» » তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

বৃন্দা

‘বয়েজ অ্যান্ড গার্লস। লেটস গো টু দ্য ডিসেকশান রুম।’ হাত থেকে চকের গুঁড়ো ঝেড়ে এনজি এসএলটি থেকে বেরিয়ে গেলেন। গ্যালারিতে বসে থাকা ছেলেমেয়েরা একে অন্যের দিকে তাকাল। জেমসি বৃন্দাকে বলল, ‘ক্যাডাভার! সড়া হুয়া ডেডবডি! ইইকস! আই হেট অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল।’

বৃন্দা বলল, ‘ন্যাকামি করিস না। ডাক্তারি পড়তে এসে মড়া না ঘাঁটলে চলবে?’

জেমসি গত পরশু ফ্রেসার্শ ওয়েলকামের দিন অডিয়েন্সের ঝাড় খেয়ে সামান্য শুধরেছে। হোস্টেলের মেয়েদের কাছে অল্পবিস্তর বাংলা শিখতেও শুরু করেছে।

‘মোড়া মিনস ক্যাডাভার না? পোচা!’ মুখ ভেটকে বলে জেমসি। এসএলটির দরজা থেকে সবাইকে আহ্বান জানায় মিস্টার আইএমসি সুরজ, ‘চলো, চলো দোস্তোঁ, ডরনা মানা হ্যায়। রামনাম সত্য হ্যায়।’

দেড়শো ছেলেমেয়ে সুরজের আহ্বানে গুটিগুটি এসএলটি থেকে বেরোয়। বৃন্দা জেমসিকে বলে, ‘পোচা নয়, পচা। মোড়া নয়, মড়া। ক্যাডাভারের ঠিকঠাক বাংলা হল মৃতদেহ।’

‘টু টাফ। আই প্রেফার মড়া।’ জানায় জেমসি।

ডিসেকশন রুম অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের একতলায়। পাশেই মর্গ। এই সহাবস্থান চাহিদা এবং যোগানের তত্ত্ব মেনে। মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ স্থাপত্য নবীন চিকিৎসকদের বোঝানোর জন্য অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে প্রতিদিন বেওয়ারিশ লাশের প্রয়োজন। এত বেওয়ারিশ লাশ প্রতিদিন এক জায়গাতেই জড়ো হয়। মর্গ।

তবে ছাত্রদের পড়াশুনোর জন্য যে কোনও লাশ চলবে না। রোড ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট বা মেট্রোয় আত্মহত্যা বা ট্রেনে কাটা পড়া ছিন্নভিন্ন মানবশরীর অ্যানাটমির পাঠে কাজে আসে না। যে সব বেওয়ারিশ লাশে মানব শরীর ত্রুটিহীন থাকে সেইসব লাশই অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে সাপ্লাই হবে। কিছু কিছু মানুষ এনজিও-র মাধ্যমে স্বেচ্ছায় দেহদানের অঙ্গীকার করে থাকেন। তাঁদের শরীর ডাক্তারি স্টুডেন্টদের পড়াশুনোর কাজে লাগে। তবে তার সংখ্যা কম। কেউ দেহদানের ফর্ম ফিলআপ করে থাকলেও তার মৃত্যুর পরে বাড়ির লোক চায় শাস্ত্রমতে সৎকার করতে। তারা এনজিও বা হাসপাতালে ফোন করে মৃত্যুর খবর জানায় না। এইসব কারণে ত্রুটিহীন মৃতদেহ পাওয়ার জন্য বেওয়ারিশ লাশই ভরসা।

দোতলা অ্যানাটমি বিল্ডিং-এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিচ্ছিরি একটা গন্ধে বেরোয়। বৃন্দার বমি পায়। সমীরণ গতকাল রাতে বৃন্দাকে বলেছেন, ‘ওটা ফর্মালডিহাইডের গন্ধ। এই রাসায়নিক মৃতদেহের পচন রোধ করে। দুর্গন্ধ ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।’

অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে ঢোকার পথ বিল্ডিং-এর পিছনদিকে। রাস্তার দিকের দেওয়ালে বড় বড় জানলা তারজালি দিয়ে আটকানো। সোঁদা, স্যাঁতসেঁতে বাতাসে হলঘরের পরিবেশ ভারী। মনখারাপের ঝুলকালি কুয়াশার মতো মিশে রয়েছে আবহাওয়ায়।

