» » সপ্তম পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

চন্দন

‘বন্ধুরা, একটা সহজ কথা সহজ করে বলে ফেলি। সেটা হল, আগামী পনেরোই অক্টোবর হোস্টেল বোর্ডাস কমিটির ইলেকশান। আজ সাতাশে সেপ্টেম্বর। হাতে দিন পনেরো আছে। তার মধ্যে অনেকটা সময় দুর্গাপুজো খেয়ে নেবে। কাজেই আজ রাত থেকে ইলেকশানের কাজ আরম্ভ করে দিতে হবে।’ গম্ভীর গলায় বলল রিপু।

‘সবে তো কাল রেজাল্ট বেরোল। একটু মস্তি করতে দাও।’ মিনতি করে সবুজ।

‘মস্তি করায় কেউ বাধা দিচ্ছে না। তোরা পার্টির হোল টাইমার নোস যে চব্বিশ ঘণ্টাই পলিটিকাল কাজ করবি। প্রতিদিন সন্ধেবেলা একঘণ্টা সময় দে। তাহলেই কাফি। যারা সাপ্লির প্রিপারেশান নেবে, তাদের একদম ডিস্টার্ব করা যাবে না।’

‘আমাদের কী করতে হবে সেটা বলবে তো!’ অধৈর্য হয়ে বলে সবুজ।

‘আমি বলছি।’ সিগারেট ধরিয়ে চন্দন বলে, ‘আমাদের বয়েজ হোস্টেল পাঁচতলা। প্রত্যেক তলায় চারটে উইং। প্রত্যেক উইং থেকে একজন ফ্লোর রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচিত হবে। অর্থাৎ আমাদের দল থেকে কুড়িজন ভোটে দাঁড়াবে। আমাদের ক্যান্ডিডেট যেমন নমিনেশান ফাইল করবে, তেমনি পিএমএফ, ন্যাবা এবং ছেঁদোরাও নমিনেশান ফাইল করবে। পিএমএফ-এর সব্যসাচী আর বিলুর সঙ্গে রিপুদা কথা বলেছে। যে যে ফ্লোরে পিএমএফ ক্যান্ডিডেট দেবে, সেখানে আমরা ক্যান্ডিডেট দেব না। এটা এক ধরনের নির্বাচনী সমঝোতা। ন্যাবা বা ছেঁদোপার্টির পক্ষে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা এখনও নেই। কিন্তু আমরা কোনও রিস্ক নেব না।’

‘পাশাপাশি,’ চন্দনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রিপু বলে, ‘ন্যাবা এবং ছেঁদোরা নিজেদের মধ্যে অ্যালি করেছে। যে ফ্লোরে ন্যাবারা প্রার্থী দেবে, সেই ফ্লোরে ছেঁদোরা ক্যান্ডিডেট দেবে না। তার মানে এই ইলেকশানে দ্বি-মুখী প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে। একদিকে মোচা আর পিএমএফ। অন্যদিকে ন্যাবা আর ছেঁদো। আমাদের কাজ খুব সিম্পল। প্রতি ফ্লোরের প্রতিটি বোর্ডারকে আমাদের ভোটার বানানো।’

‘তাই আবার হয় নাকি?’ আপত্তি করে সবুজ।

‘হয় বৎস! কীভাবে হয় সেটা চন্দন বোঝাবে। আমাদের কলেজ ফেস্ট ওপিয়ামের সময় ও যেমন ফ্লো-চার্ট বানিয়েছিল, ইলেকশান নিয়েও সেইরকম একটা চার্ট বানিয়েছে। বল চন্দন।’

রুম নম্বর একশো পঁচিশ। সময় রাত নটা। গতকাল রেজাল্ট জেনে হোস্টেলে ফেরার পরেই রিপু চন্দনকে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, ‘পাস করে গেছিস। কনগ্র্যাচুলেশনস। এবার ভোটের কাজে নামতে হবে।’

‘জানি।’ সংক্ষিপ্ত জবাব চন্দনের। ‘কী করতে হবে বলো।’

