দুই
ভৈরবগড় বর্ধমানের সীমান্তে খনি অঞ্চলের একটি বনেদী জনপদ। গ্রাম-শহরের অদ্ভুত সংমিশ্রণ। চারদিকে অসমতল রুক্ষ মাটির বিস্তার। গাছপালা স্বভাবত কম। এদিকে ওদিকে কিছু পোড়ো এবং চালুখনি রয়েছে। বেশির ভাগই কয়লাখনি, কয়েকটা অভ্র খনিও আছে। তবে ভৈরবগড়ের উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তিও কম নয়। বিশেষ করে পাঁচশো বছরের বাবা ভৈরবের বিশাল মন্দিরটা।
ট্রেনে যেতে যেতে গোয়েন্দাপ্রবর আমাকে ভৈরবগড়ের ভূপ্রকৃতির এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বললেন, আজ ১১ মার্চ মঙ্গলবার। গত ৭ মার্চ শুক্রবার সকালে ভৈরবমন্দিরের চত্বরে মহেশ্বর ত্রিপাঠী নামে এক ব্যবসায়ীর লাশ পাওয়া যায়। মহেশ্বরবাবু নির্বিরোধ মানুষ ছিলেন। স্থানীয় অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে প্রচুর টাকাকড়ি সাহায্য করতেন। কাজেই তার জনপ্রিয়তাও ছিল। এমন মানুষকে কেউ খুন করবে, ভাবা যায় না। রাত্রিবেলা মন্দিরেই বা কেন তিনি গিয়েছিলেন, পুলিস তদন্ত করে প্রথমে জানতে পারেনি। পরে জেনেছে ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার এক তান্ত্রিক সাধুবাবা, নাকি তার বাড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু তন্নতন্ন খুঁজে সেই সাধুবাবার পাত্তা আর মেলেনি।
জিজ্ঞেস করলাম, খুন করা হয়েছিল কীভাবে?
মহেশবাবুর পিঠের দিকে হার্টের পেছনে সমান ব্যবধানে তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল। সম্ভবত বসে থাকা অবস্থায় অতর্কিতে তাকে পেছন থেকে আঘাত করা হয়। কর্নেল ট্রেনের জানালার দিকে চোখ রেখে বললেন, পরবর্তী হত্যাকাণ্ড ঘটে ঠিক পরদিনই–শনিবার। একই জায়গায় একই অবস্থায় পাওয়া যায় নবারুণ ভদ্র নামে একজন রিটায়ার্ড খনি-ইঞ্জিনীয়ারের লাশ। এক্ষেত্রেও আগের দিন নবারুণবাবুর কোয়ার্টারে সেই সাধুবাবা এসেছিলেন। কিছুক্ষণ গোপনে দুজনের মধ্যে নাকি কী কথাবার্তা হয়নবারুণবাবুর স্ত্রীর কাছে পুলিশ এটুকু জানতে পেরেছে। সাধুবাবাকে যে মহেশ্বরবাবুর খুনের ব্যাপারে পুলিশ খুঁজছে, নবারুণবাবুর স্ত্রী বা নবারুণবাবুও তা জানতেন না। বাড়িতে ওই সময় আর কেউ ছিল না। এর পর যেটুকু জানা গেছে, তা হল : দুজনেই আসছি বলে বাড়ি থেকে আন্দাজ সন্ধ্যা সাতটায় বেরিয়ে যান। আর ফেরেন নি।
কর্নেল চুপ করলে বললাম, তন্ত্রসাধনায় নরবলির কথা শুনেছি। এ তো দেখছি তাই।
গতকাল বর্ধমানের পুলিসসুপারের ট্রাঙ্ককল পেলাম–তখন সবে নেপাল যাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছি। ভৈরবমন্দিরের একই জায়গায় একই ভাবে পাওয়া গেছে। ভবেশ মজুমদার নামে আর একজন ব্যবসায়ীর লাশ। বসে থাকা অবস্থায় খুন। পিঠে তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন। এবারও জানা গেছে, আগের দিন এক সাধুবাবা এসেছিলেন ভবেশবাবুর কাছে। তিনিও আসছি বলে সন্ধ্যা ছটায় বেরিয়ে যান। এবারও ভবেশবাবু বা কেউ জানতেন না, সাধুবাবাকে পুলিস খুঁজছে। তাই গতকাল সঙ্গে সঙ্গে পুলিস তেঁড়রা পিটিয়ে ঘোষণা করেছে, ঢ্যাঙা, রোগা গড়নের কোনও লাল কৌপিন ও জটাধারী সাধুবাবাকে দেখলেই যেন জনসাধারণ পুলিশে খবর দেন। বলার দরকার নেই, এলাকার সব সাধু গা-ঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ জনতার হাতে প্রচণ্ড মারধরও খেয়েছেন। কিন্তু পুলিশ যাকে খুঁজছে, তাঁরা কেউই তিনি নন। নিহতদের বাড়ির লোকের সাক্ষ্যে সেটা বোঝা গেছে। তবু ভুল হতেও তো পারে। জনাতিনেক সাধু ভৈরবগড় হাসপাতালে এখন আহত অবস্থায় রয়েছেন। আজ দুপুরে ফের এসপি ট্রাঙ্ককল করে এসব কথা জানিয়েছেন।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে গম্ভীর মুখে টানতে থাকলেন। বললাম, পুলিস ঢেঁড়রা পিটিয়ে ভুল করেছে।
