আট
পানিগ্রাহী ও সুমন্তের বৃত্তান্ত
এখন বেলা এগারোটা। কর্নেল, কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর ডঃ শর্মা এবং এ.এস. আই. বরকত আলি একসঙ্গে সী-ভিউ হোটেলের লাউঞ্জে পৌঁছেই ঘড়ির দিকে তাকালেন। দেয়ালে একটা বিরাট গোল ঘড়ি টকটক আওয়াজ দিচ্ছিল। আওয়াজটা আকৃষ্ট না করে পারে না।
ভারতবাবু কথামতো আগেই চলে এসেছিলেন। অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ঘড়িটার বয়স স্যার তিন পুরুষ। আমার কর্তাবাবার আমলের বিলিতী জিনিস। আজকালকার পরিবেশে মানায় না।
তিন জনে সপ্রশংসদৃষ্টে ঘড়িটা দেখে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলেন। চারতলা বিরাট হোটেল। দোতলায় তিনটে সিঙ্গল, তিনটে ডবল সুইট রয়েছে। প্রত্যেকটাই এয়ার কণ্ডিশনড। চমৎকার আধুনিক ব্যবস্থা। অনেকটা করে কাচের দেয়াল বিশাল দামী সব পর্দা ঝুলছে। চওড়া লাউঞ্জ রয়েছে ওপরে। সামনেও কাচের গোল দেয়াল। সেখানে বসলে মনে হয়, সমুদ্রে ভেসে আছে বাড়িটা। গাছের টব আছে অগুনতি। ভারতবাবু দেখতে সেকেলে টাইপ, কিন্তু একেলে রুচি তার হোটেলের আষ্টেপৃষ্ঠে ছাপ ফেলেছে।
ওপর-নিচে দুজন করে পুলিশ প্রহরী রয়েছে। আলির ইশারায় সুইট নম্বর সি খুলে দিল একজন সেপাই। এয়ার কণ্ডিশনড চালু করলেন ভারতবাবু। বন্ধ ছিল আজ সকাল থেকে। মিছিমিছি পয়সা খরচ করার পক্ষপাতী তিনি নন। তারপর বললেন, আমার থাকার কি দরকার হবে স্যার?
কর্নেল বললেন, না–আপনি আপনার জায়গার গিয়ে বসুন ভারতবাবু। তেমন দরকার পড়লে খবর দেব।
ভারতবাবু চলে গেলেন। সিঙ্গল সুইট হলেও দুজনের শোবার ব্যবস্থা রয়েছে। একটা খাট ছাড়াও সোফা-কাম-বেড রয়েছে একপাশের দেয়ালে। খাটের বিছানা খুব সুন্দরভাবে গোছানো। কর্নেল বিছানাটা সাবধানে পরীক্ষা করলেন। বালিশের নিচে একটা লেডিজ রুমাল পাওয়া গেল, কোণে একটা গিট। অকারণ গিট–ভিতরে কিছু নেই। আর একটা কোণা পরীক্ষা করে কর্নেল বললেন, তার একটা অভ্যাসের পরিচয় পাচ্ছি। রুমালে গিট দেওয়া আর কোণা চিবুনোর অভ্যেস। সচরাচর এই অভ্যাস সরলতার প্রতীক। গোবেচারা ধরনের, ভীতু, লাজুক মেয়েদের এ অভ্যেস লক্ষ্য করা যায়।
শর্মা বললেন, ঠিক, ঠিক।
শার্কের টেবিলে বসে সে কাগজ ছিঁড়ছিল–এও ওই অভ্যাসের অন্তর্গত কিন্তু। অনেক সময় এই স্বভাবের লোকেরা নিজের অজান্তে দামী কাগজপত্র, এমনকি নোটও ছিঁড়ে ফেলে। আমি মনস্তত্ত্ব নিয়ে সামান্য নাড়াঘাটা করেছি। বলতে পারি, এই টাইপের লোকেদের জীবনে একটা চাপা কোনও দুঃখবোধ থাকে–যা নানা কারণের জন্যে হতে পারে। বাল্যে অবহেলা, কিংবা মানসিক প্রচণ্ড আঘাত পাওয়া–কোনও তীব্র সাধ না মেটা ইত্যাদি। আমার ধারণা তন্দ্রার এরকম কিছু ছিল।
বিছানায় আর কিছু পাওয়া গেল না। ওয়াড্রোব খুলে কিছু কাপড় চোপড় পাওয়া গেল। কর্নেল বাথে ঢুকলেন। বাথ টয়লেট প্রিভি একত্রে। তোয়ালে সাবান টুথব্রাশ যা যা লাগে, সবই রয়েছে। অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলেন না কর্নেল।
ফিরে এসে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ালগুলো তন্নতন্ন খুঁজলেন। একটা চকলেটের প্যাকেট পাওয়া গেল। কিছু প্রসাধনী। আর কিছু না।
এবার স্যুটকেস ও গোটানো বেডিংটা পরীক্ষার পালা। বেডিংটা এককোণে হোল্ডলে গোটানো রয়েছে। ভোলা হলো। তন্দ্রা একটু বিলাসী মেয়ে, তার পরিচয় সবখানে রয়েছে। কিন্তু সূত্র বলতে যা বোঝায়, মিলল না।
স্যুটকেসটা আগেই আলি তালা ভেঙে দেখেছিলেন। এখনও দেখা হলো খুলে। একটা ছোট্ট ফাইলে তার শিক্ষাদীক্ষার সার্টিফিকেট পাওয়া গেল। কলকাতার একটা কলেজের ছাত্রী ছিল সে-দুবছর আগে বি.এ. পাশ করেছে। কর্নেল বললেন, এই দুটো বছর তন্দ্রা চাকরি করে থাকলে অন্তত এসব ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট থাকত–সে সঙ্গে আনত নিশ্চয়। তা যখন নেই, তখন.. বলে হঠাৎ থামলেন তিনি। স্যুটকেসে কয়েকটা ভাঁজকরা জামা কাপড়ের নিচে তলার দিকে হাত চালিয়ে একটা নীল ইনল্যাণ্ড লেটার বের করলেন।
আলি শশব্যস্তে বললেন, আমি খুব খুঁটিয়ে কিছু দেখিনি স্যার। চোখ এড়িয়ে গেছল, দেখছি। কী ওটা?
কর্নেল বললেন, তাকে লেখা পানিগ্রাহীর তৃতীয় চিঠি। এটাই আমি এতক্ষণ খুঁজছিলুম।
তিনি চিঠিটা একান্তে নিয়ে গিয়ে খুললেন–কিছু মনে করবেন না আপনারা আগে আমি দেখে নিই।
আলির মুখটা গম্ভীর দেখাল। শর্মা মুচকি হাসলেন মাত্র।
চিঠিটা পড়া হলে কর্নেল বললেন, মিঃ শর্মা, সকাল থেকে আমি মূল যে জিনিসটা হাতড়াচ্ছিলুম-খুনের মোটিভ সম্ভবত পেয়ে গেছি। মোটিভটাই ভাইটাল ব্যাপার যে-কোনও খুনের কেসে। ডাক্তাররা যেমন বলেন, রোগ ধরা পড়াটাই চিকিৎসার অর্ধেক তেমনি মোটিভ ধরা পড়লেই খুনীকে ধরা সহজ হয়ে ওঠে। যাই হোক, মিঃ শর্মা বরাবর মুখ বুজে থাকলেও চন্দরপুর-অন-সীতে যে অকারণে আসেননি–তা আমার মাথায় ছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে–মোটামুটি জানতে পেরেছি।
আলি চাপা গলায় সরল মুখে শর্মাকে প্রশ্ন করলেন ব্ল্যাকমানি কেস, স্যার?
শর্মা হাসলেন।–না, মিঃ আলি। অন্য ব্যাপার। পরে জানতে পারবেন।
কর্নেল শর্মার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, মিঃ শর্মা, এবার প্লীজ– আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিলে অনেক জটিলতা সেরে যায়।
শর্মা হেসে বললেন, অবশ্যই। বলুন, কী জানতে চান?
প্রথম প্রশ্ন : মিঃ মদনমোহন পানিগ্রাহী এখন কোথায়?
গভমেন্ট গেস্ট হাউসে।
উনি কবে এসেছেন?
একুশে জুলাই রাত্রে।
আপনি কবে এসেছে?
আজ সকালে।
আপনাকে উনি ডেকেছিলেন নিশ্চয়?