গত রাতে চন্দন, রিপু, টিনটিন, বান্টি আর সুব্রত মিলে ছোট একটা মিটিং সেরে ফেলেছিল। আজ সকালে এসএমএস করে হোস্টেলের মোচার সমস্ত সাপোর্টারদের রাত সাড়ে আটটায় একশো পঁচিশে আসতে বলা হয়েছিল। প্রতিটি রুমে গিয়েও বলে আসা হয়েছে। রেজাল্ট বেরোনোর পরে ফার্স্ট ইয়ারের বেশির ভাগ ছেলে বাড়ি চলে গেছে। তা সত্ত্বেও জমায়েত খারাপ নয়। ঘরে পঁচিশজন ছেলে বসে আছে। তাদের দিকে চোখ বুলিয়ে চন্দন বলে, ‘প্রথম কাজ প্রার্থী নির্বাচন। দ্বিতীয় কাজ ক্যাম্পেন। তৃতীয় কাজ নমিনেশান পেপার জমা দেওয়া। চার নম্বর কাজ ভোট করানো। পাঁচ নম্বর কাজ কাউন্টিং করানো।

‘এক এক করে এগোনো যাক। প্রার্থী নির্বাচন দিয়ে শুরু করি। আমাদের হোস্টেলে চারটে উইং আর পাঁচটা ফ্লোর। আমি এক্সেল স্প্রেড শিটে পুরোটা বানিয়ে রেখেছি। ফ্লোর ধরে ধরে প্রার্থীদের নাম বলব। তোদের পছন্দ হলে হাত তুলবি। অপছন্দ হলে তুলবি না। ক্লিয়ার?’

কারও কোনও বক্তব্য নেই। সব্বাই জানে, পার্টির চার-পাঁচজন মিলে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে কে কোন ফ্লোর থেকে দাঁড়াবে। এখন গণসংগঠনের মঞ্চে নামগুলো ঘোষণা করে তাতে গণতন্ত্রের ছাপ দেওয়া চলছে। এই পদ্ধতিতে কারও কোনও আপত্তি নেই। কেন না রাজনীতিতে এদের আগ্রহ নেই। গন্ডগোল এড়াতে দলে ভেড়া। যাদের আগ্রহ আছে, যেমন চন্দন, ঠিক নেতা হয়ে গেছে।

‘নর্থ গ্রাউন্ড ফ্লোরের জন্য ভেবেছি লাটুদার নাম। লাটুদা ওই উইং-এর গতবারের ফ্লোর রিপ্রেজেন্টেটিভ। কারও কোনও বক্তব্য আছে?’

সবাই নীরবে হাত তুলল।

‘তাহলে নর্থ জি থেকে দাঁড়াচ্ছে লাটুদা,’ স্প্রেড শিটে টিক মারে চন্দন। ‘কুড়িটা আসনের মধ্যে পিএমএফ পাঁচটা আসনে প্রার্থী দেবে। অর্থাৎ আমাদের মোট পনেরোজন প্রার্থীর নাম নির্বাচন করতে হবে। একজন হয়ে গেল। বাকি রইল চোদ্দ। সাউথ জি থেকে আমার প্রস্তাব…’

চোদ্দজন প্রার্থী নির্বাচন করতে চল্লিশ মিনিট লাগল। সুরজের বিরুদ্ধে স্ট্রং প্রার্থীর দাবি তুলেছে সবাই। কিন্তু ওই ফ্লোরে দীপ ছাড়া অন্য কোনও ক্যান্ডিডেট পাওয়া গেল না। সেই নিয়ে কিছুক্ষণ হইহল্লা হল। চন্দনের না দাঁড়ানো নিয়ে কথা উঠল। রিপু ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিল। সবাই বুঝতে পারল, আগামী কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচনে রিপু সরে দাঁড়াবে। ইউনিয়নের লড়াইতে ঢুকবে চন্দন। ছোট লড়াই থেকে তাই ও বাদ।

‘দ্বিতীয় কাজ, ক্যাম্পেন।’ একগাদা প্রিন্ট আউট সবার হাতে ধরিয়ে বলল চন্দন, ‘আমি প্রত্যেক ফ্লোরের প্রত্যেক উইং থেকে তিনজন ছেলের নাম বেছে নিয়েছি। হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির নির্বাচনে পোস্টারিং, মিছিল, স্ট্রিট কর্নারিং—এসব কিস্যু হয় না। জাস্ট ওয়ান-টু-ওয়ান কথাবার্তা। এই তিনজন ছেলে রুম ধরে ধরে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলবে। আমাদের ভোট অ্যাসিওর করবে। সপ্তাহে দুটো দিন, বুধ ও শনিবার একশো পঁচিশে এসে আমার কাছে রিপোর্টিং করবে। কোনও ঢপবাজি চলবে না। আমি ক্রস চেক করব। যে মিথ্যে কথা বলবে, তার কোনও শাস্তি হবে না। কিন্তু আমি, ব্যক্তিগতভাবে বাকি জীবনে তাকে আর বিশ্বাস করব না। যে রাজি নয়, সে এখনই বলে দাও। কোনও চাপ নেই।’

