অচেনা জায়গায় আমার ঘুম হয় না। তাতে ভোরে ওঠার তাগিদ ছিল। রাতটা প্রায় জেগেই কাটালুম। পাশের ড্রইং রুমের দেয়ালঘড়ির ঘণ্টা প্রত্যেকবারই শুনেছি। যখন তিনবার বাজল, তখন টের পেলুম ঘুমের টান আসছে। অমনি সিগ্রেট ধরালুম। কর্নেলের নাক ডাকা মাঝে মাঝে বন্ধ হচ্ছে। অস্ফুট কী যেন বলছে—হয়তো ঘুমের ঘোরে। আবার নাক ডাকছে। সিগ্রেট খাওয়ায় কাজ হলো। ঘুম আর এলও না। চারটেয় আমি উঠে বাথরুমে ঘুরে এলুম, তারপরে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলুম। পাঁচটায় কর্নেল উঠলেন। বাথরুমে গেলেন। তারপর যথারীতি টুপি ও ছড়ি নিয়ে বেরোলেন। দরজাটা আস্তে বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিলেন। ওঁকে খুব ঠকাচ্ছি ভেবে আমার মনটা খুশি।
পাঁচটায় বাইরের (দক্ষিণে) সেই বারান্দায় পায়ের শব্দ পেলুম। কোথায় গাড়ির আওয়াজ হলো। বেরিয়ে দেখি, সোনালী রত্না দিব্য তৈরি হয়ে আমার অপেক্ষা করছে। বারান্দায় কফি খেতে খেতে চোপরা এল। কথামতো সে দীপ্তির বাসা থেকে দীপ্তিকে সঙ্গে এনেছে। কফি খাওয়া শেষ হলে সোনালী বলল-জয়ন্তবাবু! কুইক! চলুন, আমরা সাইট সিলেকশনটা করে ফেলি।
সোনালী একটা ব্যাগে থিয়েটারের ছোরা আর পেন্টের সরঞ্জাম নিয়েছে। আমরা তক্ষুণি গেট পেরিয়ে ছোট একটা রাস্তায় গেলুম। তার ওধারে ঘন গাছপালা ঝোপঝাড় ঢালু হয়ে নীচের উপত্যকায় নেমে গেছে। রাস্তা থেকে আন্দাজ পনের ফুট দূরে ঝোপের মধ্যে একটা বড় পাথর পাওয়া গেল। গাছপালা ঘাস এবং পাথরটা শিশিরে চবচবে হয়ে আছে। আমি ভেবেই পেলুম না, কীভাবে দীপ্তি মড়া হয়ে এখানে শোবে। দীপ্তির দিকে তাকালুম। এখন দেখি, সে যেন মরীয়া। তার মুখেচোখে দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ পাচ্ছে। সে বসে পড়ল এবং সোনালী তার পিঠে ছুরিটা সেট করতে থাকল। দিব্য বলল—জয়ন্তবাবু! আপনি সোজা এই রাস্তা দিয়ে এগোলে ঘুরতে ঘুরতে নদীর ধারে পড়বেন। সেখান থেকে পলি এনে ছড়িয়ে বাংলোয় যাবেন নিজের ঘরে। রণধীর, তুমি বরং পূর্বে এগিয়ে ওই বড় রাস্তায় যাও। আমি যাচ্ছি পশ্চিমে বড় রাস্তায় ঘুরতে। সোনালী আর রত্না যাবে বারান্দায়। সবাই বাংলোয় ফিরে আধঘণ্টা অপেক্ষা করবে। তারপর এখানে আসবে একেবারে কর্নেলকে নিয়েই।
দীপ্তি ওই অবস্থায় বসে খুঁতখুঁতে গলায় বলল—এতক্ষণ পড়ে থাকতে হবে এই ঠাণ্ডায়?
