দময়ন্তী
মহাকরণের প্রতি দপ্তরের প্রতি টেবিলে এখন কম্পিউটার। নিয়মিত ট্রেনিং এবং ওরিয়েন্টেশান প্রোগ্রাম হয়, কিন্তু মেশিনটিকে মনোজ সন্দেহের চোখে দেখেন। কয়েক দশক আগে, যুবা বয়সে অটোমেশানের বিরুদ্ধে মিছিলে স্লোগান দিয়েছেন। আজ সেই মেশিন তাঁর টেবিল আলো করে বসে থাকবে, এটা ভাবতে অসুবিধে হয়। মনোজ একদমই টেক-স্যাভি নন।
কিন্তু কী আর করা যাবে? যে পুজোর যে মন্ত্র। ই-গর্ভন্যান্স নিয়ে একের পর এক সরকারি নির্দেশ আসছে। না শিখলেই নয়। সহকর্মীরা তো সব শিখে নিয়ে দেদার তাস খেলছে। বাধ্য হয়ে মনোজ হাত পাকাতে গেলেন।
গুগলে প্রথম কয়েকদিন স্তানিস্লাভস্কি, ব্রেখট, সফদার হাশমি, শম্ভু মিত্র— এইসব সার্চ দিয়ে বোর হয়ে গেলেন মনোজ। একদিন লিখলেন, ‘সেক্স’। মনোজ জানতেন না, এই শব্দটা গুগলে সার্চ করা ‘মোস্ট কমন কি ওয়ার্ড’। এর পরেই দিগন্ত খুলে গেল। সরকারি ওরিয়েন্টেশান প্রোগ্রাম, ট্রেনিং আর টিউটোরিয়াল যা শেখাতে পারেনি—ভারচুয়াল যৌনতা এক সপ্তাহে সে সব শিখিয়ে দিল। বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই। বিলুর কম্পিউটারে হাতমকশো করতেন। ওয়েব-হিসট্রি কীভাবে মুছতে হয় শিখে গেছেন।
দ্বিতীয় সপ্তাহে সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের খপ্পরে পড়লেন মনোজ। সবাই যেমন খোলে, ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে, একে তাকে ফ্রেন্ডস রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে আর ট্যাগ করে, ভুলভাল স্ট্যাটাস মেসেজ লিখে, অন্যদের আপলোড করা ছবিতে ‘লাইক’ দিয়ে বোর হতে হতে একদিন এক ‘ফ্রেন্ড’-এর প্রোফাইল থেকে সন্ধান পেলেন ‘ইন্ডিয়ান ডেটস’ নামের এক নিরীহ ওয়েবসাইটের।
ফেসবুকের সূত্রে প্রোফাইল খোলার অ-আ-ক-খ জানা ছিল। এখানে মাথা খাটিয়ে সবটা আবার বানাতে হল। দু’নম্বরি মেল আইডি বানানো দিয়ে কাজ শুরু। ইউজার নেম দিলেন ‘ম্যাচিওরড হটি’। বয়স লুকোনোর কোনও মানে হয় না। তাই ‘ম্যাচিওরড’। আর শারীরিক সক্ষমতা বোঝাতে ‘হটি’।
এবার ফোটো। মনোজ একবার ভাবলেন ছবি দেবেন না। চেনাশুনো কেউ এই সাইটের মেম্বার হলে কেলেঙ্কারির একশেষ! কিন্তু ক্যালকাটা ডেটস পরামর্শ দিল, ফোটো দিলে বন্ধু পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সবদিক ভেবে নাটকের মেক আপ করা একটা ফোটো আপলোড করলেন মনোজ। এডিট করে ছবিটাকে ঝাপসা করে দিলেন। লম্বা-চওড়া, সাজোয়ান চেহারা দাড়ি-গোঁফের আড়ালে ঢাকা। চোখে সুর্মা, পরনে পাঠান-পোশাক। নিজেকে দেখে নিজেই ইমপ্রেসড মনোজ!
ক্যালকাটা ডেটস পেশা জানতে চাইছে। কায়দা করে মনোজ লিখলেন, সিভিল সার্ভেন্ট।
পরের প্রশ্ন, রিলিজিয়ন? সঙ্গে একগাদা অপশন। এইরকম একগাদা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরে ক্যালকাটা ডেটস জানতে চাইল, ‘প্যাশন?’
এইখানে থমকালেন মনোজ। অপশনের মধ্যে থেকে বেছে নিলেন, ‘থিয়েটার।’
‘পার্টনারের সঙ্গে কী করতে চাও?’
