ছয়
মুখোশ, ছুরি ও নব-র কাণ্ড
কর্নেল একজন সেপাইয়ের জিম্মায় বাংলোর ভার দিয়ে ফার্মের জমিতে গেলেন। ডাঃ পট্টনায়ককে দেখতে পেলেন না। সেনাপতি জানালেন, ডাক্তার তার বাড়িতে গেছেন–ফোরেনসিক ল্যাবের টেবিলে বসবেন গিয়ে। তার সঙ্গে বরাবর পোর্টেবল একটা ল্যাররেটরী থাকে, কর্নেল জানেন।
আরও সব সেপাই ও অফিসার এসে গেছে ততক্ষণে। সেপাইরা ভিড় হটাচ্ছে। ইউক্যালিপটাস গাছের লম্বাটে ছায়ায় একটা টেবিল ও কিছু চেয়ার পাতা হয়েছে। সেগুলো ফার্মের আপিস থেকে আনা হয়েছে।
সেনাপতি দুজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ওঁরা দৈবাৎ এসে পড়েছিলেন চন্দনপুর-অন-সী-তে। ইন্সপেক্টর শ্রী আচার্য আর কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর শ্রী শর্মা। শর্মা একটা গোপনীয় কেসের ব্যাপারে এসেছেন। কর্নেলের নাম শুনে দুজনেই লাফিয়ে উঠলেন। কারণ গর্ত শীতে কাশ্মীরে স্কি-ট্রেনিং সেন্টারের সেই জোড়া হত্যাকাণ্ড আর কর্নেলের খবর সারা ভারতবর্ষে বড়বড় কাগজগুলো ছড়িয়ে ছিল। দিল্লী রাজধানী জায়গা। সেখান থেকে কিছু প্রচারিত হলেই তা জাতীয় হয়ে ওঠে।
একটি ময়লা প্যান্ট-শার্ট পরা লোক কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকেই জিগ্যেসপত্তর করা হচ্ছিল এতক্ষণ। সেনাপতি বললেন, কর্নেল, মেয়েটির কিছু খবর এর কাছে পাওয়া গেল। এর নাম নবসুন্দর–দ্য শার্ক রেস্তোরাঁর কর্মী। আমাদের ইনফরমার। নব, কর্নেলসায়েবকে ব্যাপারটা ফের বলো তো। সে একটা রীতিমতো নাটক কর্নেল। নব, তুমি বলো।
নব গত রাত্রে ‘দ্য শার্কে’ যা-যা ঘটেছিল, সব আওড়ে গেল। এমন কি সেই কাগজের টুকরোগুলোর কথাও বলল। সেনাপতি কাগজের টুকরোগুলো একটা খাম বের করছিলেন, কর্নেল হাত তুলে তাকে থামালেন। তারপর বললেন, আচ্ছা নব, তোমার পুরো নাম কী?
শ্রীনবসুন্দর দাশ, স্যার।
বাড়ি কোথায়?
গ্রাম কাঠাপাড়া, পোঃ সুন্দরী, থানা..
থাক। শার্কে কদ্দিন এসেছ?
তা বছর তিনেক হলো, স্যার। একেবারে গোড়া থেকেই, বলতে পারেন।
শার্ক রাত্রে কতক্ষণ অব্দি খোলা থাকে?
রাত বারোটা অব্দি। তবে কোনও কোনও রাতে একটু দেরিও হয়।
কিন্তু তোমাদের ক্যাশবাবু গতরাতে নটায় চলে গেলেন বলেছ?
হ্যাঁ স্যার। উনি তাই যান। তারপর সব আমার জিম্মায় থাকে।
মালিক থাকেন না কোনও সময়?
থাকেন। কিন্তু তার কোন ঠিক নেই। ওঁর আরও সব ব্যবসাপত্তর আছে।
আর সব লোকেরা বারোটা অব্দি থাকে কি?
থাকে স্যার। কাল বৃষ্টি হচ্ছিল–লোক হবে না ভেবে তাদের যেতে বলেছিলুম।
কাল রাতে যে মেয়ে দুটি ছিল, তারা কটায় তোমাদের রেস্তোরাঁয় এসে ঢোকে?
বৃষ্টি শুরু হবার একটু আগে।
আন্দাজ কতক্ষণ আগে?
তা মিনিট পনের হবে–ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বলতে পারব না স্যার।
তাদের একজন খুন হয়ে ওখানে পড়ে রয়েছে বলছ। তোমার চিনতে ভুল হচ্ছে না তো?
না স্যার, কী বলছেন! অতক্ষণ অব্দি বসেছিল শার্কে–আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল চেহারা।
তুমি একেবারে, নিশ্চিত হয়ে বলছ?