তুমি ঠিকই বলেছ, জয়ন্ত। কর্নেল একটু হাসলেন। পুলিস অনেক সময় একটু বেশি উৎসাহ দেখিয়ে বসে। তবে এই তিনটি অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের আরও একটি অদ্ভুত ধরনের কমন ব্যাপার আছে। সেটা পরে লোকের চোখে পড়েছে। ভৈরবমন্দিরের, চূড়ায় অন্তত পঁচিশ-তিরিশ ফুট উঁচুতে একটা ত্রিশূল আছে। প্রতিবার হত্যাকাণ্ডের পর সেই ত্রিশুলের গায়ে রক্ত দেখা যাচ্ছে কয়েকপোঁচ। জ্বলজ্বলে টাটকা রক্ত। কাছের একটা খনি থেকে ফায়ারব্রিগেড আনিয়ে পুলিশ ত্রিশূলের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে কলকাতায় বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছে। মানুষের রক্ত হলে সত্যি বড় রহস্যময় ঘটনা বলতে হয়। এত উঁচুতে কেউ উঠে রক্ত মাখিয়ে আসবে, এ তো অসম্ভব! মোচার আকৃতি মন্দিরচূড়া পাথরে তৈরি এবং ভীষণ পিছল। অত উঁচু মই কার আছে?
কর্নেল! তাহলে বেশ বোঝা যাচ্ছে, হত্যার অস্ত্র ত্রিশূল ছাড়া কিছু নয়। তিনটে সমান ব্যবধানে ক্ষতচিহ্ন, একমাত্র ত্রিশূলই সৃষ্টি করতে পারে।
ঠিক ঠিক। বলে কর্নেল ঘাড় নাড়লেন। তারপর গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার চোখে রেখে টেলিগ্রাফের তারে পাখি দেখতে থাকলেন। পাখিটা দ্রুত পিছিয়ে পড়ল। তখন উনি জানালায় ঝুঁকে গেলেন। পাখি দেখলেই আমার এই বাতিকগ্রস্ত বন্ধুটির ঘিলু যেন গলে যায়। জ্ঞানগম্যি আর থাকে না।….
সরকারী বাংলোটা ভৈরবগড়ের শেষপ্রান্তে! দক্ষিণে সামান্য দূরে জি.টিবোড়। পূর্বদিকে বেশ কিছুটা দূরে ভৈরবমন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। বিকেলে পৌঁছে খাওয়া-দাওয়ার পর লনে বসেছিলাম। আমার বৃদ্ধ বন্ধু হঠাৎ উঠে গেলেন। তারপর বরাবর যা দেখেছি, তাই দেখতে পেলাম। চোখে বাইনোকুলার রেখে উনি পূর্বের অনাবাদী মাঠে হনহন করে হেঁটে চলেছেন। ওঁর লক্ষ্যবস্তু পাখি যদি হয়, তাহলে সে-পাখি কোনও গাছের নয়। কারণ ওদিকে কোনও গাছই নেই। একটু পরে একটা ঢিবির আড়ালে ওঁর ধূসর রঙের টুপিটা অদৃশ্য হলে ঘরে ঢুকে সটান শুয়ে পড়লাম। ট্রেনজার্নির ক্লান্তি ছিল।
সন্ধ্যার পর গোয়েন্দাপ্রবর ফিরে এসে আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে অকালনিদ্রার জন্যে মৃদু ভৎর্সনা করলেন। তারপর বললেন, যাই হোক, অনেকখানি ঘোরাঘুরি করা গেল। ভৈরবমন্দির দর্শন করলাম। তারপর গেলাম রাজবাড়ি দর্শনে। রাজত্ব না থাকতে পারে, রাজা এখনও আছেন। গতবার এ তল্লাটে এসে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কাল সকালে আমাদের দুজনেরই ওখানে নেমন্তন্ন বড় অমায়িক মানুষ। আমার মতো নানারকম খেয়াল আছে ওঁর। বাড়িতে একটা চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছেন। কয়েক রকম জন্তুজানোয়ার আর পাখি আছে। গিয়ে দেখবেখন।
চৌকিদার চা দিয়ে গেল। চা খেতে খেতে বললাম, বাইনোকুলারে কী দেখছিলেন মাঠে?