অপশনে আছে ‘চ্যাটিং, ফ্রেন্ডশিপ, ইটিং আউট, রোম্যান্টিক রঁদেভ্যু, নো-স্ট্রিংস-অ্যাটাচড ফান।’
শেষটা পছন্দ হল মনোজের। এটাই থাক। ডেটিং-এর ভাষায় ‘এনএসএ ফান’। এইভাবেই পঞ্চাশোর্ধ ‘ম্যাচিওর্ড হটি’-র ‘এনএসএ ফান’-এর আবেদন ছড়িয়ে পড়ল ‘ক্যালকাটা ডেটস’ জুড়ে। এবং প্রথম চব্বিশ ঘণ্টাতেই বাজিমাত! ছাব্বিশ বছরের ‘লেডিলাভ’ মেসেজ পাঠিয়েছে, ‘থিয়েটার ইজ ইওর প্যাশন? রিয়্যালি?’
এক সপ্তাহের ভারচুয়াল বন্ধুত্ব। মাইলের পর মাইল লম্বা চ্যাট। অবশেষে ডালহৌসিতে মনোজ ও ঋষিতা দেখা করল। আকাশি-নীল ফেডেড জিনস, ময়ুর-নীল ক্রাশড কটনের কুর্তি আর গোলাপি স্নিকার পরে লালদিঘির ধারে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা। ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট ধরে ধর্মতলার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, সে শেয়ালদা চত্বরে থাকে, জেরক্স-ল্যামিনেশান-স্পাইরাল বাইন্ডিং-ডিটিপির ব্যবসা চালায়, বাড়িতে দাদা-বউদি আছে। বাবা-মা নেই। বিয়ে হয়েছিল। স্বামী অ্যালকোহলিক, ইমপোটেন্ট এবং ঠ্যাঙাড়ে। যেমন অধিকাংশ মেয়ে করে, সংসার ধরে রাখার জন্য সেই মক্কেলকে এক বছর সহ্য করেছিল ঋষিতা। তারপর বেরিয়ে আসে। এখন প্রেম বা বিবাহে রুচি নেই। শারীরিক চাহিদা মেটানোটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে যাচ্ছে। মাসের বিশেষ কয়েকটা দিন, ঋষিতার ভাষায়, ‘আমাকে দিনে একাধিকবার ডিলডো ব্যবহার করতে হয়। ফ্যান্সি মার্কেটের কালেকশান ভালো। এখন অবশ্য শপিং মলগুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে।’
মনোজের কাছে একটা অজানা জগৎ খুলে গিয়েছিল। বিবাহিত জীবনে অরুণা ছাড়া অন্য কোনও নারীতে উপগত হননি। থিয়েটারের সূত্রে অল্পবিস্তর ছোঁয়াছুঁয়ি—ওটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। মধ্য-চল্লিশ থেকেই আর ইচ্ছা জাগত না। ঋষিতার সঙ্গে কার্জন পার্কের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যৌবনবেলার মতো পুরুষাঙ্গের ধকধকানি টের পেয়েছিলেন মনোজ। বুঝেছিলেন, কিছুই চলে যায়নি। ক্লান্ত মগজ অন্য কিছু চাইছে। অন্তর্জাল সেই সুযোগ এনে দিয়েছে।
‘আমি আপনার কাছে এনএসএ ফান ছাড়া আর কিছু চাইছি না।’ ধর্মতলার মোড়ে, লেনিনের স্ট্যাচুর উলটোদিকের ফুটপাথের দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে ঋষিতা বলেছিল, ‘সেক্স এর সাইড এফেক্ট হল, এর থেকে প্রেম হয়। লাভ ইজ আ সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ। সেটা থেকে প্রোটেকশান নিতে হবে। না হলে বিপদ আপনার। ফ্যামিলি ভেসে যাবে।’
‘আমাদের সম্পর্কের কী নাম হবে?’ মৃদু স্বরে জানতে চান মনোজ।
‘ওফ! টিপিক্যাল বাঙালি মধ্যবিত্তদের মতো কথা বলবেন না তো! আমার ইরিটেটিং লাগে। আমি আপনার বউ নই, বোন নই, মা নই। পরস্ত্রী বা রক্ষিতাও নই। ফাক-বাডি বলতে পারেন। নামে কী আসে যায়?’
ফাক-বাডি! নতুন একটা শব্দ শেখা হল। মুচকি হেসে মনোজ বললেন, ‘কোনও বাংলা প্রতিশব্দ পাচ্ছি না। কাছাকাছি একটা শব্দবন্ধ পেলাম। ‘লাগ-সই’। চলবে?’
