পাঁচ

নীলরঙের বাসায় অসম্ভবের ছানা

কে টু এস! ডাঃ পট্টনায়কের মুখে প্রতিধ্বনিত হলো কর্নেলের বাক্যটি। তিনি যেন হতভম্ব হয়ে পড়লেন কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে। তারপর বললেন, কই দেখি, দেখি!

কর্নেল জানালার কাছে বেশি আলোয় সাবধানে সিগারেট-কেসের একটা কোণা ধরে বললেন, হ্যাঁকে টু এস খোদাই করা আছে। আঙুলের ছাপ নিশ্চয় পাওয়া যাবে এতে। থাক, এটা বেশি নাড়াচাড়া না করাই ভাল।

পট্টনায়ক তার ব্যাগ থেকে মোড়ক বের করলেন।… কর্নেল, এখানেই আমি কাজটা সেরে ফেলতে চাই। এই টেবিলে ওটা রাখুন।

কর্নেল হাসলেন।…সব ব্যবস্থা নিখুঁত আপনার। বাঃ! তারপর কোণের টেবিলে সিগারেট-কেসটা রাখলেন।

পট্টনায়ক মোড়ক থেকে একটা সাদা পাউডার তুলে ছড়িয়ে দিলেন ওটার গায়ে। তারপর একটা সূচের মতো সরু জিনিস দিয়ে পাউডার ঝেড়ে ফেলতেই আবছা কিছু ছাপ ফুটে উঠল আঙুলের। ক্যামেরার লেন্স পাল্টে ও একটার পর একটা নতুন ফ্লাশবা জুড়ে চারটে ছবি তুললেন। তারপর বললেন, এবার ভেতরটা দেখা যাক!

কেস খুলে দেখা গেল পাঁচটা সিগারেট রয়েছে। কর্নেল দেখে বললেন, বিলিতী সিগারেট। খুব দামী ব্র্যাণ্ড। এখানে পাওয়া যায় নাকি?

পট্টনায়ক জবাব দিলেন, বলতে পারছিনে। আমি তো ও রসের রসিক নই। খোঁজ নিলেই জানা যাবে। তারপর ভিতরের দিকে একইভাবে পাউডার ছড়িয়ে ও মুছে আরও কিছু ছবি নিলেন। তখন কর্নেল মেঝেয় হাঁটু ভাঁজ করে কিছু খুঁজতে ব্যস্ত হয়েছেন।

কর্নেল বললেন, কাল রাতে বৃষ্টির সময় এ ঘরে আনাগোনার চিহ্ন প্রচুর। বালি আর কাদার টুকরো দেখতে পাচ্ছি। কার্পেটেও তা লক্ষ্য করেছি।

হাসিরাম মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বলল, সায়েব এসে নির্ঘাৎ আমার চাকরি খাবেন, স্যার! দেখুন দিকি, কী সব করেছে ঘরের মধ্যে। আমি শুধু ভাবছি, ঢুকল কেমন করে? তালা তো ঠিকঠাক রয়েছে!

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বাইরে যাওয়ার আর দরজা নেই?

আছে। বেডরুমের দিকে। বলে হাসিরাম সেদিকে এগোল।

দুজনে ওকে অনুসরণ করলেন। বেডরুমের দরজাটা খোলা, ভারি পর্দা ঝুলছে। হলদে জমিনে বড়োবড়ো লাল ফুলের নকশা। কর্নেল বললেন, ঐ দরজাটা কি ভোলা থাকে?

হাসিরাম পর্দা তুলতে গিয়ে থেমে জবাব দিল, হ্যাঁ স্যার। তারপর ভিতরে ঢুকেই সে পিছিয়ে এল। তার মুখে প্রচণ্ড অতঙ্কের চিহ্ন। সে অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠল, রক্ত স্যার, রক্ত!

কর্নেল প্রথমে ঢুকলেন, তারপর পট্টনায়ক। এ ঘরের জানালা বন্ধ। কিন্তু যেটুকু আলো আছে, তাতেই সব দেখা যাচ্ছিল। সারা মেঝে হলদে কার্পেটে মোড়া। এক পাশে বিছানার খাট রয়েছে। দরজার সামনা-সামনি কঁকা–অন্য পাশে সোফাসেট ও বই ভরতি সেলফ। ফাঁকা জায়গায় কার্পেটের ওপর চাপচাপ রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। বিছানার ওপর, দেয়ালে সবখানে রক্তের দাগ।

পট্টনায়ক বললেন, সর্বনাশ! এখানেই তাহলে খুন করা হয়েছে মেয়েটিকে!