কেউই আপত্তি করল না। এমন কোনও হাতিঘোড়া কাজ নয়। সন্ধেবেলা আড্ডা মারতে মারতে একবার বললেই হল, মোচাকে ভোটটা দিস। আর সেটা না বলার কোনও কারণ নেই। মিনি-মেস তুলে দিয়ে চারবেলা খাবারের কোয়ালিটি এরাই ইমপ্রূভ করেছে। শোনা যাচ্ছে, এইবার জিতলে মাঝখানের বড় জমিটায় বাগান করবে। কমন রুমে ছেচল্লিশ ইঞ্চি এলসিডি টিভি বসাবে।

‘তোদের যে প্রিন্ট আউট ধরানো হল, তাতে প্রার্থীদের নাম, প্রতি ফ্লোরে ভোটদাতার নাম, ক্যাম্পেনের বিষয় বুলেট পয়েন্ট করে দেওয়া আছে। ব্যাকআপ হিসেবে সবার মেল আইডিতেও একটা করে মেল পাঠানো আছে। আশা করি তোদের ঘটে এইটুকু বুদ্ধি আছে যে কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে।’

আজকের মিটিং-এ একজনে সাপ্লি পাওয়া ফার্স্ট ইয়ার আছে। অভি। যারা সাপ্লি পেয়েছে, তাদের মিটিং-এ ডাকা হয়নি। অভি নিজের থেকেই এসেছে। সে এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। হঠাৎ বলল, ‘সব থেকে ভালো হয়, আমরা যদি সরাসরি কথা বলি। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে সরাসরি বলা, যে মোচার হয়ে এই ফ্লোরে লাটুদা দাঁড়িয়েছে। ওকে ভোটটা দিস। হোস্টেলের ছেলেরা কেউ গান্ডু নয়। বিটিং অ্যারাউন্ড বুশ করতে গেলে খেপে যাবে।’

‘সবাই এভাবে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ না-ও হতে পারে। কোনও বোর্ডার সরাসরি রাজনীতির কথা অপছন্দ করতে পারে। সেই জন্যই ফিক্সড রুল রাখা হয়নি। যে যেমন ভাবে পারে, ক্যাম্পেন করবে। যাই হোক,’ মোবাইলের ক্যালেন্ডার দেখে নিয়ে চন্দন বলে, ‘পয়লা অক্টোবর থেকে পুজো। আমাদের ইয়ারের ছেলেরা অলরেডি বাড়ি কেটে পড়েছে। যারা পড়ে আছে, যেমন অভি বা আর কেউ, তারা আগামিকাল কাটবে। নতুন ফার্স্ট ইয়ার অলরেডি কলেজ থেকে হাওয়া। সিনিয়ররাও পাত্তাড়ি গুটোবে। আমি এক্সপেক্ট করছি না, কেউ সাতই অক্টোবরের আগে হোস্টেলে ব্যাক করবে। কিন্তু তারপরে জান লড়িয়ে দিতে হবে। যারা ভোটে দাঁড়ালি তারা নমিনেশন পেপারে সই করে রুম থেকে বেরোবি। তোরা যখন বাড়ি থাকবি তখন নমিনেশান জমা দেওয়ার কাজটা আমরা এগিয়ে রাখব।’

সইসাবুদ করে ছেলেরা টুকটুক করে যে যার নিজের ঘরে চলে গেল। মিটিং শেষ। রুমে এখন রিপু, চন্দন আর অভি। চন্দন অভিকে বলল, ‘সবার সামনে বলিনি। এখন বলছি। তোর কিন্তু মিটিং-এ থাকার কথা নয়। পড়াশুনো করার কথা।’

‘ভালো লাগছে না।’ নিষ্পৃহ জবাব অভির।

‘পড়তে ভালো লাগছে না। না, একা থাকতে ভালো লাগছে না?’