অ্যাপ্রন পরে, হাতে ডিসেকশান বক্স নিয়ে দেড়শো ছেলে মেয়ে হলঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। এখানে কোনও বসার জায়গা নেই। হলঘরে আটটা টেবিল পাতা। চারপায়া টেবিলের ওপরে পাথরের স্ল্যাব। স্ল্যাবগুলো আপাতত শূন্য। দু’ সারি টেবিলের মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা সেইখানে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। বৃন্দা খেয়াল করল, সুরজ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘অ্যানাটমি বলতে তোমরা কী বোঝ?’ ইংরাজিতে প্রশ্ন করলেন এনজি। বৃন্দা চুপ করে রইল। আশেপাশে কয়েকটা হাত উঠল পণ্ডিতি ফলানোর জন্য।

‘সুরজ। তুমি বলো।’

‘ইটস আ ডেড সাবজেক্ট।’ ক্যাজুয়ালি শ্রাগ করল সুরজ। নিজের ডাবল মিনিং রসিকতায় নিজেই একপ্রস্ত হেসে নিল।

‘অ্যানাটমিস্টরা মৃতদেহ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। শরীরে কটা হাড়, কটা পেশি, কটা শিরা-ধমনী, কটা স্নায়ু, তার চর্চা চলে। মাসল এর শুরু ও শেষ, শিরা ও ধমনীর শাখা-প্রশাখা, স্নায়ুর গতিপথ, মস্তিষ্কের গঠন—সবই লেখা আছে। মোটা মোটা বই আছে, গাদা গাদা সিডি আর অ্যাপ আছে, কম্পিউটারে তথ্য স্টোরড আছে। মানুষের শরীর গত কয়েক হাজার বছরে বিশেষ বদলায়নি। তাই সাবজেক্টও বদলায়নি। সে অর্থে এটা ডেড সাবজেক্ট। তুমি ঠিকই বলেছ সুরজ। তবে কিনা, এ-বি-সি-ডি না শিখলে বই পড়া যায় না। বর্ণপরিচয় না হলে গপপো উপন্যাস পড়া যায় না। কাজেই ডাক্তার হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ হিসেবে তোমাদের মানব শরীর জানতে হবে। শরীরের প্রতিটি হাড়, মাংসপেশি, নার্ভ, আর্টারি, ভেইনের নাম জানতে হবে। পাগলের মতো মুখস্থ করতে হবে। অ্যান্ড ইউ পিপল উইল হেট মি লাইক এনিথিং।’ চুপ করেন এনজি।

‘আই হ্যাভ আ কোয়েশ্চেন স্যার।’ হাত তুলেছে সুরজ। আশকারা পেয়ে সে একটু স্মার্টনেস দেখাতে চায়।

‘বলো।’

‘আমাদের ক্লাসগুলো কীভাবে হবে? আমাদের কী গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হবে?’

‘থিয়োরি ক্লাস সবাইকে নিয়ে হবে। প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের জন্য তোমাদের দেড়শোজনকে রোল নাম্বার ওয়াইজ আমি ছটা গ্রুপে ভাগ করেছি। প্রতি গ্রুপে পঁচিশজন। তোমাদের ছ’ভাগে ভাগ করেছি কারণ ক্যাডাভারকেও অ্যানাটমিকালি আমরা ছটা পার্টে ভাগ করি। তোমরা এই ছটা কার্ড নাও। এতে অ্যালফাবেটিকালি তোমাদের নাম টাইপ করা আছে।’

সুরজ এগিয়ে গিয়ে কার্ড নিল। এনজি বললেন, ‘পড়ো সুরজ। গ্রুপে এ-তে কে কে আছে?’

সুরজ পড়ছে। বৃন্দা খেয়াল করল, তার চেনা নাম বলতে গ্রুপ এ-তে অভি ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিদের সঙ্গে আস্তে আস্তে আলাপ হয়ে যাবে।

সুরজের পড়া শেষ। কার্ড ফেরত নিয়ে এনজি বললেন, ‘কোন গ্রুপ কোন পার্ট স্টাডি করবে, সেটা আমি বলে দেব। প্রতিটি পার্ট একাধিক আইটেমে বিভক্ত।’

‘আইটেম?’ মুচকি হাসে সুরজ, ‘অ্যাজ ইন আইটেম নাম্বার?’