হাসিরাম, জানালাগুলো খুলে দাও। কর্নেল শান্তভাবে বললেন।

হাসিরাম জানালা খুলে পর্দাগুলো সরাল। প্রচুর আলো এল ঘরে। দেখা গেল, বিছানাটায় রাত্রে কেউ শুয়েছিল।

কর্নেল দরজা খুলে বেরোলেন ওদিকে। চওড়া বারান্দা রয়েছে। টবে অজস্র গাছ রয়েছে। বারান্দায় কয়েক জায়গায় রক্তের দাগ দেখা গেল। নিচে ছোট লনে নুড়ি বিছানো, দুধারে কেয়ারি করা লতার বেড়া আন্ধু ফুলগাছ। নুড়ি বিছানো পথটা ঘুরে বাংলোর পূর্বদিক হয়ে গেটে পৌঁছেছে। নুড়ির ওপর কোথাও রক্ত দেখা গেল না। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে নিশ্চয়। কর্নেল অস্ফুটস্বরে বললেন, রক্তের ছিটেলাগা বিছানায় শুয়ে রাত কাটায়, সে কে? এত নির্বিকার সে?

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, তাহলে মোটামুটি বোঝা গেল, খুনটা ওঘরে হয়েছে। তারপর এদিক দিয়ে লাশ বের করেছে খুনী। গেট পেরিয়ে আমরা যে-পথে এসেছি, সেই পথে নিয়ে গিয়ে ওই ধানের জমিতে ফেলেছে।

কর্নেল গেট ঘুরে ফের সেই সদর দরজায় গেলেন। তালাটা পরীক্ষা করে বললেন, মোমের দাগ দেখছি না। ছাপ নিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি বানানোর চিহ্ন নেই।

হাসিরাম করুণ মুখে বলল, আমি কী করব স্যার? ঘরদোরের এ অবস্থা দেখে সায়েব ক্ষেপে যাবেন যে!

কর্নেল বললেন, হাসিরাম, কাল তুমি শেষবার কখন এখানে এসেছিলে?

বিকেলে, স্যার। বৃষ্টির আগে। সায়েব আসব আসব হয়ে আছেন। পথের দিকে চোখ রেখে আমরা কাটাচ্ছি। তাই সব ঠিকঠাক আছে নাকি দেখতে এসেছিলুম।

সব ঠিকঠাক দেখেছিলে?

হ্যাঁ স্যার।

তোমাদের সায়েব নিজের গাড়িতে না ট্রেনে আসেন বরাবর?

নিজের গাড়িতে।

বাংলোর ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় সায়েবের কাছে আছে?

আছে, স্যার।

তুমি এক কাজ করো। দরজার এ তালা-চাবি আমরা নেব। তুমি আর একটা মজবুত তালা এনে দরজা আটকাও।.বলেই কর্নেল একটু ভেবে নিলেন। ফের বললেন, …থাক। মিঃ সেনাপতি বরং সে-ব্যবস্থা করবেন। বাংলোটা আপাতত পুলিশের জিম্মায় থাকাই ভাল। ডাঃ পট্টনায়ক, আপনি প্লীজ–যদি কিছু মনে না করেন, সেনাপতিকে খবর দিন। আমি আর হাসিরাম ততক্ষণ এখানে রইলুম। এস হাসিরাম, আমরা বেডরুমের দিকের খিড়কির দরজাটা এঁটে দিই। তারপর গল্পগুজব করা যাক।

ডাঃ পট্টনায়ক চলে গেলেন। কর্নেল বাংলোর সদর দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হাসিরাম মনমরা হয়ে বলল, আমার মাথা ঘুরছে স্যার, বমি বমি লাগছে। হাওয়ায় দুদণ্ড না বসলে আর পারব না।

কর্নেল ভাবলেন, হাসিরাম চাকরি যাবার ভয়ে ঘাবড়ে গেছে, বেচারা! সে বারান্দায় বসে পড়ল। কর্নেল ভিতরে ঢুকে ফের খুঁটিয়ে সবকিছু দেখতে থাকলেন। কিছু চোখ এড়িয়ে গেছে নাকি?

