চার
প্রাথমিক তদন্ত
জিপ থেকে চারজন ব্যক্তভাবে তোক নামল। পুলিশ অফিসার শ্রী সেনাপতি, ডাঃ পট্টনায়ক আর দুজন বন্দুকধারী সেপাই। তারা দৌড়ে লাশটার কাছে চলে এল। পট্টনায়কের কাঁধে একটা বড়সড় এয়ারব্যাগ আর অদ্ভুত গড়নের ক্যামেরা ঝুলছে। হাতে সেকেলে গড়নের হাতলওয়ালা আয়নার মতো কী একটা রয়েছে–গোলাকার ঢাকনা দেওয়া কাঁচ।
সেপাই দুজন তাদের কর্তব্য সেরে নিল আগে। অর্থাৎ ফার্মে লোকজনকে অন্তত পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে খেদিয়ে দিল। পট্টনায়ক সশব্যস্তে বললেন, এক মিনিট মিঃ সেনাপতি। তারপর সাবধানে এগিয়ে লাশের ডানকবজিতে নাড়ি পরীক্ষা করে নিলেন। তারপর এগিয়ে পিছিয়ে নানা ভঙ্গিতে পটাপট সুইচ টিপলেন ক্যামেরার। লাশটার চারদিক থেকে কয়েকটা ছবি তুললেন। শেষে ক্লোজশটও নিলেন গোটা তিনেক। তারপর মৃদু হেসে হাত ইশারা করলেন, হ্যাঁ, মিঃ সেনাপতি–আপনি এগোতে পারেন এবার। শী ইজ কোয়াইট ডেড।
সেনাপতি হেসে বললেন, আমার এগোনো মানে তো স্যার, লাশটা উঠিয়ে মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। অবশ্য কিছু পেপারওয়ার্ক রয়েছে। ছকবাঁধা ভাষায় একটা বিবরণ লেখা।
বলে তিনি নোটবইতে ৬বি মার্কা পেন্সিল লড়িয়ে দিলেন। রুটিন ওয়ার্কস, পুলিশের ভাষায়। আইটেমগুলো ধরাবাঁধা। তবে ফিতে বের করতে হলো। যে কোনও দুদিকের মোটামুটি স্থায়ী সীমানাচিহ্ন হিসেবে কোনও গাছ দেয়াল কিংবা এ ধরনের কিছু বেছে নিয়ে লাশ থেকে তাদের দুরত্ব মাপার কাজ রয়েছে। একটা চিহ্ন হিসেবে উঁচু আলটা পাওয়া গেল উত্তরে, পুবে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ। সেনাপতি মাপজোকের ফিতে বের করলেন। একজন সেপাই সেটার একপ্রান্ত ধরল। শেষে ট্রাকটারটা থেকে দূরত্বও মাপা হলো।
সেই সময় ডাক্তার পট্টনায়ক সতর্ক করলেন। দেখবেন, পায়ের ছাপটাপ নষ্ট হয়।
সেনাপতি এক সময় ওঁর ছাত্র ছিলেন। অনুগত প্রাক্তন ছাত্রের বিনয়ে তিনি বললেন, না স্যার–আমি জানি। তেওয়ারী, এগোও তুমি।
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে চুরুট টানছিলেন। যেন এঁদের উপস্থিতি তার চেতনার বাইরে। পট্টনায়ক তার কাছে গেলেন।…এই যে কর্নেল! এ– কেসের নাম কী দেবেন, ভাবছেন বুঝি? এ মার্ডার ইন দা ফার্ম নাকি…
কর্নেল হাসলেন অভ্যাস মতো।…না। এ মার্ডার ইন দা বিগিনিং অফ এ লং ডে। দীর্ঘ দিনের শুরুতে একটি হত্যাকাণ্ড।
পট্টনায়ক বললেন, ঠিক বলেছেন। দিন লম্বাই বটে। ইস্, চন্দনপুর-অন সীর দিনগুলো যা লম্বা লাগছে, ভাবা যায় না! কী হয়েছে বলুন তো?
আপনি ব্যস্তবাগীশ মানুষ কি না। তাই অবসর কাটানো আপনার পক্ষে রীতিমতো ড্যাম বিজনেস! কর্নেল বন্ধুকে যেন সস্নেহে আদর দিলেন। তবে যাই হোক, এখন আপনি লম্বা দিন জবাই করার মতো কিছু পেয়ে গেলেন, বলব।
তাচ্ছিল্যে ভুরু কুঁচকে পট্টনায়ক জবাব দিলেন, এ একটা বাজে কেস বলে মনে হচ্ছে–যা দেখছি। মর্গ থেকে রিপোর্ট এলে দেখবেন, নিছক ধর্ষণের পর খুন। আজকাল আধুনিকতার নামে মেয়েরা যতটা সাহস দেখাচ্ছে, প্রকৃতি তাদের শরীরে তো সে-মতো শক্তি দেননি। এ একটা মারাত্মক অবিবেচনা–তাই না? বলুন!
কর্নেল চাপা হেসে বললেন, শ্রীমতা পট্টনায়ক ও তার মেয়ের সামনে এ মন্তব্য করার সাহস আশা করি আপনার আছে, মাই ডিয়ার ডক্টর পট্টনায়ক!
পট্টনায়ক একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, রিয়্যালি কর্নেল, চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে অনেকে কিছু দেখতে পায় না। আশা করি আমার স্ত্রী কন্যার স্বাধীনতাবোধ এই ঘটনায় কিছু চোট খাবে। কল্যাণীকে সঙ্গে আনলে ভালই করতুম। যখন তখন সে একা পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গত সন্ধ্যায় বৃষ্টি না হলে ওকে আমরা দেখতে পেতুম ভাবছেন? আমার তো সব সময় ভয়, কখন কী ঘটে যায় নাকি। আজকাল সুশিক্ষিত বদমাশদের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। আমরা যাকে ক্রাইম বলি, তাই তাদের নাকি আর্ট অফ মর্ডান লিভিং! যতঃ সব!