হ্যাঁ। গতকাল দুপুরে ট্রাঙ্ক করেন দিল্লিতে। প্লেনে কলকাতা চলে আসি। আবহাওয়া খারাপ থাকায় প্লেন দমদম পৌঁছতে তিনঘণ্টা দেরি করে। তারপর রাত বারোটায় একটা সরকারী জীপ নিয়ে একা রওনা হই। পৌঁছেছি আজ ঠিক সাতটায়। পৌঁছে পুলিশ ইন্সপেক্টর আচার্যকে ফোন করেছিলুম। তাকে গেস্ট হাউসে তক্ষুনি চলে আসতে বলেছিলুম।
পাণিগ্রাহী আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন?
হ্যাঁ। দুঃখের সঙ্গে জানালেন–সব প্ল্যান ভেস্তে গেছে। এমনকি উনিই উল্টে বিপদে পড়েছেন।
ওয়েট। কর্নেল হাত তুললেন।পানিগ্রাহী প্রকাশ্যে আসছেন না কেন?
শর্মা বললেন, আসলে হয়েছে কী জানেন? বিরোধী রাজনৈতিক দল তো ওঁর বিরুদ্ধে নানা স্ক্যাণ্ডাল বরাবর রটাচ্ছে। ওঁর ভয় হচ্ছে, এটা নিয়ে আবার কাগজে হই-চই শুরু হলে ওঁর কেরিয়ারটি খতম হয়ে যাবে। তাই উনি বলছিলেন, খুনের মীমাংসা হয়ে গেলেই বরং ফার্মে আসবেন। তার মানে প্রকাশ্য হবেন।
আমি এখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই, মিঃ শর্মা। খুবই জরুরী।
চলুন–আপত্তি নেই। তবে
বুঝেছি। আমরা গোপনেই যাব। ধরুন, গেস্ট হাউসে আপনার ঘরেই চলেছি।
দ্যাটস রাইট। মিঃ আলি, প্লীজ ইট ইজ টপ সিক্রেট।
আলি বললেন, ইয়েস স্যার।
দুজনে বেরিয়ে এসে নিচে নামলেন। ভারতবাবু সবিনয়ে এগিয়ে দিলেন লন অব্দি। হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল বললেন, মিঃ শৰ্মা, যাবার পথে একবার শার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে যাব।
তাই চলুন। বরং ফার্মের ওখানে খবর পাঠালে পুলিশ ড্রাইভার দিয়ে আমার জীপটা পাঠিয়ে দিত।
থাক। আমরা পায়ে হেঁটেই যাই। মেঘ করেছে–বোদ কমে যাচ্ছে। বলে কর্নেল একবার আকাশ দেখে নিলেন। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে।
দ্য শার্ক-এর সামনে এসে কর্নেল দাঁড়ালেন। ভিতরে ঢুকলেন না। সামনের লন ও জমিটা খুঁটিয়ে দেখে পা বাড়াচ্ছেন, সেই সময় নব বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। কর্নেল বললেন, কতক্ষণ এসেছ নব?
এইমাত্র, স্যার। আসুন, ভেতরে আসুন।
না। পরে আসবখন। শোনো নব, এসেছ ভালই হলো। তুমি তো খুব কড়া নজরের মানুষ, এস–আমরা আশপাশটা খুঁজে দেখি।
কী খুঁজতে হবে স্যার? নব হাসল।…আবার কোনও খেলনা-টেলনা নাকি?
কর্ণেল গম্ভীর হয়ে বললেন, একজ্যাক্টলি। ঠিক তাই।
মুখোশটা স্যার?
হ্যাঁ–মুখোশ তো বটেই। আর–আর ইয়ে–ইয়ে-ধরো বেলুন।
বেলুন!
হ্যাঁ। একরকম বেলুন নিয়ে বাচ্চারা খেলে না? জল ভরা থাকে!
ওই তো স্যার, একটা পড়ে আছে।..বলে নব দৌড়ে গিয়ে রেস্তোরাঁর পিছন দিক থেকে একটা জলভরা বেলুন কুড়িয়ে আনল।
কর্নেল সেটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, জলটা পড়ে যায়নি। তবে সুতোটা ছিঁড়ে গেছে। নব, আরেকটা ঠিক এমনি বেলুন আমাদের দরকার।
নব লাফিয়ে উঠল।…স্যার, স্যার! ওইরকম একটা বেলুন পড়ে থাকতে দেখেছি। দাঁড়ান, এক মিনিট! আনছি। তখন দৌড়ে যেতে গিয়ে পায়ের চাপে পট করে ফেটে গিয়েছিল–ওই যে রাস্তার ওপর।
শর্মা অবাক হয়ে বললেন, বেলুনে কী আছে কর্নেল?
মিঃ পাণিগ্রাহী আপনাকে তাহলে সবটা বলেননি?
না তো–বেলুন সংক্রান্ত কোনও কথা নাঃ! ষ্ট্রেঞ্জ!
পানিগ্রাহীর সঙ্গে আজ সকালের দিকে কেউ দেখা করতে যায়নি?
না, না। তিনি তো গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এক্কেবারে আউট অফ সারকুলেশন যাকে বলে। কেউ জানেও না, তিনি এখানে আছে–শুধু ম্যানেজার ছাড়া।
ম্যানেজার বিশ্বাসী?
নিশ্চয়। সে আমাদের ব্যুরোর লোক। ডেপুটেড স্টাফ।
তাহলে অনেকদিন যাবৎ আপনারা চন্দনপুর অন-সীর ওপর নজর রেখেছেন?
নিশ্চয়?
সেই সময় ফাটা চুপসে যাওয়া ধূসররঙের আর একটা বেলুন নিয়ে নব দৌড়ে এল।…ফেটে গেছে বলে অসুবিধা হবে না তো স্যার?
কর্নেল সেটা নিয়ে বললেন, না। পেয়েছি, এই যথেষ্ট। আচ্ছা, চলি নব। মুখোশটা না পেলেও আমার চলবে–ওজন্যে তুমি মিছে পরিশ্রম করো না। চলুন, মিঃ শর্মা।
দুজনে প্রায় আধ মাইল হেঁটে সরকারী অতিথিভবনে পৌঁছলেন। সারা পথ। দুজনে যা কথা হলো, তা এই কেস সংক্রান্ত নয়। আবহাওয়া, পঞ্চবার্ষিক যোজনা, আয়কর আদায় সমস্যা–এইসব। কর্নেল টের পাচ্ছিলেন–যাই করুন, তিনি আসলে একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের ভূমিকা নিয়েছেন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর সরকারী অফিসার শ্রী শর্মা খুব সহজে তাকে কোনও সরকারী গোপনতথ্য জানাবেন না এবং সেটা বিধিবহির্ভূতও বটে।
নীচের লাউঞ্জে ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়ে শর্মাকে স্বাগত জানালেন। শর্মা চাপা গলায় বললেন, কোনও ভিজিটার এসেছিল আমার নাম করে?
না, স্যার।
মিঃ সত্যচরণ দত্তের কাছে?
একটি ছেলে এসেছিল স্যার। ফোনে জানাতেই মিঃ দত্ত. পাঠিয়ে দিতে বললেন।
সে কী! কীরকম ছেলে?
বছর একুশ-বাইশ বয়স হবে–ফরসা।
কর্নেল বললেন, মাথায় লম্বা চুল ছিল?
ম্যানেজার অবাক হয়ে বলল, না তো! ছোট-ছোট চুল।
কর্নেল গম্ভীর হয়ে গেলেন। শর্মা বললেন, যাক্ গে–সে মিঃ দত্তের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ছেলেটি কখন গেল? কতক্ষণ ছিল?
ম্যানেজার একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, মধ্যে কিছুক্ষণ ছিলুম না–স্যার। কখন গেছে, জানিনে। এসেছিল সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। নিশ্চয় চলে গেছে।
ভিজিটরস বুকে রেকর্ড রাখা হয়েছে?
হ্যাঁ স্যার, দেখাচ্ছি।
থাক। চলে যাওয়ার সময়ের রেকর্ড নিশ্চয় রাখেননি?
রাখিনি স্যার–পরে মিঃ দত্তের কাছে জেনে নিয়ে রাখব ভেবেছিলুম।
ভেবেছিলেন কিন্তু … ঘড়ি দেখে শর্মা বললেন–এখন পৌনে বারো। এখনও তা জেনে নেননি। এটা দায়িত্বহীনতার পরিচয় কিন্তু। অমনভাবে আপনাকে বলা হল তখন!
বলে তিনি ম্যানেজারের কৈফিয়ত শোনার গরজ না দেখিয়ে হনহন করে গিয়ে সিঁড়িতে উঠলেন। কর্নেল তাকে অনুসরণ করলেন।
দরজায় কার্ড আটকানো ছিল : মিঃ সত্যচরণ দত্ত। দরজা খুলে দিলেন এক ভদ্রলোক–উজ্জ্বল গৌর রঙ। মাথায় টাক। পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন। শক্ত সমর্থ গড়ন। মুখে যুবকের দীপ্তি রয়েছে। শর্মা পরিচয় করিয়ে দিলেন।… মিঃ পানিগ্রাহী।… প্রখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
কর্নেল ঘরের কোণের দিকের সোফায় তরুণটিকে লক্ষ্য করে বললেন, আশা করি–উনিই শ্ৰীমতী এস রায়?
