দময়ন্তী
‘ইউরিনের প্রোটিন দেখা হবে!’ উত্তেজিত হয়ে বলল অভি।
‘তো?’ নাক সিঁটকে বলল দময়ন্তী।
‘আমার খুব এক্সাইটেড লাগছে।’
‘আমার একটুও লাগছে না। বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকালে এইসব নোংরামো হয় জানলে ক্লাসে আসতাম না।’
‘এসে যখন পড়েছিস, তখন পালাতে পারবি না। আরতি ম্যাডামের চোখ সিটিটিভির মতো। পলক পড়ে না।’ ফিশফিশ করে বলে অভি।
এএম ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে প্রস্রাবের বর্ণ, গন্ধ, পিএইচ, প্রোটিন ভ্যালু বোঝাচ্ছেন। আস্ত একটা চক শেষ করে ছাত্রছাত্রীদের দিকে ঘুরে বললেন, ‘তাহলে, টেস্ট করার জন্য কোন ইউরিন ব্যবহার করা হয়?’
‘আর্লি মর্নিং মিড-স্ট্রিম ইউরিন।’ হাত তুলে জবাব দিল চন্দন। অভি ফুট কাটল, ‘হাত তোলা অভ্যেসটা এখনও গেল না?’
‘এই, তোরা হ্যাহ্যাহিহি করিস না। তা হলে আমার পড়াতে অসুবিধে হবে।’ হাস্কি গলায় বললেন এএম। আজ তিনি পরে আছেন হালকা নীল রঙের তসরের শাড়ি। সারা শাড়ি জুড়ে গোলাপি আর সবুজ রঙের জিয়োমেট্রিক্যাল প্যাটার্নের আঁকিবুকি। সঙ্গে লাল সিল্কের পুরোহাতা ব্লাউজ। বাঁহাতে মোটা, নীল রঙের বালা। ছেলেরা ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে না তাকিয়ে এএমের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাঁর করুণ আকুতিতে গোটা ক্লাস নিমেষে চুপ করে গেল।
‘শোন না, তোদের একটা কথা বলি।’ ফ্লোরাল প্রিন্টের রুমাল দিয়ে মুখ মুছে এএম বললেন, ‘আমার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ। পিরিয়ড ইররেগুলার হতে শুরু করেছে। সামনেই মেনোপজ। এই সময় ভীষণ মুড সুইং হয়। আমি হঠাৎ চ্যাঁচামিচি করলে তোরা কিছু মনে করিস না। পাশাপাশি এটাও ঠিক, তোরা আমাকে ইরিটেট করলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। তার দায় তোদের ওপরে বর্তাবে।’
দময়ন্তী আর একটু হলে হাততালি দিচ্ছিল। বখাটে স্টুডেন্টদের ম্যানেজ করার অনেকরকম কৌশল সে জানে। কিন্তু এইরকম অভিনব কৌশল কখনও শোনেনি। আশেপাশের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখল সে। মেয়েরা সিমপ্যাথেটিক মুখ করে ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে। ছেলেদের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ বিস্ময়! দময়ন্তী বুঝে গেল, বোরিং প্র্যাকটিকাল ক্লাস করুক বা না করুক, এএমকে কেউ কখনও ডিস্টার্ব করবে না।
‘তোদের পিছনে একটা জেরিক্যানে ইউরিন রাখা আছে। মাইন্ড ইট, ওটা ইউরিন নয়। ডিসটিলড ওয়াটারে ডিমের সাদা অংশ মেশানো আছে। ইউ হ্যাভ টু ট্রিট ইট অ্যাজ ইউরিন। তোদের সামনে যে টেস্ট টিউব হোল্ডার আছে, তাই দিয়ে একটা টেস্ট টিউব ধরবি। পিপেট দিয়ে টেস্ট টিউবে দশ মিলিলিটার ইউরিন নিবি। বুনসেন বার্নারের ওপরে টেস্ট টিউব ধরে সামান্য গরম করবি। কী রেজাল্ট হল আমাকে জানাবি। ক্লিয়ার?’
কারও কিছু ক্লিয়ার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এএম দেখিয়ে দিলেন কীভাবে টেস্ট টিউব হোল্ডারে টিউব ধরতে হয়। সেটা প্র্যাকটিস করতে গিয়ে প্রথম ধাপেই বিপত্তি। দময়ন্তীর হাতের হোল্ডার ফসকে টিউব মেঝেতে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।
‘ইডিয়েট কোথাকার!’ নেকু নেকু গলায় বললেন এএম, ‘ভালো করে ধরতেও শিখিসনি।’
‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’ ভাঙা কাচ কুড়োনোর চেষ্টা না করে এএমের চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল দময়ন্তী। তার গলার স্বর কঠিন।
এএম দরদর করে ঘামছেন। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বললেন, ‘আয়্যাম সরি। প্রিসিশনের অভাব দেখলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।’
‘আপনি যদি মনে করেন, প্রথম চেষ্টাতেই আমি খুব ভালো ল্যাব টেকনিশিয়ান হয়ে যাব, তাহলে সেটা আপনার সমস্যা, আমার নয়। প্লাস, ‘ইডিয়েট’ কথাটা ক্লাসরুমে ব্যবহারের জন্য ঠিক নয়।’ দময়ন্তীর কণ্ঠস্বরের কাঠিন্য একটুও কমেনি। অভি পিছন থেকে তার কুর্তা ধরে টানছে। বলছে, ‘ওরে চেপে যা!’