এনজি ঠান্ডা চোখে সুরজের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রায় একইরকম। এ গ্রুপের জন্য পার্ট হল, ‘ইনফিরিয়র এক্সট্রিমিটি’ মানে পা। এই পার্টকে একাধিক আইটেমে ভাগ করা আছে। ডিসেকশান ক্লাসে তোমরা এক-একদিন এক-একটা আইটেমের ডিসেকশান করবে। বাড়িতে গিয়ে গ্রে-র অ্যানাটমি খুলে সেটা স্টাডি করবে। তারপর আমাদের কাছে আইটেমের ভাইভা দেবে। সেটা শেষ হলে পার্টের ভাইভা হবে। অর্থাৎ পুরো ইনফিরিয়র এক্সট্রিমিটির ভাইভা।’

এনজির কথার মধ্যে পাঁচজন শিক্ষক-শিক্ষিকা এসে দাঁড়ালেন। এনজি বললেন, ‘আলাপ করিয়ে দিই, এঁরা তোমাদের শিক্ষক। ডানদিক থেকে প্রথমে রয়েছেন…’

এনজি-র কথা কেউ শুনছে না। প্রত্যেকে নাক চাপা দিয়েছে। বিকট, বিবমিষা উদ্রেককারী, তীব্র দুর্গন্ধে ভরে যাচ্ছে ডিসেকশান রুম। কালুয়ার নেতৃত্বে পাঁচজন ডোম ছ’টা ডেডবডি ছটা টেবিলে শুইয়ে রাখছে।

‘আমি এ গ্রুপকে ডিসেকশান শেখাব। তোমরা টেবিল ওয়ানে চলে এসো।’ এনজি আলাপ পর্ব সেরে প্রথম টেবিলে চলে গেছেন।

দেড়শো জনের দলটা ভেঙে গেল। পঁচিশ জনের ছোট দল টেবিলগুলোকে ঘিরে দাঁড়াল। বৃন্দা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে মৃতদেহের দিকে তাকাল।

বছর চল্লিশের এক নারী। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। ফর্ম্যyলডিহাইডে চুবনো থাকার ফলে শরীরে পচন ধরেনি। তবে শরীর শুকিয়ে গেছে। চোখ ঢুকে গেছে, গাল চুপসানো, কোমর সরু, হাত-পা কাঠিকাঠি, বুকের খাঁচা নৌকার দাঁড়ের মতো উঠে রয়েছে।

মহিলার মাথার দিকে দাঁড়িয়ে এনজি বললেন, ‘আমরা শুরু করছি ইনফিরিয়র এক্সট্রিমিটির পার্ট। প্রথম আইটেম হল ইঙ্গুইনাল ক্যানাল।’ তারপর গ্লাভস পরা হাতে ডিসেকশান বক্স খুলে স্ক্যালপেল বার করলেন।

বৃন্দার অস্বস্তি হচ্ছে। কেন সেটা বুঝতে সামনের দিকে তাকাল। টেবিলের ওপ্রান্ত থেকে অভি তার দিকে পলকহীন তাকিয়ে। বৃন্দার চোখে চোখ পড়ামাত্র দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। বৃন্দা দেখল, অভি ব্লাশ করছে। তার গাল আর কান ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে। কয়েকবার ঢোঁকও গিলল। বৃন্দা ভুরু কুঁচকে ভাবল, ব্যাপারটা কী? কৌতূহল নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে রইল।

বাঁদিকে সিঁথি করা একমাথা চুল। মায়াবী চোখ। না কামানো গালে এক-দুদিনের দাড়ি। সঙ্গে ব্রনর খানাখন্দ। নীল জিনস ও সাদা টি-শার্টে মাঝারি চেহারার ছেলেটিকে দেখলে মনে হয় সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। যুবকোচিত পৌরুষের বদলে লাবণ্যময় তারুণ্য খেলা করছে শরীরে। অভি বুঝতে পেরেছে যে বৃন্দা তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। ইঙ্গুইনাল ক্যানালের ডিসেকশান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সন্তর্পণে সে বৃন্দার চোখে চোখ রাখে। তারপর অপরাধীর মতো হাসে।