কর্নেল বললেন, পায়ের ছাপটাপ কিছু লক্ষ করলেন?
না। সেনাপতির মাপজোক চুকে যাক। তারপর দেখব। ডাঃ পট্টনায়ক কিটব্যাগ থেকে প্লাস্টার ছাঁচ তৈরির উপকরণগুলি বের করতে ব্যস্ত হলেন। তারপর ক্যামেরার মুখে একটা বাড়তি লেন্স পরালেন। ফের বললেন, বাজে কেস। রাজ্যের মেয়ে একাদোকা ঘুরে বেড়ায় সন্ধ্যার দিকে। রাতঅব্দিও কেউ কেউ সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে থাকে। তার ওপর মদ্যপান..ওঃ, হেল অফ ইট! আপনি দেখবেন, এই মেয়েটির পাকস্থলীতে একগাদা অ্যালকোহল বজবজ করছে।
মর্গে আমি যাচ্ছি না। বলে কর্নেল লাসটার দিকে এগোলেন।
তখন মাপজোক সেরে জিপের ইঞ্জিনের বনেটে একটা খাতা ফেলে সেনাপতি ৬বি পেন্সিলটা জোর লড়িয়ে দিয়েছেন। ডাঃ পট্টনায়ককে পাশে দেখে বললেন, আমার কাজ শেষ স্যার। আপনি এখন যেতে পারেন। ছাপটাপ কিছু তো দেখলুম না–যা ঘাস!
সেনাপতি লিখছিলেন : আজ বাইশ জুলাই ভোর ছটা তের মিনিটে কলকাতার প্রখ্যাত অপরাধ-বিজ্ঞানী কর্নেল এন সরকারের ফোন পাই। তিনি জানান, স্থানীয় অবজারভেটরি থেকে ফোন করছেন। পানিগ্রাহী ফার্মে একটা মেয়ের লাশ পড়ে আছে নাকি। তিনি ওই ফার্মের ট্রাকটার চালক শ্ৰীগোপালকিশোর দাসের কাছে খবরটা জেনেছেন বলেন। তিনি আরও বলেন, বিশিষ্ট ফোরেনসিক-বিশেষজ্ঞ ডাঃ সীতানাথ পট্টনায়ক এখন চন্দনপুর-অন-সী-তে নিজের বাড়িতে রয়েছেন–তাঁকে যেন সঙ্গে নিই। তাই তাঁকে এবং থানায় বেশি কনস্টেবল না থাকায় রামদুলাল তেওয়ারী আর অজিত মহাপাত্রকে নিয়ে অকুস্থলে চলে আসি। ফার্মের ধানী জমিতে লাশটা দেখতে পাই। লাশটার ত্রিশ মিটার দূরে দক্ষিণে একটা ট্রাকটার জমি চষতে চষতে এসে থমকে দাঁড়ায়, তার প্রমাণ পিছনে টাটকা চাষের চিহ্ন। জমিতে ধান নেই–ঘাস ও আগাছা রয়েছে। চারদিকে উঁচু আল আছে। জমিটার পরিমাণ, গোপালকিশোর বলেছে, নয় একর। জমিটার সীমানা : উত্তরে গোলাপ বাগিচা, পুবে সাত মিটার চওড়া প্রাইভেট রাস্তা, দক্ষিণে কর্মচারীদের বসবাসের ঘর, গোডাউন, যন্ত্রপাতি রাখার জায়গা, পশ্চিমে ভুট্টাক্ষেত। লাশটা রয়েছে জমির উত্তর পূর্ব কোণার দিকে। স্থায়ী সীমানাচিহ্ন উঁচু আল থেকে আনুমানিক দুমিটার এবং স্থায়ী সীমানা-চিহ্ন পূর্বে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে আনুঃ পাঁচ মিটার দূরে। লাশটার মাথা পশ্চিমে, পা পূর্বে রয়েছে। এবং লাশটা উত্তর দিকে কাত হয়ে আছে। বাঁ হাত শরীরের নিচে চাপা পড়েছে, ডান হাত ৯০ ডিগ্রী কোণ করে কোমর থেকে হাফ মিটার দক্ষিণে লম্বালম্বি ছড়ানো–তালু চিৎ। লাশটার নিচে ঘন ঘাস আছে। লাশের সেক্স স্ত্রী। বয়স আনুমানিক কুড়ি থেকে বাইশ। রঙ-আনুঃ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। পরনে ক্রিমরঙা আঁটো নাইলন স্ন্যাকস, গায়ে হলদে খদ্দরের হাফপাঞ্জাবি কালো বাটিকের কাজ করা। চুল ববছাট। কোনও গয়না নেই। প্রকাশ্য হাত অর্থাৎ ডান হাতের কবজিতে চওড়া বাদামী ব্যাণ্ডে মোটা ঘড়ি রয়েছে(কোম্পানীর নাম : এভালান্স, অ্যামেরিকার তৈরি নং ২২৮৭৯৪ এ)। সিঁথিতে সিন্দুর-চিহ্ন নেই। ডান পায়ে স্লিপার দুফিতের–পরা অবস্থায় রয়েছে। ফিতের রঙ লাল, আনুঃ তিন সে.মি. চওড়া। বাঁ পা খালি। বাঁ পা থেকে পঞ্চাশ সে.মি. দূরে সরাসরি উত্তর দিকে এবং স্থায়ী উত্তর সীমানাচিহ্নের এক মিটার দূরে আরেকটি অবিকল একই গড়নের একটি স্লিপার পড়ে রয়েছে। চিৎ হয়ে আছে সেটা। লাশটার মাথা পা অব্দি আনুঃ মাপ দেড় মিটার। ক্ষত চিহ্ন : পিঠে-হার্টের উল্টোদিকে। জমাট থলথলে রক্ত রয়েছে। কিছু নিচেই ঘাসে পড়েছে। তাছাড়া আশেপাশে কোথাও রক্তের চিহ্ন দেখি না। ফার্মের কেউ মৃত তরুণীকে চেনে না বা দেখেনি। আশে-পাশে খুঁজে মার্ডার উইপন বলা যেতে পারে এমন কিছু পাওয়া গেল না। প্রাথমিক বিবরণ মোটামুটি এই। তদন্ত সাপেক্ষ।…
মাঝে মাঝে মুখ তুলে ও পেন্সিল কামড়ে ভাবছিলেন আর লিখছিলেন সেনাপতি। এই যথেষ্ট আপাতত। এবার কয়েকজনের সাক্ষ্য লিখতে হবে। তাদের সই করাতে হবে। লিখলেন : গোপালকিশোরের বিবরণ। তারপর তাকে ডাকলেন… এই যে গোপাল, এবার বলো। কীভাবে লাশটা তোমার চোখে পড়ল?