ঘুঘু পাখির একটা ঝাঁক। এই লাল রঙের ঘুঘু পাখিরা ঝাঁক বেঁধে থাকে। এদের…
কথায় বাধা পড়ল। বাইরে কেউ ভরাট গলায় বলল, আসতে পারি কর্নেল?
কর্নেল ঘুরে সহাস্যে বললেন, আরে আসুন, আসুন মিস্টার সিনহা। আপনারই অপেক্ষায় ছিলাম।
একজন প্রকাণ্ড আকৃতির পুলিস অফিসার ঘরে ঢুকলেন। আলাপ-পরিচয় হল। যদুপতি সিনহা। এখানকার থানার অফিসার-ইন-চার্জ। একথা ওকথার পর বললেন, আপনার কথা সত্য কর্নেল! মহেশ্বরবাবু, নবারুণবাবু আর ভবেশবাবু প্রত্যেকের বসার ঘরে এককপি করে ডাকিনীতন্ত্র পাওয়া গেছে। এই দেখুন। তিনটে বই-ই এনেছি।
এই বইটাই কর্নেল চিৎপুর থেকে কিনেছেন। কর্নেল বইগুলোর পাতা উল্টে দেখার পর একটু হেসে বললেন, আনন্দময়ী পুস্তকভাণ্ডার থেকে গত ৫ মার্চ এক ভদ্রলোক একসঙ্গে ৭ কপি ডাকিনীতন্ত্র কিনেছিলেন। পাশের আর দাশ অ্যাণ্ড কোংয়ের দোকান তেকে তিনিই কেনেন একটা জটাচুল, একটা কমণ্ডলু, একটা ত্রিশূল আর কাপালিক সাধুর কাপড়চোপড়। চেহারার বর্ণনা থেকে বুঝতে পেরেছি একই লোক।
যদুপতিবাবু বললেন, চেহারার বর্ণনাটা শোনা যাক একটু।
লম্বাটে গড়ন। মোটা নাক। মাথায় আমার মত টাক।
কিন্তু সাধুবাবার বর্ণনার সঙ্গে তো ঠিক মিলছে না। সাধুবাবাকে যারা দেখেছেন, তারা বলছেন ঢ্যাঙা রোগা গড়ন। লম্বা ধারালো নাক।
নাক লম্বা আর ধারালো হওয়াটাই সুবিধেজনক। কর্নেল হাসলেন। তারপর চৌকিদারকে ডেকে যদুবাবুর জন্যে একটা খালি কাপ আনতে বললেন।
চৌকিদার কাপ দিয়ে গেল! কর্নেল পট থেকে চা ঢেলে সযত্নে যদুপতিবাবুর জন্যে চা তৈরি করে বললেন, ত্রিশুলের রক্তের রিপোর্ট কি এসেছে মিস্টার সিনহা?