দুজনের মাঝখানে পড়ে রয়েছে বেওয়ারিশ রমণীর লাশ। বিশ্রী গন্ধ ভাসছে বাতাসে। কলকল কথা বলছে ছাত্রছাত্রীর দঙ্গল। জটিল, দাঁতভাঙা মেডিক্যাল টার্ম বলছেন এনজি। তারই মধ্যে বৃন্দা অভির দিকে তাকিয়ে হাসি ফেরত দেয়। অভির চোখমুখে অস্বাভাবিক ঔজ্বল্য ফুটে ওঠে। বৃন্দার মনে হয়, কেউ যেন সুইচ টিপে বালব জ্বেলে দিয়েছে অভির ভিতরে।

বৃন্দা ডিসেকশানে মন দেয়। এনজির সুচারু হাতের ছোয়ায় রমণীর ঊরুর উপর দিকে দেখা যাচ্ছে একটি খাত। যার নাম ইঙ্গুইনাল ক্যানাল। কোন কোন পেশি ও তন্তু দিয়ে ক্যানালের দেওয়াল তৈরি, বোঝার চেষ্টা করে সে। হঠাৎ বিকট শব্দে ডিসেকশন হল কেঁপে ওঠে।

শব্দটা এসেছে গ্রুপ এফ থেকে। হলের সবাই সেই টেবিলের দিকে তাকায়।

ক্যাডাভার দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছে সুরজ। ছয়ফুটিয়া যুবক কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেছে মেঝেতে।

সাবিনা ব্যাগ খুলে জলের বোতল বার করে সুরজের মুখে ছেটাল। চারজন ডোম সুরজকে চ্যাংদোলা করে ডিসেকশন হলের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। এনজি কড়া গলায় বললেন, ‘গাইজ অ্যান্ড গার্লস। তোমরা ডিসেকশানে মন দাও।’

গ্রুপ এ-র ছেলেমেয়েরা আবার টেবিল ঘিরে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চিপে এনজি বললেন, ‘আইটেম নাম্বার আর আইটেম যে এক জিনিস নয়, এটা এইবারে বুঝে গেল!’

রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে মেট্রো দাঁড়াল বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে ওপরে উঠে এস পি মুখার্জি রোডের ফুটপাথে পৌঁছে বড় শ্বাস নিল বৃন্দা। ডিসেকশান হলের দুর্গন্ধ এখনও তার শরীরে লেপ্টে রয়েছে। বাড়ি ঢুকে স্নান না করলে যাবে না।

শান্তিধামে এখন ভিজিটিং আওয়ার। বাড়ির সামনে গাদাগাদি করে ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে রয়েছে। গুচ্ছের লোকের ভিড় টপকে রিসেপশানের পিছন দিকের লিফটের বোতাম টিপল বৃন্দা। এটা প্রাইভেট লিফট। শান্তিধামের বাসিন্দা ও কর্মচারীদের জন্য।

চারতলায় পৌঁছে সোজা নিজের বাথরুমে ঢুকল বৃন্দা। আজ সে বাথটাবে স্নান করবে। কল চালিয়ে শোওয়ার ঘরে ফেরত আসে। ঝুনুর মা চা নিয়ে এসেছে। বৃন্দাকে দেখে বলল, ‘কোন নর্দমায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলে? গা দিয়ে বোকা পাঁঠার মতো বোঁটকা গন্ধ আসছে।’

‘নর্দমার থেকেও খারাপ জায়গায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম।’ ঝুনুর মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দেয় বৃন্দা। ‘আমি একঘন্টা ধরে চান করব। মাকে বলে দিও, আমাকে যেন বিরক্ত না করে।’

‘তোমার মা পাস্তা বানাচ্ছে। খাবে তো?’

‘খাবো।’ চা শেষ করে বাথরুমে ঢোকে বৃন্দা। কল বন্ধ করে বাথ-সন্ট, অ্যারোমেটিক অয়েল আর লিকুইড সোপ বাথটাবে ঢালে। ফটাফট জিনস, টি-শার্ট আর অন্তর্বাস খুলে জলে নামে। বাথটাবে পড়ার জন্য প্লাস্টিকের তৈরি কমিক্স রাখা আছে একদিকের র‌্যাকে। একটা কমিক্স নিয়ে পড়তে শুরু করে। আধঘণ্টা জলে বসে থাকার পরে আরও আধঘণ্টা ধরে সারা গায়ে ছোবড়া ঘষে স্নান করার পরে মনে হল গন্ধটা গেছে। বাথটাব থেকে উঠে শাওয়ারের তলায় আর এক প্রস্ত স্নান করে বৃন্দা। বাথটাবের ঝাঁঝারির ঢাকনা খুলে নোংরা জল বার করে দেয়। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে কেপরি আর টি-শার্ট পরে। ভিজে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রান্নাঘরে এসে বলে, ‘মা, খাব।’