‘আয়্যাম সরি!’ আবার বললেন এএম। দময়ন্তী কাজে ফিরল। পরীক্ষার বাকি ধাপগুলো তরতর করে উতরোল। টেস্ট টিউব গরম করার পরে দেখা গেল ইউরিনের একটা অংশ সাদা হয়ে জমে গেছে।
‘অ্যাজ ইন এগ অ্যালবুমিন।’ ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখছেন এএম। ‘ডিমের প্রোটিন অংশকে সেদ্ধ করলে জমে সাদা হয়ে যায়। ইটস আ ভেরি বেসিক টেস্ট টু ডিটেক্ট প্রোটিন ইন ইউরিন। বাই দ্য ওয়ে, নর্মালি ইউরিনে কোনও প্রোটিন থাকে না। কিডনির ছাঁকনি খারাপ হয়ে গেলে তবেই আসে।’
প্র্যাকটিকাল ক্লাসের বাকি অংশটা শক্ত টারমিনোলজি শুনে কেটে গেল। তিনটের সময় ক্লাস শেষ করে এএম প্র্যাকটিকাল ক্লাস থেকে বিদায় নিলেন।
অভি দময়ন্তীকে বলল, ‘তোর সাহস তো কম না! এইচওডি-র সঙ্গে ঝগড়া করলি? জানিস, উনি তোকে ফেল করিয়ে দিতে পারেন?’
‘দিতে পারেন আবার কী? অলরেডি দিয়েছেন।’ পাশ থেকে ফুট কাটে চন্দন।
চন্দনের কথায় পাত্তা না দিয়ে দময়ন্তী অভিকে বলল, ‘আমি কারও সঙ্গে ঝগড়া করিনি। উনি আমাকে ইডিয়েট বলেছেন। আমি তার প্রতিবাদ করেছি।’
বৃন্দাকে এতক্ষণ দেখা যায়নি। সে পিছনের সিটে বসেছিল। এএম ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে সামনে এসেছে। বলল, ‘এএম মেয়েদের একদম পছন্দ করেন না। লেফট অ্যান্ড রাইট ফেল করান। কিন্ত ছেলেদের সাতখুন মাফ। স্পেশালি সে যদি সুরজের মতো টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম মিস্টার আইএমসি হয়।’
প্রবাল পাশ থেকে বলল, ‘যারা কম্পিটিশানে নাম দিয়েছিল, তাদের জন্য কোনও স্টুডেন্ট কনসেশন নেই?’
‘যারা মিস্টার আইএমসিতে পার্টিসিপেট করেছিলি কিন্তু খেতাব পাসনি, তারা একসঙ্গে ওঁর ঘরে ডেপুটেশান দিতে পারিস। তুই, সবুজ, সঞ্জয় আর দীপ একসঙ্গে যা! উনি গ্রুপি পছন্দ করেন।’
‘ভ্যাট! খালি বাজে কথা!’ দময়ন্তী আপত্তি করে, ‘তুই ম্যাডামের সম্পর্কে এত কথা জানলি কোত্থেকে?’
এই প্রশ্নে বৃন্দা মিইয়ে যায়। বলে, ‘আমার চেনা একজন এখানে ডাক্তারি পড়ত। সে বলছিল যে কমিউনিটি মেডিসিনের বসের সঙ্গে আরতী ম্যাডামের কী সব চক্কর আছে।’
‘ম্যাডাম কিন্তু হেবি সেক্সি আছে।’ সুরজও আলোচনায় যোগদান করেছে, ‘পুরো ”ম্যায় হুঁ না” সিনেমার সুস্মিতা সেন। ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে গেলে এভরি হার্ট গো-জ ধকধক!’
‘সুস্মিতা সেনও কেমিস্ট্রির টিচার ছিলেন না? কী যেন নাম ছিল ক্যারেক্টারের?’ মনে করার চেষ্টা করছে প্রবাল।
‘চাঁদনি চোপড়া,’ পাশ থেকে লাইফলাইন দেয় সুরজ। বৃন্দাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ম্যাডাম কমিউনিটি মেডিসিনের স্যারের সঙ্গে ”মেক আউট” করেন—এটা সিয়োর?’