যদুপতিবাবু বললেন এসেছে। ফোরেনসিক বিশেজ্ঞরা পরীক্ষা করে বলেছেন, মানুষেরই রক্ত।
আমি চমকে উঠলাম। গায়ে কাঁটা দিল। কর্নেল যদুপতিবাবুর দিকে নিষ্পলক চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর বললেন, বিকেলে ভৈরবমন্দিরে গিয়েছিলাম। মন্দিরের চূড়ার গড়ন মোচার মত। একেবারে খাড়া উঠে গেছে অন্তত কুড়িবাইশ · ফুট উচ্চতা তো বটেই। তার ডগায় ত্রিশূল বসানো আছে। মন্দিরের মূল দেয়ালের উচ্চতাও প্রায় দশ-বারো ফুটের কম নয়। যদি না কেউ মূল দেয়ালের অংশটুকুতে উঠতে পারে মোচার মত চূড়ার অংশে উঠবে কিভাবে? ভীষণ পিচ্ছিল আর খাড়া।
যদুপতিবাবু বললেন, কেন? বাঁশের মই দিয়েও ওঠা যায়।
কর্নেল মাথা নাড়লেন। তাহলে মইয়ের গোড়া নিচের মাটিতে দুটো ছাপ রাখবে। মাটিটা পুত্থানুপুঙ্খ পরীক্ষা করেছি বিশেষ ধরনের আতশ কাচ দিয়ে। কোনও ছাপ নেই। দ্বিতীয়ত, মইয়ের ডগাও চূড়ার ওপর দুটো ছাপ ফেলবে। বাইনোকুলারের সাহায্যে তাও খুঁটিয়ে দেখেছি। দুটো ছাপ চূড়ায় শেষপ্রান্তে ত্রিশূলের ঠিক নিচেই আছে। কিন্তু ওটা নিশ্চয় ফায়ারব্রিগেডের মইয়ের ডগার ছাপ। ত্রিশূলের রক্তের নমুনা নেওয়ার সময় আপনারা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এনেছিলেন। ফায়ার ব্রিগেডের মই গাড়ির সঙ্গে ফিট করা থাকে। তাই নিচের মাটিতে মইয়ের দাগ পাইনি।
যদুপতিবাবু হাসলেন। পুলিসোচিত ভঙ্গিতে চোখ নাচিয়ে বললেন, জাস্ট আপনার ওপিনিয়ন নিলাম। আমরাও ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখেছি, কর্নেল! মানুষের রক্ত ত্রিশুলে লেগে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে ভৈরবমন্দিরের ট্রাডিশন কিন্তু সাংঘাতিক। শুনেছি, প্রাচীনকালে শিবচতুর্দশীর রাতে শিবলিঙ্গে জলের বদলে মানুষের রক্ত ঢালা হত। আর এই কাপালিক সাধুরাও আসলে হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক। তা না হলে নরবলি দিতে পারে, বলুন?
কর্নেল বললেন, এক্ষেত্রে কিন্তু নরবলি দেওয়া হয়নি। মন্দির প্রাঙ্গণে হাড়িকাঠ আছে। তা সত্ত্বেও ভিকটিমদের মুণ্ডু কাটা হয়নি। পিঠে ত্রিশূল বিঁধিয়ে মারা হয়েছে।
তান্ত্রিক ব্যাপার। এ হয়তো কামাখ্যার ডাকিনীতন্ত্রের মতে আলাদা পদ্ধতিতে বলিদান।
যদুপতিবাবু হো হো করে হাসতে লাগলেন। কর্নেল বইগুলোর পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। বললেন, আশ্চর্য তো! প্রতিটা বইয়ের মারণতন্ত্র অংশটা আণ্ডার লাইন করা দেখছি।
যদুপতিবাবু মন্তব্য করলেন, ধাঁধার পর ধাঁধা! ত্রিশূলে মানুষের রক্তও ব্যাপারটাকে অলৌকিক করে তুলেছে।
কর্নেল বললেন, সাধুর কথায় মহেশ্বর ত্রিপাঠী না হয় মারণতন্ত্র জপতে রাত্রিবেলা মন্দিরে গেলেন। কিন্তু তার পরিণতি দেখে পরবর্তী ভিকটিম নবারুণবাবু কেন ভয় পেলেন না বা তার মনে সন্দেহ জাগল না এবং তিনিও মন্দিরে গেলেন? তারপর দেখুন তৃতীয় ভিকটিম ভবেশবাবুও ঠিক তাই করলেন। বড় অদ্ভুত!
যদুপতিবাবু দুলতে দুলতে বললেন, মানুষ যত শিক্ষিত হোক, কুসংস্কার বড় কঠিন রোগ কর্নেল!