মন্দিরার পাস্তা বানানো হয়ে গেছে। টেবিলে খাবার রেখে তিনি ঝুনুর মায়ের সঙ্গে ধোপার বাড়িতে কী কী কাপড় পাঠানো হবে, তার লিস্ট তৈরি করছেন। বৃন্দাকে দেখে বললেন, ‘এতক্ষণ ধরে স্নান করলি? ঠান্ডা লাগলে?’

‘আজকে ডিসেকশান শুরু হল। এখন থেকে আমি রোজ দুবেলা চান করব।’ পাস্তার থালা হাতে বলে বৃন্দা।

‘তার মানে ধোপার খরচ বাড়বে’।

‘তুমি এত কিপটে কেন বলো তো?’ মন্দিরাকে ধাঁতানি দেয় ঝুনুর মা। ‘রাজরানির মুখে এসব কথা মানায় না। তোমাদের পয়সা খাবে কে?’

‘আর যেই খাক না কেন, ধোপাকে বা তোমাকে খেতে দেব না।’ মৃদুস্বরে ঝুনুর মাকে ভর্ৎসনা করেন মন্দিরা। পাস্তা চিবোতে চিবোতে বৃন্দা দেখে মন্দিরার কোলে একটা ফোটো অ্যালবাম রাখা রয়েছে। এগুলো পুরনো জমানার অ্যালবাম। প্রি-ডিজিটাল যুগে লোকে ছবি প্রিন্ট করে অ্যালবামে সাজিয়ে রাখত।

টক করে অ্যালবামটা তুলে নেয় বৃন্দা। এটা কয়েক বছর আগে তার দেখা।

‘ওটা তোর দেখা।’ বিব্রত হয়ে বলেন মন্দিরা।

‘আর একবার দেখব।’ অ্যালবাম আর পাস্তার থালা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দ্য লোনলি ওয়াইফের অতীতে ডুব দেয়।

কালো, খসখসে, হ্যান্ডমেড পেপারের ওপরে আটকানো অজস্র ছবি। অধিকাংশই রঙিন। অল্প কিছু সাদাকালো ছবি আছে। আছে মন্দিরা অভিনীত সব সিনেমার রিভিউ, ইনভিটেশান কার্ড, লবি-কার্ড, পোস্টারের ফোটো, ফিল্মি জগতের মানুষদের চিঠিচাপাটি। এক কালের বাংলা ফিল্ম ইনডাস্ট্রির ডাকসাইটে হিরোইনের ‘অভিনয়-সমগ্র’ বলা যেতে পারে এই অ্যালবামকে। বৃন্দা জানে, মন্দিরার কাছে সব ছবির ডিভিডি আছে। মোট ন’টি ছবিতে অভিনয় করে অবসর নিয়েছিলেন তিনি।

মন্দিরার প্রথম ছবি ‘বেপাড়ার মেয়ে।’ মহানায়ক প্রদীপকুমারের সঙ্গে নবাগতা মন্দিরাকে চমৎকার মানিয়েছিল। গোল্ডেন জুবিলি পার্টিতে ওয়াইন গ্লাস হাতে, কাঞ্জিভরম পরা মন্দিরাকে দেখে মুগ্ধ বৃন্দা।

দ্বিতীয় ছবির নাম ‘প্রত্যাঘাত’। মুম্বইয়ের বাঙালি বিনোদ চক্রবর্তীর পরিচালনা। তিনজন হিরোর ছবি। তিন হিরোইনের রোল গানের দৃশ্যে তাদের কাঁচুলির থেকেও ছোট। রোলের দৈর্ঘ যেমনই হোক না কেন, ছবিটা ভালোই ব্যবসা দিয়েছিল। বিনোদ চক্রবর্তীর লেখা একটি চিঠি মন্দিরা ল্যামিনেট করে অ্যালবামে আটকে রেখেছেন। যশ চোপড়া মন্দিরার অভিনয় দেখে ইমপ্রেসড—এমন কথা চিঠিতে লেখা আছে।