তরুণটি কাঁচুমাচু মুখে হাসল। পাণিগ্রাহী অবাক হয়ে হাঁ করে তাকালেন কর্নেলের দিকে। বুদ্ধিমান শ্ৰী শৰ্মা হো-হো করে হেসে উঠলেন।
কর্নেল তরুণটির পাশে গিয়ে বসে বললেন, সকালেই চুল কাটা হয়েছে দেখছি! মাই ইয়ং ফ্রেণ্ড, অনেক কথা আছে। আপাতত আমি মিঃ পাণিগ্রাহীর সঙ্গে আলাপটা সেরে নিই। বাই দা বাই, এই বেলুন দুট নিশ্চয় আমার তরুণ বন্ধুটির সুপরিচিত?
ঘরে হাসির শব্দ হলো দ্বিগুণ। পানিগ্রাহী বললেন, সুমন্ত, কর্নেল সরকারের নাম তুমি জানো না সম্ভবত। তার কাছে কিছু চাপা থাকে না। যাক গে, কর্নেল আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে এমন সময়ে আপনাকে আমরা পেয়ে গেছি। বেচারা তন্দ্রার জন্যে কিছু করতে পারার সাহস এবার এসেছে আমার মধ্যে।
কর্নেল পানিগ্রাহীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি পি. এর জন্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন? কোন কোন কাগজে?
কলকাতার তিনটে ইংরেজি কাগজে।
দেখুন তো তন্দ্রাকে লেখা এই তিনটে ইনল্যাণ্ড চিঠি আপনার নাকি? বলে কর্নেল চিঠি তিনটে পানিগ্রাহীর হাতে দিলেন।
পানিগ্রাহী দ্রুত চোখ বুলিয়েই বললেন, হ্যাঁ–আমারই।
এই তিন নম্বর চিঠিটার তারিখ হচ্ছে ৮ জুলাই। যে নির্দেশ তাকে দিতে চেয়েছিলেন, তা এতে রয়েছে। আপনি সী ভিউ হোটলের মালিক ভারতবাবুর গতিবিধির ওপর চোখ রাখতে বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, ভারতবাবুর মহিলাদের প্রতি দুর্বলতা আছে। কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে কীভাবে মিশনে জানাতে হবে। আচ্ছা মিঃ পানিগ্রাহী, তন্দ্রা যে এ ধরনের কাজে রাজী হবে এবং অছাড়াও ভারতবাবুর মতো ব্যবসায়ী মানুষকে পটানোর ব্যাপারে তার ক্ষমতা আছে তা আপনি কীভাবে জানলেন?
পাণিগ্রাহী একটু অপ্রস্তুত হলেন যেন।…না–মানে ওর ফোটোই ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে দিয়েছিল। আমার মহিলাদের সম্পর্কে… একটু হাসলেন পানিগ্রাহী— আধুনিক মহিলাদের ব্যাপারে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে, কর্নেল!
ফটো দেখে কী বৈশিষ্ট্য টের পেয়েছিলেন?
সেক্সি গড়ন। বিশেষ করে চোখ দুটো। ওই চোখ আমি চিনি।
আরও অনেক ছবি আর দরখাস্ত আপনি পেয়েছিলেন কি?
নিশ্চয়। প্রচুর প্রচুর! আপনি দেখতে চাইলে…
থাক। তাদের মধ্যে তাকেই আপনি বেছে নিলেন?
দ্যাটস রাইট।…বলে পানিগ্রাহী একটু ইতস্তত করে ফের বললেন, থাক,
লুকোব না। এই সুমন্তর সুপারিশেই ওকে আমি নিই।
কর্নেল তার দিকে স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু মিঃ পানিগ্রাহী, ভারতবাবুর কালো টাকা, নিষিদ্ধ ড্রাগের কারবার ইত্যাদি কুকর্মের ব্যাপারে নজর রাখার জন্য উপযুক্ত সরকারী কর্তৃপক্ষ রয়েছেন। আপনি তাদের জানালেই তো সেকাজ তারা সরকারী খরচ আর উৎসাহ-উদ্যমে চালাতে পারতেন। বরং আরও ভাল পারতেন তাদের সব বিশেষজ্ঞ আছেন। তা না করে আপনি নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে ব্যক্তিগত উদ্যমে সেকাজে কেন নামতে গেলেন?
পানিগ্রাহী ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। হন্তদন্ত বললেন, নামব না কী বলছেন কর্নেল? আপনি জানেন না, এর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক কেরিয়ার আর অ্যামবিশান জড়িয়ে আছে! গত ইলেকশানে ভারতবাবু আমার বিরোধীদলের প্রতিদ্বন্দ্বীকে জেতাবার জন্যে লাখ টাকা খরচ করেছিল। সে ওদের সমর্থক। ওদের পার্টির ফাণ্ডে সে নিয়মিত মোটা টাকা দেয়। ওদের একটা জীপও দান করেছে সে। এ এলাকায় আমার নামে যত কুৎসা রটানো হয়েছে, তার মূল ওই লোকটাই–তা জানেন?
তাই বুঝি?
নিশ্চয়। আর দেখুন, মিঃ শর্মার সামনেই বলছি স্থানীয় পুলিশ বলুন, এনফোর্সমেন্ট বলুন, কাস্টমস বলুন–আমার জানা হয়ে গেছে! সব ওই ভারতের কাছে টিকি বাঁধা রেখেছে। আপনার তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা কী করবে, আমার ভালই জানা আছে। আর সেজন্যেই তো খোদ দিল্লি থেকে একেবারে সি. বি. আই. এর বড়কর্তাকে আসার জন্যে ট্রাঙ্ককল করেছিলুম। আপনার সামনেই উনি বসে আছেন। জিগ্যেস করুন ওঁকে। এর জন্যে হোম মিনিস্টারকে ধরতে হয়েছিল পর্যন্ত।..বলে উত্তেজিত পানিগ্রাহী একটু দম নিলেন। ফের বললেন, এর আগে বিস্তর চেষ্টা করেছি সরকারের লোকজনকে দিয়ে। তাদের এই এক কথা–ভারতবাবুর ব্যাপারে সন্দেহজনক কিছু নেই। বুঝুন তাহলে। অথচ আমি জানি–ভালভাবেই জানি যে লোকটা নিয়মিত ড্রাগের চোরা কারবার চালায়। হোটেল থাকায় সুবিধে হয়েছে। বিদেশী গলার হোটেলে এসে ওঠে। কোনও সন্দেহ করার উপায় নেই। লেনদেন দিব্যি চলে। আসে বিদেশী ড্রাগ এল. এস. ডি. যায় গাঁজা আর কোকেন। আসে ভেনডিটা ক্যাপসুল, যায়। আফিং। আসে…
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, বুঝলুম। তাছাড়া এটা নিশ্চয় রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতা হিসেবে আপনার নৈতিক কর্তব্যও বটে।
পানিগ্রাহী সোৎসাহে বললেন, একজ্যাক্টলি, একজ্যাক্টলি!
তাহলে ভারতবাবুর ওপর চোখ রাখবার জন্যে আপনি মিস তন্দ্রা ভাদুড়ী নামে একটি সেক্সি চেহারার মেয়েকে চাকরি দিলেন এবং ভারতবাবুর হোটেলে সুইট ভাড়া করে থাকতে নির্দেশ দিলেন। মিঃ পানিগ্রাহী, ২১ জুলাই তারিখটি তন্দ্রা আসার এবং সেইসঙ্গে আপনারও আসার জন্যে কেন বেছে নিলেন? কেন ২০, ১৯, ১৮, ১৭ কিংবা অন্য কোনও তারিখ নয়?
ঠিকই ধরেছেন কর্নেল সরকার! ওই তারিখে আসতে বলার উদ্দেশ্য ছিল। আমি কোনও সুত্রে জানতে পেরেছিলুম যে ২২ তারিখ রাত্রেই ভারতবাবু একটা মোটারকমের লেনদেন করবে। কিন্তু কীভাবে শয়তানটা আমার সব প্ল্যান টের পেয়ে ভাড়াকরা খুনী লাগাল তন্দ্রার পিছনে। মুখোশ পরে খুনী ফলো করল তন্দ্রা আর সুমন্তকে। তারপর…।
কিন্তু ওটা স্রেফ ফার্স মিঃ পানিগ্রাহী!
ফার্স? তার মানে?