গোপালকিশোরের বলা শেষ হলে সেনাপতি তার সই নিলেন। তারপর কর্নেলের কাছে গিয়ে সবিনয়ে জানালেন, আপনার স্টোরিটা স্যার…
কর্নেল বললেন, অবশ্যই।…
তখন ডাঃ পট্টনায়ক লাশের ডানহাতের আঙুলের ছাপ নিতে ব্যস্ত। পরে সতর্কভাবে চারপাশের ঘাস আর আগাছায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে ঘোরাঘুরি করলেন। না–কোনও রক্তচিহ্ন নেই, কোনও পায়ের ছাপও নেই। সূত্র বলা যায়, এমন কোনও জিনিসও চোখে পড়ল না তার। কোনও সিগারেটের টুকরো বা পোড়া দেশলাই কিংবা কোনও রুমাল। অবশেষে অস্ফুট মন্তব্য করলেন, সাধারণ খুন! সম্ভবত রেপের পর মার্ডার–আগেই অনুমান করেছি।
সেনাপতি ফার্মের অন্যান্য লোকজনের প্রাথমিক সাক্ষ্য নিচ্ছেন। কর্নেল ডাক্তারের কাছে এসে বললেন, মিঃ পট্টনায়ক, দেখাশোনা শেষ হলো?
যথেষ্ট। বলে পট্টনায়ক হাঁফ ফেলার ভঙ্গিতে কাঁধে ঝোলানো জিনিসপত্রসুদ্ধ একটি আড়মোড়া দিলেন।
কতক্ষণ আগে মারা গেছে, মনে হলো আপনার?
পট্টনায়ক হাসলেন।…দ্যাটস এ ডিফিকাল্ট কোয়েশ্চেন কর্নেল। ঠিকমতো মড়া না ঘেঁটে..।
আপনার অনুমানের ক্ষমতা অসাধারণ বলেই জানতুম।..কর্নেল সপ্রশংস স্বরে বললেন।…রাইগর মরটিস শুরু হয়েছে নিশ্চয়?
আমার অনুমানের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব–অন্তত দশ থেকে এগারো ঘন্টা আগে মেয়েটি মারা গেছে। আপাতদৃষ্টে ইনস্ট্যান্ট ডেথ–আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছে বলতে পারি। অবশ্য, দেয়ার আর আদার ফ্যাক্টরস।
তাহলে আপনার অনুমান অনুসারে রাত নটা থেকে দশটার মাঝামাঝি খুনের, সময়টা দাঁড়ায়। কী বলেন?
সঠিক সময় বলা কঠিন। তবে ওই সময়ের মাঝামাঝি অথবা কিছু পরেও হতে পারে।
বৃষ্টি শুরু হয় বিকেল সাড়ে ছটায়। থামে–আমার হিসেব মতে, রাত দুটোর কাছাকাছি। আমি একটা বই পড়ছিলুম। বৃষ্টি ছাড়ার পর ঘুমিয়ে পড়ি। তাহলে লাশের অবস্থা দেখে আপনার কি মনে হয় যে রাত নটা-দশটা বা তারপর থেকে বাকি বৃষ্টিটা লাশের ওপর পড়েছে?
বাধা দিয়ে ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, দ্যাট ডিপেণ্ডস। প্রথমত, যা বুঝলুম– খুনটা এখানে করা হয়নি। অন্য কোথাও খুন করার পর লাশটা এখানে এনে ফেলা হয়েছে। কারণ ঘাসে বা জমিতে কোথাও ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। লাশের নিচে নরম মাটি চাপে বসে গেছে কিছুটা। তার মানে-ভারি কিছু পড়লে যা হয়। অর্থাৎ লাসটা বয়ে এনে ফেলেছে খুনী। কখন ফেলেছে প্রশ্ন হলে অবশ্য চোখ বুজে বলতে পারব যে আপনার কথামতো রাতে বৃষ্টি থামবার আগেই সেটা ঘটেছে। লাশের ওপর বৃষ্টি পড়ার লক্ষণ খুব স্পষ্ট।
কর্নেল বললেন, তা যদি হয়-তাহলে লাশ বয়ে আনার পথে রক্ত ধুয়ে পড়বেই। কোথাও-না-কোথাও দু-একফোঁটাও আমরা দেখতে পাব। কারণ বৃষ্টির জল গড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্ন এ মাটিতে ওঠে না।
ঠিক বলেছেন। ডাঃ পট্টনায়ক লাফিয়ে উঠলেন।…চলুন, আরও ভালভাবে দেখতে দেখতে কিছু দূরের মাটি পরীক্ষা করা যাক।
করেছি। কিন্তু চারদিকে ফার্মের এলাকায় অন্তত কোথাও তেমন রক্তচিহ্ন আমি দেখিনি।
সে কী! তাহলে লাশটা শূন্য থেকে এখানে গজালো নাকি? অদ্ভুত তো!
রিপিট করি। এখানেই খুন হলে ধস্তাধস্তির চিহ্ন থাকতই-দৌড়ানোর চিহ্ন থাকত?