‘দুটোই।’

‘বৃন্দার সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি কর।’ চন্দনের কণ্ঠস্বরে বিদ্রুপ।

‘বৃন্দা সাপ্লি পায়নি।’

‘না পাক। তোকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারল। আর একবার অ্যানাটমি পড়তে পারবে না?’

অভি কোনও উত্তর না দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে। রিপু এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে সংলাপ শুনছিল। এবার বলল, ‘অভি বৃন্দার সঙ্গে প্রেম করছে নাকি?’

‘একদম, একদম। হাত ধরে ঘোরাঘুরি, বাড়ি যাওয়া, মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুজুরগুজুর, মিনিটে মিনিটে এসএমএস…’ প্রেমের যাবতীয় সাইনস অ্যান্ড সিম্পটমস দেখা যাচ্ছে।’ জবাব দেয় চন্দন। অভি বিরক্ত মুখে একশো পঁচিশের দরজা খোলে।

রিপু বলে, ‘কীরে অভি? চন্দন যা বলছে তা কি সত্যি?’

রুম থেকে বেরোনোর আগে অভি মৃদু স্বরে বলে, ‘অ্যানাটমিতে ঝাড় না খেলে ”হ্যাঁ” বলতাম। আপাতত সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের কায়দায় বলি, ”ইটস কমপ্লিকেটেড”।’ তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

রিপু বলে, ‘আমার ফাইনাল এমবি এসে গেল। আমি আর আপ্পু ইলেকশানের চক্করে খুব বেশি জড়াব না। তোদেরকেই সামলাতে হবে।’

চন্দন বলে, ‘আমি কাল সকালে বাড়ি যাচ্ছি। বেষ্পতিবারে ফিরে নমিনেশান ফর্ম জমা দেওয়ার কাজটা করে দেব। তারপরে আবার বাড়ি গিয়ে দুর্গাপুজো চুকিয়ে আসব। পুজোয় তো হোস্টেল ফাঁকা থাকবে।’

‘একদম ফাঁকা নয়। অন্য স্টেটের অনেক ছেলে থাকে। সাপ্লি পাওয়া মালগুলো থাকে। ডিসট্রিক্টের ছেলেরা কলকাতার পুজো দেখবে বলে থেকে যায়। তুইও থেকে গেলে পারতিস। কলকাতার পুজো কখনও দেখেছিস?’

‘দেখিনি। এবার দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাড়ির লোক বহুত হুজ্জুত করছে।’

‘বাড়ির কথা ছাড়! বাবা-মারা ওরকম বলে!’

‘বাবা-মাকে পুজোর ব্যাপারে ম্যানেজ করা যাবে। ওটা ইস্যু নয়। আমাদের ওখানে একটা পলিটিকাল গন্ডগোল হচ্ছে। সেটায় বাবা যাতে বেশি জড়িয়ে না পড়ে সেটা দেখতে বাড়ি যাওয়া। নতুনগ্রাম এখন ফুটছে।’

‘কী রকম?’ জানতে চায় রিপু।

‘ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়ানোর ব্যাপারে নতুনগ্রামের অনেক ভূমিকা আছে। আমাদের ওখানকার ছেলেমেয়েরা ব্রিটিশদের গুলি করে, ফাঁসির দড়িতে ঝুলে,ইতিহাসের পাতায় ছবি হয়ে বসে আছে। যখন তখন ঘেরাও করা, রাস্তা কাটা, ব্রিজ ওড়ানো, বোমা বানানো, বাচ্চাদের জামাপ্যান্টের মধ্যে ওয়েপন পাচার করা আমাদের ওখানকার কালচারের মধ্যে পড়ে। নতুনগ্রাম ছেলেরা আর বাঁজাপলাশের জোয়াকিমরা জরির কাজ, হীরে পালিশের কাজ, রান্নাবান্নার কাজ নিয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে। বিদেশেও আছে। তারা টাকা পাঠাচ্ছে। খিদিরপুর থেকে যে সব বেসরকারি বাস নতুনগ্রাম হয়ে আরও দূরে যায়, তাতে বস্তাবন্দী হয়ে অস্ত্র ঢুকছে প্রত্যেক রাতে। জনমোর্চা জমি নোটিশ লটকে দিয়েই খালাস। অধিগ্রহণ করতে পারবে বলে মনে হয় না। লোকাল লোক রেজিসট্যান্স দেবে। মোচার কয়েকজন পাঁড় সাপোর্টার ছাড়া বাকি সবাই এই ব্যাপারে এককাট্টা। নবযুগ, জাতীয়তাবাদী পার্টি, ইনডিয়ান পিপলস পার্টি, জনমোর্চা থেকে সরে যাওয়া লোকেরা—সবাই এক হয়েছে। পড়ে আছে আমার বাবার মতো কয়েকজন। আমার বাবা ক্যালানি না খেয়ে যায়।’

