সাত

তামাশাবাজি ও একটা মড়া

একটু পরে দেখা গেল, থানার এ. এস. আই. বরকত আলি এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে ফার্মের গেট পেরোচ্ছেন। এঁরা সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। আচার্য বললেন, মিঃ সেনাপতি, বসুন! সেপাইরা গেছে, নবও গেছে–এতক্ষণ ব্যাটাকে ধরে ফেলেছে। যাবে কোথায়? নবর হাত থেকে এখন ওকে বাঁচাতে হিমশিম খাবে সেপাইরা। আপনি ব্যস্ত হবেন না–দিস ইজ নট ইওর ফল্ট। ওই দেখুন আপনারা, আলিসায়েব আসছেন কাকে নিয়ে। মনে হচ্ছে, ঘটনার জালটা বেশ ছড়ানো। নব খুন করেছে কারো টাকা খেয়ে–তা বই তো নয়! অতএব পিছনে লোক রয়েছে আই অ্যাম সিওর, মশাই। কর্নেল কী বলেন?

কর্নেল বললেন, ফ্যাক্টস। ফ্যাক্টস থেকেই তো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব।

আলির সঙ্গের ভদ্রলোক রীতিমতো ভদ্রলোক। ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরা, গিলেকরা হাতা, গলায় সরু সোনার চেন, বয়সে অবশ্য প্রৌঢ়, পায়ে পাম্প-শু রয়েছে। তার হাতে মস্ত একটা বাঁধানো রেজিস্টার মতো রয়েছে। এই সব লোক দেখেই বলা যায়, ছায়ায় সারাক্ষণ থাকেন, তাই কীরকম চাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেন। পান খান। আঙুলে অনেক আংটিও রয়েছে। আলিসায়েব এসে একটি সেলাম ঠুকে কিছু বলতে মুখ খুলছেন সবে, কর্নেল হাসিমুখে বললেন, আশা করি, ইনি কোনও হোটেলের মালিক। আসুন, আসুন! ওটা নিশ্চয় হোটেল রেজিস্টার। সী-ভিউ নিশ্চয়। খ্রিস্টার হোটেল এখানে তো ওই একটিই। বলুন স্যার, নিশ্চয় সিঙ্গল স্যুট বুক করেছিল হতভাগ্য মেয়েটি?

সবাই হাঁ করে কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ভদ্রলোকের মুখও হাঁ–ভিতরে একটা খয়েরি রঙের মাংসখণ্ড–অবশ্যই সেটি রসনা–প্রকাণ্ড বিলিতী কুকুরের মতো বসে থাকতে দেখা যাচ্ছিল–এবং গলার গর্ত ও আলজিভটাও, নজরে পড়ছিল। ভীষণ ঘাবড়ে যাওয়া মূর্তি।

আলি বললেন, হ্যাঁ স্যার। মেয়েটির নামধাম সব পাওয়া গেছে। এই যে– রেজিস্টারটা দেখুন। কই ভারতবাবু, দিন।

ভারতবাবু টেবিলে ওটা রেখে একপাশে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে মুখে সামান্য হাসি ফুটল। কথাও।…হাঁ স্যার। যা বর্ণনা পেলুম, আর আমার লোকেরাও এসে দেখে গেছে–উনিই তিনি। কাল রাত্তির থেকে নিখোঁজ। বৃষ্টি ছাড়ল না। তাছাড়া…

কর্নেল বললেন, এক মিনিট। তারপর একফালি কাগজে চিহ্ন দেওয়া পাতাটা খুললেন। অফিসার তিনজন মুণ্ডু বাড়িয়ে দিলেন।

তন্দ্রা ভাদুড়ী। স্থায়ী ঠিকানা : ১২৩/১৭ হরি মুদী লেন, কলকাতা-১৩। এসেছে ২১ জুলাই দুপুর বারোটায়। সুইট নম্বর সি, সিঙ্গল। স্পেশাল রেফারেন্স শ্রী-মদনমোহন পানিগ্রাহী, পানিগ্রাহী ফার্ম, ..