নিশ্চয়ই।
বৃষ্টির মধ্যেই কোথাও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে?
অবশ্য, অবশ্য।
বৃষ্টির মধ্যেই লাশটা এনে ফেলা হয়েছে?
দ্যাটস রাইট।
কিন্তু কোথাও বৃষ্টি-ধোওয়া রক্তের চিহ্ন নেই মাটিতে। কোনও পায়ের দাগ নেই।
ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, যদি লাশটাকে ছাতার আড়ালে বয়ে আনা হয়– তাহলে…
কর্নেল হেসে বললেন, সম্ভব। তাহলে বলতে হয়, ছাতা ধরে একা লাশ বয়ে আনার মতো হারকিউলিসই এর হত্যাকারী!
কেন? একাধিক লোক থাকতে পারে বয়ে আনার সময়।
কিন্তু তাদের পায়ের চিহ্ন কোথায় গেল?
মাটিতে বেশি বালি থাকায় ধুয়ে গেছে।
লাশটা ভারি স্বাস্থ্যবতী মোটাসোটা মেয়ের লাশ। নরম বালিমেশানো মাটিতে পা বসে যাবেই।
ব্যাপারটা তাই বটে। ডাঃ পট্টনায়কের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।
কর্নেল একটু কেশে বললেন, আশা করি, ডাঃ পট্টনায়ক জমিতে মানুষের পায়ের দাগ না দেখলেও বিজন্তুর পায়ের দাগ লক্ষ করেছেন?
হ্যাঁ–তা করেছি। ক্ষেতে গরু চরার চিহ্ন স্পষ্ট। ঘাস পরীক্ষা করেও সেটা বোঝা গেছে।
খুরের দাগগুলো এখানে আসার পর আমি দেখতে পাই। গোপাল বলেছে, প্রায়ই বেড়া গলিয়ে বাইরের গরু ঢুকে পড়ে। কাজেই, বৃষ্টির মধ্যে কোনও গরু অবশ্য মোষও হতে পারে, এই ক্ষেতে ঢুকেছিল। লাশের কাছেও ওই রকম চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু আমরা কেউ তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছিনে কারণ, ক্ষেতে বা মাটিতে ওটা খুবই স্বাভাবিক চিহ্ন। ডাঃ পট্টনায়ক, একবার ফের লাশটার কাছে যাই, চলুন।
একটু পরিহাসের ভঙ্গিতে ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, গরু-মোষ ইত্যাদি শৃঙ্গধারী জীবের পক্ষে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড অবশ্য অসম্ভব নয়। তাড়া করার সময় পিঠে শিঙ বিঁধিয়ে মাটিতে আছাড় দিলেও দিতে পারে।
কর্নেল পরিহাসে সাড়া দিলেন না। বললেন, বিয়্যালি। অন্তত একটি কেসের বেলায় তাই সাব্যস্ত করা হয়েছিল মনে পড়ছে। বর্ধমানে এক ডেয়ারিতে পর-পর দুজন মারা পড়ে–দুজনেই একই রাতে। একটা নতুন ভাল জাতের ষাঁড় কেনা হয়েছিল সদ্য। ষাঁড়ের শিঙে রক্তের দাগ ছিল। ভারি অদ্ভুত কেস বলব।
পট্টনায়ক উৎসাহী হয়ে বললেন, অদ্ভুত কেন? যাঁড়ের গুঁতোয় বিস্তর মানুষ মরতে দেখেছি।
বলছি। আগে ব্যাপারটা ভাবুন। মাঠের মধ্যে নির্জন একটা ডেয়ারি। অবশ্য পাসেই একটা হাইওয়ে রয়েছে। ষাঁড়টা একটা বেড়াদেওয়া ফাঁকা জায়গায় বাঁধা ছিল। তার পাশেই নাগালের মধ্যে ছিল একটা খড়ের গাদা। সে দড়ি ছিঁড়ে প্রথম নম্বর শিকারের ওপর চড়াও হয়। খড়ের গাদায় ঠেসে ধরে। লোকটার হার্টে শিঙ ঢুকে যায়। দ্বিতীয় নম্বরের বেলাতেও একই পরিণতি ঘটে। মর্গের রিপোর্টে বলা হয়, তিন ইঞ্চি মোটা কোনও সূচলো কিছুর আঘাতে মৃত্যু ঘটেছে। মার্ডার উইপন হিসেবে ষাঁড়ের রক্তমাথা শিঙটাকে সাব্যস্ত করা হয়। দ্বিতীয় মত্যুর কারণও একই। যাঁড়ের ডান শিঙে রক্ত ছিল। এমন সময় দৈবাৎ ওখানেই আমার গাড়ি বিগড়ে আটকা পড়লুম। তারপর, বুঝতেই পারছেন, চেঁকির পক্ষে ধানভাবনা ছাড়া রেহাই নেই। আমার প্রশ্ন অফিসারদের চমকে দিল। ষাঁড় দুবার দুজন মানুষকে মারবার জন্য আলাদা-আলাদা শিঙ ব্যবহার করে কি না।
ডাঃ পট্টনায়ক হাসতে হাসতে বললেন, ওয়াণ্ডারফুল!
খড়ের গাদার তলা থেকে সত্যিকার মাৰ্ডর উইপন বেরোল। একটা লোহার গোঁজ সেটা। দুষ্ট প্রকৃতির গরু-মোষ বাঁধা হয় তা দিয়ে।
তারপর?
কর্নেল জবাব না দিয়ে জমিতে গিয়ে নামলেন। পট্টনায়ক তার পিছোনে এগোলেন। তারপর হাতের সেই অদ্ভুত কাঁচটা মাটির কাছাকাছি ধরে জানোয়ারের পায়ের দাগগুলো পরীক্ষা করতে থাকলেন। কর্নেল বললেন, অনেকক্ষণ থেকে আপনার হাতে ওই জিনিসটা লক্ষ করছি। নতুন কোনও ফোরেনসিক যন্ত্র বেরিয়েছে বুঝি?
ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, আমারই উদ্ভাবনী ক্ষমতার নমুনা এটা। আতশ কাঁচই বলতে পারেন। তবে এর আণুবীক্ষণিক বৈশিষ্ট্য অসাধারণ। নিজে তৈরি করে নিয়েছি।
কর্নেল হাত বাড়িয়ে বললেন, একবার দেখি আপনার যন্ত্রটা।
যন্ত্র বলতে যা বোঝায়, এটা তা নয়। জাস্ট এ মালটিরিফ্লেকটর গ্ল্যাস। বলে পট্টনায়ক হাতলওয়ালা জিনিসটা কর্নেলকে দিলেন।
কর্নেল লাশের পিঠের দিকে একটু তফাতে প্রথমে ঘাসের পাতা, তারপর একহাতে ঘাস সরিয়ে ক্ষেতের তলা উদোম করলেন। দেখতে দেখতে বললেন, বেলে ধরনের মাটির একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। দেখে যান মিঃ পট্টনায়ক! এইসব মাটিতে অজস্র লালচে ছিটে দেখতে পাওয়া যায়। আপনার রিফ্লেকটরে ছিটেগুলো এক সেন্টিমিটার চওড়া দেখাচ্ছে। লক্ষ্য করছেন?
পট্টনায়ক দেখে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ–অনেক আগেই লক্ষ্য করেছি। গুচ্ছ গুচ্ছ লাল দানা রাখা বেলেমাটির স্বভাব। ওই দেখুন, কোথাও কত বেশি চওড়া দেখা যাচ্ছে দানাগুলো। জাস্ট অ্যান ইচ্ছ।
কর্নেল লাল মোটা গুচ্ছটার ওপর রিফ্লেকটর স্থির রেখে বললেন, শুধু বেলে বা দোঁয়াশ মাটিতে এমন থাকে না, এঁটেল মাটিতেও বিস্তর লাল ছিটে দেখা যায়। একবার এক গ্রামের বিলের ধারে নাবাল জমিতে লাশ পোঁতা ছিল একটা। বিজ্ঞ অফিসারটির কোনও তুলনা হয় না–তিনি কাছাকাছি জায়গার মাটি থেকে…বাই জোভ! বলে হঠাৎ মুখ তুলে একটু হাসলেন।…ডাঃ পট্টনায়ক, আমরাও অনায়াসে সেই আদিম ও শ্রমসাপেক্ষ পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারি।
পট্টনায়ক কপালের ঘাম মুছে বললেন, তাহলে তো পুরো ন একর জমি ( খুঁটে-খুঁটে লাল দানাগুলো তুলে নিতে হয়। দ্যাটস এ বিগ জব–খাটুনি ভীমস্য!
কর্নেল বললেন, আপাতত একটা ইঁদুরের খাটুনি খাটা যেতে পারে। আপনার কাছে প্ল্যাস্টিক পেপার আছে?
অবশ্যই।
তাহলে এই সবচেয়ে মোটা দানাগুলো–অন্তত ট্রাকটারের চাকা অব্দি জায়গায় যতগুলো সম্ভব তুলে নিই।
তারপর?
তারপর আপনি আপনার টেবিলের সামনে গিয়ে বসবেন। রাসায়নিক বিশ্লেষণ করবেন।
নিশ্চয়–তাতে আমি পিছপা নই।
ছুরি পেলে ভাল হতো একটা।
নিন–সবই আছে। বলে কিটব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করলেন ডাক্তার। এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন কর্নেল রিফ্লেকটারটা একখানে ধরে কী দেখছেন।…কী? সত্যিকার রক্ত নাকি?
না–একটা গর্ত।
খুরের দাগ ছাড়া আর কী হবে?
এটা আরও গভীর মনে হচ্ছে, মিঃ পট্টনায়ক। বলে কর্নেল লাশটার পিঠের দিকে রিফ্লেকটারটা নিয়ে গেলেন। তারপর একেবারে পা বরাবর থামলেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল হঠাৎ। চোখে বিস্ময় ফুটল।–কী কাণ্ড! এদিকেও একই সাইজের একটা গর্ত। একটা মাত্র খুর দেবে বসবে–এবং দু জায়গায়? বলে তিনি আগের গর্তটা থেকে ছুরি দিয়ে দ্বিতীয় গর্ত অব্দি একটা সরলরেখা টানলেন।
ডাঃ পট্টনায়ক অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলেন। বললেন, কী হলো?
এই সরলরেখাটা লাশের সমান্তরাল?
তাতে কী প্রমাণ হয়?
কিছু প্রমাণ হওয়া নির্ভর করছে আপনার বিশেষজ্ঞ কার্যকলাপের ওপর। ডাঃ পট্টনায়ক, এই গর্ত দুটোর ছাপ নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আর নিন দু একটা সাধারণ খুরের যে ছাপগুলো দেখছি, তার থেকে। আমি ততক্ষণ লাল দাগগুলো তুলে ফেলি।
কর্নেল তাই করতে ব্যস্ত হলেন। পট্টনায়ক ক্যামেরার লেন্স খুলে আরেকটা অদ্ভুত গড়নের লেন্স পরালেন। তারপর গর্ত দুটর ছবি তুললেন।
কয়েক মিনিট পরে দুজনে উঠে গেলেন সেনাপতির কাছে। সেনাপতি তখনও জাবেদা খাতায় কী সব টুকছেন। কর্নেল বললেন, জিগ্যেসপত্তর শেষ হলো মিঃ সেনাপতি?
হ্যাঁ স্যার।
তেমন কোনও বিশেষ ইয়ে পেলেন-টেলেন নাকি?
মালী হাসিরাম বলছিল, রাতে বৃষ্টির মধ্যে ওই বাংলোতে আলো দেখেছে, তারপর….
হ্যাঁ। আমাকেও বলেছে।
এখানে ওই বাংলো-ভূতের গল্প বেশ চালু আছে। বলে সেনাপতি হেসে উঠলেন।
আর কেউ ভূত দেখেছে বলেনি?