তৃতীয় ছবির নাম, ‘সানাই’। অতীতের নামি পরিচালক অজিত রায়ের শেষ ছবি। হিরো আবারও প্রদীপকুমার। তবে এই ছবিটা চলেনি। গ্রাম বাংলার পটভূমিকায়, এক বিয়েবাড়িতে আসা বরের বন্ধু আর কনের বোনের প্রেম কাহিনি পাবলিক খায়নি। ‘সানাই’ বৃন্দার দেখা। খুব খারাপ সিনেমা। ছবিটার স্ক্রিপ্ট খারাপ, মিউজিক জঘন্য, লাইটিং অ্যামেচারিশ, মেকআপ যাত্রার মতো। প্রদীপকুমার যাত্রার হিরোদের মতো চড়া দাগের অভিনয় করেছে। যার পাশে মন্দিরার আন্ডার অ্যাক্টিং একদম মানায়নি। এই ছবি ফ্লপ করায় হার্ট অ্যাটাক করে অজিত রায় মারা যান। তাঁর শ্রাদ্ধের আমন্ত্রণপত্র সযত্নে সাজিয়ে রেখেছেন মন্দিরা।

মন্দিরার পরের তিনটি ছবি বাম্পার হিট। বিনোদ চক্রবর্তীর ‘প্রত্যাশা’, আর্ট ফিল্ম করিয়ে জিনিয়া দাশগুপ্তর ‘স্বপ্নের বারান্দা’, নবীন পরিচালিক জুটি শামিম-অজন্তার ‘রাতপরি’। ‘প্রত্যাশা’ গোল্ডেন জুবিলি করেছিল। আজও টিভিতে দেখালে চ্যানেলের টিআরপি বেড়ে যায়। মফসসলের মেয়ের শহরে এসে স্ট্রাগল করার গল্প। ছবিটা দেখতে দেখতে বহুবার কেঁদেছে বৃন্দা।

‘স্বপ্নের বারান্দা’-ও বৃন্দার প্রিয় ছবি। জিনিয়া নারীকেন্দ্রিক ছবি করেন। আদ্যন্ত ফেমিনিস্ট ছবি বানিয়ে বলেন, ‘আমি ফেমিনিস্ট নই, আমি হিউম্যানিস্ট।’ কলকাতার এক অধ্যাপিকা স্বপ্নে একটি বারান্দা দেখতে পান। ঘর বা বাহির নয়, শুধু একটি বারান্দা। সেই বারান্দার সন্ধানে বেরোন তিনি। এই জার্নি নিয়েই ছবি। দেশে ব্যবসা করতে না পারলেও বিদেশের একাধিক ফেস্টিভালে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। আন্তর্জাতিক ফিল্ম মার্কেটে ছবিটি ভালো দাম পায়। প্রোডাকশান কস্ট বহুকাল উঠে গেছে। নতুন নতুন দেশে ছবিটা আজও বিক্রি হয়। প্রযোজক আজও টাকা পান।

‘রাতপরি’ টিপিক্যাল মশলা-মুভি। হাই সোসাইটি কল-গার্লের রোল। ‘হোর উইদ আ গোল্ডেন হার্ট’ ফরমুলা যুগে যুগে হিট। দেবদাসের চন্দ্রমুখী সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ‘রাতপরি’তে মন্দিরার লিপে মিশা ধাবোলকারের গলায় ছটা গান ছিল। ক্যাবারে সং, লুলাবাই, রোম্যান্টিক ডুয়েট, মীরার ভজন, স্যাড সং—কী নয়! পুজোর মণ্ডপে গানগুলো আজও বাজে। বাঙালি নস্ট্যালজিয়া আর গানগুলো সমার্থক।