হোয়াট! লাফিয়ে উঠলেন সেনাপতি।

কর্নেল বললেন, তার মানে কোনও বিপদ-আপদের ক্ষেত্রে শ্রীপানিগ্রাহীর সঙ্গে হোটেল কর্তৃপক্ষকে যোগাযোগ করতে হবে। তন্দ্রা তাহলে কলকাতার কোনও রেফারেন্স দেয়নি–যা স্বাভাবিক ছিল। তাহলে দাঁড়াচ্ছে : পানিগ্রাহী মেয়েটিকে ভালই চেনেন। আর…।

আলি তার পকেট থেকে দুটো চিঠি বের করে বললেন, চেনেন স্যার? এই দেখুন, ওঁর সুইট তল্লাসী করে এই চিঠিদুট খুব ইমপরট্যান্ট মনে হলো বলে সঙ্গে এনেছি। সুইটে আমাদের তালা আটকানো হয়েছে এখন।

দুটই ইনল্যাণ্ড লেটার। দুটতেই তন্দ্রা ভাদুড়ীর নাম ঠিকানা ইংরজিতে টাইপ করা। এবং দুট চিঠিরই ভাষা ইংরেজি, টাইপ করা। প্রথমটার শুরু, ডিয়ার মিস ভাদুড়ী। দ্বিতীয়টার শুরু, মাই ডিয়ার মিস তন্দ্রা। দুটোর তলায় শ্রী মদনমোহন পানিগ্রাহীর সই। চিঠি দুট পড়ে জানা গেল, শ্ৰীপানিগ্রাহী তন্দ্রাকে পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি দিচ্ছেন।

প্রথম চিঠিটা :

বিজ্ঞাপনটি আপনার নজরে পড়েছে দেখে আমি আনন্দিত। আপনি দরখাস্ত পাঠিয়েছেন, কিন্তু কোনও ফোটো পাঠাননি। শিগগির ফোটো পাঠান। পি.এ.র পক্ষে দরকারী যোগ্যতা আপনার আছে। এবার কিন্তু বক্স নম্বরে পাঠাবেন না। আমার ঠিকানা দেওয়া হলো। বাই দা বাই, মাইনের কথা লিখেছেন। সর্বসাকুল্যে হাজার টাকা প্রায়।

এর তারিখ ২ জুলাই।

দ্বিতীয় চিঠিটা :

ফোটো পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ। এই চিঠিটা নিয়োগপত্র বলে জানবেন। পরে ফর্মাল নিয়োগপত্র পেয়ে যাবেন এখানে এসে। আকস্মিক কারণে আমি পনের দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। চন্দনপুরে ফিরব বাইশ-তেইশ তারিখ নাগাদ। আপনি একুশ তারিখ রওনা হোন। এই সঙ্গে পৃথক ইনসিওর করা খামে তিনশো টাকা পাঠালাম। এটা অগ্রিম। আপনার রাহাখরচ এবং চন্দনপুরে এসে যদি আমার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, সেজন্য হাতখরচ বাবদ। আপনার অসুবিধে হবে না। আমার লোক হোটেল বুক করে রাখবে। সী-ভিউ-তে একটা সিঙ্গল সুইট পাবেন। মনে রাখবেন নামটাসী-ভিউ। আমার প্রেসটিজের জন্যেই আপনাকে কিছু প্রেসটিজ মেনে চলতে হবে। আমার ফার্মে গিয়ে নিজে খোঁজ নেবেন না। এখানে রাস্তার লোককে জিগ্যেস করলেও জানতে পারবেন, আমি ফিরেছি কি না। আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। আমি ফিরলেই নিজে হোটেল থেকে আপনাকে নিয়ে আসব। দিস ইজ ভেরি ইমপরট্যান্ট।…তারপর পুনশ্চ আরও কিছু নির্দেশ আপনি শীঘ্রই পাবেন। নির্দেশগুলি খুব গোপনীয়। তাই চিঠিতে জানাব কি না ভাবছি। যাই হোক, অপেক্ষা করুন।

এটার তারিখ ৭জুলাই।

আচার্য মন্তব্য করলেন, বিজ্ঞাপনটা তাহলে জুনের কাগজে বেরিয়ে থাকবে। সেনাপতি, সব বড় দৈনিকগুলোর বিজ্ঞাপন কলমে খোঁজ নিতে হবে। পেয়ে যাবেন। কলকাতায় লালবাজারে ট্রাঙ্ক করে ওঁদের বলুন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বের হয়ে যাবে।

সেনাপতি মাথা দোলালেন।

শর্মা বললেন, কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে আমার। কর্নেল কী বলেন?