একেবারে, স্যার। ভুল হয়নি।
তাদের হাতে কোনও ব্যাগ-ফ্যাগ ছিল না?
না।
তোমরা কি খাওয়ার পর দাম নাও?
মদের দামটা আগে নিই, অন্য কিছু খেলে পরে নিই।
প্রথমবার হাফ-পেগ করে জিন নিয়েছিল বলেছ, তার দাম কে দিল?
ফরসা লম্বা মেয়েটি। সে বেলবটম প্যান্টের পিছনের পকেট থেকে টাকা বের করেছিল।
তার ঠোঁটে লিপস্টিক ছিল?
নব একটু ভেবে বলল, বোধ হয়, না স্যার।..না, ছিল না। কারণ, ওর ঠোঁট দুট কীরকম মোটা-সেটা চোখে না পড়ে পারে না।
কীরকম সেটা, মানে?
মানে ইয়ে…স্যার, ওরকম ঠোঁট মেয়েদের মুখে মানায় না। কেমন যেন পুরুষালি।
তার গায়ে গেঞ্জি ছিল বলেছ। চুল লম্বা ছিল, তাও বলেছ। কতটা লম্বা?
নব তার ঘাড়ের অনেকটা নিচে হাত দিয়ে দেখাল।…এতটা লম্বা হবে।
ঘাড় থেকে ছসাত ইঞ্চি?
হ্যাঁ স্যার।
চুল খোলা ঝুলছিল?
হ্যাঁ স্যার।
নব, তুমি হিপি দেখেছ?
অনেক দেখেছি, স্যার। বিস্তর।
তার বুকে ব্রেসিয়ার ছিল না কিভাবে বুঝলে?
নব সলজ্জ স্বরে বলল, বুকটা উঁচু ছিল স্যার।
নব, এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই। মেয়েরা, ব্রেসিয়ার না পরে থাকলে নড়াচড়ার সময় স্তনদুটো দোলে। তুমি তেমন কিছু নিশ্চয় লক্ষ করে থাকবে?
অতটা লক্ষ করিনি। তবে বুক উঁচু ছিল, তাতে কোনও ভুল নেই।
এই সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর আচার্য হাসতে হাসতে মন্তব্য করলেন, আজকাল ছেলেরাও মেয়ে সেজে থাকতে পছন্দ করে। মোহনপুরে একদল ইভ-টিজার ধরলুম গতকাল, দুজনকে দেখে তো বুঝতেও পারিনি যে আসলে ওরা ছেলে।
কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, ঠিকই। আচ্ছা নব, ওদের মধ্যে কথাবার্তা নিশ্চয় হচ্ছিল?
হচ্ছিল। তবে এত চাপা গলায় যে কিছু শুনতে পাইনি।
অর্ডার দিচ্ছিল কে?
ফরসা মেয়েটিই। তবে স্যার, টেবিল ঠুকে ইশারায় অর্ডার দিচ্ছিল। আরও একদিন–না, আগের দিন তারও আগের দিন ওরা এসেছিল। রাত নটা অব্দি ছিল দুজনে। হাফ করে খেয়ে আসছিল প্রতিদিনই। শুধু গত রাতে আরেকটা হাফ পেগের অর্ডার দেয়।
দুজনকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল, না হাসি-খুশি?
দুজনেই গম্ভীর। আগের দিনও তাই দেখেছি।
ফরসা মেয়েটির আর তেমন কোনও বিশেষ চিহ্ন বা কোনও ভঙ্গি তোমার মনে পড়ছে?
নব একটু ভেবে ঈষৎ উদ্দীপ্ত হয়ে বলল, স্যার, ফরসা মেয়েটির হাতে উল্কি ছিল।
আর কিছু?
আর কিছু…মনে পড়ে না স্যার।
কোন হাতে উল্কি ছিল?
সেটা…হ্যাঁ, হ্যাঁ–বাঁ হাতে গেলাস ধরছিল। বাঁহাতে উল্কি ছিল এখানটায়। বলে নব তার বাঁহাতের তালু চিৎ করে কবজি থেকে ছইঞ্চি দূরে একটা জায়গা দেখাল। তারপর ফের উদ্দীপ্ত মুখে বলে উঠল, স্যার! মেয়েটি বেঁয়ে। বাঁহাতে সিগারেট খাচ্ছিল, বাঁহাতে দাম দিচ্ছিল.
তার মানে লেফট হ্যাণ্ডার?
কী বলো?
হ্যাঁ।
দুজনেই সিগারেট খাচ্ছিল?