সোনালী ধমক দিয়ে বলল— প্রোপাজালটা কিন্তু তোমারই। ভুলে যেও না।
দীপ্তি করুণ মুখে ফের বলল—যদি কর্নেলের ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যায়।
আমি বললুম— হবে না। ঠিক ছটায় আজকাল উনি যোগাসন করেন।
সোনালী কাজ করতে করতে বলল কুইক! দেরী হয়ে যাচ্ছে। পাঁচটা পঁয়ত্রিশ হয়ে গেল।
দিব্য ও চোপরা পরস্পর উল্টোদিকে চলে গেল। আমি পা বাড়িয়ে একবার ঘুরে দেখে নিলুম—দীপ্তির পিঠে ছোরাটা অদ্ভুত কৌশলে বসানো হয়েছে এবং সোনালী অশেষ যত্নে টকটকে লাল রঙ মেশাচ্ছে—অবিকল টাটকা রক্ত যেন! আমার গা শিউরে উঠল। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্যই না দেখাচ্ছে!…
ছোট্ট রাস্তাটা একটু পুবে এগিয়ে রাস্তার গা ঘেঁষে দক্ষিণে ঘুরেছে এবং নীচের দিকে নেমেছে। বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা ও ভরা নদী চোখে পড়ল বাঁক থেকে। ভোরের ধূসর আলো কুয়াশায় নীল রঙ ছড়াচ্ছে। একটু শীত লাগছিল। কিন্তু চারপাশে পাখির ডাক, এই সবুজ সুন্দর বনভূমি নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিল।
হাঁটছিলুম বেশ জোরে। কারণ খুব শিগগির ঘুরে আসতে হবে। জুতোর তলায় পলি নিয়ে সেই পলি ছড়িয়ে আসতে হবে অকুস্থলে। তারপর যেন কিছু জানিনে এইভাবে নিজের ঘরে বসে কর্নেলের অপেক্ষা করতে হবে। প্ল্যানটা নির্ভর করছে প্রত্যেকের সময় জ্ঞান এবং দক্ষ অভিনয়ের ওপর।
দশ মিনিটের মধ্যেই নদীর ধারে পৌঁছলুম। পাহাড়ী নদী। স্রোত বইছে প্রচণ্ড। পাড়ে যেখানে পলি জমেছে, সেখানে বার কতক হাঁটলুম। যখন জুতোর রবারের সোলে যথেষ্ট পলি জমল, তখন ফেরা শুরু হলো।
ওঠার সময় হঠাৎ বাঁদিকে দূরে একটা টিলা থেকে কর্নেলকে নেমে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ালুম। কর্নেল নীচে অদৃশ্য হলেই হুঁশ হলো যে সময় চলে যাচ্ছে। বেশ জোরে হাঁটা শুরু করলুম।
অকুস্থলে পৌঁছে একটু অস্বস্তি হলো। কিন্তু এ সবই তো নিছক ফান ভেবে হাসতে হাসতে জুতোর তলা থেকে খানিকটা পলি ছড়িয়ে দিলুম। তারপর ঝোপের ফাঁকে উঁকি মেরে পাথরটার কাছে দীপ্তিকে দেখতে পেলুম। দৃশ্যটা মারাত্মক। তাই ফের অস্বস্তি জাগল। দীপ্তি কাত হয়ে পাথরে হেলান দেওয়ার মতো মাটিতে বসেছে—মাটিতে ঘাস নেই। ওর শাড়িটা পাথরে ও মাটিতে এমন কায়দায় রাখা যে ওকে শিশিরের ঠাণ্ডাটা পেতে হচ্ছে না। পিঠে বাঁদিকে ছোরার বাঁট এবং অবিকল রক্ত চবচব করছে! দীপ্তি চোখ বুজে মুখ নামিয়ে পাথরে মাথাটা ঠেকিয়ে রেখেছে। ফিসফিস করে ডেকেছি—হঠাৎ শিসের শব্দ হলো। ঘুরে দেখি, রাস্তা থেকে সোনালী হাত নাড়ছে। কিছু পলিমাটি দীপ্তির কাছে ছড়িয়ে তক্ষুণি ওর কাছে গেলুম। সোনালী বলে উঠল-কুইক! কর্নেল ফিরছেন—ওই দেখুন!