কর্নেল তাঁর চোখের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে বললেন, ঠিকই বলেছেন। ভারতবাবুকে এবার কিছু জিগ্যেস করব।

ভারতবাবু বিনয়ে নত হয়ে জবাব দিলেন, একশোবার, স্যার। অবশ্যই।

মেয়েটি মানে তন্দ্রা ২১ তারিখে একা এসেছিল বলছেন তাহলে?

হ্যাঁ, স্যার। একা। দুপুর বারোটার বাসে নেমেছিলেন।

লাগেজ ছিল সঙ্গে?

হ্যাঁ–একটা বেডিং আর বড়ো একটা স্যুটকেস।

লেডিজ ব্যাগ–মানে, যাকে ভ্যানিটি ব্যাগ বলা হয়–তেমন কিছু..

ছিল স্যার। কাঁধে ঝুলছিল। তার থেকে একটা পার্স বের করে টাকা মেটালেন। ওনার চোখে গোগো চশমা ছিল। পরনে…

থাক। আচ্ছা ভারতবাবু, তন্দ্রা ওদিন হোটেল থেকে প্রথম কখন বেরোয় মনে। আছে?

তিনটেয় একটি ঢ্যাঙা মতো মেয়ে এসে ওঁর খোঁজ করলেন। সব ঘরে ফোনের ব্যবস্থা আছে। আমি ওনাকে রিং করে ভিজিটারের কথা বললুম–। উনি বললেন, কী নাম? ভিজিটারকে জিগ্যেস করলে জানালেনবলুন, মিস এস রায়। ফ্রম ক্যালকাটা। তন্দ্রাদেবী তক্ষুনি ওনাকে পাঠিয়ে দিতে বললেন। ঘণ্টাখানেক পরে দুজনে দোতালা থেকে নেমে বেরিয়ে গেলেন।

ঢ্যাঙা মেয়েটির চেহারা মনে আছে?

আছে বই কি স্যার। তারপর তো সকাল দুপুর রাত্রি সব সময় দুজনকে একসঙ্গে দেখেছি। রাত্রেও থেকেছেন ওঁর সুইটে। গেস্ট হিসেবে খাওয়া-দাওয়াও করেছেন।

এবার চেহারা বলুন।

ঢ্যাঙা, হাত দুটো বেশ ছড়ানো লম্বা, মোটা হাড়ের গড়ন বলা যায়। বাঁ হাতে উল্কি ছিল। সবসময় সাজপোষাক বদলানো অভ্যাস। পাঞ্জাবি, বেলবটম প্যান্ট, নয়তো গেঞ্জি। কেমন যেন পুরুষালি চালচলন। গলার স্বরও মোটা। ঘাড়ের কিছু নিচে অব্দি খোলামেলা চুল।

সে মেয়ে, তা কিসে বুঝলেন?

সবাই হেসে উঠলেন এ প্রশ্নে। ভারতবাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না স্যার-তা কি হয়? ছেলে না মেয়ে, তা বুঝব না আবার?

আজকাল ছেলেরাও লম্বা চুল আর মেয়েদের ঢঙে পোশাক পরছে। আশা করি, বিচ-এ লক্ষ্য করেছেন।

তা ঠিক, স্যার। তবে ওনার বুক–বুক ছিল যে।

ব্রেসিয়ার ছিল? বলে কর্নেল হাসি চাপলেন–ফের বললেন, না–মানে, কেউ কারও জামা তুলে পরীক্ষা করার কথা ওঠে না। আমি বলছি, বাইরে থেকে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছিল কি না?