হাহা করে হেসে ঋষিতা বলেছিল, ‘চলবে কি মশাই? দৌড়বে। তবে আপনি কেমন দৌড়ন, এটা জানা খুব দরকার।’
‘আর আমার যেটা জানার দরকার, সেটা হল, তুমি তোমার বয়সি কোনও ফাক-বাডি খুঁজছ না কেন? তোমার পছন্দের মানুষের যে প্যারামিটার দিয়েছ, তাতে লেখা আছে ম্যাচিওরড, মুসট্যাশড মেল, প্রেফারেবলি ইন দেয়ার গোল্ডেন ফিফটিজ! কেন?’
বয়কাট চুল ঝাঁকিয়ে ঋষিতা বলেছিল, ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষ প্রতিবার তার যৌনক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জীবনের প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার কাছে ফিরে যেতে চায়। আমিও হয় তো তাই চাইছি।’
‘তুমি জীবনে প্রথমবার একজন ফিফটি প্লাসের সঙ্গে সেক্স করেছিলে? তখন তোমার বয়স কত?’
‘তখন আমার বয়স তেরো। উনি আমার জ্যাঠা ছিলেন। মারা গেছেন।’
মনোজ স্তব্ধ হয়ে ডাস্টবিনের দিকে তাকিয়েছিলেন। এসব জিনিস তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে। তাঁর এখান থেকে পালাতে ইচ্ছে করছে। চুলোয় যাক ভারচুয়াল ডেটিং। চুলোয় যাক ঋষিতা। যৌনতাবিহীন জীবন কাটাতে তাঁর কোনও অসুবিধে হবে না।
মেয়েরা সব বোঝে। ঋষিতাও বুঝেছিল। সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছিল সে। থিয়েটার নিয়ে তর্ক লাগিয়েছিল। শ্যামবাজারের থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার, বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার, নাটককে সময়ের কাছে কতটা দায়বব্ধ থাকতে হয়, সরকারের ধামা ধরে থিয়েটার চলে কি না—এইসব নিয়ে আলোচনা করতে করতে দু’জনে হেঁটে মৌলালি পৌঁছেছিল। মোহিত চট্টোপাধ্যায় নাটকের লিরিসিজম নিয়ে কথা বলতে বলতে বিশাল তিনতলা বাড়ির সামনে পৌঁছেছিল দু’জনে। একতলায় কাঁসা-পেতলের বাসনের দোকান, মোবাইল সারাইয়ের দোকান, জেরক্স-ল্যামিনেশান-স্পাইরাল বাইন্ডিং -ডিটিপির অফিস। কুড়ি-একুশ বছরের এক ছোকরা অফিস সামলাচ্ছিল। ঋষিতা তাকে বলল, ‘পাপ্পু, যা। তোর আজ ছুটি। আমরা এখন কাজ করব।’
‘থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।’ পাপ্পু দৌড় দিল। রোলিং শাটার নামিয়ে, কাচের স্লাইডিং ডোরে তালা মেরে ঋষিতা বলল, ‘মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘সুন্দর’ দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ। অনেকবার। আবারও দেখব।’ ঋষিতার চুলের মুঠি ধরে সপাটে, অথবা সাপটে চুমু খেলেন মনোজ। এত তীব্র যৌন উত্তেজনা অনেক দিন, অনেক মাস, অনেক বছর অনুভব করেননি তিনি।
‘আমি কিন্তু ট্যাবলেট খাই না।’ জিনস খুলতে খুলতে বলল ঋষিতা।
‘ও!’ ঋষিতার জিনসের জিপার খুলতে খুলতে বলেছিলেন মনোজ, ‘তুমি কি তাহলে আরও অনেকের…’
‘শশশ! আমার নাম ‘লেডিলাভ’! আপনার নাম ‘ম্যাচিওরড হটি’। এর বেশি কিছু জানার প্রয়োজন নেই।’ ঠোঁট দিয়ে মনোজকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল ঋষিতা। পরবর্তী আধঘন্টা ধরে এমন সব ঘটনা ঘটিয়েছিল, যা মনোজ একমাত্র নীল ছবিতে দেখেছে। কখনও অরুণার জন্য অপরাধবোধে ভুগতে,কখনও ‘অরুণা কেন এসব পারে না তাহলে আমাকে ঋষিতার কাছে আসতে হতো না’ রাগে ফুটতে ফুটতে, পঞ্চাশোর্ধ্ব মনোজ নিজের হারিয়ে যাওয়া যৌবন পুনরাবিষ্কার করছিলেন। যৌন প্রহার করার সময় একটা মেয়েকে যন্ত্রণা আর আনন্দে একটানা ছটফটাতে দেখলে কী আনন্দ যে হয়! বিশেষত সে যদি হয় পঁচিশ বছরের ছোট!