পশ্চিমে বাংলোর গেট। ফুল গাছের আড়ালে ওঁর টুপি চোখে পড়ল। আমরা দুজনে গেট দিয়ে প্রায় দৌড়ে বারান্দার উঠলুম। দিব্য ও চোপরাকে বসে থাকতে দেখলুম। রত্না মুখে দুষ্টু-দুষ্টু ভাব ফুটিয়ে বসে আছে।
সোনালী বলল-জয়ন্তবাবু! আপনি আর ঘরে যাবেন না! এখানে থাকুন। প্রথমে আমিই কিন্তু হইচই জুড়ে দেব। রেডি! পাঁচ গোনার পর গেম শুরু হবে। রেডি! ওয়ান…টু…থ্রি…ফোর…
পাঁচ বলার সঙ্গে সঙ্গে দিব্যেন্দু উঠল এবং বিকট ভঙ্গি করে চেঁচিয়ে উঠল— খুন! খুন!
একই মুহূর্তে আমার চোখ গেল সোনালীর দিকে। সোনালী যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে কারণ এখানে তার ভূমিকাই প্রথম এবং মূল ছিল। অবাক আমিও। দিব্যেন্দুর মতো ভব্য ছেলে এই সুন্দর শারদীয় ভোরবেলাটাই যেন খুন করে ফেলল!
তারপর সোনালী একঝিলিক হেসেছে এবং ভুরু কুঁচকে দিব্যেন্দুকে যেন ধমকই দিয়েছে। দৌড়ে গেছে কর্নেলের উদ্দেশে। দিব্যেন্দু সমানে চেঁচাচ্ছে—খুন! খুন! এবং চোপরাও গলা মেলাল। রত্না হাসি চাপছে দেখলুম। দিব্যেন্দু আমার দিকে হাত নেড়ে তার সঙ্গে গলা মেশাতে ইশারা দিল। আমি ঘাবড়ে গেছি।
মাত্র কয়েকটি সেকেণ্ড এসব ঘটল।
বাবুর্চি-চাকর-দারোয়ান-মালী-পরিচারিকাপ্রমুখ ভৃত্যগোষ্ঠী যেন দুপাশের উইংস থেকে স্টেজে প্রবেশ করল। তারপর রাতের গাউনপরা এবং আরক্ত চোখ নিয়ে স্বয়ং অনিরুদ্ধ বেরিয়ে এলেন।
এও কয়েক সেকেণ্ডের ঘটনা।
তারপর কর্নেলকে বেরুতে দেখলুম। তার পাশে সোনালী হাতমুখ নেড়ে কী বলতে বলতে এগোচ্ছে। কর্নেলের ভঙ্গিতে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। সত্যিসত্যি খুনের গন্ধ পেয়ে যেন শকুনের মতো ওঁর স্বভাবসিদ্ধ রীতিতে এগিয়ে আসছেন। সোনালী অদ্ভুত অভিনয় করছে বলা যায়। সে হাত তুলে ওদিকটা দেখিয়ে ভয়ার্ত স্বরে চেঁচাল-ওদিকে! ওখানে-ওখানে!
অনিরুদ্ধের মুখেও ভীষণ আতঙ্কের ছাপ। ঠোঁট কাঁপছে দেখলুম। বাকশক্তি রহিত।
এরপর সোনালী ও কর্নেলের পিছন পিছন আমরা লন পেরিয়ে গেট দিয়ে ছোট রাস্তায় পড়লুম। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলুম বারান্দায় রত্না রয়ে গেছে এবং অনিরুদ্ধকে কিছু বলছে। দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখলুম, অনিরুদ্ধ ঘরে ঢুকছেন—অর্থাৎ মজাটা জেনে গেছেন। রত্না দৌড়ে আসছে।
ঝোপ ঠেলে পাথরটার সামনে কর্নেল দাঁড়ালেন এবং দীপ্তিকে ওই অবস্থায় দেখে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন—এ কী!