ভারতবাবু লাফিয়ে উঠলেন।..স্যার, স্যার! বুক আঁটো ছিল না ওনার। আজকাল যে বিদিশী মেম-সায়েবদের দেখাদেখি অনেকে ব্রেসিয়ার পরা ছেড়েছেন! বিচে কত সব ঘুরে বেড়ান–আমার হোটেলেও ওঠেন।

তার মানে ব্রেসিয়ার ছিল না?

ঠিক স্যার।

গতকাল–মানে ২২ তারিখ কখন ওরা হোটেল ছেড়ে বের হন, মনে আছে?

আছে, স্যার। আমার নজর কড়া রাখতে হয়। বুঝতেই পারছেন, আজকাল হোটেলের আইন-কানুন সরকার কড়া করেছেন। গতকাল ওনারা বের হন, বিকেল। সাড়ে চারটে নাগাদ। সময়টা মনে আছে। কারণ, এক মন্ত্রীমশায় ওসময় চেক আউট করলেন। আপনাদের আশীর্বাদে মন্ত্রীরাও সী ভিউ-এ এসে থাকেন অনেক সময়। সরকারী অতিথিভবনে যখন আরও বড় কোনও মন্ত্রী থাকলে…

রাইট। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অতিথিভবনে থাকলে রাজ্যের মন্ত্রীদের পক্ষে হোটেল ছাড়া উপায় কী? কর্নেল মন্তব্য করলেন।…আচ্ছা ভারতবাবু, ভিজিটরদের নাম বা সই নেবার জন্যে নিশ্চয় আপনার রেজিস্টার রয়েছে?

আছে স্যার। মিস এস রায়ের প্রথমদিনকার সই আছে। পরে আর নিইনি। কারণ উনি তো দেখলুম, মিস তন্দ্রার সঙ্গেই থাকছেন-টাকছেন।

একুশ তারিখে ওরা রাতে কটায় হোটেলে ফিরেছিল?

রাত দশটা নাগাদ।

কোনও বোর্ডার রাতে না ফিরলে আপনারা কী করেন?

থানায় জানিয়ে দিই, স্যার।

কখন জানান?

সেটা স্যার অবস্থার ওপর নির্ভর করে। তবে–ভভারের দিকে থানায় খবর দেওয়া আমাদের রীতি। আসলে হয় কি জানেন? আকাশের অবস্থা ভাল থাকলে অনেকে সী বিচেই রাত কাটান। স্যার, বুঝতেই পারছেন, যা যুগ পড়েছে। সারারাত ড্রিঙ্ক করে তখন যে যেখানে পায়, শুয়ে পড়ে। ভোরবেলা বিচে গেলে আপনি দেখবেন–

তা দেখেছি বটে।

এমনকি মেয়েরাও স্যার–মেয়েরাও! রাত্রিবেলা আবহাওয়া ভাল থাকলে সী বিচে খুব অশ্লীল সব ব্যাপার ঘটতে থাকে আজকাল। ক্রমশ বাড়ছে এটা।

সেনাপতি বললেন, নানা, অতটা বাড়িয়ে বলবেন না মশাই। আমাদের লোক রোঁদে ঘোরে। গত বছরকার সেই রেপ কেসটার পর রাত্রে সী বিচে কড়া নজর রাখা হয়। তাছাড়া, আলো রয়েছে। কী সব যা-তা বলছেন?

ভারতবাবু ধমক খেয়ে ঘাবড়ে গেলেন–তা হয় স্যার–তবে কি না আজকাল যা যুগ পড়েছে। আজকাল ছেলে-মেয়ে বুড়োবুড়ি আইন-টাইন মানলে তো? সরকার তো নিজের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত।

কর্নেল বললেন, তাহলে সেরকম কিছু ভেবেই তন্দ্রার ব্যাপারে থানায় জানাননি, বলতে চান?

হ্যাঁ, স্যার। এসব আকছার ঘটে কি না।

মিঃ আলি, তন্দ্রার জিনিসপত্র সার্চ করেছে?

আলি বললেন, করেছি স্যার। তেমন সন্দেহজনক কিছু পাইনি। মানে–এই কেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তেমন কিছু। শুধু এই চিঠি দুটোই যা পেয়েছি।

তন্দ্রার শিক্ষা-দীক্ষার সার্টিফিকেট?