হ্যাঁ।
সিগ্রেটের টুকরোগুলো কোথায় ফেলছিল?
অ্যাশট্রেতে।
অ্যাশট্রে কি সাফ করে ফেলেছ?
হ্যাঁ, স্যার। ভোরে সুইপার এসে সাফ করে প্রতিদিন।
আচ্ছা নব, দেশলাই জ্বালছিল কে?
খুন হওয়া বেঁটে মেয়েটি, স্যার। সে ধরিয়ে দিচ্ছিল–একবার লক্ষ করেছি।
ফরসা মেয়েটি বেশি সিগারেট খাচ্ছিল, না বেঁটে মেয়েটি? নাকি দুজনেই একসঙ্গে সমান খাচ্ছিল?
নব একটু ভেবে বলল, বেঁটে মেয়েটি দুএকবার–তবে ফরসা মেয়েটি বেশি।
কর্নেল কথা কেড়ে বললেন, সে নিশ্চয় নিজের সিগারেটের পোড়া টুকরো থেকে সিগারেট ধরাচ্ছিল?
হ্যাঁ, স্যার। ঠিক বলেছেন।
সেনাপতি বললেন, তাহলে সে চেইন-স্মোকার দেখছি!.
কর্নেল বললেন, নব, এবার সেই ছোরা হাতে লোকটির কথা বলল। সে মাথায় তোমার চেয়ে ছোট, না উঁচু?
না স্যার, ছোট। রোগামতো টিঙটিঙে লোক। ময়লা রঙ। হাতে লোম ছিল।
চুল?
চুল…তখন খুঁটিয়ে দেখার মতো অবস্থা তো ছিল না স্যার। তার ওপর মুখে মুখোশ পড়া।
কোনও বিশেষ চিহ্ন বা ভঙ্গির কথা মনে পড়ছে?
না স্যার। সে আধ মিনিটেরও কম লম্ফঝম্ফ করে পালাল। তখন কিছু লক্ষ করার কথা মাথায় কারও আসা সম্ভব, স্যার?
পায়ে জুতো ছিল দেখেছ?
মনে পড়ছে না। বলছি তো–তখন যা অবস্থা চলেছে…
কিন্তু তুমি তো শক্ত-সমর্থ প্রায় পালোয়ান মানুষ, নব। বারে মাতালদের হাঙ্গামা নিশ্চয় হয়। তোমাকেও তা থামাতে হয়। কী বলো?
হয়, স্যার। আমাকে মাতাল বলে কথা নেই, আপনাদের আশীর্বাদে, ভদ্রলোক ছোটলোক সবাই বেশ ডরায়। আমি নিজেও কম মারামারি করিনি এ জীবনে। থানার স্যাররা সে-হিসট্রি সব জানেন।
অথচ নব, তুমি তখন ছোরা হাতে একটা লোককে দেখে হতভম্ভ হয়ে রইলে। কোনওরকম বাধাও দিলে না! ইচ্ছে করলে তো তুমি ওকে ছোরা কেড়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিতে পারতে!
নব মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু মুখে বলল, আপনার আশীর্বাদে তা পারতুম, স্যার!
কিন্তু তা করোনি।
আমার…আমার কী যেন হয়েছিল! এখন আফসোস হচ্ছে, স্যার।
কর্নেল তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, নাকি তুমি মোটেও বাঁধা দিতে চাওনি?
নব লাফিয়ে উঠল। তীব্র প্রতিবাদের সুরে বলল, ছি ছি! এ কী বলছেন স্যার! চোখের সামনে একটা খুনখারাপি দাঁড়িয়ে দেখার ছেলে নব নয়। আমার পরম শত্রুকেও যদি কেউ খুন করতে চেষ্টা করে আমি সামনে থাকলে তা প্রাণ গেলেও হতে দেব না। কত বড়বড় গুণ্ডা আর বদমাশ পিটিয়ে আমি ঠাণ্ডা করেছি। বালেশ্বরের ওদিকে গিয়ে নবর নাম বললে এখনও সাপ রাস্তা ছেড়ে সরে যায়!
কর্নেল তার কথার ওপর কথা ফেললেন।…সাপও রাস্তা ছেড়ে যায়। অথচ মুখোশপরা লোকটা দিব্যি ছোরা হাতে দুটি মেয়েকে খুন করতে ঢুকেছে–আর ঢুকেছেও তোমার ঘরে বলা যায়–তুমি অমনি বোবা বনে গেলে নব?