মন্দিরার সাত ও আট নম্বর ছবি হিন্দিতে। ‘আখরি জানবাজ’ বিনোদ চক্রবর্তীর ছবি। মালটিস্টারার এবং ফ্লপ। ‘তেরে খোয়াইশ’ সুপারহিট ডিরেক্টার মদনমোহন ভাটের ছবি এবং সুপার-ডুপার হিট। মন্দিরা মুম্বইতে শিফট করবেন, এরকমটা প্রায় ঠিক। যশ চোপড়ার সঙ্গে পরের ছবির কনট্র্যাক্ট সাইন হবে, এমন সময় মনোতোষের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্যামি ব্যানার্জির সঙ্গে আলাপ হল মন্দিরার। প্রেম করতে করতে ন’নম্বর ছবিটা করেছিলেন মন্দিরা। মনোতোষের পরিচালনায় মন্দিরার অন্তিম ছবি, ‘অচেনার ডাক’। এ ছবিও বক্স অফিসে যথেষ্ট সফল। পারিবারিক মেলোড্রামায় একাধিক নামকরা, জাঁদরেল অভিনেতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর কমিক টাইমিং-এর প্রশংসা করে সমালোচকরা বলেছিল, ‘ভারতীয় সিনেমা শুধু স্টার নয়, একজন চরিত্রাভিনেতাও পেয়েছে। ব্যবহারের দায়িত্ব পরিচালক ও প্রযোজকদের।’

পরিচালক ও প্রযোজকরা মন্দিরাকে আর পায়নি। অচেনার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি তখন ঘরের বউ।

অ্যালবাম দেখতে দেখতে কত সময় কেটে গেছে খেয়াল করেনি বৃন্দা। হঠাৎ খেয়াল করল, ঘরের মধ্যে পরিচিত একটা গন্ধ। তামাক, অ্যালকোহল, আফটার শেভ, ডিওডোর‌্যান্ট আর নতুন ইস্ত্রি করা জামাকাপড়ের গন্ধ। বাবার গন্ধ।

ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ। অন্ধকার নেমে আসায় মাথার কাছের টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে নিয়েছিল বৃন্দা। ল্যাম্পের আলো বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। আলোকবৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করেছে স্যামির পা।

‘বাবা!’ নিচু গলায় বলে বৃন্দা। ‘কটা বাজে গো?’

‘দশটা!’ জড়ানো গলায় জবাব দেন স্যামি, ‘খেতে চল।’

‘এত রাত হয়ে গেল?’ অ্যালবাম বালিশের পাশে রাখে বৃন্দা। সাতটা নাগাদ অ্যালবাম নিয়ে বসেছিল। ছবি দেখতে দেখতে তিনঘণ্টা পার করে দিল?

‘কলেজ থেকে ফিরতে অসুবিধা হচ্ছে না তো?’ প্রশ্ন করেন স্যামি। আজ বাবা আর মেয়ে মৌলালি পর্যন্ত একসঙ্গে গেছে। মৌলালিতে গাড়ি থেকে নেমে বাকি রাস্তা হেঁটে গেছে বৃন্দা। কলেজ থেকে ফেরার সময় বৃন্দা ব্রেকজার্নি করেছে। ট্রামে উঠে ধর্মতলায় এসে মেট্রো ধরেছে। ভিড় বাসে ওঠার অভ্যাস এখনও হয়নি।

‘অসুবিধে হচ্ছে না। তুমি কাপড় জামা ছাড়বে না?’ স্যামির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রতিপ্রশ্ন করে বৃন্দা। ঘরের আলো জ্বেলে দেয়।

‘ছাড়ব।’ অ্যালবাম হাতে নিয়ে স্যামি বলেন, ‘মায়ের পাস্ট সাকসেসের ছবি দেখছিস? আমার আজকের সাকসেস স্টোরি শুনলে অবাক হয়ে যাবি।’

বৃন্দা ভুরু কুঁচকে স্যামির দিকে তাকায়। স্যামির গোটা জীবনটাই সাফল্যে ভরপুর। স্কুলে, কলেজে, স্বদেশে, বিদেশে, সরকারি হাসপাতালে, বেসরকারি নার্সিং হোমে—সর্বত্র। সেই লোক বউয়ের অতীতের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত বোধ করছেন? যাচ্চলে! স্যামির হাত ধরে বৃন্দা ডাইনিং স্পেসে নিয়ে আসে। মন্দিরা খাবার টেবিলে বসে রয়েছেন। হাতে ফিল্ম ম্যাগাজিন। বৃন্দা বলল, ‘বাবা, আমরা আগে খেয়ে নিই। তারপর তুমি জামাপ্যান্ট ছেড়ো।’

