» » জিরো জিরো জিরো

বর্ণাকার

সে-রাত শুতে গিয়ে দেখি কর্নেল বেজায় গম্ভীর। আমি শুয়ে পড়লুম। উনি টেবিল ল্যাম্পের সামনে বসে একটা প্রকাণ্ড বই পড়তে থাকলেন। বললুম—ব্যাপার কী? সরাদিন ট্রেনজার্নির পর ওই বুড়ো হাড়ের ভেল্কি দেখানো কেন? আলোয় আমার ঘুম আসে না।

কর্নেল বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই বললেন—এক মিনিট, জয়ন্ত। টি ই লরেন্স চ্যাপটারটার আর এক প্যারা বাকি। তুমি প্লীজ একটুখানি ধৈর্য ধরো। লাভবান হবে।

—আমার কিসের লাভ?

—থ্রি জিরোর তত্ত্ব আঁচ করেছি ডার্লিং! দৈনিক সত্যসেবক-এ এটা ছাপা হলে কাগজের বিক্রি বাড়বে এবং তোমারও বেতনের ইনক্রিমেন্ট হবে। লাভটা তো তোমারই।

অতএব ধৈর্য ধরলুম। কিন্তু সকাল-সকাল ঘুমিয়ে না পড়লে ভোর পাঁচটায় ওঠা কঠিন হবে। মনে মনে হাসলুম। ওঁকে নিয়ে সোনালীরা যা মজা করতে যাচ্ছে, উনি তো টেরও পাচ্ছেন না। মার্ডার গেমটা যে নিছক ফান, তা টের পাবার মুহূর্ত অব্দি উনি ওই থ্রি জিরোর তত্ত্বের সঙ্গে দীপ্তির এই অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড জড়িয়ে কী না নাজেহাল হবেন! মাথায় একটা মতলব গজালো। দীপ্তি কর্নেল যাওয়ামাত্র যেন ধরা না দেয়। অন্তত আধঘণ্টা ওঁকে নাজেহাল করা যাবে। তারপর ফাঁস করা হবে যে ব্যাপারটা ফান। ভোরে এই প্রস্তাবটা ওদের দেব।…

চোখ খুলতেই দেখি আমার বৃদ্ধ বন্ধুটি কখন নিঃশব্দে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং আমাকে দেখছেন। বললেন—তুমি চোখ বুজে হাসতে অভ্যস্ত, তা তো জানতুম না ডার্লিং! নিশ্চয় তেমন কিছু ব্যাপার ঘটেছে। আর শোন, তোমার ওই হাসিটুকুর মধ্যে দুষ্টু ছেলের আদল লক্ষ্য করছিলুম। নিশ্চয় কোনও মতলব ভাঁজছিলে।

গম্ভীর হয়ে বললুম—ভাঁজছিলুম। আপনি তো গোয়েন্দা— নাকি মনের চিন্তার আভাস মুখেও বুঝতে পারেন। আপনিই বলুন, কী মতলব ভাঁজছিলুম?

কর্নেল আমার পাশেই খাটে পা ঝুলিয়ে বসলেন। তারপর বললেন-জয়ন্ত, আমি অন্তর্যামী নই। তবে এটুকু টের পাচ্ছি যে তোমরা কজন যুবক যুবতী মিলে একটা কিছু ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যাক্ গে—এবার শোনো থ্রি জিরোর ব্যাপারটা। পশ্চিম এশিয়ার অর্থনীতি বইটার তিরিশ পাতায় লরেন্সের কাহিনী আছে। খুব মন দিয়ে পড়ছিলুম আর মনে হচ্ছিল, সত্যি-বড় বিচিত্র মানুষ ওই লরেন্স! কী বিপুল ইচ্ছাশক্তি! কী সাহস আর ধৈর্য! পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতাও কী অসাধারণ! ওঃ!

ওঁর যেন ভাবাবেগের ঘোর লেগে গেল। চোখ বুজে যেভাবে মাথা নাড়া দিলেন, বারকতক, মনে হলো রোমাঞ্চ সামলাচ্ছেন। অবাক হয়ে বললুম—ব্যাপারটা কী? হঠাৎ লরেন্সকে নিয়ে এত উচ্ছ্বাস কেন?

কর্নেল চোখ খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—তুমি জানো না জয়ন্ত! একটা প্রচণ্ড প্রাণশক্তি না থাকলে তুরস্ক সরকারের অস্ত্রশস্ত্র আর রসদবাহী মালগাড়ির ওপর মাত্র জনাকতক বেদুইন গ্যাংস্টার নিয়ে হামলা করা যায় না। বোঝে ব্যাপারখানা। মালগাড়িতে সশস্ত্র সেনারাও ছিল। তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে লরেন্স নিতান্ত সাধারণ অস্ত্র নিয়ে লড়লেন! এবং…

বাধা দিয়ে বললুম—শুনেছি, মানে ছবিতে দেখেছি—আগে থেকে ডিনামাইট পোঁতা হয়েছিল লাইনের তলায়। যাই বলুন, এটা নিছক সাবোটাজ! এমন অন্তর্ঘাতমূলক কাজ যেকোনও বাচ্চাই করতে পারে। লরেন্সের মহিমাটা টের পাচ্ছি না।

কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—পাচ্ছ না বুঝি?

নাঃ।

 কর্নেল হঠাৎ হাসলেন একটু। তারপর মাথা নেড়ে বললেন-হ্যাঁ, তা ঠিক। সাবোটাজ করতে খুব একটা বীরত্ব লাগে না! রাইট, রাইট! সাবোটাজ!

কর্নেল বারবার সাবোটাজ শব্দটা আওড়াতে-আওড়াতে ফের টেবিলে গিয়ে বসলেন। বইটা খুললেন। তখন বিরক্ত হয়ে বললুম—আবার পড়তে বসলেন নাকি?

কর্নেল বইটা খুলে কী দেখে নিয়েই বন্ধ করলেন এবং টেবিল-বাতির সুইচ অফ করে বললেন-জয়ন্ত, আশা করি এবার তোমার সুনিদ্রা হবে।

ওঁর ছোট টর্চটা জ্বলতে জ্বলতে কোণের অন্য বিছানার দিকে এগোল। একটা চাপা শব্দ হলো অন্ধকারে। বুঝলুম, উনি শুয়ে পড়লেন।

এবং কয়েক মিনিট পরেই ওঁর নাক ডাকা শুরু হলো। কী অদ্ভুত মানুষ!….