যৌনস্নানের শেষে অনেক্ষণ শুয়ে রইলেন মনোজ। অনেক কাল এইরকম ঝোড়ো যৌনতার অভ্যেস নেই। বেদম হয়ে পড়েছেন।
ঋষিতাই আগে বিছানা ছাড়ল। বাথরুমে ঘুরে এল। টপাটপ জিনস আর কুর্তি গলিয়ে, ব্যবহৃত কন্ডোম প্যাকেটে পুরে মনোজের ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, ‘কফি করছি। আপনি রেডি হয়ে নিন।’
মনোজের ওঠার ইচ্ছে ছিল না। জোর করে উঠলেন। আয়নায় দেখে নিলেন কোনও দাগটাগ আছে কি না। ঋষিতা বড্ডো কামড়ায়। স্নান সেরে জামা প্যান্ট গলিয়ে, কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তুমি কি অফিসেই থাকো?’
‘আমার বাড়ি আনসারুদ্দিন স্ট্রিটে। সারা দিন অফিসে কাটাতে হয় বলে শোওয়ার ব্যবস্থা রেখেছি। দুপুরে একঘণ্টা গড়িয়ে নিই।’
‘তোমার দাদা কী করেন?’
‘আপনার বড্ড কৌতূহল। নেহাত আসল কাজটা ভালো পারেন, তাই উত্তর দিচ্ছি। না হলে স্ট্রেট ফুটিয়ে দিতাম। এখান থেকে বেরিয়ে মৌলালির দিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা রেস্তোরাঁ পাবেন। নাম রোম্যানো স্যান্টোস। আমার দাদা ওটার মালিক।’
‘রোম্যানো স্যান্টোস? ভারি অদ্ভুত নাম তো!’
‘বোকাবোকা নাম। ভালো চলে অবশ্য। চাইনিজের কোয়ালিটি খুব ভালো। আপনি দয়া করে যেন কিছু কিনতে ঢুকবেন না।’
‘আচ্ছা।’ চুল আঁচড়ে অফিস থেকে বেরোয় মনোজ। পিছন থেকে ঋষিতা বলে, ‘আমি ফোন না করলে আপনি আমাকে ফোন করবেন না। ঠিক আছে?’
‘এ আবার কী রকম একপেশে নিয়ম?’ হাসতে হাসতে বলেছিলেন মনোজ। ‘যদি করি তা হলে কী হবে?’
‘আপনার বাড়ি গিয়ে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে আসব।’ হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিল ঋষিতা। ‘যখন স্নান করছিলেন, তখন মোবাইল থেকে আপনার বাড়ির ল্যান্ডলাইন নম্বরটা লিখে রেখেছি। টু সিক্স ফাইভ ফোর হাওড়ার এক্সচেঞ্জ, তাই না?’
মনোজ নিঃশব্দে তিনতলা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। ঋষিতাকে আর ফোন করেননি। ক্যালকাটা ডেটস ওয়েবসাইট থেকে নিজের প্রোফাইল ডিলিট করে দিয়েছিলেন। মোবাইল থেকে মুছে দিয়েছিলেন ঋষিতার নম্বর। এই বয়সে অ্যাডভেঞ্চার ভালো নয়। সংসার নষ্ট হয়ে যাবে। নাটকের রিহার্সাল আর জীবন সংগ্রামের কল শোতে বেশি বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন।
ফোন এল এক সপ্তাহ বাদে, দুপুরবেলায়। মনোজ তখন মুড়ি আর শসা দিয়ে টিফিন করছিলেন। ঋষিতার মোবাইল নম্বর ডিলিট করে দিলেও শেষের তিনটে সংখ্যা মনে ছিল। ওরই ফোন এসেছে সেটা বুঝেও মনোজ বললেন, ‘হ্যালো?’ সম্বোধনের শেষে জিজ্ঞাসা চিহ্ন।
‘ঋষিতা বলছি। আগামিকাল সন্ধে সাতটা।’ ফোন কেটে গিয়েছিল।
মুহূর্তের মধ্যে যাবতীয় সংকল্প এক ফুঁয়ে উড়ে গেল। ঋষিতার গলার আওয়াজ শুনে প্যান্টের ভিতরে পুরুষাঙ্গ নড়াচড়া শুরু করেছে।