ওঁর পিছনে দাঁড়িয়ে চোপরা এবার নিঃশব্দে হাসতে থাকল। দিব্যেন্দু ভুরু কুঁচকে ওকে ধমকাল বটে, নিঃশব্দে চুপিচুপি নিজেও হাসতে শুরু করল। সোনালী কান্নার গলায় বারবার বলতে থাকল—বেঁচে আছে তো কর্নেল? দীপ্তিকে কে খুন করল?
সত্যি, বড় চমৎকার অভিনয় করতে পারে মেয়েটি।
হঠাৎ কর্নেল ঘুরে আমাদের সবাইকে যেন একবার দেখে নিলেন। তারপর পা বাড়িয়ে দীপ্তির কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। আমরা সবাই চুপ। মজার চরম মুহূর্ত উপস্থিত।
কর্নেল যেই দীপ্তির একটা হাত তুলে নাড়ি পরীক্ষা করতে গেলেন, অমনি রত্না আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সব নিষেধ ভুলে খিলখিল করে হেসে উঠল। সোনালীও নিঃশব্দ ধমক দিতে গিয়ে তাল হারাল। এবং সেও হেসে ফেলল। দেখাদেখি আমিও হো হো করে হেসে উঠলুম। দিব্যেন্দু আমার পাঁজরে চিমটি। কাটল। চোপরা একটু পিছনে দাঁড়িয়ে হাসছে। ভৃত্যগোষ্ঠী আমাদের হাসি দেখে প্রথমে হতবাক, স্তম্ভিত—পরে মজাটা টের পেয়ে গেছে। তাদেরও দাঁতগুলো ভোরের লালচে আলোয় ঝকমক করতে দেখলুম।
রত্নার হাসি শুনেই কর্নেল ঘুরেছিলেন। কিন্তু ওঁর মুখে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। উনি সিরিয়াস হয়েই নাড়ি পরখ করছেন। এবং ওঁর চোখে সেই সুপরিচিত তীক্ষ্ণতা লক্ষ্য করে আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলুম।
সোনালী হাসতে হাসতে বলে উঠল দীপ্তি! দি গেম ইজ ওভার! উঠে পড়!
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। রত্না হাসতে হাসতে বলল কর্নেল! এবার কিন্তু মার্ডারারকে আপনার খুঁজে বের করা চাই। অনেক ক্লু আছে!
সোনালী দীপ্তির দিকে এগিয়ে ধমকের সুরে বলল—আঃ! ওঠ না! এই দীপ্তি! ওঠ!
কর্নেল গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন দীপ্তি উঠবে না।
সোনালী বললে উঠবে না মানে?
—ওর ওঠার ক্ষমতা আর নেই।..বলে কর্নেল আমার দিকে দ্রুত ঘুরলেন। জয়ন্ত, শীগগির যাও। অনিরুদ্ধবাবুকে খবর দাও। এবং ফোনে থানায় জানাতে বলো।
বাধা দিয়ে দিব্যেন্দু বলল—কিন্তু স্যার, পুলিশ এলে ফানটা মাঠে মারা যাবে।
কর্নেল হঠাৎ গর্জন করে উঠলেন—নো, নো মাই ইয়ং ফেণ্ড! ইট ইজ নো ফান! এটা সত্যিকার খুন। দীপ্তিকে কেউ সত্যিকার ছোরা দিয়ে খুন করেছে।
দিব্যেন্দু, রত্না ও চোপরা একসঙ্গে বলে উঠল—অসম্ভব! আমিও বলে উঠলুম— কর্নেল! কী বলছেন! এ তো নিছক মজা করার জন্যে…
কর্নেল ফের গর্জে উঠলেন শাট আপ! যা বললুম— করো গিয়ে। কুইক!
আমি যন্ত্রের মতো পা বাড়ালুম। পিছনে স্তব্ধতা। এতক্ষণে টের পেয়েছি, কর্নেল সত্যি রসিকতা করছেন না এবং দীপ্তি সত্যি সত্যি খুন হয়ে গেছে। আমার পা কাঁপতে লাগল। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে টাল সামলালুম।
বারান্দায় উঠে এবার পিছু ফিরে দেখি, দলটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।..