কর্নেল রাঙতার ছুরির তথ্য জানালেন। পানিগ্রাহী হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, তাহলে তো ব্যাপারটা ভারি রহস্যময়! আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, তাকে ওইরকম ভয় দেখিয়ে ভারতবাবু তাড়াতে চেয়েছিল এখান থেকে?
এও হতে পারে। আই এগ্রি। কিন্তু তন্দ্রা খুন হলো সত্যি সত্যি।
হ্যাঁ–খুন হলো?
মিঃ পানিগ্রাহী, এবার আমি ফের কিছু প্রশ্ন করি।
বলুন কর্নেল?
এই ছেলেটি–সুমন্ত, একে কোথায় পেলেন?
সুমন্ত আমার অনেকদিনের চেনা ছেলে। আমি ওকে আসতে বলে এসেছিলুম কলকাতা গিয়ে। তখনই ও বিজ্ঞাপন দেবার পরামর্শ দেয়। যাই হোক, আফটার অল তন্দ্রা মেয়ে, তার একটা রিস্কের ব্যাপার ছিল। তাই ভাবলুম, তার বয়ফ্রেণ্ড হিসেবে ও যদি নিছক বেড়াতে এসে তার সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে গেছে–এভাবে তার কাছাকাছি থাকে, তাহলে সুবিধে হয়। তন্দ্রা আর আমার মধ্যে গোপন যোগাযোগের মাধ্যম হবে সুমন্ত। আজকাল তরুণ-তরুণীদের মেলামেশার রীতি ভারতবাবু তো চোখের ওপর দেখছে। তাই সন্দেহ হবে না!
আপনার তৃতীয় চিঠিতে তারই উল্লেখ আছে বটে। কলকাতা থেকে জনৈক এস. রায় দেখা করবে তাকে। তন্দ্রা যেন তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। তন্দ্রা সেই নির্দেশ পালন করেছিল জানতে পেরেছি। কিন্তু কেন সুমন্ত মেয়ে সাজল? বুকে এই বেলুনদুটো আটকে একেবারে মডগার্ল সেজে…
বাধা দিয়ে পানিগ্রাহী বললেন, পরে ভেবে দেখেছিলুম, সুমন্ত সঙ্গে থাকলে ভারতবাবুকে করতলগত করতে পারবে না তন্দ্রা। বয়ফ্রেণ্ডওয়ালা মেয়ের সঙ্গে সে। মিশতে সাবধানী হয়ে উঠবে। তার চেয়ে তার মেয়েবন্ধু হয়ে থাকাটা খুব সুবিধাজনক। সুমন্ত চৌকস ছেলে। রাজনৈতিক দলে কালচারাল সুখ্যাতি আছে কর্মী। হিসেবে। সে দরকার হলে মারামারি খুনোখুনিতেও সিদ্ধহস্ত।… বলে সস্নেহে সুমন্তর দিকে তাকালেন পাণিগ্রাহী। তারপর বললেন, যাই হোক–তখন আর হাতে সময় নেই। সুমন্তকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলুম, আমি কী নামে কোথায় থাকব…
তন্দ্রাকেও কি জানিয়েছিলেন পরে–মানে, সুমন্তর মারফত?
হ্যাঁ। তা–এই গেস্ট হাউসের বেয়ারাকে দিয়ে চিঠি পাঠালুম। আপনি সেই বেয়ারাকে জিগ্যেস করলেই জানতে পারবেন।
থাক্, বলুন। সুমন্ত তখন কোথায় ছিল?
আমার বাংলোয়?
হুঁ–তাকে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েছিলুম।
কিন্তু হাসিরাম তো একুশ তারিখ বিকেলে বাংলো সাফ করতে গিয়েছিল। সে তো কিছু বলল না।
হাসিরাম সুমন্তকে চেনে। সুমন্ত গত ইলেকশানে–এ বছর মার্চে আমার সঙ্গে বাংলোয় ছিল কয়েকদিন। তখন অবশ্য মাথায় লম্বা চুল ছিল না ওর। কিছুকাল আগে কলকাতায় ওর সঙ্গে দেখা হয়–তখন ওর মাথায় লম্বা চুল দেখেছিলুম। তাই আমার শেষ মুহূর্তে মতলব এসেছিল যে ওর যা মেয়েলি চেহারা, আনায়াসে মডগার্ল বলে চালানো যায়। অবশ্য বেয়ারার চিঠিতে আমি ওকে বুকে জলভরা বেলুন বাঁধতে লিখিনি।..হো-হো করে হাসলেন পাণিগ্রাহী। সুমও হাসল।
তাহলে হাসিরাম সুমন্তকে দেখেছিল বাংলোয়। সে আমার কাছে তাহলে কথাটা চেপে গেছে। আচ্ছা, মিঃ পানিগ্রাহী, এবার বলুন–২২ জুলাই রাত্রে আপনি কী কী করেছেন?
কথা ছিল–আমার সেই সোর্সের খবর সতি হলে সুমন্ত তক্ষুনি সোজা এখানে এসে আমাকে খবর দেবে। তাই ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি রেনকোট পরে বেরোলুম। তখন রাত সাড়ে দশটা। এই গেস্ট হাউসের পিছনেই একটা জংলা পথ আছে–টিলার গা ঘেঁষে আমার বাংলোয় পৌঁছেছে। আমি বেরিয়ে দোটানায় পড়লুম। সী ভিউতে যাব না, আমার বাংলোয়। সুমন্ত যদি আমাকে জানাত যে সে একুশ তারিখ রাত্রে বাংলোয় না থেকে হোটেলে তার কাছেই ছিল এবং পরের রাতেও থাকবে–তাহলে আমি বাংলোয় যেতুম না। অন্য প্ল্যান করতুম। কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েদের আমি সত্যি বুঝতে পারিনে। সুমন্ত তন্দ্রার সঙ্গে রাত কাটাবে আর তন্দ্রা সব জেনেও তাতে আপত্তি করবে না–আমি ভাবিনি।
সুমন্ত চাপা স্বরে বলল, তন্দ্রা বরাবর আমার গার্লফ্রেণ্ড ছিল।
পানিগ্রাহীর স্বরে রাগ ও ভর্ৎসনা প্রকাশ পাচ্ছিল। বললেন, দা হেল অফ ইট! যা গে–আমি তখন উদ্বিগ্ন। ভাবলুম, বৃষ্টির জন্যে নির্ঘাৎ ভারতবাবুর প্ল্যান ভেস্তে গেছে-তাই তখনও কোনও খবর পাচ্ছিনে সুমন্তদের কাছ থেকে। তাই
এবার শর্মা মন্তব্য করলেন, না মিঃ পাণিগ্রাহী। এইসব রাত্রেই তাদের চমৎকার মওকা। আপনি কেন যে লোকাল থানায় মিঃ সেনাপতিকে কিছু বলে রাখেননি, সেটাই অবাক লাগছে আমার!