‘তুই জন্মানোর আগে থেকেই মোচার খাতায় তোর নাম লেখা ছিল।’ হাসতে হাসতে বলে রিপু।

‘বলতে পারো। আমি যাকে বলে, নীল রক্তের লাল মোচা।’

পরীক্ষার আগে আগে চন্দন পার্টির মেম্বারশিপ পেয়েছে। অক্সিলিয়ারি গ্রুপ বা এজির ক্লাস নিয়মিত হতো না। কেন না, যাদের এজি দেওয়া হয়েছিল, তারা একটা মিটিং করেই বলে দিয়েছে, ছাত্র সংগঠনে গা ঘষাঘষি করতে আপত্তি নেই। কিন্তু পার্টির খাতায় নাম লেখাবে না। রয়ে গেছে চন্দন। জনমোর্চার অতীত ইতিহাস, পার্টির নিয়মকানুন নিয়ে চন্দনের পড়াশুনো অন্যদের থেকে অনেক বেশি। ওকে নিয়ে আলাদা মিটিং হতো না। অধীর মাঝে মাঝে আনসারুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসে চন্দনকে ডেকে পাঠাত। সেখানে অল্পবিস্তর পার্টি ক্লাস হতো। মাসদুয়েক এইরকম চলার পরে রিপু একদিন চন্দনকে ডেকে বলল, ‘তোকে সিএম-শিপ দেওয়া হল।’

সিএম মানে ক্যান্ডিডেট মেম্বার। অর্থাৎ, পার্টি মেম্বারশিপের অ্যাপ্রেনটিস পর্ব। এই অবস্থায় কিছুদিন চন্দনকে চোখে চোখে রাখা হবে। কোনও বেচাল না দেখলে দেওয়া হবে পিএমশিপ বা পারমানেন্ট মেম্বারশিপ।

চন্দন পিএম হয়ে গেছে একমাসের মধ্যে। পার্টি সংগঠনের শাখা সম্পাদক রিপু, কিন্ত সে এখন ফাইনাল এমবিবিএস-এর পড়া নিয়ে ব্যস্ত। সব কাজ চন্দনকেই দেখতে হয়।

রিপু আর চন্দনের গপপোর মধ্যে রুমে দু’জন মানুষ ঢুকে পড়েছেন। তাদের দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে রিপু বলল, ‘আরে অধীরদা, তপনদা! আপনারা? এত রাতে?’

জনমোর্চার ছাত্র সংগঠনের কলকাতা জেলা কমিটির সেক্রেটারি অধীরের কথা এক্ষুনি চন্দন ভাবছিল। ভদ্রলোক অনেককাল বাঁচবেন। সঙ্গের লোকটি চন্দনের অচেনা। না-গোঁজা, বুক-খোলা টি-শার্ট; ফর্মাল ট্রাউজারের সঙ্গে স্নিকার, কলপ করা গোঁফ, পেশিবহুল চেহারা ও ভুঁড়ির কম্বিনেশান বলে দিচ্ছে, লোকটা পুলিশ!

‘তোমাদের হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির খোঁজখবর নিতে এলাম।’ খাটে বসে বললেন অধীর। তপন একপাশে দাঁড়িয়েছিলেন। চন্দন তাঁকে একটা সিগারেট দিয়ে বলল, ‘বসুন।’

সিগারেট নিয়ে তপন বললেন, ‘আমি সিগারেট খাই বুঝলেন কী করে?’