‘মেক আউট? সেটা আবার কী বস্তু?’ প্রবাল অবাক।
‘আররে ইয়ার! ”মেক আউট” মিনস ”ডু দে হ্যাভ সেক্স”? তোরা, বাঙালিরা তো ”সেক্স” ওয়ার্ডটা শুনলে অজ্ঞান হয়ে যাস। তাই ”মেক আউট” বললাম।’ বিরক্তির সঙ্গে বলে সুরজ।
‘বাঙালিরা ”সেক্স” শব্দটা শুনলে অজ্ঞান হয়ে যায়? আর তোর মতো মুম্বাইয়ের ছেলেরা ”সেক্স” শব্দটা শুনলে কী করে? প্যান্ট নামিয়ে দেওয়াল ধরে দাঁড়ায়?’ চাবুকের মতো কথাগুলো বলল দময়ন্তী।
বৃন্দা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘অ্যাই সুরজ, ম্যাডাম কার সঙ্গে কী করেন তাই নিয়ে তোর কী? শুনলি তো, মেনোপজ হচ্ছে।’
সুরজের চোখ লাল। সে রাগী মুখে দময়ন্তীকে বলল, ‘আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে ভালো করলি না কিন্তু।’ তারপর বৃন্দাকে বলল, ‘আই লাভ সেক্স উইদ এজেড উইমেন। কোনও প্রবলেম আছে?’
সুরজের কথায় সবাই বিরক্ত। প্রবাল বলল, ‘বস, তুই ভুলভাল না বকে হোস্টেলে চল। আরেকবার দাবাংটা মেরে আসি। এলিটে চলছে।’
অভি বলল, ‘তুই মুম্বইয়ের ছেলে হয়ে এত ভালো বাংলা জানলি কী করে?’
সুরজের মেজাজ খানিকটা ঠান্ডা হয়েছে। সে অভিকে বলল, ‘আমার জন্ম কলকাতায়। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সেন্ট জেমসে পড়েছিলাম। বাবা মুম্বইতে ট্রান্সফার হয়ে গেল, তাই চলে গেলাম। চল প্রবাল, দাবাং মারকে আতা হ্যায়।’
অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং থেকে বেরোতে বেরোতে অভি দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোকে দেখে বারুদ বালিকা বলে মনে হয়।’
দময়ন্তী অভির কলার ধরে বলে, ‘এটা একটা কবিতার বইয়ের নাম না?’
অভি অবাক হয়ে দময়ন্তীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অবশেষে বলে, ‘দিল্লিওয়ালি বাংলা কবিতার খবর রাখে? ব্যাপারটা ঘেঁটে গেল বস!’
‘খবর রাখি না,’ শ্রাগ করে দময়ন্তী। ‘আমার মা-র বই পড়া বাতিক। এই বইটা বাড়িতে আছে। কার লেখা জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারব না। সিক্সটিজ বা সেভেনটিজের কোনও পোয়েট হবে। আয়্যাম নট সিওর।’
‘অমিতাভ দাশগুপ্ত।’ কবির নাম বলে দেয় অভি।
বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল ক্লাসের পরে আজ আর কিছু নেই। চন্দন, প্রবাল আর সুরজ হোস্টেলের দিকে চলে গেল। মেয়েরা গার্লস হোস্টেলের দিকে এগোচ্ছে। অভি-দময়ন্তীর-বৃন্দার মতো ডে-স্কলাররা বাড়ি যাবে। তিনজনে এজেসি বোস রোডের দিকে এগোয়। অভি যাবে শিয়ালদা স্টেশন। দময়ন্তী এন্টালি। বৃন্দা ধর্মতলা।
সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর সামনে বিলু তিনজনের রাস্তা আটকাল। অভিকে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘বাড়ি,’ আড়চোখে বৃন্দা আর দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় অভি। এই কলেজে এখনও কেউ জানে না যে বিলু তার দাদা। বিলুর সেইরকম অর্ডার ছিল।
‘তাড়াতাড়ি ফোট। ডানকুনি লোকাল আর দশ মিনিট পরে ছাড়বে।’ অভির মাথায় চাঁটি কষায় বিলু। বিলুর আচরণের মধ্যে সিনিয়র দাদাসুলভ আচরণের বাইরে অন্য কিছু একটা ছিল। দময়ন্তী বিলুকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কী করে জানলে ও কোথায় যাবে? তোমরা কি একই দিকে থাকো?’