আছে স্যার। বি এ সারটি…।

আর কোনও চিঠিপত্র?

কয়েকটা আছে ওর স্যুটকেসে। খুব পুরনো। মনে হলো বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনের লেখা সব।

একটু পরে আমাকে একবার তার ঘরে নিয়ে যাবেন, মিঃ আলি।

নিশ্চয়, স্যার?

ভারতবাবুকে নিয়ে গিয়ে আপাতত লাশটা দেখান। দ্যাটস ইওর রুটিন জব।বলে কর্নেল সেনাপতির দিকে মৃদু হেসে কটাক্ষ করলেন।

সেনাপতি বললেন, ইয়েস মিঃ আলি। ভারতবাবু, যান দেখে আসুন।

ওঁরা চলে গেলেন লাশটার দিকে। কর্নেল ঘড়ি দেখলেন, নটা পনের। তারপর আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ পরিষ্কার। শুধু পাখিদের আনাগোনা আছে। সাত মাইল দূরে একটা বার্ড স্যাংচুয়ারি রয়েছে, তাই এত পাখির আনাগোনা। বাঁহনোকুলারটা আনলে ভাল হতো। কর্নেল আকাশ দেখতে থাকলেন।…

একটু পরে ভারতবাবুরা ফিরলেন জমি থেকে। ভারতবাবুর মুখটা কালো হয়ে গেছে এবার। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। হাঁ, স্যার, তন্দ্রা ভাদুড়ী। উঃ ভগবান! অমন জলজ্যান্ত মেয়েটা–এ এক অসম্ভব দৃশ্য স্যার! এর বিহিত হওয়া দরকার। দেশে আইন-কানুন থাকতে এসব আর চলতে দেওয়া যায় না।

সেই সময় গেটের দিকে চ্যাঁচামেচি শোনা গেল। তারপর দেখা গেল নব ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। আর তার পিছনে একদল লোক তাড়া করেছে। তাদের মধ্যে লালটুপিও দেখা যাচ্ছিল। এখানে কর্নেল বাদে সবাই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেছেন আগের মতো। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছেন।

নব প্রায় হুমড়ি খেয়ে টেবিলের কাছে পড়ল। সে প্রচণ্ড হাঁফাচ্ছিল। কর্নেল উঠে তার হাত ধরে টেনে তুললেন। ভিড়টাও এসে পড়ল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। কর্নেল সামরিক আওয়াজ দিলেন-বজ্রকণ্ঠ বলা যায়–স্টপ ইট! থামুন আপনারা।

ভিড়টাও হাঁফাতে থাকল খানিক তফাতে। নব শ্বাস-প্রশ্বাসের ফাঁকে বলে উঠল–পেয়েছি স্যার, পেয়ে গেছি! আজ সকালেই এটা পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল। ঝোপের ধারে দেখেছিলুম স্যার!

কর্নেল তার হাত থেকে দোমড়ানো চকচকে কী একটা নিলেন। তারপর হাসিমুখে অফিসারদের সামনে সেটা ধরে বললেন, এই সেই মুখোশধারীর ছোরা!

হ্যাঁ–রাঙতামোড়া খেলনার ছোরা। আচার্য বললেন, স্ট্রেঞ্জ! সেনাপতি হাঁ করে চেয়ে থাকলেন। কেবল শর্মা খিকখিক করে হাসতে হাসতে বসে পড়লেন।