এই সময় আরেকজন পুলিশ অফিসার এলেন। পরিচয়ে জানলাম, ইনি আই বি দারোগা খগেন্দ্র বিশ্বাস। গম্ভীর মুখে বললেন, জরুরি খবর আছে স্যার। বিকেল চারটে নাগাদ রঞ্জন আঢ্যির বাড়িতে সেই সাধু এসেছিলেন। সাধুকে বসতে বলে, রঞ্জনবাবু ভেতরের ঘরে গিয়ে থানায় ফোন করেন। আমরা ছুটে যাই–আপনি তখন বাইরে ছিলেন। রঞ্জনবাবুর বাড়ি গিয়ে সাধুকে পাইনি। রঞ্জনবাবু ফোন করে গিয়ে দেখেন, সাধু নেই। সম্ভবত ব্যাপারটা আঁচ করে কেটে পড়েছিল।
কর্নেল বললেন, সাধুবাবা রঞ্জনবাবুকে কী বলছিলেন?
খগেন্দ্রবাবু বললেন, এককপি ডাকিনীতন্ত্র কিনতে পীড়াপীড়ি করছিলেন।
আর কিছু?
না স্যার! রঞ্জনবাবু বললেন, এছাড়া আর কিছু বলেননি সাধু। কিন্তু ফোন করে এসে রঞ্জনবাবু দেখেন, এককপি ডাকিনীতন্ত্র বসার ঘরে পড়ে রয়েছে। পাতা উল্টে দেখেছি, মারণমন্ত্রের তলায় ডটপেন দিয়ে আণ্ডার লাইন করা।
রঞ্জনবাবু এখন কোথায়?
বাড়িতেই থাকার কথা। ওঁর বাড়িতে আর্মড গার্ড মোতায়েন করেছি। ওঁকে বেরোতেও নিষেধ করেছি।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। এখনই রঞ্জনবাবুর কাছে যাওয়া দরকার। ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। চলুন মিস্টার সিনহা। জয়ন্ত, তুমিও এস।
বাইরে জীপ দাঁড় করানো ছিল। যদুপতিবাবু ড্রাইভ করছিলেন। আলো-আঁধারি আঁকাবাঁকা রাস্তায় এগিয়ে বাজার এলাকায় ঢোকার মুখে হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। যদুপতিবাবু অস্ফুট স্বরে বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
অনেক গলিঘুজি ঘুরে একস্থানে জীপ দাঁড়াল। সামনে একটা দোতলা নতুন বাড়ির বারান্দায় হ্যাঁজাক জ্বলছিল। বেঞ্চে দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসেছিল। তারা উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকল। বাড়িটা নিঃঝুম কেন বুঝতে পারলাম না। যদুপতিবাবু জিজ্ঞেস করলেন, রঞ্জনবাবু বেরোননি তো?
একজন কনস্টেবল মাথা নেড়ে বলল, না স্যার! কিছুক্ষণ আগেও ভেতরে ওঁর। গলা শুনেছি।
দরজার কড়া নাড়লে হেরিকেন হাতে একটি লোক জানালা খুলে প্রথমে আমাদের দেখে নিল, তারপর দরজা খুলল। বুঝলাম, রঞ্জনবাবু খুব সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। যদুপতিবাবু বললেন, তোমার মনিবকে খবর দাও হে! বলল, আমরা এসেছি।
লোকটি বলল আজ্ঞে হুজুর, বাবু তো নেই!
আমরা চমকে উঠলাম। খগেন্দ্র বিশ্বাস চোখ কটমটিয়ে বললেন, নেই মানে?
ভেতর দিকের দরজার পর্দা তুলে বিবর্ণ মুখে এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা বললেন, ঘণ্টাখানেক আগে ফোন বাজল। দাদা ফোন ধরল। কী কথাবার্তা হল। তারপর দাদা ব্যস্ত হয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বলল, এক্ষুণি আসছি। জরুরি কাজ আছে। আমি নিষেধ করলাম, শুনল না। আর বৌদি তো শয্যাশায়ী।
কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, মিস্টার সিনহা। এখনই ভৈরবমন্দিরে যাওয়া দরকার। শীগগির!