বিলু ফচকে হেসে উত্তর দিল, ‘একই দিকে। ইনফ্যাক্ট একই বাড়িতে। ও আমার ভাই।’
‘ওমমা! তাই? হাউ সুইট!’ অভির চুল ঘেঁটে দেয় দময়ন্তী। অভি আর বৃন্দা কলেজ গেটের দিকে দৌড় লাগায়। বৃন্দা ধর্মতলাগামী ট্রামে উঠে পড়ে। তাকে টাটা করে অভি দৌড়োয় স্টেশানের দিকে। সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর সামনে এখন বিলু আর দময়ন্তী। দময়ন্তীর দিকে ফিরে বিলু বলে, ‘কফি খাবি?’
‘জীবনদার ক্যান্টিনে? নো ওয়ে!’
‘ওখানে না। সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর একতলায় একটা দোকান আছে। প্রতিবন্ধীরা চালায়। কফিটা খারাপ বানায় না।’
‘চলো।’ ক্যাজুয়ালি বলে দময়ন্তী। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না।
দোকানটার নাম ‘সঞ্জীবন’। চা, কফি, পেস্ট্রি, পাউরুটি, বিস্কুট, পোট্যাটো চিপস, মিনারেল ওয়াটার এইসব পাওয়া যায়। একটি মেয়ে হুইলচেয়ারে বসে সবকিছু সামলাচ্ছে। দশটাকা দিয়ে দু’কাপ কফি নিয়ে বিলু বলল, ‘চল। বাইরে গিয়ে দাঁড়ে বসি। একটু বাদে ভিজিটিং আওয়ার শুরু হবে। তখন পেশেন্ট পার্টির ভিড়ে এখানে টেকা যাবে না।’
‘দাঁড়? সেটা আবার কী?’ বিলুর হাত থেকে কাগজের কাপ নিয়ে সেন্টিনারি বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে প্রশ্ন করল দময়ন্তী।
সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর সামনে যে রাস্তা, তার গা বরাবর ইটের তৈরি নিচু প্রাচীর। পাঁচিলের ওপাশে অতীতে বাগান করার চেষ্টা হয়েছিল। আপাতত সেখানে জঞ্জালের স্তূপ। পাঁচিলের ওপরে বসে বিলু বলল, ‘এইটা হল দাঁড়। আমাদের আড্ডার ঠেক। সন্ধে নাগাদ এখানে ভাটাতে আসি।’
‘ইন্টারেস্টিং!’ বিলুর পাশে বসে বলল দময়ন্তী।
‘কলকাতায় এসে কেমন লাগছে?’ কফিতে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করে বিলু।
‘খুব ভালো। আমি ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জায়গা দেখেছি। লন্ডন, শান্তিনিকেতন, দিল্লি। আবুধাবি, মিশর, ইথিয়োপিয়া, ফ্রান্স। খুব বড়লোক, খুব গরিব, খুব অভিজাত, খুব ছোটলোক, ভীষণ মিডিওকার—সব রকম জায়গা দেখা। কিন্তু কলকাতা আলাদা। ভীষণ ওয়ার্ম একটা শহর। আর আমি হাফ বং! বাঙালিয়ানা বা কলকাতা বা পশ্চিমবাংলা নিয়ে সেন্টিমেন্ট থাকবেই। যদিও পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় সেটল করতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না।’
‘বিশ্বনাগরিক বলতে চাস নিজেকে?’
‘খুব ট্যাঁশ শোনালেও উত্তরটা হল, হ্যাঁ।’ দময়ন্তীর সোজাসাপটা উত্তর শুনে বিলু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। অবশেষে বলে, ‘এত জায়গা কীভাবে ঘুরলি? বাবা-মা কী করেন? নিজেকে হাফ-বং কেন বলছিস?’
‘পরের উত্তরটা আগে দিই?’ আর এক চুমুক কফি খেয়ে বলে দময়ন্তী, ‘আমার বাবা ব্রিটিশ। মা বাঙালি। এই কারণে আমি হাফ বং। আমার জন্ম লন্ডনে। আর, তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলি, আমার বাবা পেইন্টার। মা জার্নালিস্ট। দু’জনেই পেশার কারণে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমি ল্যাংবোটের মতো পিছন পিছন যেতে বাধ্য হয়েছি।’
বিলু মাথা নিচু করে শুনছিল। বলল, ‘এখন তোর বাবা-মা কোথায়?’
‘কলকাতায়। র্যাদার এন্টালিতে।’ দক্ষিণ দিকে তর্জনী দেখায় দময়ন্তী। ‘দু’জনেই পাস্ট দেয়ার প্রাইম। মনে হচ্ছে কলকাতায় সেটল করল। ফাইনালি।’
‘আর তুই?’
