। জানেন? হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে আমরা ভবানীপুরে মামার বাসায় গেলুম, সেটাই আমাদের ইলিয়ট রোডে কর্নেলের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার সময়ও একই ট্যাক্সি। দীপ্তি এটা লক্ষ্য করেছিল। বলেছিল ব্যাপার কী রে? এই একটা ট্যাক্সিই পাচ্ছি খালি? আমি অবশ্য ট্যাক্সিওয়ালাকে লক্ষ্য করিনি। বলেছিলুম—তোর চোখের ভুল। বাইরের লোক তো তুই, তাই সব ট্যাক্সিওয়ালাকে একই লোক বলে ভুল করছিস! যেমন সব চীনেম্যানকে দেখে একই লোক। মনে হয়!

কিষাণ সিং বললেন—বেশ ইন্টারেস্টিং তো!

কর্নেল বললেন হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সি ভবানীপুরে নিয়ে যায় তোমাদের। তারপর সম্ভবত ওই ট্যাক্সিটাই তোমার মামার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিল এবং তোমরা রাস্তায় নামতেই নিজে থেকে অফার দেয়।…

সোনালী সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। লোকটা আমাদের ডেকে বলল-আইয়ে মেমসাব! দীপ্তি বলল—সেই ট্যাক্সিঅলা না? আমি আর রত্না গ্রাহ্য করিনি। ট্যাক্সি পাওয়াই বড় কথা।

—রাইট। তোমরা যখন আমার বাসায় গেলে, আমি অভ্যাসমতো জানালায় দাঁড়িয়েছিলুম। দেখলুম ট্যাক্সিটা তোমাদের নামিয়ে দিয়েই ফিরল। কিন্তু চলে গেল না। ওধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নাম্বারটা আমার মনে আছে।..বলে কর্নেল পকেট থেকে নোটবই বের করলেন। বললেন—লিখে নিন মিঃ সিং। এক্ষুণি  কলকাতায় খোঁজ নিতে হবে। এটা বিশেষ জরুরী।

কিষাণ সিং একজন অফিসারকে তক্ষুনি ফোনের কাছে পাঠালেন। তারপর কর্নেল বললেন—সোনালী, দীপ্তির ব্যক্তিগত জীবনের দু-একটা কথা তোমার মুখেই শুনতে চাই।

বলুন। যা জানি, বলব।

—ইয়ে, ওর কি কোনও প্রেমিক ছিল? লজ্জার কারণ নেই, বলো।

সোনালী মুখ নামিয়ে বলল—দিব্যের সঙ্গে একসময় ওর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাছাড়া দিব্যের সঙ্গেই ওর বিয়ের কথাও চলছিল। দিব্য রিফাইনারিতে চাকরিটা পেয়ে গেলেই বিয়েটা হতো।

—আই সী! কিন্তু ঘনিষ্ঠতাটা একসময় ছিল বলছ কেন?

—ইদানিং দীপ্তি যেন দিব্যকে এড়িয়ে চলছিল। আর…

—বলো!

—আর রণধীরদার সঙ্গে একটু বেশি মেলামেশা করছিল।

—মানে তোমার বাবার প্রাইভেট অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটির সঙ্গে?

—হ্যাঁ। তবে এ নিয়ে দিব্যর সঙ্গে কোনওরকম মনকষাকষি দেখেনি। আমরা একসঙ্গেই বেশিরভাগ সময় থাকি। তেমন কিছু ঘটলে টের পেতুম। দিব্যও এসব মাইণ্ড করার ছেলে না।

ইদানিং দীপ্তির মধ্যে কোনও বিশেষ ভাবান্তর টের পাচ্ছিলে কি?

সোনালী একটু ভেবে বলল—তেমন কিছু দেখেনি। তবে…

—তবে?

মাঝে মাঝে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকত। জিগ্যেস করলে কিছু বলবে মনে হতো—কিন্তু শেষ অব্দি বলত না। শুধু বলত—শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।

—আচ্ছা, ওকথা থাক। আজ সকালে তুমি দীপ্তিকে ওভাবে রেখে বারান্দায় চলে এলে! তখন বারান্দায় রত্না ছিল। তাই না?

—হ্যাঁ। আমরা দু’জন ছিলুম।

—ওদিক থেকে কোন শব্দ শুনতে পেয়েছিলে? কিংবা কাকেও যেতে দেখেছিলে?

—না।

—ভেবে বলো।

সোনালী জোরের সঙ্গে মাথা দোলাল। আমরা দুজনেই ওদিকে তাকিয়েছিলুম।

তারপর প্রথমে দিব্য না চোপরা ফিরে এল?

—চোপরা।

—কোনদিক থেকে?

—পুবদিক।

—তার মধ্যে কোনও ভাবান্তর ছিল?

—নাঃ। হাসতে হাসতে এল।

—ভেবে বলো। কারণ তোমার উইশফুল থিংকিং হতে পারে।

সোনালী ভেবে নিয়ে জবাব দিল-মনে হচ্ছে, হাসতে দেখেছি। তারপর একটু গম্ভীর হয়েছিল মনে পড়ছে। একটু…হ্যাঁ কর্নেল, ওকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। কারণ রত্না ওকে ডাকলে শুনতে পেল না। তখন রত্না বলল, খুব ঘাবড়ে গেছ মনে হচ্ছে! ও যেন চমকে উঠে আবার হাসতে লাগল।

দিব্য এল কোনদিক থেকে? কতক্ষণ পরে?

—পশ্চিমদিক থেকে। মিনিট তিন-চার পরে। দিব্যকে কিন্তু খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিল। এখন মনে পড়ছে। ও এসেই বলল—খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে যেন!..বলেই সোনালী নড়ে উঠল। কর্নেল! মনে পড়ছে, দিব্য যেন হাঁফাচ্ছিল।

—বলো কী!

—হ্যাঁ। রত্না ওকে ধমক দিয়ে বলল—দাদা সবতাতেই নার্ভাস হয়ে পড়ে। আমি ঠাট্টা করে বললুম—হবু ব্রাইড ইজ মার্ডারড। কষ্ট হচ্ছে না বুঝি? তা শুনে দিব্য রাগ দেখিয়ে বলল—খুব ডেঁপো মেয়ে হচ্ছ। সেই সময় দেখি জয়ন্তবাবু ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতো। পলিমাটিগুলো ছড়িয়ে চলে আসার কথা। অথচ উনি যেন কী দেখছেন। তাই আমি দৌড়ে গেটে গেলুম ওকে ডাকতে।

—তার মানে জয়ন্তকে তুমি ফিরতে দেখনি?

—না। মানে, তখন আমরা নিজেদের মধ্যে ওইসব কথাবার্তা বলছি তো। তাই ওদিক আর তাকাচ্ছিলুম না!

—রত্না আর তুমি বারান্দায় থাকার সময়ও কেউ ওখানে গেলে তাহলে তোমার চোখে পড়ার চান্স বেশি ছিল না।

সোনালী ব্যস্ত হয়ে বলল না না, ছিল। তখন…

—অবশ্য দক্ষিণের ঢালু থেকে ঝোপ ঠেলে কেউ এলে তাকে পেতে না।

—হ্যাঁ। তা পেতুম না।

—ঠিক আছে সোনালী। তুমি জয়ন্তের কাছে গিয়ে বসো। নাকি মিঃ সিং কিছু প্রশ্ন করবেন?

সবাই মাথা দোলালেন। সোনালী আমার পাশে এসে নিঃশব্দে বসে গেল। কিষাণ সিং ডাকলেন—দিব্যেন্দু চ্যাটার্জিকে ডাকো..