আবার আমরা জীপে উঠলাম। অন্ধকার ঘোরালো সঙ্কীর্ণ রাস্তায় জীপ ছুটে চলল প্রচণ্ড গতিতে। মিনিট পনেরো পরে যখন থামল, জীপের হেডলাইটের আলোয় বিশাল এবং জরাজীর্ণ এক মন্দিরের ফটক দেখতে পেলাম। আবছা আলোয় ডাইনে-বাঁয়ে ধ্বংসস্তূপ আর আগাছার জঙ্গলও চোখে পড়ল।
টর্চ জ্বেলে মন্দিরের ফটক পেরিয়ে আমরা প্রাঙ্গণে ঢুকলাম। তারপর সবাই থমকে দাঁড়ালাম। প্রাঙ্গণে ফুট তিনেক উঁচু একটা চত্বরের ওপর পা মুড়ে আসনে বসা অবস্থায় কেউ মুসলিমদের নমাজ পড়ার ভঙ্গিতে উবু হয়ে রয়েছে। মাথাটা ঝুঁকে মাটিতে ঠেকেছে। সবার আগে চত্বরে উঠলেন কর্নেল। বললেন, হুঁ–যা ভাবছিলাম।
খগেনবাবু ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, বোকা! বোকা! অত করে বললাম ভদ্রলোককে।
যদুপতিবাবু চারধারে টর্চের আলো ফেলছিলেন। বললেন, বিশ্বাস? জীপ নিয়ে যাও। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এস সঙ্গে।
কর্নেল ঝুঁকে টর্চের আলোয় হতভাগ্য লোকটিকে দেখছিলেন। পিঠে তিনটি ক্ষতচিহ্ন। রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। কর্নেল বললেন, মারা গেছেন সঙ্গে সঙ্গে। খুনী শরীরের ভাইটাল পয়েন্টগুলো ভালই জানে।
এদিন আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে অস্বাভাবিক গম্ভীর এবং অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকতে দেখছিলাম। আমার কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি। যেন আমার কথা ওঁর কানে ঢুকছিল না। গতিক দেখে মুখ বন্ধ করেছিলাম। চুপচাপ দেখে যাচ্ছিলাম ওঁর ক্রিয়াকলাপ।
ওঁর সারাটা দিনের গতিবিধি ও ক্রিয়াকলাপ বর্ণনা করতে গেলে আরব্য উপন্যাস হয়ে যাবে। ডাইরীতে যেভাবে লিখে রেখেছিলাম, সেভাবেই সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরছি।
…সাড়ে সাতটায় কর্নেলের ডাকে নিদ্রাভঙ্গ। রাতের সেই বীভৎস ঘটনার পর মন বিভ্রান্ত। গোয়েন্দাপ্রবর অভ্যাসবশে সম্ভবত প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছেন। দাড়িতে সাদা কী লেগে আছে। পাখির পালক? বিষণ্ণ হেসে ফেলে দিলেন। ভীষণ গম্ভীর হাবভাব। রাজবাড়িতে ব্রেকফাস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। রেডি হতে তাড়া দিলেন। তারপর আপন মনেই বললেন, আশ্চর্য জয়ন্ত! আজও ভৈরবমন্দিরের ত্রিশূলে রক্তের নতুন দাগ ফুটে উঠেছে। চমকে উঠলাম শুনে। এ নিশ্চয় অলৌকিক কাণ্ড।
আটটায় রাজবাড়ির গাড়ি এল। রাজবাড়ি ভৈরবমন্দিরের পেছনে। রাজবাহাদুর সুপ্রতাপ সিংহ অমায়িক মানুষ। খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসেন। কর্নেলের মতোই প্রকৃতিবিদ্যার বাতিক আছে। কত রকম দুপ্রাপ্য অর্কিড, ক্যাকটাস, আরও বিচিত্র গাছগাছড়ার সংগ্রহ আছে। ছোট্ট একটি চিড়িয়াখানাও আছে। বেশি নেশা পায়রার। পৃথিবীর নানাদেশের পায়রা পুষেছেন। কথায় কথায় কর্নেল জানতে চাইলেন, মুসিলিটা ক্যালিটা (শব্দ দুটো এরকমই মনে হল) জাতের পায়রা আছে নাকি। রাজাবাহাদুর মুচকি হেসে চোখ নাচিয়ে বললেন, আসুন। দেখে যান। কাঠের খাঁচার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। গম্ভীর গলায় মেঘে বলে সে কী রাজকীয় হাঁক। বাড়ি কেঁপে উঠল। উঁকি মেরে দেখি, একটা সাদা পায়রা ঝিম ধরে বসে আছে খাঁচায়। ঢ্যাঙা নোগা মত এক ভদ্রলোক এলেন। মাথায় নীল টুপি, গায়ে স্পোর্টিং গেঞ্জি, পরনে আঁটো প্যান্ট, হাতে একটা ছড়ি। এসেই গাল চুলকে বললেন, তোমাকে খবর দিতে যাচ্ছিলাম। কাল বিকেলে ওড়াবার সময় মাদীটা বেশি দুরে চলে গিয়েছিল। ভাবলাম, সন্ধ্যার মুখে ফিরে আসবে। বোমের মাথায় লাল আলোটা জ্বেলে নাড়াচাড়া করলাম। ফিরে এল না।
রাজবাহাদুর খাপ্পা হয়ে বললেন, ব্যস! গেল। টাকাকে টাকা, পরিশ্রমকে পরিশ্রম!