‘আমিও এখানেই থিতু হতে চাই। দ্যাটস ফর শিওর। আসলে, এতদিন পর্যন্ত আমার কোনও কিছুর প্রতি মেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট তৈরি হয়নি। ছোটবেলা থেকে বারবার বিভিন্ন জনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। বাবা-মায়ের ঠাঁই বদলের ফলে সেসব বন্ধুত্ব ভেঙে গেছে। তখন খুব কষ্ট হতো। রোজ কাঁদতাম। ইথিওপিয়ার হারুন নামে একটা ছেলের সঙ্গে অনেককাল পেনফ্রেন্ডশিপ রেখেছিলাম। হঠাৎ চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। আর কখনও কোনও খবর পাইনি। তখন বুঝেছিলাম যে, কোনও সম্পর্কই টেঁকে না। তাই পরে আর ওই রিস্ক নিতাম না। এখন নানা টেকনোলজিক্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট হয়েছে। ইমেল, সোশাল নেটওয়র্ক, মোবাইল ফোন। লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ মেনটেইন করা সহজ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার ফিজিক্যালিটি লাগে। যাকে চাই, তাকে হাতের কাছে চাই। স্কাইপে বা জি-টকে নয়। বন্ধুত্ব ব্যাপারটা আমার কাছে জরুরি।’
‘আর কমিটমেন্ট?’
‘কমিটমেন্ট ইজ টু বিগ আ ওয়ার্ড। আমি এখন ওসব নিয়ে ভাবতে চাই না। কলেজে ভরতি হয়েছি। পড়াশুনা করব, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারব, মজা করব, ডিগ্রি নেব! আপাতত এইটুকুই প্ল্যান। নট আ পেনি মোর, নট আ পেনি লেস।’
‘রাজনীতিতে আগ্রহ নেই?’
‘আঃহা! কামিং টু দ্য পয়েন্ট।’ হাহা করে হাসছে দময়ন্তী। ‘ফিশিং ফর নিউ রিক্রুট ফর ইয়োর পার্টি? কী যেন নাম তোমার দলের? প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম। তাই না? ইউ আর অ্যাপ্রোচিং রং পার্সন বিলুদা!’
‘আমি বলেছি যে তোকে রিক্রুট করতে চাই? আমি জাস্ট জিজ্ঞাসা করেছি যে তোর রাজনীতিতে আগ্রহ আছে কি না?’ বিরক্ত হয়ে বলে বিলু।
‘আছে। মোস্ট প্রোব্যাবলি তোমার থেকে বেশি আছে। কারণ আমার মা একজন জার্নো। অ্যান্ড হার ফিল্ড অব স্পেশালাইজেশন ইজ ন্যাশনাল পলিটিকস উইদ আ ফোকাস অন বেঙ্গল। বাড়িতে দিনরাত রাজনীতির চর্চা হয়।’
‘রিয়্যালি?’ ফিকফিক করে হাসছে বিলু। ‘রাজনীতিতে আগ্রহ আছে কিন্তু মানুষে আগ্রহ নেই। এটা হিপোক্রিসি হয়ে গেল না?’
‘হল না। তুমি জানতে চেয়েছ আমার রাজনীতিতে আগ্রহ আছে কি না। আমি সেই প্রশ্নের উত্তরে ”হ্যাঁ” বলেছি। তুমি যদি জানতে চাইতে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে আমার আগ্রহ আছে কি না, তাহলে বলতাম, ”না”। আমি নিজেকে অ্যাকডেমিশিয়ান অন পলিটিক্স বলেছি। পলিটিশিয়ান বলিনি।’
‘যাকে চালু কথায় ”আর্মচেয়ার পলিটিশিয়ান” বলা হয়।’ দাঁড় থেকে নেমে বলে বিলু।
‘অ্যাবসলিউডটলি রাইট।’ দাঁড় থেকে দময়ন্তী নেমেছে। জিনসের পিছন ঝেড়ে সে বলে, ‘থ্যাংকস ফর দ্য কফি। বাই।’
‘উঠল বাই তো কটক যাই। দাঁড়া, অত বাই বলতে হবে না। তোর কোনও ডাক নাম নেই? দময়ন্তী নামটা খুব বড়। উচ্চারণ করতে দাঁত ভেঙে যায়।’
‘উচ্চারণ কোরো না। প্রোনাঙ্কচুয়েশান করো। তা হলেই ঝামেলা মিটে যায়,’ শ্রাগ করে দময়ন্তী, ‘বাঙালিদের উচ্চারণের ব্যাপারে খুব একটা সুনাম নেই। হিন্দি তো বলতে পারেই না, বাংলাটাও ভুল বলে।’
‘যেমন?’ জানতে চায় বিলু। দময়ন্তী বলে, ‘কেয়া হুয়া, হুক্কা হুয়া টাইপের হিন্দি বাদ দিচ্ছি। বাঙালি ”সম্মান”কে বলে ”সনমান”। ”প্রতিবাদ”কে বলে ”পতিবাদ”। ”লজ্জাজনক”কে বলে ”লজ্জাস্কর”। জঘন্য উচ্চারণ!’