‘গা থেকে নিকোটিনের গন্ধ আসছে। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমায় নিকোটিনের হলদে ছাপ, টি-শার্টের পকেটে লাইটারের আদল…’ নিজে সিগারেট ধরিয়ে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি বাড়িয়ে দেয় চন্দন।

‘আমার নাম তপন চৌধুরী। আমি এন্টালি থানার এসআই,’ সিগারেট ধরিয়ে নমষ্কার করেন তপন। ‘আপনাদের এই কলেজটা আমার এলাকায় পড়ে। হোস্টেলের বা কলেজের ইলেকশান মানে আমার হেডেক। মেডিক্যাল কলেজে সে রকম বাওয়াল হয় না। তবে খবর নেওয়াটা ডিউটির মধ্যে পড়ে।’

চন্দন খেয়াল করল, তপনের মধ্যে নেতার ন্যাওটা সুলভ আচরণ নেই। অধীরের সঙ্গে এসেছেন বটে, তবে তাঁকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। চন্দন বলল, ‘আপনারা বোধহয় ছোটবেলার বন্ধু। অথবা কলেজ মেট।’

‘হঠাৎ কেন মনে হল তোমার?’ স্বপনের হাত থেকে সিগারেটের কাউন্টার নিয়ে টান দিয়ে বলেন অধীর। তাঁর ঠোঁটের কোণে পাতলা হাসি।

‘আপনাদের ক্যাজুয়াল রিলেশান দেখে।’

তপন প্রশংসাসূচক দৃষ্টিতে চন্দনের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আমার বয়স পঞ্চান্ন। রিটায়ারমেন্টের পাঁচ বছর বাকি। আমার ছেলে তোমারই বয়সি। তোমাকে তুমিই বললাম। কিছু মনে করলে না তো?’

‘আরে, না না! মনে করার কী আছে?’

‘আমার ছেলে আর তুমি বয়সে এক হলে কী হবে? আমার ছেলেটা এক্কেবারে গাধা। পরপর দুবার জয়েন্ট দিল। একবারও মেডিক্যাল চান্স পেল না। এখন ডেন্টাল কলেজে ভরতি হয়েছে।’

রিপু এতক্ষণ শুনছিল। বলল, ‘তপনদা, চন্দন ওদের ব্যাচে উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছিল। মেডিক্যালে র‌্যাঙ্ক পঁচানব্বই।’

‘পাবলিকের একটা ধারণা আছে যে ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা আজকার আর অ্যাকটিভলি পলিটিকস করে না।’ মুচকি হেসে বলেন তপন।

‘আপনিও রাজনীতি করতেন নাকি?’ জানতে চায় চন্দন।

‘সন্ন্যাসী যেমন পূর্বাশ্রমের কথা বলে না, রাজ কর্মচারীরাও তেমন রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা বলে না। অধীরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা একদমই অরাজনৈতিক। বরং আমি থাকলে ওর ছড়ি ঘোরাতে অসুবিধে হয়।’ বলেন তপন।

‘হোস্টেলের মধ্যে পুলিশ ঢোকা কিন্তু বেআইনি।’ তপনকে বলেন অধীর।

‘ছাত্র সংগঠনের নেতা হতে পারিস। কিন্তু তুইও বহিরাগত। তোরও হোস্টেলে ঢোকাটা বেআইনি।’ হাসতে হাসতে বলেন তপন। তাঁর কথা শুনে চন্দন আর রিপুও হাসল।

চন্দনের দিকে তাকিয়ে তপন বললেন ‘তোমার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগল। আমার ছেলেকে অনেকটা তোমার মতো দেখতে। বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোঁট্টা, শ্যামলা। পারলে একদিন আলাপ করিয়ে দেব। ওদের কলেজ রাস্তার উলটো ফুটে।’

‘আচ্ছা।’ ঘাড় নাড়ে চন্দন। রিপু আর অধীরকে তপন বললেন, ‘চললাম। পরে কথা হবে।’

তপন বেরিয়ে যাওয়ার পরে অধীর রিপুকে বললেন, ‘পার্টির মিটিং হচ্ছে?’