পানিগ্রাহী ফুঁসে উঠলেন, সেনাপতি! ও তো ভারতের লোক, মশাই! আমার সোর্স জানিয়েছিল…সেনাপতি-টেনাপতি সবাই সব জেনেও চুপ করে থাকবে।
শর্মা বললেন, কিন্তু আপনি এলাকার রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা মিঃ পানিগ্রাহী।
পানিগ্রাহী চটে উঠলেন।…ওঁদের ওই ল্যাক অফ ভিসনের জন্যেই তো আমরা আমলাতন্দ্রের বিরুদ্ধে চেঁচাই। আপনারা মশাই বাস্তব অবস্থা কিছুমাত্র টের পান না। স্বয়ং মিনিস্টার না লাগলে আপনাদের টনক নড়ে না। আমি কোন ছার! আমি কী করতে পারি লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের! যখন এম এল এ ছিলুম, তখন পারতুম। এখন এম এল এ নই স্রেফ নেতা। মিনিস্টাররাও একশোটা কথা বললে তবে একটা কথায় কান পাতেন। আমি তো মশাই যাত্রাদলের রাজা–ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার।
কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, ফ্যাক্ট। তারপর কী হলো বলুন।
পানিগ্রাহী শান্ত হয়ে বললেন, আমি প্রথমে বাংলোয় যাওয়ার সিদ্ধান্ত করলুম। মাত্র গজ দশেক গেছি, দেখি, কে দৌড়ে আসছে। অন্ধকার ছিল–কিন্তু বিজলী চমকাচ্ছিল। সুমন্তকে চিনতে আমার ভুল হলো না। সুমন্তও আমাকে দেখতে পেয়েছিল। যাই হোক–ও আমাকে সাংঘাতিক খবর দিল। শার্কে বসে থাকার সময় কে ওদের মুখোশ পরে ছুরি নিয়ে তাড়া করে। দুজনে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমার ফার্মে ঢুকে পড়ে। বাংলোতে যায়। সেখানে তাকে একা রেখে সে আমাকে খবর দিতে আসছিল।
একা রেখে! এই কাণ্ডের পরও? শর্মা এই প্রশ্ন করলেন।
সুমন্ত বললে, হ্যাঁ–ওকে সঙ্গে আনিনি। কারণ বৃষ্টিতে ভিজে আর এইভাবে তাড়া খেয়ে তন্দ্রা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিল। তাছাড়া ওর দিকেই যেন ছোরাধারী লোকটার লক্ষ দেখেছিলুম বেশি। তন্দ্রা মেয়ে। আমার পক্ষে যা সম্ভব ওর পক্ষে তা নয়। তাই ওকে রেখে এসেছিলুম। বাংলোয় সে নিরাপদে থাকবে। ভিতর থেকে ভালোভাবে দরজা আটকাতে বলে আমি তবে বেরিয়ে এসেছিলুম।
পাণিগ্রাহী বললেন, সুমন্ত আমাকে খবর দিতেই আমি আরও উদ্বিগ্ন বোধ করলুম। আমার কাছে একটা লাইসেন্সড রিভলভার আছে। আমি আর সুমন্ত তক্ষুনি ফিরে গেলুম বাংলোয়।
কর্নেল বললেন, গিয়ে দেখলেন দরজা খোলা। আর বেডরুমে তন্দ্রা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে।
পানিগ্রাহী ব্যস্তভাবে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ–গিয়ে সেই ভয়ানক দৃশ্য দেখলুম। সুমন্তর এ ব্যাপারে মাথা খোলে সবসময়। সে আমাকে একটা চমৎকার পরামর্শ দিল। তা না করলে এই মার্ডারের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়ুক বা না পড়ুক–পড়ার চান্স তো থাকেই, প্রচণ্ড স্ক্যাণ্ডাল রটে যাবে। আমার পলিটিক্যাল কেরিয়ার নষ্ট হবে। তখন ওর কথা মতো
মড়াবওয়া লোক আর একটা খাটিয়া যোগাড় করলেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করছি, কর্নেল।
সুমন্ত বলল, আমি বেরিয়ে প্রথমে গেলুম সমুদ্রের কাছে শ্মশানে। শ্মশান থেকে একটা মাচান নিয়ে এলুম। অনেক খাটিয়া বা মাচান ওখানে পড়ে থাকে দেখেছিলুম। এই মাচানটা টাটকা ছিল। সেটা বয়ে সোজা নাক বরাবর ফার্মের খোলা গেটে ঢুকে বাংলোয় আনলুম। আগে গেটটা খোলা রেখেছিলুম। তারপর মাচানে তন্দ্রার লাসটা চাপিয়ে ওপাশের বারান্দায় নিয়ে গেলুমতলায় পুরনো একটা ষেক দেওয়া হয়েছিল। রক্তগুলো ধুয়ে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু মোমবাতির আলোয় সেটা সহজ মনে হলো না। ভাবলুম, সকালে ধুয়ে ফেলব খন। হাসিরামকে সব জানাতে হবে। যাই হোক, লাশটা দুজনে বয়ে এনে বড়ো রাস্তার ধারে একটা বটতলায় রাখলুম। তখনও বৃষ্টি থামেনি। পানিগ্রাহীদাকে এখনে সবাই চেনে। উনি চলে গেলেন। আমি গেলুম ডোমপাড়ায়। গিয়ে বললুম– পাশের গ্রামের মড়া আমারই এক আত্মীয়া। বটতলায় বৃষ্টির মধ্যে আটকা পড়েছিলুম। মড়াবওয়া লোকগুলো সব মদদ খেয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করে মড়া ফেলে পালিয়েছে। আমি ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি। ওদের সাহায্য দরকার।…ওরা প্রথমে রাজি হলো না। সব তখন ঘুমের ঘোরে আর নেশায় টলছে তো! ওদের অনেক টাকা আর মদ খাওয়ানোর প্রস্তাবে রাজি হলো। চারজন লোক নিজেরা ঠিক করে দিল। তাদের নিয়ে পাশের খুঁড়িখানায় গেলুম। দেখি, তখনও সব মক্কেল রয়েছে। তিনটে বোতল কেনা হলো দিশী। ওরা সেখানে বসে খেল। তারপর আমার সঙ্গে বটতলায় এসে মড়া তুলল। অন্ধকার। বৃষ্টি পড়ছে। মাতাল হয়ে উঠেছে লোকগুলো। আমরা হরিধ্বনি দিতে দিতে এগোলুম।
কর্নেল বললেন, কিন্তু মড়া শেষ অব্দি শ্মশানে না নিয়ে মিঃ পানিগ্রাহীর ফার্মের জমিতে ফেললে কেন?
পানিগ্রাহী বললেন, ওটাই তো সুমন্তর অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি!
সুমন্ত বলল, শ্মশান থেকে মাচান লুকিয়ে আনা সোজা। কিন্তু মড়া নিয়ে যে যাব, শ্মশানের রেজিস্টারের চোখ এড়াবে না। ডেথ সার্টিফিকেট চাইবে। রক্তক্ত দেখতে পাবে, তাই
কর্নেল বললেন, একথা আগে ভাবোনি তোমরা।
না স্যার। তখন দুজনেরই মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন। অতটা তলিয়ে ভাবিইনি। অন্ধকার রাতে বৃষ্টির মধ্যে ঝোঁকের বশে চলেছিলুম।
তারপর?
ফার্মের গেটের কাছে গিয়ে ঠিক করলুম–অন্য উপায় ঠিক করা যাক। আফটার অল, তা আমার গার্লফ্রেণ্ড–গভীর ভালবাসা কিছু ছিল না, কিন্তু তাহলেও স্যার–আমার মরালিটি যেটুকু আছে, তাতে বাধল। পাণিগ্রাহীদার সামনেই বলছি–আমার সন্দেহ হলো, বা রে! একটি অসহায় মেয়ে ওঁর কাজে এসেই খুন হলো। আর উনি পুলিশকে জানাবার বা খুনীকে ধরিয়ে দেবার যেন নামই করলেন না! উপরন্তু লাশটা সামলাতে বলছে! আমার বিবেকে বাধল, স্যার! আমি ঠিক করলুম–এমন কিছু করা দরকার যাতে পানিগ্রাহীদা বাধ্য হয়ে তার মার্ডারের কথা পুলিশকে জানাবেন কিংবা নিজের সম্মানরক্ষার জন্য খুনীকে ধরতে নিজের প্রভাব খাটাবেন। কিন্তু কিছুই করছেন না। তাই রাগ হলো। ওঁকে তন্দ্রার মার্ডারের সঙ্গে আমি জড়াবো ঠিক করলুম। তাই লোকগুলোকে দাঁড় করালুম। বললুম– দেখ–এখন বৃষ্টির মধ্যে লাশ চিতেয় ওঠানো অসম্ভব। রেজিস্ট্রারবাবুও হয়তো আফিং খেয়ে ঘুমোচ্ছন। সেই ভোরবেলা ছাড়া কিছু করা যাবে না। বরং এক কাজ করা যাক। লাসটা কোথাও ফেলে দিই। এত বৃষ্টির মধ্যে কী করা যাবে তোমরাই বলো? এখানটায় ফেললে মিউনিসিপ্যালিটির মেথররা তুলে কোথায় ফেলে দেবে-সঙ্কার হবে না। তার চেয়ে এই ফার্মের জমিতে ফেললে কাজ হবে। এক হোমরা-চোমরা নেতার জমি। ভোটের জন্যে ওনারা সব করেন-কী বলো? মাতাল লোকগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ঠিক, ঠিক। পানিগ্রাহীবাবুর জমিতেই ফেলে যাই। নির্ঘাৎ সদগতি হবে লাসটার। না করে উপায় আছে? লোকে বলবে– ওই দেখ, সামান্য খরচা করে উনি মড়াটা পোড়াতে পারলেন না! উনি আবার গরীবের হয়ে কাজ করবেন?.বুঝতেই পারছেন স্যার, মাতাল সাদাসিধে মানুষ সব। তখন ওদের দিয়ে যা খুশি করানো যায়। আমরা গেট দিয়ে ঢুকে লাশটা কোণার দিকে ফেললুম।
তোমাদের পায়ের দাগ নরম জমিতে নিশ্চয় থাকত। কিন্তু গোপালকিপোর ট্রাকটার চালিয়ে তা নষ্ট করে দিয়েছে। তবে মাচানের দুটো বাঁশের চাপে গর্ত থেকে গেছে। তোমরা মাচানের একদিক মাটিতে ঠেকিয়ে লাশটা ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে। তাই লাশের মাথা ও পায়ের কাছে দুটো গর্ত দেখলুম। দুটো বাঁশের মাথায় চাপা পড়ে গর্ত দুটো হয়েছিল।
তাই হবে।
তারপর?