মেঘেন্দ্রবাবু বললেন, বাজপাখির পাল্লায় না পড়ে তো ফিরে আসবে। এতদিন ধরে ট্রেনিং দিচ্ছি। বেঁচে থাকলে ফিরতেই হবে। আর যদি নাই ফেরে, কথা দিচ্ছি–আমি এর একটা জোড়া এনে দেব।
রাজাবাহাদুর পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেঘেন্দ্রলাল ঘোষ। ওঁর শ্যালক। একসময় সার্কাসে ছিলেন। নানা ঘাটের জল খেয়েছে জীবনে। চিরকুমার মানুষ। চেহারায় জীবনসংগ্রামের পোড়-খাওয়ার ছাপ স্পষ্ট। রাজাবাহাদুর শ্যালকের হাতে পশু পাখির দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। মনে হল, শ্যালককে খুব স্নেহ করেন।
চিড়িয়াখানা থেকে ফের ড্রইংরুমে। কর্নেলের সঙ্গে রাজাবাহাদুরের পায়রা নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা। তারপর এল খুনোখুনির প্রসঙ্গ। রঞ্জন আঢ্যির কথা উঠতেই রাজাবাহাদুর মুখ বিকৃত করে বললেন, ওই সুদখোরটার এমন পরিণতি স্বাভাবিক। বুঝলেন না? নকশালরা আবার অ্যাকশানে নেমেছে।
কর্নেল বললেন রঞ্জন আঢ্যি সুদখোর নাকি?
হ্যাঁ। তাছাড়া যে কটা লোক মারা পড়েছে, সব কটাই সুদখোর। মহাজনী কারবার ছিল।
কিন্তু নবারুণবাবু? উনি তো রিটায়ার্ড মাইন ইঞ্জিনীয়ার!
হাসলেন রাজাবাহাদুর। নবারুণও তো সুদখোরের বংশ মশাই! রক্তে ওটা আছে। শুনেছি, সেও টাকা ধার দিত খনিশ্রমিকদের। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা, বুঝলেন না? খনিশ্রমিকরা নেশাভাঙ করে আর জুয়া খেলে ফতুর হয়। নো প্রপার এডুকেশান, নো হেলদি অ্যাটমসফিয়ার। ওদের দোষ কী?
কিন্তু তাহলে কাপালিক সাধুর ব্যাপারটা কী মনে হয় আপনার?
ছদ্মবেশী নকশাল-স্কোয়াড। রাজাবাহাদুর রায় দিলেন। আমার ডাইরীতে পরবর্তী অংশ ফের সংক্ষিপ্ত।..রাজাবাহাদুরের কাছে বিদায় নিয়ে পুলিস স্টেশন। সেখানে কর্নেল-যদুপতিবাবুর দুর্বোধ্য গোপন মন্ত্রণা। ডাকবাংলোতে প্রত্যাবর্তন। আমার পুনঃপুনঃ প্রশ্ন। কর্নেলের উৎকট নীরবতা। আমি খাপ্পা। কর্নেলের চোখ বুজে কিয়ৎক্ষণ ধ্যান। তারপর হঠাৎ নিষ্ক্রমণ। প্রশ্নের জবাব পেলাম না।
বেলা একটায় কর্নেলের ফোন। লাঞ্চটা যেন আমি একা সাবাড় করি। এবং বিকেল চারটেয় যেন থানায় যাই রহস্যের পর্দা উন্মোচন দেখতে যদি আমার আগ্রহ থাকে।