‘ওদের পরীক্ষা ছিল।’ চন্দনের দিকে ইঙ্গিত করে রিপু।

‘পরীক্ষা একমাস আগে শেষ হয়ে গেছে। গতকাল রেজাল্ট বেরিয়েছে। এত দিনে একটাও মিটিং করা গেল না? বেশিক্ষণ তো লাগে না। পার্টি চিঠিগুলো পড়বে, গণ সংগঠন ও পার্টি সংগঠন নিয়ে আলোচনা করবে—এই তো ব্যাপার! এত নিষ্ক্রিয়তা ভালো নয়। আমাদের পার্টির অর্ধেকের বেশি সদস্য পলিটিক্যালি ইন্যাকটিভ হয়ে পড়েছে। তিরিশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফল। সামনেই রিনিউয়াল। শুদ্ধিকরণের জন্য নিষ্ক্রিয় সদস্যদের পদ পুনর্নবীকরণ করা হবে না। সদ্য পার্টিতে এসেই যারা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে, তারা বেরিয়ে যাওয়াই ভালো।’

‘দেখুন অধীরদা, অতীতে কার্ড-হোল্ডার হতে গেলে পাঁচ-সাত বছর ঘষতে হতো। মিটিং করা, মিছিল করা, পোস্টার লেখা, পোস্টার সাঁটা, সব কাজে দড় হতে হতো। আজকের দিনে আপনি সেই ডেডিকেশান ডিমান্ড করতে পারেন কি? বিশেষত মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্রের কাছে? জনমোর্চার সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আমি আপনার পিছনে ঘুরঘুর করিনি। রিপুদাই আমার পিছনে ঘুরঘুর করেছিল। এজি তো অনেকেই হয়েছিল। আজ তারা কোথায়? যে আছে, তাকে ঘাঁটাবেন না।’ অধীরকে একটানা অনেক কথা শুনিয়ে দেয় চন্দন।

‘বাবাঃ! এ ছেলে তো নকশালদের মতো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছে। পার্টিতে থাকলে হয়।’ নাক সিঁটকোয় অধীর।

‘মতের মিল না হলেই নকশাল বলে দেগে দেওয়ার অভ্যেস অনেক পুরনো। ওটা বন্ধ করুন। আর আপনার ভয় নেই। আমি অন্য কোথাও যাব না। তবে মৃন্ময় চ্যাটার্জির তাড়া খেয়ে জনমোর্চা কোথায় যায়, এটাই দেখার।’

‘ওফ! তুমি ওই ছোটলোকের বাচ্চাটার নাম কোরো না তো। আনকালচার্ড, সাইকোপ্যাথ, কাগুজে বাঘ একটা! মিডিয়া ওকে তুলেছে। মিডিয়াই ওকে ফেলবে। যত্ত অ্যান্টি-জনমোর্চা প্রোপোগান্ডা।’

‘তাও ভালো, ওকে সিআইএর এজেন্ট, তোজোর কুকুর অথবা বুর্জোয়া কবি বলেননি। ভুল করা আর ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে আমাদের পার্টির কোনও জুড়ি নেই।’

চন্দনের কথা শুনে অধীর রাগ করলেন না। কৌতূহল ভরে বললেন, ‘এইসব গালাগালি না করে মিটিংটা রেগুলার করতে পারো তো। তাহলে আমাকে আর আজেবাজে বকতে হয় না।’

‘পার্টি মিটিং হোক বা না হোক, জনমত না পড়ে আমার দিন শুরু হয় না। তবে আপনার সঙ্গে আমি একমত যে মিটিং রেগুলার হওয়া উচিত। ডিসিপ্লিন খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

অধীর সিগারেট শেষ করে বললেন, ‘সামনে পুজো। তারপরে হোস্টেলে ইলেকশান। এই দুটো পেরিয়ে যাক। তারপর কথা হবে।’ তারপর রিপুকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

চন্দনও একশো পঁচিশ থেকে বেরোল। রাতের খাওয়া সেরে ফেলা যাক। কাল ভোর ভোর বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।

পারুল বললেন, ‘জলখাবার দেব? না একেবারে ভাত খাবি? আসতে আসতে তো বেলা এগারোটা বাজিয়ে দিলি।’

চন্দন বলল, ‘কী করব বলো? পরপর দু’জায়গায় অবরোধ। মেচেদায় একবার, ডিমারিতে একবার। ওগুলো না হলে কখন চলে আসতাম!’

পারুল বললেন, ‘চান করে নে। একেবারে খেতে দিয়ে দিই। সজনে ফুলের বড়া আর পটল মাছের ঝাল করেছি।’

‘বাবা কোথায়? তুমি বললে আজ কোর্টে যায়নি। তা হলে বাড়িতে নেই কেন?’