ভোমরলাল বলছিল, বৃষ্টির সময় ধুপ ধুপ শব্দ শুনেছে! বোঝা যায়–এ উদ্ভট ব্যাপার। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া দিচ্ছিল রাত্রে। তাছাড়া লোকটা প্রচণ্ড গাঁজা টানে।
আর কিছু?
বুধন সিং বলল যে রাতে তার ঘুম হয়নি, টাট্টি পেয়েছিল। তখন অন্ধকারে কাছাকাছি কোথাও মড়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সে হরিধ্বনি শুনেছে।
অত রাত্রে বৃষ্টির মধ্যে?
সেটাই পিকিউলিয়ার। তবে ও স্বীকার করেছে, তার কানের ভুল হতে পারে।
এবার কী করবেন মিঃ সেনাপতি?
সেনাপতি উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, রুটিন ওয়ার্কস ছাড়া আপাতত কী করা যাবে বুঝতে পারছিনে। মড়াটা তুলে মোহনপুর মর্গে পাঠাতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স আনবার জন্য ট্রাঙ্ককল করতে পাঠিয়েছি অজিতকে। তার আগে লাশটা সনাক্ত করতে হবে। সেটাই জরুরী এখন। লোকালিটিতে খবর পাঠানো হয়েছে। সব হোটেলেও খবর গেছে। তেওয়ারীকে দায়িত্ব দিয়েছি। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তবে সবচেয়ে মুসকিল কী জানেন? পানিগ্রাহী সায়েবের ফার্মে লাশটা ফেলে খুনী আমাদের খাটুনি বাড়িয়েছে। তিনি পলিটিসিয়ান ভীষণ প্রভাবশালী লোক। এ খুনের হেস্তনেস্ত না করলে বিধানসভা থেকে লোকসভাঅব্দি হইচই লাগিয়ে দেবেন।
ডাক্তার পট্টনায়ক একটু হেসে বললেন, ঠিকই। বিশেষ করে ভদ্রলোকের মহিলাদের প্রতি আগ্রহ প্রচুর। তরুণী ও সুন্দরী হলে তো কথাই নেই। এই হচ্ছে ওঁর চরম ভাইটাল পয়েন্ট।
সেনাপতি বললেন, দুর্বল পয়েন্ট বলুন, স্যার।
রোদ বেড়েছে ইতিমধ্যে। আকাশের আজ সাজগোজ করার ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না। কৌপিনপরা সন্ন্যাসীর মতো ছাইমাখা গায়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। ইউক্যালিপটাস গাছের পাতাগুলো বাতাসের টানে মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে চমকে ওঠা গরুর পালের মতো কান খাড়া করছে আর নামাচ্ছে। একজন-দুজন করে। লোক আসতে দেখা যাচ্ছিল। ভিড়ের অবস্থা কী হবে আঁচ করা যায়। ছোট্ট টাউনশিপ ইতিমধ্যে ছটফট করতে শুরু করেছে।
লোকজনের আসা লক্ষ করে ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো সেনাপতি, লাশ এক্ষুণি সনাক্ত হয়ে যাবে। হোটেলের লোকগুলো আসবার অপেক্ষা শুধু।
সেনাপতি সাহস পেয়ে বললেন, তাই আশা করছি। সনাক্ত হলেই খুনের মোটিভ বের করতে আমার দেরি হবে না। আর মোটিভ বেরোলেই খুনীর পাত্তা পাব।
কর্নেল সকৌতুকে বললেন, রাইট! রোগ কী জানতে পারলেই আরোগ্যের বাড়া সেটা। কী বলেন মিঃ পট্টনায়ক? আপনারা ডাক্তাররা তো তাই বলেন? ডায়গোনেসিস ইজ বেটার দ্যান কিওর কী না?
ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, অবশ্যই। কর্নেল, এবার কিন্তু আমি কেটে পড়তে চাই। ভিড় দেখলে আমার হাঁফ ধরে যায়। চলুন, এগোই।
কর্নেল বললেন, আমারও। ইয়ে–মিঃ সেনাপতি, আমরা যদি এখন ফার্মের কাউকে নিয়ে ওই বাংলোটা দেখতে যাই, আপনার কোনও আপত্তি আছে– মানে, আইদার অফিসিয়াল অর পারসোনাল?
নেভার। যান না স্যার, দেখে আসুন। বরং আপনাদের মতো দুজন জায়ান্ট হ্যাঁণ্ড পাশে পেয়ে আমি কী বোধ করছি, বোঝাতে পারব না। এই ভোমরলাল! ইধার আও। সায়েবদের বাংলো দেখিয়ে আনে। চাবি কোথায়?
— ভোমরলাল জানাল, চাবি হাসিরামের কাছে। তখন হাসিরামকে হুকুম করা হলো। হাসিরাম কর্নেল ও ডাক্তারের আগে আগে ধুকুর ধুকুর দৌড়ল।
বাঁদিকে গোলাপক্ষেত। একটু বিবর্ণ দেখাচ্ছে। পোকা লেগেছে সম্ভবত। কর্নেল বললেন, দিল্লীর কুতুবমিনারের পাশে যে গ্রামটা আছে–মেহেরৌলি। একবার এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে সেই গ্রামের মাঠে-মাঠে এলোমেলো ঘুরেছিলুম। ওখানেই শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কিছু জমি আছে। তাই নিয়ে সেবার খুব বিতর্ক উঠেছিল। যাই হোক, সেই বিতর্কিত জমি দেখবার আগ্রহ আমার ছিল না। আমি অজস্র গোলাপক্ষেত দেখে আনন্দ কুড়োচ্ছিলুম। এক জায়গায় গোলাপক্ষেতে ময়ূর হেঁটে গেল। ভাবতে পারেন, সে কী হৃদয়গ্রাহী ঘটনা!
ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, কর্নেল! ভাববেন না–এখানেও ময়ূর বাস করে। ওই সরকারী অরণ্যে।
হঠাৎ কর্নেল হাস্যকর ভঙ্গিতে দৌড়ে হাসিরামের কাধ ধরে ফেললেন। ডাক্তার অবাক। হাসিরাম ঘাবড়ে গিয়ে শ্লেটে বাচ্চাদের আঁকা মূর্তির মতো সর্বাঙ্গে করুণ হয়ে পড়েছে। পট্টনায়ক দৌড়ে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বললেন, কী ব্যাপার?
কর্নেল হাসছিলেন।…কিছু না। হাসিরাম এবার আমাদের পিছনে থাকবে। কারণ কোনও বিশেষ চিহ্ন তার পায়ের তলায় ধ্বংস হোক, এটা বাঞ্ছনীয় নয়। এর পায়ের পাতা হাঁসের মতো চওড়া–লক্ষ করছেন? হাসিরাম, তুমি খুশি হবে কি না জানিনে, তুমি নির্ঘাৎ এই সমুদ্রে ছিলে পূর্বজন্মে।
হাসিরাম আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ছিলুম বই কি স্যার। সেজন্যেই তো ভয়ে ঘুমোতে পারিনে। যেই তন্দ্রামতো আসে, মনে হয় সমুদ্রের তলায় চলে গেছি–দম বন্ধ হয়ে যায় স্যার।
কর্নেল ওর হাত থেকে চাবির গোছাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, পেছন পেছন এস।
সে ঠিক তাই করতে লাগল। পথটা একটা গেট পেরিয়ে আরেকটা পথে এসে মিশেছে, গেট খুলে বেরতে হলো। টিলার ঢালু গায়ে তেমাথা সৃষ্টি হয়েছে একটা। একটু চড়াই ভাঙতে হলো। পিচ-চটা রাস্তাটা সংকীর্ণ। একটু পরেই রাস্তার পিচ হঠাৎ শেষ হলো। কাঁচা রাস্তা–দুধারে ইউক্যালিপটাস গাছ আর ঝোপঝাড়। বাঁদিকে ঘুরে আন্দাজ বিশ মিটার দূরে বাংলোর গেটে শেষ হয়েছে। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, ডানহাতি রাস্তাটা কোত্থেকে এসেছে হাসিরাম?
হাসিরাম জবাব দিল, ওটা ফার্মের বাইরের রাস্তা স্যার। সরকারী জায়গা। ফরেস্ট বাংলোর নিচে দিয়ে চলে গেছে। একেবারে জঙ্গলে ঢুকেছে–তারপর চন্দনপুর বালেশ্বর রোডে মিশেছে।
কর্নেল কাঁচা রাস্তাটা তীক্ষ্ণদৃষ্টে লক্ষ্য করে বললেন, হুম! ডাঃ পট্টনায়ক!
বলুন কর্নেল।
এই টিলাটাও বেলে মাটিতে ভরতি। আবার জায়গায় জায়গায় বালিও যথেষ্ট দেখছি–ঘাস গজাতে পারেনি। কিন্তু..কী কাণ্ড!
কী, কী?
মোটর গাড়ির চাকার দাগ।
তাই তো বটে!
দুজনে হেঁটমুণ্ডে গেট অব্দি ঘুরে-ঘুরে দাগগুলো পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন। হাসিরাম একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল।
কর্নেল বললেন, গাড়িটা গেট অব্দি এসে ফিরে গেছে বোঝা যাচ্ছে। হুম, এখানে ঘোরানো হয়েছে। তাহলে…তাহলে এটা হচ্ছে সামনের ডান চাকা। কী বলেন?
হ্যাঁ–তাই মনে হচ্ছে।
কিন্তু দেখুন, বা চাকার দাগ একরকম–ডান চাকার আরেকরকম?
অ্যাঁ? সে কী? ডাঃ পট্টনায়ক চমকে উঠলেন।
হ্যাঁ। আর সব দাগই একরকম। একটা করে সোজা রেখা, আর দুদিকে টানা দুসার ত্রিকোণ, মধ্যের ত্রিকোণটা বড়। কিন্তু সামনের ডান চাকার মধ্যের নকশাটা চারকোণা, টানা রেখার বদলে ফুটকি রয়েছে। আর খাজগুলো বেশ চওড়া। হুম! ডাক্তার পট্টনায়ক! এই চাকাটা নতুন কেনা হয়েছে বাকি তিনটে পুরনো। আপনি কি ছবি নেবেন অনুগ্রহ করে?
পট্টনায়ক ক্যামেরা নিয়ে বললেন, নিচ্ছি। কিন্তু কেসের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন কি? মিছেমিছি ছবি নেওয়ার চেয়ে সিওর হওয়া ভাল– তাই না?
সেই সময় হাসিরাম বলল, ফরেস্টে বেড়াতে অনেকে গাড়ি নিয়েই আসে স্যার। পাহাড়ের এদিকটা বেশ ঢালু কি না–আর রাস্তাও রয়েছে।
পট্টনায়ক বললেন, ঠিক তাই। সেজন্যেই এ অব্দি এসে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেছে কেউ। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে অত রাত্রে গাড়ি কে আনল?
কর্নেল বললেন, ছেড়ে দিন। টায়ারের নকশা আমার মনে থাকবে। ছবি নেবার দরকার নেই।
ক্লান্ত পট্টনায়ক একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।…হ্যাঁ, ফিল্মও ফুরিয়ে গেছে দেখছি।
গেট খুলে ছোট্ট ফুলবাগিচা পেরিয়ে বারান্দায় উঠলেন ওঁরা। তারপর কর্নেল তালাটা পরীক্ষা করে খুললেন। একটা জানালার খড়খড়ি ভোলা রয়েছে দেখা গেল। কর্নেল বললেন, খড়খড়ি কি বরাবর তোলা ছিল হাসিরাম?