নব ফ্যালফ্যাল করে তাকাল… আমার বুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল যেন।
তোমার বুদ্ধি সামান্য একটা–তোমারই ভাষায় রোগা টিঙটিঙে লোককে ছোরা হাতে লম্ফঝম্ফ করতে দেখে গুলিয়ে গেল? দুঃখিত নব, এটা বিশ্বাস করতে পারছিনে।
নব বিব্রত মুখে হাত কচলাতে থাকল। এইসময় সেনাপতি যেন নবর। হয়েই সাফাই দেবার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, কর্নেল স্যার! নব আমাদের বিশ্বাসী। ও ভীষণ সাহায্য করেছে নানা ব্যাপারে। তাছাড়া ইনফরমারের গতিবিধি জানবার জন্যেও আমাদের ইনফরমার রয়েছে। নব ইজ কোয়াইট ক্লিন ইন অল রেসপেক্ট।
কর্নেল বললেন, একটা কথা মিঃ সেনাপতি। নবর ধরনের লোকেরা সচরাচর কীরকম হয়ে থাকে আমরা জানি। অতীতে সে বদমাইশি খুনোখুনি করেছে। তারপর সম্ভবত নানা ঘটনার চাপে ওর চরিত্র বা জীবনযাত্রার ধাঁচ বদলাতে বাধ্য হয়েছে সে নিজে, কিংবা হয়তো শুধু বাইরের চাপেই বদলে গেছে। সাধারণত এই ধরনের লোকই পুলিশের ইনফরমার হবার উপযুক্ত। পুলিশের কার্যকলাপের আওতায় এসে এরা কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটা পাল্টা ভূমিকা নিতে শুরু করে। তাদের অহংবোধ উদ্দীপ্ত হয় এবং আইনের পথে প্রকাশ্যে, নিজের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে দেখে তাদের পক্ষে অনেক সময়। সমাজের একটি উপকারী মানুষ হয়ে ওঠাও বিচিত্র নয়। ব্যতিক্রমও আছে নিশ্চয়। এবার আসছি, এ ধরনের লোকেদের দ্বিতীয় একটি মানসিক বৈশিষ্ট্যের কথায়। যেহেতু তাদের তীব্র অহংবোধ এখন আইনের প্রশ্রয় পাচ্ছে এমনকি সামাজিক দিকে থেকে নৈতিক প্ররোচনা ও পিঠচাপড়ানি দুই-ই পাচ্ছে এরা বেপরোয়া হয়ে গুণ্ডা বদমাশ ঠ্যাঙাতে তৎপর হয়। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রতিদ্বন্বিতার মনোভাব। তার কাছে এখন পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম খনী বা গুণ্ডা-বদমাশ যে নস্যি, এটা দেখানোর জেদ মাথায় উগ্র হয়ে ওঠে। ভাবটা এই : আরে যা ব্যাটা পুঁচকে! অমন কত মাল পকেটে ভরেছি অ্যাদ্দিন! …আমার মনে হচ্ছে, নবর মধ্যে এইসব ভাব থাকা স্বাভাবিক।
সেনাপতি মাথা দোলালেন।…হ্যাঁ, আছে। আই এগ্রি। নিশ্চয় আছে।
আছে। অথচ সে গতরাতে হাঙরের মুখোশপরা ছোরাধারী একটা রোগা টিঙটিঙে লোককে দেখে ঘাবড়ে গেল!…
নব বাধা দিয়ে বলল, না স্যার, না স্যার। ঘাবড়াইনি। হকচকিয়ে গিয়েছিলুম। এ যে এক আজব ঘটনা স্যার!
এমন ঘটনার মুখোমুখি তাহলে কখনও হওনি বলছ! ভেবে বললো, নব।
হইনি বললে মিথ্যে বলা হবে। একবার আচমকা একটা লোক আমাকে ছোরা নিয়ে হামলা করেছিল… বলে নব সেনাপতির দিকে সায় নেবার ভঙ্গিতে তাকাল।…ঠিক না, স্যার? তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ছুরিসুদ্ধ থানায় নিয়ে গেলুম না, স্যার?
সেনাপতি বললেন, দ্যাটস রাইট।
কর্নেল প্রশ্ন করলেন, তাহলে, নব?
নব ঘামছিল। ভারি গলায় বলল, কী বলব–কী যেন হয়েছিল তখন! খুব হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। আপসোস হচ্ছে–ইস্! আর একবার যদি ওরকমটি হতো!
কর্নেল একটু হাসলেন। তারপর বললেন, যাক্ গে, ছেড়ে দাও। যা হবার হয়েছে। এখন বলল, মুখোশটা কেমন ছিল?