‘তোর বাংলায় কিন্ত কোনও টান নেই।’
‘কেনই বা থাকবে? আমি ইংরিজিটাও শুদ্ধ বলি। বাংলাটাও। বাড়ির শিক্ষা। বাই দ্য ওয়ে, আমার ডাকনাম দিঠি।’
‘বাহ! শর্ট অ্যান্ড সুইট। দিঠি, তোর বাবা পেইন্টার বললি না? কী নাম ওঁর?’
‘ড্যানিয়েল আর্চার। এবার আমি কাটছি।’ এজেসি বোস রোডের দিকে এগোয় দময়ন্তী। তার হাত চেপে ধরে বিলু বলে, ‘ড্যানিয়েল আর্চার মানে দিল্লি ডিকনস্ট্রাকটেড আরগোয়া নাগেটস সিরিজ যাঁর আঁকা? যাঁর স্ত্রী শক্তিরূপা সেনগুপ্ত উইকেন্ড-এর এডিটর?’
‘হ্যাঁ বাবা, হ্যাঁ। তুমি দেখছি আমার বাবা-মায়ের ব্যাপারে আমার থেকে বেশি জানো।’ হাসতে হাসতে বলে দময়ন্তী।
‘এতক্ষণে বোঝা গেল কেন তুই বিশ্বনাগরিক, কেন তুই কমিটমেন্ট ফোবিক, কেন তুই আর্মচেয়ার পলিটিশিয়ান!’ বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়ে বিলু, ‘ঠিক আছে দিঠি। কাল দেখা হবে। বাই।’
‘উঠল বাই তো কটক যাই!’ বিলুকে জিভ ভেঙিয়ে এজেসি বোস রোডের ভিড়ে মিলিয়ে গেছে দময়ন্তী।
বিলু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, ‘দিঠি! চমৎকার নাম!’ তারপর হোস্টেলের দিকে এগোয়। এই মেয়েটাকে সে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে। মেডিক্যাল কলেজে ট্যাঁশ মেয়ে কম দেখেনি সে। কিন্তু এ যেন সবার থেকে আলাদা। নিজের শিকড়ে ভীষণ গ্রাউন্ডেড। একই সঙ্গে ভীষণ আন্তর্জাতিক। হয় তো এরকম মেয়ে অনেক আছে। বিলুর দেখার জগৎ ছোট বলে এরকম মনে হচ্ছে। যাই হোক না কেন, মেয়েটার প্রতি বিলু একটা টান অনুভব করছে। প্রেমফ্রেম নয়, জাস্ট টান। মেয়েটাকে সংগঠনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এই কলেজের পিএমএফের তিন-চারটে মেয়ে আছে। মহিলা সদস্যের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।
সংগঠনের কথা ভাবতে ভাবতে বিলুর মাথা থেকে দয়মন্তীর চিন্তা উধাও। মনে পড়ে গেল, স্টেট লেভেলের লিডারদের সঙ্গে আজ মেডিক্যাল স্কোয়াডের একটা মিটিং আছে কালিঘাট থানার পাশে এক কমরেডের বাড়িতে। সব্যসাচী খবরটা দিয়েছে। স্টেট লিডারদের সঙ্গে কখনও মিটিং করেনি বিলু। রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ দিকে গড়াচ্ছে। গত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করার পরে সন্দীপ সামন্তর ঔদ্ধত্য বেড়ে গেছে। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সদম্ভে বলেছেন, ‘আমরা দুশোটা আসন পেয়েছি। ওরা তিরিশটা আসন পেয়েছে। এখন ওরা চুপ করে পনেরো বছর বসে থাক। আমাদের কাজ করতে দিক।’ হিটলারের সঙ্গে কোনও তফাৎ নেই লোকটার।