পরের দিন দেরি করে বাড়ি ফিরে অরুণাকে নাটক নিয়ে প্রথম মিথ্যেটা বলেছিলেন মনোজ। যে, কল শো ছিল। সেটা না বললে দেরি করে ফেরার ব্যাখ্যা দেওয়া যেত না। তারপরে অনেক বার মিথ্যে বলতে হয়েছে। কেন না দুপুরবেলা মনোজের পক্ষে অফিস কাটা সম্ভব হলেও ঋষিতার পক্ষে পাপ্পুকে দুপুরবেলা দোকান থেকে বার করে দেওয়া অসম্ভব। অগত্যা সন্ধেবেলা। পাঁচটায় অফিস শেষ হলে ইউনিয়ন রুমে নাটকের রিহার্সাল দিতে হয়। ঋষিতার কাছে যাওয়ার দিন আধঘন্টা আগে বেরোন মনোজ। সন্ধেবেলার অফিসপাড়ার যানজট পেরিয়ে এন্টালি পৌঁছতে সওয়া সাতটা। ঋষিতার ওখান থেকে বেরোতে কখনও আটটা, কখনও সওয়া আটটা। বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়।
কয়েকবার মেলামেশার পরে ঋষিতা অনেক সহজ হল। কথাবার্তার সূত্রে মনোজ জানতে পারলেন, সে-ও একটা নাটকের গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। মূলত ঋষিতার উদ্যোগেই জীবন সংগ্রাম এন্টালিতে সফদার হাসমির ‘হল্লা বোল’ পারফর্ম করে গেছে। সেই নাটকের দিনই বিপদটা হয়েছিল।
মনোজ তখন অভিনয় করছেন। মোবাইল রাখা ছিল ঋষিতার কাছে। বারবার ফোন আসায় ঋষিতা ফোন ধরেছিল। ঋষিতার যুক্তি খুবই স্বাভাবিক। মনোজ যখন অভিনয় করছেন, তখন যে কেউ তাঁর ফোন ধরতে পারে।
মনোজ ঋষিতাকে অরুণার সন্দেহবাতিক আর শুচিবায়ুর কথা বলেননি। থেকে থেকেই অরুণা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঋষিতার কথা জিজ্ঞাসা করেন। মনোজ শান্তভাবে বারকয়েক উত্তর দিয়েছেন। তারপর একবার রেগে গেছেন। মনোজ ভেবে দেখেছেন, যে কোনও হাজব্যান্ড এইরকম আচরণ করবে।
কেসটা গুবলেট হয়ে গেল জগদ্দলের নাম করায়। সন্ধে সাতটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত ঋষিতার কাছে কাটিয়ে মনোজ কী করে জানবেন যে শেয়ালদা মেইন লাইনে ট্রেন বন্ধ? আর এমন কপাল, সেদিন তিনি ফিরেছেন শেয়ারের ট্যাক্সিতে। রাস্তাঘাটে এ নিয়ে কোনও আলোচনা শুনতে পাননি।
আগের থেকে অনেক সাবধান হয়েছেন মনোজ। ঋষিতাকে বারবার বলে সময়টা সাতটার বদলে পাঁচটায় নামিয়েছেন। তা হলে সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি ঢোকা যায়। অরুণাকেও সময় দিতে হচ্ছে। বিরক্তিকর হলেও, এতে অরুণা অনেকটা ভালো আছে। সন্দেহবাতিক খানিকটা কমেছে। এই বয়সে এসে প্রতি সপ্তাহে পুরনো বউ ঘাঁটাঘাঁটির মতো বোরিং কাজ আর কিছু হয় না।
গতরাতে অরুণাকে যান্ত্রিক আদর করতে করতে মিজারেবলি ফেল করেছেন মনোজ। আজ অফিসে তাই ডিপ্রেসড ছিলেন। কাজে মন নেই, আড্ডায় অংশ নিচ্ছেন না, টিফিনে রুচি নেই। থেকে থেকেই মনে হচ্ছে, এই তা হলে বার্ধক্যের শুরু? তা হলে কি মাংকি ক্যাপ পরে, হাতে লাঠি নিয়ে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটার দিন সমাগত? ছানি, ব্লাড সুগারের ওষুধ, কোষ্ঠ সাফ করার দাওয়াই, বাঁধানো দাঁত—চোখের সামনে একের পর এক ছবি ভাসছে। এমন সময় ঋষিতার ফোন এল। ‘পাঁচটা নাগাদ আসবে নাকি? পাপ্পুকে আজ আগে ছেড়ে দিলাম!’
দু’পায়ের ফাঁকে রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে। খসখসে গলায় মনোজ বললেন, ‘যাব। আজ দু’বার হবে।’
‘ও মা কেন?’ হাসতে হাসতে বলে ঋষিতা। ‘বউ আজকাল দিচ্ছে না?’