কর্নেল বললেন, গত রাতে শার্কে একটা মজার নাটক অভিনীত হয়েছিল। স্রেফ নাটক বা ফার্সই বলব। খেলনার মুখোশ আর খেলনার ছোরা নিয়ে একটা রোগা টিঙটিঙে লোক ঢুকে পড়ে লম্ফঝম্ফ করেছিল। অন্য সময় এই ব্যাপারটার কী প্রতিক্রিয়া ঘটত বলা যায় না। কিন্তু কল্পনা করুন, বাইরে অশান্ত সমুদ্র ভয়ঙ্কর গর্জন করছে। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। বিচের একপ্রান্তে নির্জন একটা বার-কাম-রেস্তোরাঁ হাঙরে ওইরকম রাত্রিবেলার বিশেষ একটা পরিবেশে কাকেও ভয় দেখিয়ে কাবু করতে এই খেলনার মুখোশ আর রাঙতার ছুরিটা যথেষ্টই। হলফ করে বলতে পারি, আমি থাকলেও একইভাবে ভয় পেতুম এবং ভুল করে বসতুম। নবও প্রথম মুহূর্তে ভুল করে বসবে–সত্যি কিছু ঘটছে ভেবে। কিন্তু নবর মত একজন অভিজ্ঞ সুদক্ষ সাহসী লোক প্রথম মুহূর্তে ভুল করে ধোঁকাবাজিতে পড়লেও পরক্ষণে তার সহজাত ক্ষমতা আর অভিজ্ঞ ইন্দ্রিয়সমূহের অনুভূতিবলে টের পেয়েছিল যে এই ঘটনার কোথাও একটা গুরুতর অস্বাভাবিকতা আছে। তার কিছুক্ষণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার কারণ ওই অবচেতন মানসিক দ্বন্দ্ব। হ্যামবর মতো লোকের পক্ষে এটা খুবই স্বাভাবিক। ভুলে যাবেন না, সে একজন নিরক্ষর মানুষ। এখনও প্রচুর সরলতা কোনও-না-কোনওভাবে প্রকৃতি তার মধ্যে টিকিয়ে রেখেছে। নবর মতো একজন খুনখারাপি মারামারিতে সিদ্ধহস্ত অভিজ্ঞ মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতির ফলে যুক্তিজ্ঞান আয়ত্ব করলে হয়তো সে হো-হো করে হেসে উঠত। নয়তো তক্ষুনি এগিয়ে দুথাপ্পড় কষে দিত। কিন্তু তার যুক্তিজ্ঞান কিছুটা সহজাত আর প্রকৃতি অবিশ্রান্ত ঘা মেরে মেরে যেটুকু তাকে দিতে পেরেছেন, তার যোগফল মাত্র। ভুলে যাবেন না, এদিক থেকে প্রতিটি নিরক্ষর মানুষের মধ্যে যে মৃদুতম আদিম ব্যাপারগুলি রয়েছে, তা আমরা প্রাণীদের মধ্যে পুরোপুরি দেখব। হাতে ঢিল না নিয়েও কিছু ছোঁড়ার ভঙ্গি করলে কাকটা যতই দেখতে পাক যে হাত খালি, তবু ভয় পেয়ে একটু সরে যাবে। কিন্তু নব প্রাণী নয়, মানুষ। তাই সে অবচেতন দোটানায় পড়েছিল। যাক্, এত বেশি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। আশা করি, তার তত্ত্বালীন মানসিক অবস্থা বোঝাতে পেরেছি। ছোরাটার দিকেই তার বেশিমাত্রায় চোখ পড়া স্বাভাবিক। এবং পড়েছিলও। তার নিশ্চয় কোনও সন্দেহ জেগেছিল–হয়তো সেটা অবচেতন বিহ্বলতার মধ্যে।…

নব বলল, কেমন সন্দেহ লাগছিল–ছোরাটা কেমন যেন…

হ্যাঁ। তাই শেষ অব্দি নব আর ও ব্যাপারে উৎসাহী হয়নি। আমি মার্ডার কেসে দুটো দিকে সচরাচর লক্ষ রাখি। তাই থেকে সিদ্ধান্তে আসি। প্রথমটা হচ্ছে খুবই ইমপরট্যান্ট : ব্যক্তিগত মানসিক প্রতিক্রিয়া। দ্বিতীয়টা হচ্ছে : ফ্যাক্টস। তথ্য বা বাস্তব ঘটনা। নবকে আমরা তার ওই নিষ্ক্রিয়তার জন্য আইনত কিংবা বিবেকের দিক থেকে খুব একটা দায়ী করতে পারিনে। এই সমুদ্রতীরে আজকাল যুবক-যুবতীরা প্রচুর ফার্সের অবতারণা করেন। প্রায়ই বিকেলে আমি দেখেছি, আবহাওয়া ভাল থাকলে অনেকে ছদ্মবেশের খেলা–যাকে বলে অ্যাজ ইউ লাইক গেম, খেলে থাকেন।