নতুনগ্রামে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্টেট কমিটির মিটিঙে প্রচণ্ড মতবিরোধ হয়েছিল। এটাও সব্যসাচীর মুখে শুনেছে বিলু। দলের একাংশ এই সরকারকে আরও একটা টার্ম সময় দিতে চাইছে। হাজার হোক, এরাই একদিন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছিল। জমিহীন কৃষকদের মধ্যে পাট্টা বিলি করেছিল। দলের অন্য অংশের বক্তব্য, অতীত ধুয়ে জল খেয়ে লাভ নেই। সন্দীপ সামন্ত এখন দেশি এবং বিদেশি পুঁজিপতির দালাল। শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এইসব করছেন। অবিলম্বে জনমোর্চাকে গদিচ্যুত করতে হবে। তার জন্য যদি দক্ষিণপন্থী শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, তাই সই। পকেট থেকে সিগারেট বার করে দাঁড়ে ঝোলানো জ্বলন্ত দড়ি থেকে ধরিয়ে, গলগল করে ধোঁয়া ছেড়ে হোস্টেলের দিকে এগোলো বিলু। সন্ধের মিটিংয়ে জানা যাবে, স্কোয়াডের বক্তব্য কী।
জোড়াগির্জা, মিশনারিজ অব চ্যারিটি, প্র্যাট মেমোরিয়াল, সেন্ট জেমস স্কুল— সব মিলিয়ে এন্টালির এই চত্বরটায় বেশ সাহেব সাহেব গন্ধ আছে। মায় আয়কর দফতরের নামও ‘ব্যাম্বু ভিলা’। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান—সব রকম মানুষজনের বসবাস। লেদার এক্সপোর্টকারী কোটিপতি থেকে চামড়ার কারখানার দিনমজুর, ড্রাগ পাচারকারী থেকে ড্রাগখোর, মাসাজ পার্লারের মেয়েলি ছেলে থেকে এসকর্ট এজেন্সির ডবকা ছুঁড়ি, মাংসের দোকানের শিশু কসাই থেকে সুপারি কিলার, চার্চের ফাদার থেকে হজ ফেরত মৌলবি—সবাই গায়ে গা লাগিয়ে ঘুরঘুর করে। কোটি টাকার এসইউভি আর রিকশা, তারকাটা ট্রাম আর ব্রেককাটা অটো, ঠেলা আর তিনশো সিসির বাইক পরস্পরের পাশে আরামসে দাঁড়িয়ে থাকে। এলাকাটা বেশ পছন্দ দময়ন্তীর।
আরও পছন্দ গোলমহল। একতলাটা, ড্যানিয়েলের ভাষায়, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’। কাঁসা-পেতলের বাসনের দোকান, দেওয়ালের ফুটোয় গজিয়ে ওঠা মোবাইল রিপেয়ারিং শপ, ফোটোকপি-ল্যামিনেশন-স্পাইরাল বাইন্ডিং-ডিটিপির ঝাঁ চকচকে অফিস, শ্যাম্পু-কন্ডিশনার-জেল-মুসের খালি কৌটো দিয়ে উইন্ডো সাজানো বিউটি পার্লার—এইসব পেরিয়ে ঘুপচি, ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেই সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ। পাথরের দেওয়াল, মার্বেলের মেঝে, ঝরোখার ফুটো দিয়ে আসা রোদ্দুরের বল্লম, পায়রার বকম বকম। বাইরের শব্দ ও দৃশ্যদূষণ ভিতরে পৌঁছয় না।
দোতলার দখল নিয়েছেন শক্তিরূপা আর ড্যানিয়েল। তিনতলাটা দময়ন্তীর। সংবাদ সাপ্তাহিকের সম্পাদকের বসার ঘর যেমন হওয়া উচিৎ, দময়ন্তীর স্টাডি রুম অবিকল সেরকম। বিশাল বড় ঘরের দেওয়াল জোড়া লম্বা বুকশেলফ বইয়ে ঠাসা। মেহগনি কাঠের মস্ত টেবিল কাগজপত্র আর ফাইলের স্তূপ। ডেস্কটপ কম্পিউটার সব সময় কুঁককুঁক শব্দ করছে। টেবিলের অন্যপ্রান্তে গোটাদশেক চেয়ার। বোঝা যায় এই বাড়িতে একসঙ্গে অনেক অতিথি আসেন।
স্টাডি আপাতত খালি। কিন্তু মেশিন চালু রয়েছে। অর্থাৎ শক্তিরূপা বাড়িতে। অবাক হল দময়ন্তী। সদ্য সম্পাদকের দায়িত্ব যিনি গ্রহণ করেছেন, তাঁর পক্ষে কাজের দিনে বিকেল চারটের সময় বাড়ি থাকা সম্ভব নয়!