ফোন কেটে দেন মনোজ। দ্রুত বাকি কাজ শেষ করেন। শরীর গরম, কান গরম, গাল গরম। মাথায় চিড়িক চিড়িক করে ফুলকি ছড়াচ্ছে আদিম রিপুর আগুন। শরীর আজ অসহায়ভাবে শরীর চাইছে।
সাড়ে চারটেয় অফিস থেকে বেরিয়ে, পাঁচটার সময় মৌলালি পৌঁছলেন মনোজ। এন্টালির তিনতলা বাড়িটায় যখন ঢুকছেন, তখন ন্যাপস্যাক কাঁধে, চশমা পরা একটা মেয়ে তার পাশ দিয়ে হেঁটে দোতলায় সিঁড়ির দিকে গেল। কানে মোবাইল। মনোজ শুনতে পেলেন, মেয়েটা বলছে, ‘দ্যাখো বিলুদা, প্রচুর চাপের মধ্যে আছি। এখন আমাকে আর পরোপকার করতে বোলো না।’
‘রোববার একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প করবি, তার মধ্যে চাপ নেওয়ার কী আছে? ঠিক হ্যায়। সাপ্লির পরেই কথা হবে।’ ফোন কেটে দিয়েছে বিলু। মোবাইল বন্ধ করে টকাটক সিঁড়ি টপকে দোতলায় ওঠে দময়ন্তী। বিলুর ওপরে অত্যন্ত বিরক্ত সে। রেস্তোরাঁয় ডেকে পলিটিকাল জ্ঞান দেওয়ার জন্য তো বটেই, গোপাল নস্করের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্যও। বিলুকে তার ভালোই লাগে। তবে রাজনীতির কথা বললেই ভালো লাগা উড়ে যায়। একটাই কথা মনে হয়। স্কাউন্ড্রেল। রাজনীতি যাদের শেষ আশ্রয়।
অবশ্য, দময়ন্তীর বিলুকে ভালো লাগে তার ওই রাজনৈতিক চালচিত্রের জন্যই। আজকের জমানায় একটা ছোকরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে, সততার সঙ্গে গরিবদের কথা ভাবছে। এর মধ্যে কোনও ভণিতা বা ওপর চালাকি নেই। জুনিয়রদের বিপদে সব সময় এগিয়ে আসে। পড়াশুনোর পাশাপাশি দেশ-দুনিয়ার জন্য ভাবে। এই জন্যই বিলু ভালো। দময়ন্তীর অ্যানাটমিতে সাপ্লি আটকানোর জন্য বেচারা অনেক চেষ্টা করেছিল। এনজি একবগগা। রাজি হননি। সুরজকেও ফেল করিয়ে পাপস্খালন করেছেন। সুরজের হয়ে ন্যাবারা এনজিকে নানা ভাবে চমকেছিল। ফোনে, সরাসরি দেখা করে, অ্যাডমিনিস্ট্রিশানের মাধ্যমে। এনজি সিদ্ধান্ত বদলাননি। কুৎসিত গালিগালাজ শুনতে শুনতে কলেজ ছেড়েছেন। সুরজ চমকেছে, সাপ্লিতে পাস না করালে এনজির ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেবে। এরা এখনও ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেনি। এখনই এই অবস্থা। যদি সত্যিই নবযুগ ক্ষমতায় আসে, তখন না জানি কী হবে!
গোপাল নস্কর আর এক ঘরের-খেয়ে-বনের-মোষ-তাড়ানো পাবলিক। এক রবিবারে দময়ন্তীকে টানতে টানতে নতুনগ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন। দময়ন্তীর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। সাপ্লির টেনশান, মোটামোটা অ্যানাটমি বইগুলো আবার পড়া, আবার ডিসেকশানের জন্য ক্যাডাভার দেখা, আবার সারফেস মার্কিং প্র্যাকটিস—এইসব অশান্তির মধ্যে পরোপকার করতে ভালো লাগে?