‘তিনি বেরিয়েছেন। বাঁজাপলাশের জোয়াকিমদের বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছেন, সরকারকে জমি দান করলে আখেরে আমাদের কত লাভ হবে। কেউ শুনছে না। নেহাত লোকটাকে সবাই মানিগন্যি করে তাই। না হলে এতদিনে মার খেয়ে যেত!’ রাগের ঝাঁঝ পারুলের গলায়।

‘জোয়াকিমদের উচ্ছেদ করে সেখানে হাসপাতাল হবে? এটা কোন দেশি নিয়ম?’

‘তোর বাবাকে জিগ্যেস কর। বলছে, হাসপাতালে নাকি প্রতি পরিবারের একজনকে চাকরি দেবে। ওই চাকরির ক্যাঁতায় আগুন। হাসপাতাল হল ডাক্তার আর নার্সদের জায়গা। সেখানে অশিক্ষিত, বামন জোয়াকিমরা কী কাজ করবে? গেটের দারোয়ান? জমাদার? ঝাড়ুদার? ক্যান্টিনের ঠাকুর? রুগিরা হাসবে তো! জমির সঙ্গে মানুষের বাঁধনটা বড় শক্ত। সেই বাঁধন কাটার চেষ্টা করছে জনমোর্চা সরকার। সন্দীপ সামন্ত সামনের ভোটে এমন হারান হারবে, যে পালাবার পথ পাবে না।’

পারুলের কথা শুনে অবাক হল চন্দন। পারুল বরাবর দৃঢ়চেতা। কিন্তু বাইরে শান্ত। সংসারকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু বাইরের লোককে বুঝতে দেন না। স্বামী অনুগত স্ত্রীর ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেন। এইরকম হিসেবি এবং বুদ্ধিমতী মহিলার এ হেন বিস্ফোরণ দেখে চন্দন বুঝল সিচুয়েশান সত্যিই গন্ডগোলের। খাওয়াদাওয়া শেষ করে সে নিজের ঘরে ঢুকল।

নন্দন এখনও বাড়ি ফেরেনি। সার্কাসের দলের সঙ্গে শিলিগুড়িতে আছে। নিজের ঘরে ঢুকে চন্দন দেখল এখনও সাজিয়ে রাখা রয়েছে ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত যাবতীয় বইপত্র আর খাতা। কিছুদিন আগেও এগুলো দেখলে ভালো লাগত চন্দনের। আবাসবাড়ির সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করত।

আজ আত্মার সেই বন্ধনটা খুঁজে পেল না। বইগুলোকে মনে হল আবর্জনা। জায়গা নষ্ট করছে। সমস্ত বইখাতা ঘর থেকে বার করে উঠোনে রাখল চন্দন। কাল কাগজওয়ালাকে বেচে দিতে হবে। ফার্স্ট এমবিবিএস-এর কিছু বই সে ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে। সব বই এক সঙ্গে আনা সম্ভব নয়। সেই বইগুলো ফাঁকা বুক র‌্যাক সাজাল। তারপর দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে সিগারেট ধরাল। চোখের সামনে ভেসে উঠল অভির মুখ।

অভি ঝাড় খাওয়ায় চন্দনের আনন্দ হয়েছে। বৃন্দার ব্যাপারে অভি তার কম্পিটিটার। কাজেই অভি ঝাড় খাওয়ায় চন্দন খুশি।

চন্দনের সঙ্গে অভির কীসের তফাত? দু’জনের কেউই শহরের নয়, কেউই দেখতে সুন্দর নয়, দু’জনেই আনস্মার্ট, দু’জনেই ইংরিজি বলতে পারে না। চন্দন উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট বয়। আর অভি ফার্স্ট এমবিবিএসে ঝাড় খেয়েছে। চন্দনই তো এগিয়ে। তাই না? তা হলে বৃন্দা তার। সোজা কথা! ঘুমিয়ে পড়ার আগে চন্দন ভাবল, নমিনেশান পেপার জমা দেওয়ার জন্য একবার কলেজ যেতে হবে। ছুটির বাকি সময়টা সে নতুনগ্রামের বাড়ি বাড়ি যাবে। গন্ডগোলের উৎস কতটা গভীর, এটা জানা জরুরি।

খানিকটা বৃন্দা, খানিকটা অভি, খানিকটা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ, খানিকটা নতুনগ্রামের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে চন্দন।