‘না। আমি আসছি।’ অ্যালবাম নিয়ে মাস্টার বেডরুমে ঢুকে যান স্যামি। মিনিট দশেক বাদে স্নান সেরে, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে, গায়ে পারফিউম ছড়িয়ে বেরোন। চেয়ারে বসে বৃন্দাকে বলেন, ‘ফিল্ম অ্যাকটর বা অ্যাকট্রেস দেখলে অত এক্সাইটেড হোস কেন? দে আর অ্যাভারেজ পার্সন। রোগবালাই হলে ডাক্তারদের কাছেই আসতে হয়। আমার কাছে যেমন চন্দ্রিমা এসেছে। আজই ওর অ্যাপেনডিক্স অপারেশন করলাম।’

ঝুনুর মা খাবার দিয়েছে। ডালে রুটি ডোবাতে গিয়ে স্যামির দিকে তাকাল বৃন্দা। চন্দ্রিমার অপারেশন স্যামি করেছেন সপ্তাহখানেক আগে। যেদিন বৃন্দা কলেজে জয়েন করল, তার আগের সন্ধ্যায় চন্দ্রিমাকে শান্তিধাম থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। স্যামি সেটা ভুলে গিয়েছেন? অত্যধিক মদ্যপান করলে স্মৃতিভ্রম হয়। অ্যালকোহলিকরা বানানো গপপো বলে স্মৃতির শূন্যস্থান পূর্ণ করে। স্যামির কি তাই হল?

নাকি এ এক ধরনের জেলাসি? কলকাতা শহরের সফলতম শল্য চিকিৎসক তার স্ত্রীকে ঈর্ষা করছেন? যে স্ত্রী অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন আজ থেকে কুড়ি বছর আগে? হাস্যকর ব্যাপার!

বৃন্দা দেখল স্যামি স্যালাডের বোল থেকে চামচ দিয়ে শসা তুলছেন। চামচ ধরা স্যামির হাত থরথর করে কাঁপছে।

হাত কাঁপা বা ট্রেমরও অ্যালকোহলিজমের লক্ষণ। সার্জনের হাত কাঁপা মানে কেরিয়ারের পতনের শুরু।

বৃন্দা আড়চোখে মন্দিরার দিকে তাকায়। মন্দিরাও স্যামির কম্পমান হাত দেখছেন। তাঁর দুচোখে বিষণ্ণতা কাজলের মতো লেপটে রয়েছে। মাথা নিচু করে রুটি চিবোতে চিবোতে বৃন্দা ভাবে, বাবার শিল্পী বন্ধুদের এই বাড়িতে ঢোকা বন্ধ করতে হবে। ‘থ্রি উইচেস’ সুদিন, বিপিন আর মনোতোষের জন্যই স্যামির এই হাল!

‘তোমার কাল ওটি আছে। এইরকম ট্রেমর নিয়ে কাজ করবে কী করে?’ স্যামির হাত থেকে চামচ নিয়ে তার পাতে স্যালাড তুলে দেন মন্দিরা। স্যামি এক কুচি শসা মুখে পুরে বলে, ‘আগামী এক সপ্তাহ প্ল্যানড ওটি বন্ধ। তাপসী দেশে যাচ্ছে।’

‘তাপসী না থাকলেও অন্য ওটি সিস্টার তো আছে।’

‘তা আছে। তবে কুনালও বাড়ি যাচ্ছে। নার্সিংহোমের মেট্রন এবং আরএমও থাকবে না বলে নেক্সট উইকে ওটি রাখা হয়নি।’

বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনতে শুনতে বৃন্দা ভাবছিল, মন্দিরা এইবার মদ্যপান প্রসঙ্গে স্যামির তিন বন্ধুর কথা বলবে? মন্দিরা সে প্রসঙ্গে গেলেন না। তার বদলে বললেন, ‘মনোতোষদা আজ ফোন করেছিল।’

‘কেন?’ খাওয়া বন্ধ রেখে জ্বলজ্বলে চোখে মন্দিরার দিকে তাকান স্যামি।

‘জানি না। ঝুনুর মা ফোন ধরেছিল। আমি তখন বাথরুমে ছিলাম।’ খাওয়া শেষ করে চেয়ার থেকে উঠেছে মন্দিরা।

বৃন্দা দেখল, স্যামি রুটি ছিঁড়ছেন। তাঁর হাতের আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপছে।