নয়

পথিমধ্যে বিস্ফোরণ

কর্নেল ভাবছিলেন, পাখি উড়ে গেছে–এই উড়ো চিঠির খবর পানিগ্রাহীকে সুমন্ত দেয়নি বলে তিনি যেন বিচলিত বোধ করলেন। কেন? দ্বিতীয়ত পানিগ্রাহীর নির্দেশ ছিল–ভারতবাবু সংক্রান্ত (এবং কোনও মহিলা সংক্রান্তও বটে) যা কিছু ঘটবে, সব তাকে দুজনে যেন জানায়। এই দুটো ব্যাপার কেবলই মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সুমন্ত তেমন কোনও ভদ্রমহিলাকে লক্ষ করেনি হোটেলে। এর কারণ বোঝা যায় দুটো। এক : সুমন্ত মেয়ে সেজে থাকায় সে স্বভাবত খুব বেশি ঘোরাফেরা করেনি প্রকাশ্যে। দুই : সুমন্ত তার গার্লফ্রেণ্ড তাকে পেয়ে মেতে উঠেছিল। অন্যদিকে চোখ রাখবার স্পৃহা ছিল না। একজন তথাকথিত মড-এর পক্ষে এগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু সুমন্তের মতো ছেলের পক্ষে কতটা স্বাভাবিক?

এ সুইটের মহিলাটি কি এখনও আছেন হোটেলেঃ কর্নেল খুব জোরে পা চালিয়ে হাঁটছিলেন। কোথাও রিকশো দেখা যাচ্ছে না। রোদ নেই অবশ্য–মেঘলা দিনের বিষণ্ণতা আছে। হোটেলে যাওয়া খুবই জরুরী। কর্নেল যত এগোলেন, তত তার ধারণা দৃঢ় হলো যে, এ সুইটের মহিলাটি ভোরেই কেটে পড়েছেন সম্ভবত। নির্বোধ না হলে নিশ্চয় থেকে যাবেন।

সুমন্ত শিস দিতে দিতে হাঁটছিল। সত্যি, তার অবাক লাগে কর্নেল ভাবলেন– একালের ইয়ংম্যানদের তিনি বুঝতে পারেন না। এরা এত নির্বিকার আর তাৎক্ষণিকতাবাদী! সব ওমর খৈয়ামের চেলা একেকটি।…জীবনসুরা শূন্য হবার। আগে/পাত্রখানি নাও ভরে নাও, নিবিড় অনুরাগে।… এরা কেমন যেন নিঃসাড়, বোধশূন্য, জড়ভরত! যন্ত্রের মতো রোবোটই বলা যায়। পূর্বপুরুষদের সূক্ষ্মতম ইন্দ্রিয়গুলি এরা জন্মের সঙ্গে বয়ে আনেনি। গভীর যা কিছু তা এদের স্পর্শ করে না। বাংলায় একে বলে–গোলেমালে হরিবোল দিয়ে কাটানো।

কর্নেল! সুমন্ত ডাকল।

হ্যাঁ সুমন্ত, বলো।

পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করবে নাকি?

কর্নেল হাসলেন।… তুমি যদি অসত্য কিছু না বলো, পুলিশ তোমাকে গ্রেফতার করবে বলে মনে হয় না।

আপনার কি মনে হচ্ছে আমি কোথাও কিছু মিথ্যা জুড়েছি।

দ্যাট ডিপেণ্ডস, মাই ডিয়ার ইয়ং ফ্রেণ্ড।

ডিপেণ্ডস অন হোয়াট? কিসের ওপর?

পানিগ্রাহীর সঙ্গে তোমার সম্পর্কের ওপর।

ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুধু টাকার। স্রেফ মানি অ্যাণ্ড নাথিং এক্স।

শার্ক থেকে তাড়া খেয়ে তুমি আর তন্দ্রা যখন বাংলোয় ঢোকো, তখন সময় কত ছিল? আমি তখন জিগ্যেস করিনি। মোটমাট ঘটনাটি জানতে চেয়েছিলুম শুধু। কিন্তু পুলিশ চায় অবজেকটিভ ফ্যাক্টস অ্যাণ্ড ফ্যাক্টরস। মাইণ্ড দ্যাট, সুমন্ত। আজকাল পুলিশের কাজকর্ম মোর সায়েন্টেফিক প্রসেসে চলে। অন্ধকারে তারা কিছু হাতড়ায় না। কটার সময় তোমরা বাংলোয় ঢুকেছিলে?

ঘড়ি দেখিনি তখন। তবে আন্দাজ সাড়ে নটা হবে।

কতক্ষণ পরে তুমি তাকে রেখে বেরিয়েছিলে?

আধঘণ্টা প্রায়–হা, ওইরকমই হবে।

ঢুকেই কি সিগারেট ধরিয়েছিলে?

কেন স্যার?