শক্তিরূপা ও ড্যানিয়েলের শোবার ঘরটিও বিশাল বড়। ঘরের মাঝখানে গোটাকয়েক থাম আছে। এগুলো আগে ছিল না। ড্যানিয়েলের পরামর্শ মতো স্থপতি বানিয়ে দিয়েছেন। তাতে ঘরের রূপ খুলেছে। দেওয়ালে ঝুলছে ড্যানিয়েল এবং শক্তিরূপার সংগ্রহ করা সারা পৃথিবীর শিল্পকর্ম। ট্রাইবাল মুখোশ, পোড়ামাটি বা ধাতুর গয়না, চামড়ার বটুয়া এবং চাবুক, কাপড়ের স্ক্রল ও থাংকা, বিভিন্ন কেতার টুপি ও হাতপাখা, নানা আকৃতির ওয়াল হ্যাঙ্গিং আর উইন্ড চাইমে ঘরটি ঠাসা। শুধু ড্যানিয়েলের কোনও পেন্টিং নেই।
দোতলাতে আরও দুটো ঘর ছিল। আর্কিটেক্ট ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলে, মাঝের দেওয়াল ভেঙে সেটাকে একটা ঘরে বদলে দেওয়া হয়েছে। রাজস্থানি স্থাপত্যের জানলা ভেঙে বসানো হয়েছে শক্তপোক্ত কাচের উইনডো। আলোয় ভাসাভাসি এই ঘরটি ড্যানিয়েলের স্টুডিও। সারাদিন এই ঘরে কাটান তিনি। খেতে আর ঘুমোতে বাইরে বেরোন। রান্নাঘর আর খাবার ঘরও দোতলায়।
তিনতলায় একটিই ঘর। গোল, গম্বুজের মতো। ওঠার ব্যবস্থা বলতে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। আকারের কারণেই ঘরটির নাম হয়ে গেছে গোলঘর। দময়ন্তীর আস্তানা এই গোলঘর। শক্তিরূপা প্রথমে আপত্তি করেছিলেন। ড্যানিয়েল মেয়ের পছন্দ সমর্থন করেছেন এবং ঘরটি সাজিয়ে দিয়েছেন। গোলঘরের মাঝখানে একটা গোল বিছানা। ছাদের হুক থেকে ঝুলছে মশারি। রাতে শোয়ার সময় দড়ি ধরে টানলে গোল মশারি নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
গোলঘরের একদিকের পরিধি বরাবর বসার জায়গা। বেঁটে, চৌকো, গদিগুলো রাজস্থান থেকে আনা। পরিধির অন্যদিকে পড়ার টেবিল ও বই রাখার জায়গা। দামি, বিদেশি ব্র্যান্ডের ফারনিচার। হালকা, মজবুত, চূড়ান্ত ফাংশনাল, দুর্দান্ত স্টাইলিশ। গোলঘরে এ ছাড়া আছে একটা ইন্টারকম। এখানে এত হাওয়া বয় যে নিচ থেকে কেউ ডাকলে শোনা যায় না।
স্টাডি রুম থেকে স্টুডিওয় এসে ড্যানিয়েল এবং শক্তিরূপাকে দেখতে পেল দময়ন্তী। ড্যানিয়েল স্টুডিওর আর্মচেয়ারে বসে রয়েছেন। পরনে ঢোলা পাজামা আর বেনিয়ান। শক্তিরূপা মেঝেয় বসে রয়েছেন। পরনে এখনও অফিসের পোশাক, জিনস ও কুর্তি। গলা থেকে আইকার্ড পর্যন্ত খোলেননি। সাউন্ড সিস্টেম থেকে রবি ঠাকুরের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে—
‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি—
তবু মনে রেখো।’
স্টুডিওর দরজায় দাঁড়িয়ে দময়ন্তী বলল, ‘আসব?’
‘আয়!’ রিমোট টিপে গান বন্ধ করে হাত নেড়ে মেয়েকে ডাকেন ড্যানিয়েল। ঘাড় ঘুরিয়ে শক্তিরূপাও বলেন, ‘আয়।’
‘তুমি আজ তাড়াতাড়ি চলে এলে?’ স্টুডিওর ঠান্ডা মেঝেতে পা দিয়ে প্রশ্ন করে দময়ন্তী।
‘কেন এলাম বল তো?’ মেয়ের দিকে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করেন শক্তিরূপা। অনেক ভেবেও দময়ন্তী কোনও কারণ খুঁজে পায় না। তাদের তিনজনের কারোর আজ জন্মদিন নয়। তা হলে তৃতীয় অনুমানটাই ঠিক। ড্যানিয়েল-শক্তিরূপা যে ভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসছেন, তাতে পরিষ্কার, দুজনের কাছেই আজকের দিনটা স্পেশাল।
‘আজ তোমাদের বিবাহবার্ষিকী?’ জিজ্ঞাসা করে দময়ন্তী।
‘হ্যাঁ,’ একগাল হেসে জবাব দিলেন ড্যানিয়েল। ‘আজ আমরা শ্যামদেশের সুখাদ্য চাখতে বাইরে যাব।’
‘উফ! তোমার এই বাংলা!’ ড্যানিয়েলের হাঁটুতে চিমটি কাটেন শক্তিরূপা। দময়ন্তী বলে, ‘থাই ফুড? তার তো খুব অদ্ভুত নাম হয়। ভাত মতো খাও। খাও ঘি ভাত। খাও শুয়ে। খাও ফটাফট।’
‘ভ্যাট!’ আপত্তি করেন শক্তিরূপা, ‘কলেজে ঢুকে এইসব উলটোপালটা কথা শিখেছিস।’
সুখী দম্পতিকে বিরক্ত না করে দময়ন্তী গোলঘরে চলে যায়। রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার আগে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।