নব বলল, অনেকটা রাতে শুতে যাবার সময় আমি একবার ভেবেছিলুম স্যার, ওটা হয়তো ওনাদের সেই তামাশাবাজি। প্রায় দেখি, খেলনার পিস্তল নিয়ে ওনারা…।

ঠিক বলেছ, নব। তামাশাবাজি! কিন্তু আমাদের পক্ষে গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে, সেই তামাশাবাজির পরবর্তী ঘটনা–যা এই জমিতে দেখা গেল। এখন আমাদের ভাবতে হবে, সেই নিছক তামাশাবাজির সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের কোনও যোগসূত্র আছে কি না।

আচার্য বললেন, আমার ধারণা, খুবই আছে। মেয়ে দুটিকে ওইভাবে বাইরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল খুনীর। নিয়ে গিয়ে খুন করেছে।

শর্মা বললেন, আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা তা নয়। ওটা যে তামাশাবাজি, তা আমরা এখন জানলুম। প্রমাণ পেলুম। কিন্তু আসলে খুনীর ওটা একটা শো। খুন যে মুখোশধারীই করেছে, এটা দেখানো। পুলিশকে ভুল পথে চালানো তার উদ্দেশ্য ছিল।

কর্নেল বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, মিঃ শর্মা। ওই তামাশাবাজি ঘটে যাবার পরে–আমি প্রমাণ যা পেয়েছি, তন্দ্রা আর তার সঙ্গী পানিগ্রাহীসায়েবের বাংলোয় যায়। নিশ্চিন্তে সিগারেট খায় দুজনে। ওখানেই বেডরুমে তাকে খুন করা হয়। তারপর এই জমিতে তার লাশ ফেলে যায় খুনী। কোন পথে লাশ এনেছিল, এখনও প্রমাণ পাইনি–যদিও সোজা বাংলো থেকে এই প্রাইভেট রাস্তা দিয়ে কিংবা গোলাপক্ষেত পেরিয়ে আসা তার পক্ষে সহজ ও স্বাভাবিক ছিল।

সেনাপতি বললেন, গোলাপক্ষেতে কোনও পায়ের দাগ পাইনি স্যার।

রাস্তাতেও পাইনি।

গোলাপক্ষেতে রক্তের কোনও চিহ্নও পাওয়া যায়নি।

রাস্তাতেও না। তাহলে লাশ কোন পথে এল?

সদর গেট দিয়ে আসতে পারে। কিন্তু গেট তো বন্ধ ছিল। ভোমরলাল!

ভোমরলাল এগিয়ে এল..বলুন স্যার!

সেনাপতি বললেন, সকালে আজ কখন গেট খুলেছ?

আপনাদের আসার একটু আগে।

তালা বন্ধ ছিল রাত্রে?

হ্যাঁ, স্যার।

অমনি গোপালকিশোর লাফিয়ে এল। ভোমরলাল, মিথ্যে বলো না। আমি লাশটা দেখে সদর গেট খুলেই দৌড়ে গেছি। তখন গেটের তালা খোলা ছিল ঝুলছিল কড়ায়। তুমি এখন ঢাকছ। চাকরি যাবার ভয়ে তো? ও আমি বুঝেছি।

ভোমরলাল ঘাবড়ে গেল। ঘাড় চুলকোতে লাগল।

গোপালকিশোর বলল, ভোমরলালের এ অভ্যাস আছে স্যার। ও সন্ধ্যে থেকে নেশা চড়ায়। তারপর নেশার ঘোরে রাত্রে গেটে তালা দিতে ভুলে যায়। এজন্যে সায়েব কতবার ওকে বকেছেন। গাঁজার কল্কেয় টান দিয়ে ও খাটিয়ায় গিয়ে মড়ার মতো পড়ে থাকে। তার ওপর কাল বৃষ্টি হচ্ছিল প্রচণ্ড। বেড়াল স্যারও একটা বেড়াল! জলকে বেজায় ডরায়।

সবাই হেসে উঠল। ভোমরলাল কঁচুমাচু মুখে বসে পড়ল একপাশে।;

সেই সময় কর্নেল এগিয়ে গেলেন ভিড়ের দিকে। তারপর তার অভ্যাস মতো একটু কেশে বললেন, আপনারা আশা করি সবাই স্থানীয় বাসিন্দা?