তারপর চুপিচুপি লোক চারটে চলে গেল। নিষেধ করে দিলুম ব্যাপারটা গোপন রাখতে। তা না হলে তারাও তো বিপদে পড়ে যাবে।
তুমি কী করলে।
প্রথমে আমি খাটিয়াটা নিয়ে গিয়ে শ্মশানে ফেলে দিলুম। তোষকটা আর দড়িগুলোসুষ্ঠু। তারপর ভিজতে ভিজতে ফিরলুম। তখন রাত একটা বেজে গেছে। আমি বাংলোয় গিয়ে রইলুম। আর কোন চুলোয় যাব, বলুন?… পানিগ্রাহীদার ওপর আমার খুব রাগ হয়েছিল। তাছাড়া কেমন সন্দেহও জাগতে শুরু করেছিল। ভারতবাবুর ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছিল… ।
পানিগ্রাহী ফুঁসে উঠলেন–যা-তা কী বলছ সুমন্ত?
কর্নেল বাঁধা দিলেন।..প্লীজ। সুমন্ত, তুমি বলো।
সুমন্ত বলল, ওই বাংলোয় রাত কাটানো কী দুঃসাধ্য তখন। যে-ঘরে যে বিছানায় শুয়েছি, তার একহাত দূরে তাকে কেউ স্ট্যাব করেছেউঃ! হরিবল। ঘুম তো হলোই না। বৃষ্টি ছাড়ল শেষরাত্রে। ভোরে উঠে বেরিয়ে চলে গেলুম পাহাড়ের ওপর আশ্রমে। অনেকক্ষণ কাটালুম। মাথা ঘুরছিল। তারপর সটান গেলুম সেলুনে। কারণ, বুঝতে পারছিলুম, আমার লম্বা চুল শক্ত হয়ে উঠেছে। তারপর সব জানতে পারলুম লোকের মুখে। সমুদ্রের ধারে-ধারে ঘুরে ঠিক করলুম, পানিগ্রাহীদার কাছে কৈফিয়ত নিতেই হবে। আগাগোড়া একটা ভাওতার মধ্যে কেন উনি আমাকে আর তাকে ঘোরালেন?..
পানিগ্রাহী লাফিয়ে উঠলেন কিন্তু কর্নেল তার হাত ধরে নিবৃত্ত করে বললেন, অধৈর্য হবেন না মিঃ পানিগ্রাহী। সুমন্ত ইজ রাইট। ভারতবাবুর গতিবিধির উপর নজর রাখতে চেয়েছিলেন তার প্রমাণ আপনার এই তৃতীয় চিঠিটি। এবং…
সুমন্ত বলে উঠল, পানিগ্রাহীদার হুকুমে অনেক কাজ করেছি। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাকে বুকে বেলুন বেঁধে মডগার্লও সাজতে হলো! এখন আমার সবটাই এত অপমানজনক মনে হচ্ছে। এর মধ্যে ওঁর কোনও পলিটিক্যাল মোটিভ নেই! সবটাই ব্যক্তিগত। নিশ্চয় ভারতবাবুর ওপর অন্য কোনও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা আছে ওঁর।
আবার দুপক্ষকে সামলাতে হলো। কর্নেল বললেন, উত্তেজিত হবেন না কেউ–প্লীজ। আমরা কেসের খুব ভাইটাল পয়েন্টে এসে গেছি।
পানিগ্রাহী বললেন, ব্যক্তিগত ব্যাপার হবে যদি, সি.বি.আই. থেকে মিঃ শর্মাকে কি ছেলেখেলা করতে ডেকেছিলুম?
সুমন্ত বলল, দ্যাটন দা শো বিজনেস; ওটা আপনার চালাকি!
কর্নেল বললেন, প্লীজ, প্লীজ! আচ্ছা মিঃ পানিগ্রাহী, এই গেস্টহাউস থেকে বেরোতে হলে নিচের লাউঞ্জ পেরোতেই হবে–আমি লক্ষ করে এসেছি। তাহলে আপনার এখানে চেক ইন করা অব্দি কবার বাইরে বেরিয়েছেন, তার রেকর্ড আমরা ম্যানেজারের কাছে পেয়ে যাব। কী বলেন?
পানিগ্রাহী বললেন, একশোবার পাবেন। নিচে চব্বিশ ঘণ্টা কেউ না কেউ কাউন্টারে থাকে। হয় ম্যানেজার, নয় কোনও ক্লার্ক। নাইট ডিউটির ব্যবস্থা রয়েছে। চেক করুন, তাহলে বুঝবেন। মাত্র একবারই আমি বেরিয়েছিলুম–গতরাত্রে। জাস্ট সাড়ে দশটায়।
কর্নেল পকেট থেকে এবার আরেকটা নীলখামের চিঠি বের করে বললেন, এই চিঠিটা আমি বাংলোয় পেয়েছি। ওপরে লেখা রয়েছে প্রাপক শ্রী মদনমোহন পাণিগ্রাহী। কিন্তু চিঠিটার লেখকও শ্রী মদনমোহন পানিগ্রাহী। তারিখ ২১ জুলাই।
হ্যাঁ–আমি ওই চিঠিতেই সুমন্তকে মেয়ে সাজবার নির্দেশ দিয়েছিলুম। প্রাপকের নাম…।
বুঝেছি। ওটা আপনার সর্তকতা। চিঠিটা দেখেই আমার অবাক লাগে। তখনই জানতে পারি, আপনি কোথাও আছেন, এই চন্দনপুর-অন-সী-তেই। সম্ভাষণ করেছেন প্রিয় এস বলে। যাই হোক, এই চিঠিটা আপনার তন্দ্রাকে লেখা তৃতীয় চিঠির পরিপূরক। বাই দা বাই, সুমন্ত একটা সবে ধরানো সিগারেট নিবিয়ে ফেলে এসেছ কি তুমি?
সুমন্ত বলল, তাকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়েই আমি বেরিয়েছিলুম পানিগ্রাহীদার কাছে।
সবে ধরিয়ে দিয়েই বেরিয়েছিলে?
হ্যাঁ! ও সিগারেট খুব কম খেত। এই মানসিক অবস্থায় খেতে চাচ্ছিল না। আমি চলে আসার সময় ওকে বললুম–সিগারেট খাও, তাহলে ভয় করবে না। সিগারেটটা শেষ হবার আগেই আমি ফিরব। মোমবাতির আলো আছে–ভয় নেই। আর…বেডরুমে বিছানায় একটা ছোরা রেখেছিলুম। ছোরাটা সঙ্গে নিয়ে বেড়ানোর অসুবিধে ছিল–বেশ বড় ছোরা। তাছাড়া ছোরা নিয়ে বেড়ানোর কী দরকার, বুঝতে পারিনি। যাই হোক, ছোরাটা ওকে দিয়ে এসেছিলুম।
ছোরাটা বাংলোয় দেখতে পাইনি আমি।
আমরাও পাইনি স্যার। যখন তাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখলুম, ছোরাটা খুঁজছিলুম তন্ন তন্ন করে। আমি তো জানতেই পারছিলুম, খুনী ওই ছোরাটাই মেরেছে তাকে।
রাইট। তুমি চলে যাওয়ার পর জঙ্গলের পথে কিংবা কোথাও গাড়ি দেখেছিলে কি?
না স্যার।.. বলে একটু ভেবে নিয়ে সুমন্ত ফের বলল, তবে পানিগ্রাহীদাকে নিয়ে যখন বাংলোয় যাই, তখন জঙ্গলের দিকে পাহাড়ের পশ্চিম পিঠে একটা আওয়াজ আমার কানে এসেছিল। গাড়ির আওয়াজ বলে মনে হচ্ছিল। পানিগ্রাহীদাকে বললুম– কথাটা কিন্তু উনি বললেন–মেঘ ডাকার শব্দ।
পাহাড়ের দক্ষিণ গা দিয়ে যে-পথ, সে-পথে তোমরা এসেছ বা গেছ। কিন্তু পশ্চিম গা দিয়ে গাড়ি চলার কোনও পথ আছে কি?
আছে স্যার। তবে কোনও তৈরি রাস্তা নয়। ঝোপঝাড় বিশেষ নেই। বালিয়াড়ি মতো আছে। ইচ্ছে করলে কেউ পাহাড় ঘুরে পশ্চিম থেকে উত্তর হয়ে পুবদিকে এসে আশ্রমের পথে উঠতে পারে। তারপর এইগেস্টহাউসের পিছনের সদর রাস্তায় আসা যায়।
মিঃ পানিগ্রাহী, পিছনটা তো আপনার ঘর থেকে দিব্যি দেখা যায়। কোনও গাড়ি দেখেছিলেন রাত্রে?