প্লীজ সুমন্ত– নেভার স্যার! তুমি আমাকে কর্নেল বলেই ডেকো। দ্যাট আই লাইক মাচ।

সিগারেট… ।

হ্যাঁ-সিগারেট। খুব ভেবে জবাব দাও।

ঢুকে ভিজে কাপড়-জামা বদলে নিইধরুন, পাঁচ মিনিট। তন্দ্রার বদলানোর উপায় ছিল না। হা–ঢোকার মিনিট পাঁচ পরে সিগারেট ধরালুম।

কর্নেল মনে মনে হিসেব করে বললেন, ধরা যাক্ কুড়ি মিনিট। তুমি ওঠার সময় তাকে নিজের সিগারেট থেকে সিগারেট ধরিয়ে দিয়েছিলে?

হ্যাঁ। কিন্তু কুড়ি মিনিট কী বলছেন?

তুমি চেইনস্মোকার–কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে।…এটা তুমি জানো?

সুমন্ত অবাক হলো।…না তো!

তুমি সবসময় সিগারেট খাও না, তাই না?

হ্যাঁ। তা খাইনে বটে। খুব ভাবনা-টাবনা থাকলে খাই।

তখন চেইনস্মোক করো। অর্থাৎ নিজের সিগারেট থেকে ধরিয়ে ঘন-ঘন টানো।

সুমন্ত মাথা নাড়ল।…ঠিক বলেছেন কর্নেল।

ধরলুম–প্রতি সিগারেট পুড়তে ম্যাক্সিম্যাম সময় লাগুক পাঁচ মিনিট তোমার ক্ষেত্রে। কেমন? তাহলে বাংলোয় তুমি তিনটে সিগারেট খেয়েছিলে মোট। তার মানে বেশিপক্ষে পনের মিনিট। পাঁচ মিনিট জামা কাপড় বদলেছ। তাহলে কুড়ি হলো। তুমি বড়জোর কুড়ি মিনিট পরে বেরিয়েছিলে সুমন্ত, আধঘণ্টা নয়।

তা হতে পারে।

বাংলো থেকে গেস্ট হাউস যেতে যেখানটায় পানিগ্রাহীসায়েবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, দূরত্ব কতটা বলতে পারো?

তা-তিন-চারশো মিটার হবে।

তিন-চারশো? উঁহু–থাক। দূরত্ব মাপা তোমার কর্ম নয়। বলো–আন্দাজ কতটা সময় হেঁটে ওঁর দেখা পেয়েছিলে?

দৌড়ে যাচ্ছিলুম তো। মিনিট ছ সাত–উঁহু, মিনিট চারেরনাঃ, কর্নেল, মিনিট হিসেব করা মুশকিল। উত্তেজনার ঝেকে দৌড়োনো বৃষ্টি পড়ছিল।

ওই পথটার যা অবস্থা দেখেছি তাতে আমার ধারণা, খুব সহজে তুমি দৌড়তে পারছিলে না। পাথুরে পথ–তাছাড়া পিচ্ছিল হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। সমতলও নয়। অতএব আমার ধারণা, .. কর্নেল একটু থেমে ফের বললেন, পানিগ্রাহী বলছিলেন, ঠিক সাড়ে দশটায় উনি তোমার খোঁজে বেরোন। তাহলে সুমন্ত, বেশিপক্ষে আমি দশ-পনের মিনিট পরেই ধরে নিচ্ছি তোমারে সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল পৌনে এগারোটা নাগাদ। শার্কের নব বলেছে, সাড়ে নটায় মুখোশধারী ঢোকে। অতএব শার্ক থেকে বাংলো পাঁচ মিনিট যথেষ্ট, তারপর কুড়ি মিনিট, হলো পঁচিশ। তার মানে বাংলো থেকে বেরিয়েছিলে রাত নটা পঞ্চান্ন বা ধরো দশটা। কেমন? এবার সুমন্ত, টাইম ফ্যাক্টর গোলমেলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আন্দাজ কমপক্ষে আধঘণ্টা, বেশিপক্ষে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় হাতে রইল। এতটা সময় তুমি নিশ্চয় ওই রাস্তায় দৌড়োওনি! দ্যাটস অ্যাবসার্ড। তোমার কথাতেই বলি–তিন-চারশো গজ রাস্তা দৌড়োতে অতটা সময় কোনও অবস্থাতেই লাগতে পারে না। দ্বিতীয়ত তোমার পোশাক বদলানো–এটাও গোলমালে ফেলছে। বলেই কর্নেল একলাফে সুমন্তর একটা হাত ধরে ফেললেন, পালানোর চেষ্টা করো না সুমন্ত। আমি দেখতে বুড়ো হলেও পেশীগুলো বুড়ো হয়নি।

সুমন্ত ধস্তাধস্তি শুরু করল রাস্তার মধ্যে। কিন্তু কর্নেলের গায়ে অসুরের শক্তি। তারপর তিনি পকেট থেকে একহাতে রিভলভারটা বের করে ওর কাঁধে নল ঠেকালেন।…সুমন্ত, চুপচাপ আমার সঙ্গে চলল। আমি এ জীবনে কারও বেয়াদপি বরদাস্ত করিনি। হ্যাঁ–পা বাড়াও।…