হ্যাঁ স্যার। সায়েবের আজকালের মধ্যেই আসার কথা। তাই সাফ করে গেছি কাল বিকেলে। ঘরে দেখছেন ভেন্দিলেটার নেই। তাই সায়েবের হুকুম আছে…
মি? পট্টনায়ক, একরকম গন্ধ পাচ্ছেন কি?
পাচ্ছি।
কিসের বলুন তো?
কসমেটিকসের মনে হচ্ছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক মিঃ পানিগ্রাহীর বাংলোয়? বলে একটু হাসলেন পট্টনায়ক।
জানালাগুলো খুলে দাও তো হাসিরাম।
হাসিরাম জানালাগুলো সব খুলে দিলে ঘরটা আলোয় ভরে গেল। এককোণে একটা চমৎকার সোফাসেট রয়েছে। দেয়ালে-দেয়ালে সুন্দর পেন্টিংস টাঙানো রয়েছে। একটা শোকেস ভরতি সুদৃশ্য দেশী-বিদেশী পুতুল। বুকশেলফে কিছু বই ও ম্যাগাজিন। কোণের সোফাসেটের দিকে এগোতে গিয়ে কর্নেল হাঁটু দুমড়ে বসলেন হঠাৎ….ডাঃ পট্টনায়ক, এ-ঘরে গতরাত্রে লোক ছিল! বলে তিনি আঙুল দিয়ে একটা কী দেখালেন।
পট্টনায়ক সেটা দেখতে পেয়ে বললেন, সিগারেটের টুকরো?
কর্নেল বললেন, তিনটে পোড়া সিগারেটের টুকরো। মিঃ পট্টনায়ক। আমি একটা পোড়া দেশলাই কাঠি পেয়েছি। আসুন, ভাল করে খুঁজি। তিনটে সিগারেট যখনতখন আরও দেশলাই কাঠি পাবার আশা আছে। ইয়ে-হাসিরাম, তোমার সায়েব সিগারেট খান না নিশ্চয়?
না স্যার।
তাই অ্যাশট্রে দেখছিনে কোথাও?
পট্টনায়ক বললেন, কী মুসকিল! তা বলে অতিথিদের জন্য অ্যাশট্রে রাখবেন না-কি?
কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, এ বাংলোয় কোনও অতিথিকে আপ্যায়িত করেন মিঃ পানিগ্রাহী-তাই না হাসিরাম? অবশ্য তার প্রেমিকারা সিগারেট খান কি না জানিনে।
হাসিরাম সায় দিয়ে বলল, এ তার প্রাইভেট বাংলো স্যার। আমি ছাড়া এখানে কারো আসার হুকুম নেই। কেউ দেখা করতে এলে ওধারে ফার্মের গেটের কাছে আপিসে গিয়ে দেখা করেন।
পট্টনায়ক দেশলাই কাঠি খুঁজছিলেন। পেলেন না। বললেন, আশ্চর্য তো! আর কোথাও একটা কাঠির টুকরো নেই!
কর্নেল কাঠির টুকরো ও সিগারেটের নিটে পাফ পকেটে রেখে সোফার দিকে আরও ঘনিষ্ঠ হলেন। বললেন, হাঁটুর নিচে সোফার গায়ে সিগারেট ঘষে নেভাবার চিহ্ন দেখছি। মিঃ পট্টনায়ক! আরেকটা সিগারেট পেলুম। এটা সবে ধরানো হয়েছিল কিন্তু ঘষটে নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনও কারণে?
পট্টনায়ক বললেন, সিগারেটটায় ও কিসের দাগ।
লিপস্টিকের।
মাই গড! স্ত্রীলোক সিগারেট খাচ্ছিল?
এ থেকে ঠোঁটের ছাপ নিতে উৎসাহী হবেন নিশ্চয়?..কর্নেল সকৌতুকে বললেন, ডাঃ পট্টনায়ক, কিছু ফ্যাক্টস এখানে তাহলে পাওয়া গেল। তার থেকে দাঁড়াচ্ছে : একটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রীলোক এখানে সিগারেট খাচ্ছিল এবং…
হাসিরাম বলে উঠল, স্যার এই দেখুন–মোমবাতি জ্বালিয়েছিল কেউ।
ডাঃ পট্টনায়ক, পুরুষটি চেইন-স্মোকার যাকে বলে। সে সিগারেটের আগুনে সিগারেট ধরাতে অভ্যস্ত। তাই আমরা একটামাত্র পোড়া দেশলাই কাঠি পেলুম। মহিলাটিকেও সে নিজের সিগারেট থেকে আগুন দেয়। মহিলাটি কয়েকটি টান দিতে সবে শুরু করেছে, তখন হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যে সে তক্ষুনি হাঁটুর কাছে বুঝতে পারছেন? টেবিল নয়–হাঁটুর কাছে ঘষে নিভিয়ে ফেলে। তার একটাই অর্থ হয়। তার সিগারেট লুকোতে চেয়েছিল। তার থেকেও অর্থ খোঁজা যেতে পারে– এমন কেউ অভাবিতভাবে এসে পড়েছিল, যার সামনে সে সিগারেট খায় না। আপনি কী বলেন?
পট্টনায়ক বললেন, ওয়াণ্ডারফুল! কিন্তু খুনের সঙ্গে এসবের কি কোনও যোগসূত্র থাকতে পারে?
হয়তো পারে–আবার নাও পারে। বলে কর্নেল অন্যমনস্কভাবে উঠে দাঁড়ালেন। আমরা কিছু জানি না–অন্ধকারে ঘুরছি। কিন্তু আমার ধারণা যদি কারেক্ট হয়–অর্থাৎ খুনের অতীত গোপনে এখনও কাজ করে চলেছে, তাহলে..মাই গুডনেস! একটা সিগারেট-কেস! বলে টেবিলের তলা থেকে রুপোলি রঙের একটা সিগারেট-কেস দু আঙুলের কোণায় ধরে তুললেন।…কে টু এস!