পানিগ্রাহী বললেন, অসম্ভব! রাত্রের বৃষ্টি ছিল অকল্পনীয়। ওই অবস্থায় কেউ গাড়ি বের করতে সাহস পাবে না।
কিন্তু আমি বাংলোর পূর্ব গেটে গাড়ির চাকার দাগ দেখেছি। হিলের দক্ষিণ দিককার জঙ্গলের রাস্তা–মানে আপনাদের যাওয়া-আসার রাস্তা অবশ্য পাথুরে। কোনও দাগ পাইনি। যদিও ভেবেছিলুম, এই পথেই রাত্রে বৃষ্টির মধ্যে একটা গাড়ি এসেছিল এবং চলে গেছে। ভেবেছিলুম নয়–গাড়ি যাওয়া-আসা ফ্যাক্ট। কিন্তু উত্তর অংশটা খুঁজিনি। এখন মনে হচ্ছে ওদিক দিয়েই গাড়িটা এসেছিল এবং চলে গিয়েছিল।
অ্যাবসার্ড! কে অত রাত্রে গাড়ি নিয়ে যাবে–আমার বাংলোয়?
খুনী যাবে–উঁহু, গিয়েছিল। সুমন্ত চলে আসার পরেই সম্ভবত কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়িটা গিয়েছিল ওখানে।
তাহলে তো আলো নজরে পড়ত!
ঠিক। আলো জ্বালেনি খুনী। অন্ধকারেই গিয়েছিল।
অসম্ভব! ওই বিপথে ঝোপঝাড় বালিয়াড়িতে
মিঃ পানিগ্রাহী, ধরুন, ওই জায়গা–তার মানে পুরো এলাকা খুনীর এত মুখস্থ যে সে বিন্দুমাত্র অসুবিধা বোধ করেনি। সে এমন লোক যে বাংলোর চারপাশের নাড়িনক্ষত্র তার জানা। তাই আলো জ্বালাতে হয়নি। আলো জ্বাললে অনেকের চোখে পড়ত। তাছাড়া চুপি চুপি আসতে চেয়েছিল সে।
কে হতে পারে সেভারতবাবু ছাড়া? নির্ঘাৎ ওই শয়তানটা। আপনার বর্ণনা অনুযায়ী এবার আমার ধারণার কথা বলি। খুনী চুপি চুপি এসে বাংলোর দরজায় নক করেছিল। উঁহু, সে সোজা তন্দ্রার নাম ধরে ডেকেছিল। বোঝা যায়, তন্দ্রা তার সুপরিচিত। তাই সে তাকে তক্ষুনি দরজা খুলে দেয়। এবং তাকে সে রীতিমতো শ্রদ্ধাভক্তি করত বলেই তক্ষুনি সিগারেটটা হাঁটুর পাশে সোফার গায়ে ঘষে নিভিয়ে ফেলে। বলতে বলতে নিজের যুক্তির শক্তিমত্তা নিজেই টের পেয়ে পানিগ্রাহী লাফিয়ে উঠলেন।…মিলে যাচ্ছে, একেবারে দুয়ে দুয়ে চার মিলে যাচ্ছে। এখানে হোটেলওয়ালা ভারতবাবু ছাড়া তার তো আর কারও সঙ্গে আলাপ ছিল না। আর ওকে সে বয়সের খাতিরে হোকনজর রাখার সুবিধে হবে বলে অন্তরঙ্গ হয়ে শ্রদ্ধাভক্তি দেখাতে চেয়েছিল নিশ্চয়। বলে যান–আমার কাছে খুনীর চেহারা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। এতক্ষণ ধারণা ছিল, তার লোক তাকে খুন করেছে। এবার বোঝা যাচ্ছে না, সে নিজেই ওকাজ করেছে। মিঃ শর্মা, তাহলে বুঝতে পারছেন তো? নিশ্চয় তন্দ্রা কিছু জেনে ফেলেছিল আঁটঘাটের খবর। তাই ভারত মরীয়া হয়ে উঠেছিল।
শর্মা বললেন, তাই দাঁড়াচ্ছে বটে। প্রথমে মুখোশপরা লোক লাগিয়ে রাংতার ছোরা দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দেওয়া যথেষ্ট মনে হয়নি। কারণ, সেই মুখোশধারী সম্ভবত ফিরে গিয়ে বলে থাকবে যে আসামিরা ফার্মে ঢুকে পড়েছে। তার মানেই প্রতিদ্বন্দ্বী পানিগ্রাহীসায়েবের লোকের কানে যাওয়া! আরও বিপদের সম্ভাবনা এবার। কাজেই একেবারে খতম করাই ভাল। ভারতবাবুকে চেনে তন্দ্রা। কাজেই তাকে দেখল…
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, প্লীজ প্লীজ! আমাদের এখন আরও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ বাকি আছে। সুমন্ত, এবার আমার আরও কিছু প্রশ্নের জবাব দাও।
— পানিগ্রাহী কটমট করে তাকালেন সুমন্তের দিকে। সুমন্ত গ্রাহ্য করল না। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভ মুখে বলল, বলুন স্যার?
কর্নেল বললেন, একটা কাগজ তুমি আর তন্দ্রা পড়ছিলে শার্কে বসে থাকার সময়। তারপর তন্দ্রা কাগজটা কুচিকুচি করে ফেলে দেয়। কী সেটা?
একটা উড়ো চিঠি, স্যার। দুপুরে ডাইনিং হলে খেয়ে আমি আর তন্দ্রা ওপরে স্যুটে ঢুকলুম, দেখি–চিঠি পড়ে রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে :
ডাইনি মেয়ে দুটোকে–
তোরা যদি আজই হোটেল ছেড়ে না যাস, ভীষণ বিপদ হবে। তোদের যে পাঠিয়েছে, তাকে বলিস–পাখি উড়ে গেছে চিরকালের মতো …
এই সময় পানিগ্রাহী প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, অ্যাঁ! উড়ো চিঠির কথা তো বলোনি!
কর্নেল পকেট থেকে লম্বা সরকারী খাম বের করলেন। তারপর ভিতর থেকে কয়েকটা কুচি কাগজ বের করে বললেন, এগুলো চিনতে পারছ?
সুমন্ত সোৎসাহে বলল, হ্যাঁ স্যার। ওইটাই। বড়বড় আঁকাবাঁকা হাতের লেখা। ইংরেজিতে লেখা–হ্যাঁ, ওটাই বটে।
কর্নেল পানিগ্রাহীকে প্রশ্ন করলেন, আপনি চিনতে পারছেন, এ হাতের লেখা কার?
পানিগ্রাহী একবার দেখে নিয়ে বললেন, না। তাছাড়া অমন টুকরো কাগজের লেখা চেনা অসম্ভব আমার পক্ষে। তবে বাজী রেখে বলব, ও ভারতের লেখা। এক্সপার্টের কাছে পাঠান।…তারপর সুমন্তের দিকে কটমট করে চেয়ে বললেন, তুমি একটা ওয়ার্থলেস!
কর্নেল কুচিগুলো খামে ভরে সুমন্তকে বললেন, তাহলে চিঠিটা তোমরা। গতকাল দুপুরে খাওয়ার পর পেলে। তারপর কী করলে?
সুমন্ত বলল, টের পেলুম, পানিগ্রাহীদা ঠিক জায়গায় তাক করেছে। তাকে বললুম– ভয়ের কারণ নেই। পানিগ্রাহীদা নিশ্চয় পুলিস আর নিজের লোকজন নিয়ে তৈরি হচ্ছেন। উনি বলে দিয়েছিলেন, ২২ তারিখ রাত্রেই কিছু ঘটবে। কাজেই রাত্রি আসুক আগে। আমরা কড়া নজর রাখি। কিন্তু তন্দ্রা আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলল।
কী কথা?
বলল–পানিগ্রাহীসায়েব ভারতবাবুর ওপর লক্ষ রাখতে বলেছেন, তার পিছনে কোকেন, এল এস ডি বা নিষিদ্ধ ড্রাগের চোরাকারবার ধরা মোটেও উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্যটা সে এবার টের পেয়ে গেছে।… সুমন্ত থামল।
পাণিগ্রাহী তেড়ে এলেন।…কী উদ্দেশ্য বলল তন্দ্রা?
কর্নেল বললেন, প্লীজ, প্লীজ! সুমন্ত তুমি বলো।
সুমন্ত বলল, ভারতবাবুর সঙ্গে এক ভদ্রমহিলার কী সম্পর্ক–তন্দ্রা বলল মিঃ পানিগ্রাহী যেন সেটাই জানতে চান আসলে। তন্দ্রা আরও বলল, তিন নম্বর চিঠিতে তাকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে..