তবে নতুনগ্রাম পৌঁছে দিব্যি লাগল। শান্তিনিকেতনের বাইরে বাংলার কোনও গ্রাম দেখেনি দময়ন্তী। শান্তিনিকেতনও আর গ্রাম নেই। গাদাগাদা বাড়ি, হোটেল আর রিসর্ট মিলিয়ে শ্যামবাজারের মতো চেহারা হয়েছে। সে তুলনায় নতুনগ্রাম অনেক ভালো। মেচেদা-নতুনগ্রাম সড়কের দু’পাশে সারসার পাকা বাড়ি। শহর-শহর ভাব। পাকা বাড়ির ফাঁক দিয়ে চারপা এগোলেই দিগন্ত বিস্তৃত ধানখেত। আকাশ কতটা নীল, ঘাস কতটা সবুজ আর বাতাস কতটা বিশুদ্ধ হতে পারে—দময়ন্তীর ধারণা ছিল না।
দময়ন্তী যতটা সুন্দর আর পবিত্র ভেবেছে, নতুনগ্রাম নিশ্চই অতটা ‘ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড়’ নয়। এখানেও ঘরোয়া কোঁদল আছে, পঞ্চায়েতের দাদাগিরি আছে, রাজনীতির আর্ম-টুইস্টিং আছে, শ্যালোর জলে আর্সেনিক আর ফসলে কীটনাশকের বিষ আছে। তবে প্রথম দর্শনে সেসব চোখে পড়েনি। গোপাল নস্করের বাড়ি বাঁজাপলাশ গ্রামে। হেলথ সেন্টার ছাড়া এটা এই গ্রামের একমাত্র পাকা বাড়ি। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, দোতলা। ভদ্রলোক বিয়ে-থা করেননি। একগাদা কমবয়সি ছোকরা বাড়িতে থাকে। তারা কী করে বুঝতে পারেনি দময়ন্তী। ছেলেগুলো পড়াশুনা করছে, রান্নাবান্না করছে, নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টা করছে। সন্ধে নাগাদ আগুন জ্বেলে তার চারদিক ঘিরে গোল হয়ে বসে গানবাজনাও করছে। গোপাল বলেছিল, বাড়িটা কমিউন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরা ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টির ছেলে। অন্য রাজ্যের ছেলেও আছে। নিজের বৃত্তের বাইরে এরা একদমই কথা বলে না।
বাঁজাপলাশ গ্রামের সব্বাই বামন—এটা দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল দময়ন্তী। গোপাল বলেছিল, এরা সবাই একই জেনেটিক রোগে আক্রান্ত। ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে করে এমন হয়ে গেছে। যে কয়েক ঘর লম্বা মানুষ ছিল, তারা বাঁজাপলাশ ছেড়ে চলে গেছে। এরা পেশাগত ভাবে জেলে। পাশাপাশি এই গ্রামের লোকের হাতে যাদু আছে। তারা ভালো রান্না করে, ভালো জরির কাজ জানে, হিরে পালিশের কাজ জানে। তারা সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে। লেখাপড়া শেখে না বলে দেদার এক্সপ্লয়েটেড হয়। বারো-তেরো বছরে বাড়ি ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। কুড়ি বছরের আশেপাশে গ্রামে ফিরে একটা মেয়েকে বিয়ে করে, গর্ভবতী বানিয়ে কাজের জায়গায় ফেরত যায়। বছরে বা দুবছরে একবার বাড়ি ফিরে সন্তানের মুখ দেখে, বউকে আবার গর্ভবতী করে আবার কাজের জায়গায় ফেরত যায়। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত এই রুটিন চলে। তার পরে শরীর নেয় না। জরি আর হিরে শিল্পে যারা আছে, তাদের চোখ খারাপ হয়ে যায়। অন্যরা শারীরিক সক্ষমতায় পেরে ওঠে না। অগত্যা বাধ্যতামূলক অবসর। টাকা জমানোর জন্যে ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে যাওয়ার ধারণা এদের মধ্যে নেই। নন ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান ‘মায়াকম’-এর এজেন্ট এই গ্রামে রোজ আসে। বাঁজাপলাশের প্রতিটি বাড়ির টাকা জমা রাখা আছে মায়াকমে।
দময়ন্তী ডাক্তারির কী-ই বা বোঝে? ফার্স্ট এমবিবিএস-ও পাস করেনি। বিলু আর সব্যসাচী রোগী দেখেছিল, দময়ন্তী খাতায় লেখালেখি করছিল। বাঁজাপলাশ গ্রামের বাচ্চাদের মাথায় উকুন, গায়ে স্কেবিস, পেটে কৃমি, ভিটামিনের অভাবে বাচ্চাগুলো রাতকানা। অথচ এখানে হেলথ সেন্টার আছে। সেখানে কোনও ডাক্তারের পোস্টিং না থাকলেও সিস্টারের পোস্টিং আছে। হেলথ সেন্টার কখনও খোলে কখনও খোলে না। এখানকার গর্ভবতী মায়েরা রক্তাল্পতায় ভুগছে। জ্বরজারি, সর্দিকাশি, পেটখারাপ তো আছেই। গোটা পনেরো পেশেন্ট দেখার পর দময়ন্তী প্যাটার্ন বুঝে রোগী দেখা শুরু করল। দেখতে দেখতেই তাদের সঙ্গে গপপোগাছা। জেলে পরিবারগুলোয় এক সমস্যা। পলিউশানের কারণে সমুদ্রে মাছ কমছে। জেলের কাজ ছেড়ে পুরুষমানুষরা জনমজুরি ধরছে। সরকারের একশো দিনের কাজ খাতায় কলমে। বেশিরভাগ জোয়াকিম কাজ পায় না। পেলেও টাকা কম পায়। বউরা বাড়ির কাজ করে। পঞ্চায়েতকে বলেও বিপিএলের কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে সেটা এরা জানে না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে জনমোর্চা সরকারের জমি অধিগ্রহণের নোটিশ। এরা এতদিন ভাবত, কী খাব? এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কোথায় যাব?