তারপর বেডরুমে ঢুকলেন। ওদিকের দরজাটা ভিতর থেকে এঁটে দিলেন। দরজার কপাটে খুনীর ছাপ থাকা সম্ভব। যাকগে, সে পরের ব্যাপার। বুকশেলফ দটোর কাছে গিয়ে দেখলেন, তালা বন্ধ রয়েছে। রাজনীতি, ফার্মিং, খেলাধুলো সংক্রান্ত নীরস বই সব। কোণের দিকে একটা টুলে একগাদা ইংরেজি পত্রিকা আছে। কর্নেল পত্রিকাগুলো উল্টে চললেন। একটু পরেই তার অবাক লাগল নিজের আচরণ। পত্রিকাগুলো এভাবে নিজের অজান্তে কেন হাতড়াচ্ছেন? কী সূত্র পাবেন বলে আশা করছেন? সেই মুহূর্তে অনুভব করলেন, তিনি যেন এই হত্যাকাণ্ডরূপী রক্তফুলে ভরা গাছটার শিকড় এই বাংলোর তলায় আবিষ্কার করতে চাইছেন। বাংলোর সঙ্গে তার যোগসূত্র আছে বলে কীভাবে যেন বিশ্বাস হয়ে গেছে অবচেতন মনে। বাংলোটা শ্ৰীমদনমোদন পানিগ্রাহীর। অতএব পরোক্ষে তাই কি এই ভদ্রলোকেরই জীবনযাত্রা হাতড়াতে ব্যস্ত হলেন? কেন? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? পানিগ্রাহীর নারীঘটিত দুর্বলতা, এই বাংলোয় স্ত্রীলোক নিয়ে নির্জনে একান্তে এসে, থাকা…এইগুলো হচ্ছে বাস্তব তথ্য বা ফ্যাক্টস। এই ফ্যাক্ট তাকে অবচেতনায় প্ররোচিত করেছে নিঃসন্দেহে। অমনি একটু অস্বস্তি হলো। পানিগ্রাহী তো এখনও আসেননি। সুইডেন থেকে পৌঁছেছে কি না তাও জানা নেই। সেটা খবরের কাগজ থেকে আগে জেনে নেওয়া উচিত ছিল। খামোকা বেচারাকে সন্দেহ করা ঠিক হচ্ছে না।

অথচ একটা কিন্তু ভাব থেকেই যাচ্ছে।…

কী একটা খচখচ করে বিধছে মনে।…

হঠাৎ একটা দৃশ্য মাথায় ভেসে এল। ডাঃ.পট্টনায়ক সিগারেট কৌটোটা : দেখামাত্র কেমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। তার মুখের সেই বিস্ময় ও শিহরণ কর্নেলের দৃষ্টি এড়ায়নি।

বারবার মনে হলো, এটা তারই চোখের ভুল। কিন্তু…

ঠিক সেই সময় পত্রিকাটি অন্যমনস্কতার দরুন হাত থেকে পড়ে গেল। তারপর তার পাতার ফাঁকে একটা নীলরঙের খামের কোণা উঁকি মারল। খামটা বের করে নিলেন। নীল খাম। ভিতরে চিঠি রয়েছে। কোনও ডাকটিকিট নেই, পোস্টাপিসের ছাপ নেই। তার মানে হাতে-হাতে পাঠানো হয়েছে। ওপরে পানিগ্রাহীর নাম লেখা।

সাবধানে এক কোণা ধরে চিঠিটা বের করে খুললেন। পরক্ষণে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। নানা, এ অসম্ভব। এ কী দেখছেন! আর তারিখ তো গত কালকের! ২২ জুলাই!

চিঠিটা পকেটে ভরে ফেললেন। তাঁর দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে রইল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। পৃথিবীতে বিস্ময়কর অনেক কিছু আছে কিন্তু অসম্ভব বলে সত্যি কিছু নেই। এ যেন নীলরঙা একটা বাসায় অসম্ভবের ফুটফুটে একটি ছানা। কর্নেল চুরুট। ধরিয়ে বেরিয়ে এলেন।…