এমনি একটা মুখোশ-বাচ্চারা যা পরে। বিচে বিকেলে বেচতে আসে ফেরিওয়ালারা। ভূতের মুখোশ, রাক্ষসের মুখোশকত রকম। কানে গাটার দিয়ে আটকাতে হয়। নাক ও চোখের ফুটো থাকে।
তাহলে বলছ খেলনার মুখোশ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, আর ছোরাটা সেই রকম খেলনার নয়, আশা করি!
নব কেন যেন একটু অবাক হলো, খেলনার ছোরা?
সী-বিচে খেলনার মুখোশ আর রাঙতামোড়া ছুরি তলোয়ার তীর ধনুক বিক্রি হতে আমি দেখেছি। কর্নেল সকৌতুকে বললেন, ফের, নব, আমাদের বেশ অদ্ভুত গল্প শোনালে তাহলে!
অমনি নব এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। সে আচমকা দৌড়ে পালিয়ে গেল।
ঘটনাটা এমন আচমকা ঘটল যে সবাই হতভম্ব হয়ে পড়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। নব যখন ফার্মের সদর গেট পেরিয়েছে, তখন দুজন সেপাই উপস্থিতবুদ্ধি মতে পাকড়ো, পাকড়ো শালা বদমাশকো বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ল। সেনাপতি, শৰ্মা, আচার্য এবার স্প্রিঙের পুতুলের মতো চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন একসঙ্গে। আচার্য বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ দিলেন, পাকড়ো শালা খুনী কো! সেনাপতি চেয়ার সরিয়ে রিভলভার খুলে বেরোবার চেষ্টা করতেই কর্নেল তার হাতটা ধরলেন। কোথায় যাবেন? বসুন। কর্নেল এতক্ষণ একটুও নড়েননি।
ওদিকে ফার্মের কিছু লোক আর ভিড় থেকে কয়েকজন মিলে দৌড়ে যাচ্ছে দেখা গেল।
সেনাপতি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, কর্নেল, কর্নেল! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে জেরার চোটে নবর মুখোশটা খুলে দিয়েছেন! ব্যাটা সেটা টের পেয়েই পালাল। উঃ! একটুও ভাবিনি–ও ব্যাটারই কাজ! শয়তান কখনও মানুষ হয়– না হয়েছে? চোখে ধুলো দিয়ে দিব্যি ইনফরমার সেজে কাটাচ্ছিল, একটুও টের পাইনি।
আচার্য হাঁসফাঁস করে বললেন, আমি বারবার বলেছি, ও ব্যাটা খুনে গুণ্ডা সম্পর্কে সাবধানে থাকা উচিত আপনাদের। অতটা বিশ্বাস করবেন না!
আচার্য স্থূলোদর মানুষ। তার লাল মুখ ঘেমে কালো দেখাচ্ছে। ভুড়িটা ফেটে যাবার উপক্রম হয়েছে। সেনাপতির একটা হাত ধরে কর্নেল আটকানোর চেষ্টা করছেন।
কিন্তু কর্নেলের মুখে শান্ত হাসি। সবার মনে হচ্ছিল যে এই হাসি নবকে চরম পয়েন্টে জেরা করে ফেলার জন্যে তৃপ্তির হাসি। শর্মা বসলেন অবশ্য। বসে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, আগাগোড়া একটা বানানো গল্প বলে ব্যাটা কেমন ভুল পথে চালানোর চেষ্টা করছিল। হুঁ! মুখোশপরা একটা লোক। নাও, এখন পৃথিবী হাতড়ে বেড়াও তার জন্যে! এই ফন্দিটা একটুও টের পাইনি আমরা।
আচার্য বললেন, আসলে ও ইনফরমার, তাই বিশ্বাস করতে হচ্ছিল।
কর্নেল বললেন, ওকে বিশ্বাস করে কোনওবার কখনও ঠকেছেন, এমন ঘটনা আছে?
না–ঠকিনি। এবার অ্যাদ্দিনে ঠকলুম। অবশ্য আমি ঠকিনি আমার বরাবর সন্দেহ ছিল গু-খাওয়া গরু। খোলভুষি খাবে কেন?
কর্নেল বললেন, বাই দা বাই, মিঃ আচার্য–আপনি কি মুর্শিদাবাদের লোক?
আচার্য অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ। কেন বলুন তো?
নিশ্চয় গ্রামাঞ্চলে বাড়ি ছিল?
হ্যাঁ। কেন, কেন? কিসে বুঝলেন?
ওই গ্রাম্য প্রবাদবচনে। বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।…! একজ্যাক্টলি! বিষ্ঠাভক্ষণকারী প্রাণীরা এমনি হয়।