কর্নেল কথা কেড়ে বললেন, হ্যাঁ–বিশেষ করে কোনও মহিলার সঙ্গে ভারতবাবুর যোগাযোগ ঘটেছে কি না।
ঠিক তাই স্যার। তা তাকে বললুম– তুমি কীভাবে জানলে যে ওটাই আসল কারণ। তন্দ্রা বলল–চিঠির নির্দেশ অনুযায়ী আমি নজর রেখে দেখলুম এ স্যুটে এক ভদ্রমহিলা আছেন। ভারতবাবু প্রায়ই তার ঘরে গিয়ে কাটাচ্ছেন। ২১ তারিখ রাত্রে আকাশ পরিষ্কার ছিল। দুজনকে বাইরে থেকে আসতে দেখেছিল নাকি তন্দ্রা–আমি ঘুমোছিলুম। তন্দ্রা বলল, সে উঁকি দিয়ে দেখল– নির্জন করিডরে ভারতবাবু আর মহিলা ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছেন। হঠাৎ সেই সময় মহিলাটির চোখে পড়ে তার সুইটের দরজায়। অমনি ওরা সরে আলাদা হয়ে যায়। আর তন্দ্রাও দরজা বন্ধ করে। কাজেই তন্দ্রা বলল–তার ফেমিনিন ইনস্টিংক্ট অনুযায়ী নাকি মিঃ পানিগ্রাহীর আসল লক্ষ ওটাই। আমরা দুজনে সারা বিকেল ওই নিয়ে আলোচনা করলুম। ভদ্রমহিলাকে আমি দেখিইনি। যাই হোক, আমরা দুজনে সিদ্ধান্তে এলুম যে ২২ তারিখ-টারিখ কোনও ব্যাপারই নয়। আসলে ওই সময়ের মধ্যে ওই ভদ্রমহিলার আসার কথা ছিল এখানে–এটা পানিগ্রাহীদা জানতে পেরেছিলেন। তাই আমাদের গোয়েন্দা হিসেবে লাগিয়েছিলেন। আমরা দুজনেই চন্দনপুরে অচেনা বললেই হয়। গত মার্চে আমি এদিকে ইলেকসানে খেটে গেছি কিন্তু তখন তো মাথায় লম্বা চুল ছিল না আমার। আর অত মনেই বা কে রাখে! অমন কয়েকডজন কর্মী খেটেছিল।
কর্নেল বললেন, এক মিনিট! মিঃ পানিগ্রাহী, আপনার ফোনটা একবার নেব?
পানিগ্রাহী ক্লান্তভাবে বললেন, হ্যাঁনিন না। হোটেলে রিং করবেন?
না। সেনাপতিকে। বলে কর্নেল ফোন তুললেন।…একবার প্লীজ থানায় দিন।…হ্যাঁ, হ্যালো! কে বলছেন? মিঃ সেনাপতি ফিরেছেন?…কেউ ফেরেননি? ডাঃ পট্টনায়কের ওখানে গেছেন? আমি কর্নেল সরকার বলছি। ঠিক আছে। ছাড়ছি?
কর্নেল ফোন ছেড়ে সরে এলেন। হ্যাঁ, সুমন্ত, তারপর বলল।
সুমন্ত বলল, আমরা সমুদ্রের ধারে ঘুরছি, বৃষ্টি এসে গেল। তখন সামনে শার্কে ঢুকলুম। আগের দিনও ঢুকেছিলুম। বেশ সুন্দর বার-কাম রেস্তোরাঁ। তন্দ্রার ওই অভ্যাস। একবার কিছু মাথায় এলে তা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে যাবে। আমরা হোটেলে গিয়ে সোজা পানিগ্রাহীদার কাছে গিয়ে রিপোর্টটা দেব আর সোজা জেনে নেব রহস্য–এই হলো আমাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু বৃষ্টি দেরি করিয়ে দিল। তারপর হঠাৎ ছোরা হাতে মুখোশপরা মূর্তি এসে…
কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। সুইট নাম্বার এতে মহিলাটিকে দেখেছিল তন্দ্রা?
হ্যাঁ, স্যার।
মিঃ পানিগ্রাহী, মহিলাটি কে?
পানিগ্রাহী ভুরু কুঁচকে বললেন, ওসব সুমন্ত আর তন্দ্রার অলীক ধারণা। অবশ্য ভারতের লাম্পট্য চিরাচরিত। সবাই জানে। ওরা দুজনেই ভুল করেছিল। আসলে আমার খবর ছিল–মহিলাদের মারফতও ড্রাগ পাচার হয়। তাই ওদের মহিলাদের দিকেও লক্ষ রাখতে বলেছিলুম। তাছাড়া–কোন মহিলার সঙ্গে ভারতের কী হচ্ছে না হচ্ছে জানবার জন্যে আমি মিঃ শর্মাকেই বা কেন কষ্ট করে দিল্লি থেকে আসতে বলব? আর কেনই বা অত গাঁটের পয়সা খরচ করে দু-দুটো লোক লাগাব? বলুন–কোনও যুক্তি আছে।
কর্নেল বললেন, –আছে। যদি মহিলাটি… বলেই চুপ করে গেলেন হঠাৎ। পানিগ্রাহী ঝুঁকে এলেন।…বলুন বলুন।
থাক। আমি আগে নিশ্চিত হতে চাই–তারপর সিদ্ধান্তে আসব। আচ্ছা মিঃ শর্মা, উঠি তাহলে। আপনি বিশ্রাম করুন। মিঃ পানিগ্রাহী, চলি। সুমন্ত তুমি তুমি বরং এস আমার সঙ্গে।
পানিগ্রাহী গম্ভীর হয়ে বললেন, ও থাকবে কর্নেল। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে।
কর্নেল হাসিমুখে সুমন্তর দিকে তাকালেন।…সুমন্ত, আমার মনে হয় পুলিস তোমার এজাহারটা দাবি করবে। সেটা শীগগির হলেই তোমার পক্ষে নিরাপদ।
সুমন্ত উঠে বলল, নিশ্চয়। চলুন কর্নেল। পানিগ্রাহীদা, পরে দেখা হবে।
সুমন্ত কর্নেলের আগেই বেরিয়ে এল। শর্মা করিডর অব্দি এসে চাপা গলায় বললেন, সবটাই ধাঁধা, কর্নেল। যাক গে, খুব ক্লান্তি লাগছে। যা জার্নির ধকল গেছে। আমি একটু জিরিয়ে নিই। ওবেলা দেখা হবে।
পানিগ্রাহী গুম হয়ে ঘরে একা বসে রইলেন।
রাস্তায় নেমে কর্নেল বললেন, বাংলোয় পাওয়া সিগারেট কেসটা…
সুমন্ত কথা কেড়ে বলল, ওটা আমাকে ডঃ পট্টনায়কের মেয়ে কল্যাণী প্রেজেন্ট করেছিল। গত ইলেকশানে এসে কল্যাণীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। একটু হৃদ্যতাও হয়েছিল।
তাহলে পট্টনায়ক-ফ্যামিলি তোমাকে ভালই চেনেন। অথচ তুমি বললে, এখানে তুমি অচেনা।
ফ্যামিলিতে বিশেষ চেনে না। চেনে শুধু কল্যাণী। সে তো কলকাতায় আছে এখন।
উঁহু, কল্যাণী এসেছে।
কল্যাণী এসেছে নাকি? বাঃ, জানতুম না। ভালই হলো। উঃ, দুটোদিন যা লুকোচুরি খেলা গেছে, কোনওকিছু ভাববার ফুরসতই পাইনি। আমি বরং তাহলে ওদের বাড়িতেই থাকব আজ রাত্তিরটা। কাল সকালে কেটে পড়বখন।
কল্যাণীর সঙ্গে তোমার আলাপ কীভাবে হয়েছিল?
বললুম– তো–এখানে এসে–মার্চ মাসে। একটা ফাংশান মতো হয়েছিল। আমি গীটার বাজিয়েছিলুম। গীটার সঙ্গে ছিল না। তাই গীটারের খোঁজ করছিলুম। তখন বউদি–মানে পানিগ্রাহীদার স্ত্রী কল্যাণীদের বাড়ি থেকে আনিয়ে দিলেন। ওই সূত্রে কল্যাণীর সঙ্গে চেনাজানা হলো। বউদির সঙ্গে কল্যাণীদের ভীষণ ভাবটাব ছিল, দেখেছিলুম।
কর্নেল অন্য কথা ভাবছিলেন। এ-যুগের ইয়ংম্যানরা ভারি আশ্চর্য। বেচারা তন্দ্রা!