ভিড় থেকে একবাক্যে সাড়া এল।

আপনারা কেউ বলতে পারেন, গত রাত্রেধরুন, রাত নটার পরে, আগে নয় কিন্তু কেউ হরিধ্বনি শুনেছেন? ফার্মের মালী হাসিরাম আমাকে বলেছে, কাল অনেকটা রাত্রে সে কোথাও মড়া নিয়ে যাওয়ার হরিধ্বনি শুনেছে। কেউ আপনাদের মধ্যে

একজন মধ্যবয়সী সাধারণ মানুষ এগিয়ে এল ভিড় ঠেলে। বলল, হ্যাঁ– স্যার। বৃষ্টি তখনও হচ্ছিল। আমার স্টেশনারী দোকানের ঝপ বন্ধ করতে গিয়ে দেখলুম, ভিজতে ভিজতে কারা মড়া নিয়ে যাচ্ছে। হরিধ্বনিও দিচ্ছে। তখন রাত এগারোটা প্রায়। কলকাতায় মাল আনতে তোক পাঠাবার কথা ছিল আজ সকালে। তাই স্টক মিলিয়ে লিস্ট করছিলুম।

আপনার নাম?

আজ্ঞে, হরিহর মহাপাত্র। সোনালি স্টোর্স দেখেননি স্যার? অবজারভেটরির পাশেই। বাজারে জায়গা পাইনি–তাই একটেরে দোকান করেছি।

মড়া যারা বইছিল, তাদের চেহারা কীরকম?

অতটা লক্ষ করিনি। আবছা দেখেছিলুম। সঠিক বর্ণনা দিতে পারব না স্যার।

চারজন ছিল?

চারজন? হুঁ–তাই তো থাকে স্যার। না–না, পাঁচজন–পাঁচজন ছিল।

খাটিয়া ছিল নিশ্চয়?

খাটিয়া–মানে খাট-ফাট ছিল না–সেটা দেখেছি। দুটো বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা মাচা মতো ছিল যেন।

ভেবে বলুন।

হ্যাঁ-স্যার। ভেবেই বলছি। বৃষ্টির মধ্যে তো–আবছা হলেও রাস্তার আলো ছিল। এক পলক দেখেই নিজের কাজে ব্যস্ত হলুম স্যার। রাত্রিদিন তো কত মরছে নিয়ে যাচ্ছে। দূরের সব গ্রাম থেকেও লোকেরা এপথে মড়া নিয়ে সমুদ্রের ধারে শ্মশানে আসে। কত দেখছি অ্যাদ্দিন ধরে! হরিহরবাবু নিরাসক্ত দার্শনিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন।

মিঃ সেনাপতি, এই ব্যাপারটা আপনি একটু খোঁজ নিন। গত রাত্রে যে মড়াটা এসেছিল, তা কোথা থেকে। শ্মশানেও লোক পাঠান। কারা বয়েছিল, তাও জানুন।

সেনাপতি অবাক হয়ে বললেন–মড়া! আচার্য আর শর্মা হেসে উঠলেন।

কর্নেল বললেন, হ্যামড়া। কাল রাত নটার পর মনে রাখবেন রাত নটার পর থেকে বৃষ্টি না থামা অব্দি অর্থাৎ রাত দুটো পর্যন্ত কোনও মড়া কারা রয়েছে, কার মড়া ইত্যাদি ডিটেলস খবর খুব জরুরী।…তিনি এবার শান্তভাবে চুরুট ধরালেন। ফের বললেন, এবার আমাকে সেই ছেঁড়া কাগজগুলো দিন।