নতুন দিল্লি ভারতবর্ষের রাজধানী। কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের কর্মস্থল। লন্ডন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহরগুলির মধ্যে পড়ে। এই সব জায়গায় ঘুরে বেড়ানো দময়ন্তীর কাছে বাঁজাপলাশ গ্রাম এক রিভিলেশন! আলোকোজ্জ্বল ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র তলায় মুখ লুকিয়ে থাকা, হতদরিদ্র ভারতবর্ষ। শপিং মল, পার্কোম্যাট, মাল্টিপ্লেক্স, থ্রি বিএইচকে কন্ডোভিলের ঝাঁ-চকচকে বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাচ্ছে অনাহারে অর্ধাহারে, অন্ধকারে, অশিক্ষায় ডুবে থাকা বাঁজাপলাশ গ্রাম। যে গ্রাম ভারতবর্ষের ভিত্তি।
দময়ন্তীর মাথা গুলিয়ে যায়। পাগল পাগল লাগে। সে আদ্যন্ত শহুরে মেয়ে। কলকাতা শহরের একটা ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম আছে, যার প্রেমে সে পড়ে গেছে। বাকি জীবন এই শহরেই কাটাবে। কিন্ত ওই গ্রাম তার জন্য নয়। আর ওখানে যাবে না। ওই বাস্তবতায় প্রবেশ না করে তার দিব্যি চলে যাবে। বিলুর কথায় নেচে, গোপালের উত্তেজক ভাষণে হিপনোটাইজড হয়ে পার্টি ক্যাডারে পরিণত হওয়ার জন্য সে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ঢোকেনি।
রবিবার অনেক রাতে বাঁজাপলাশ গ্রাম থেকে কলকাতায় ফেরার পরে অদ্ভুত এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। বাঁজাপলাশ গ্রামের কথা ভাবতে ভাবতে গোলঘরে নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিল দময়ন্তী। অ্যালোপাম না খেয়ে। অনেকদিন পর ওষুধহীন ঘুম। হয় তো সারাদিনের পরিশ্রমে শরীর কাহিল ছিল। হয় তো নতুন পরিবেশে গিয়ে মন শান্ত ছিল। যে কারণই হোক না কেন, দময়ন্তী ঘুমল। রবিবার রাত দশটা থেকে সোমবার সকাল ন’টা পর্যন্ত ওষুধ ও দুঃস্বপ্নহীন রেস্ট। ঘুমের শেষে নিজেকে কী ঝরঝরে যে লাগছিল! মনে হচ্ছিল, শান্তির সমুদ্রে অবগাহন হল।
আবার ওষুধ খাচ্ছে দময়ন্তী। সামনে সাপ্লি। চাপ প্রচুর। তার মস্তিষ্ক বলছে, ‘বাঁজাপলাশ গ্রামে আর যাবে না। ওই দুঃখ, দারিদ্র, অনাহার, কুসংস্কার দেখে তুমি যখন কিছু করতে পারবে না, তখন চোখ বন্ধ রাখো। ওরা ছিল, আছে, থাকবে। তুমি কেন মিথ্যে মিথ্যে কষ্ট পাবে?’
আর হৃদয় বলছে, ‘তোমার নিজের চিকিৎসা লুকিয়ে আছে বাঁজাপলাশে। তোমার সুশ্রুষা ওই অসুস্থ বাচ্চা আর তাদের মায়েরা। সাপ্লি চুকলেই চলে যাও গোপালের কমিউনে। বাচ্চা আর মায়েদের চিকিৎসা করো। তারপর ফিরে এসো। দেখবে, ওষুধহীন এক রাত ঘুম তোমার অপেক্ষায় রয়েছে।’
মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত দময়ন্তী সাপ্লির প্রিপারেশান নিতে থাকে।