দুই

ট্রাকটারের তিন মিটার দূরে

এ অঞ্চলের মাটির জলশোষণ ক্ষমতা বেশি বলে যত বৃষ্টি হোক কাদা খুব কমই হয়। মাটিতে বালির ভাগ স্বভাবত বেশি। একসময় ফসল ফলানোর কথা ভাবাই যেত না। গত দশ বারো বছরে সরকারী যোজর কল্যাণে কোথাও-কোথাও চাষবাস লক্ষ করা যাচ্ছে। দুতিনটে আধুনিক ধাঁচের মেকানাইজড কৃষি-খামারও গড়ে উঠেছে। চন্দনপুর-অন-সীর বুকের কাছে পানিগ্রাহী এগ্রিকালচারাল ফার্ম। একটা টিলার নিচে ঊনিশ একর বেড়াঘেরা অসমতল জমি নিয়ে ফার্ম। ভুট্টা, বজরা আর মরশুমে অল্পস্বল্প বিদেশী ধান ফলে। তবে বেশিটাই গোলাপ ফুলের চাষ।  এইটাই মুখ্য।

পানিগ্রাহীরা একসময় বড় জমিদার ছিলেন। এখন বংশের একমাত্র পিদীম মদনমোহন সব জোতজমা খুইয়ে ওই ফার্মে এসে ঠেকেছেন। তবে ফার্মটা নিছক সৌখিনতা বলেই মনে হয়। ফুলের রানী গোলাপসুন্দরী। কাজেই লোকে পয়সা বা লাভালাভ দেখে না, দেখে সৌখিনতা। ফার্মের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে কিছুক্ষণের জন্য জীবনের কদর্যতা বলে কিছু আছে, তা মনে পড়ে না। তবে কেউ বিশ্বাস করে না যে ওই ফুল থেকে মদনমোহনের একেকটা ইলেকশানের সব খরচ ওঠে। হ্যাঁ, মদমমোহন পাণিগ্রাহী রাজনীতি করেন। হেরে ভুট হন, তবু ভোটে দাঁড়ান।

খামারে অবশ্য তিনি খুবই কম থাকেন। দিন পনের আগে মদনমোহন যথারীতি ফার্মে এসেছিলেন, চলেও যান এবং বলে যান, জনৈক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে সুইডেন যাবেন। ফিরবেন ঊনিশে জুলাই। ফার্মে যদি আসেন, তো বাইশ-চব্বিশ তারিখ। আজ তেইশে জুলাই। এখন ভোর পাঁচটা। গত রাতের তুমুল বৃষ্টির বিশেষ কোনও চিহ্ন কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু খানাখন্দে কোথাও কিছু ঘঘালাটে জল আর মসৃণ কাদা থকথক করছে। তবে সমুদ্রের গর্জন বেড়েছে। বাতাস বইছে খরতর– পুবের বাতাস। টিলা ও দুরের বালিয়াড়ির ঝাউবন একটানা শনশন শব্দ করছে। সমুদ্ৰশকুনের ডানার মতো ধূসর আলোয় ক্রমশ জেগে উঠছে ভাটার চরের মতো চন্দনপুর-অন-সী। গোপালকিশোর পানিগ্রাহী ফার্মের গেটের পাশে তার ছোট্ট ঘরে জেগে বসে হাই তুলছিল।

টিনের মাঝারি সাইজের গুদামের লাগোয়া তার ঘর। পাশে একটা চালাতে কিছু কৃষি-যন্ত্রপাতি রয়েছে। সে ট্রাকটার চালায়। হার্ভেস্টার কম্বাইন তার জিম্মায়। গত একটি দিন পাণিগ্রাহীসায়েবের আশায় সে কাটিয়েছে। গোলাপক্ষেতে কী দুয়ে মড়ক লেগেছে। কিছু করা যাচ্ছে না। কর্তা ছাড়া এ কর্ম হবার নয়। মিঃ পাণিগ্রাহী এসব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। সে উদ্বিগ্ন হয়ে তার পথ চেয়ে বসে রয়েছে।

গোপালকিশোর সিগারেট ধরাল। তারপর চটিটা পায়ে গলিয়ে বাইরে এল। আকাশ দেখল। সমুদ্রের দিকে দিগন্তে কিছু খয়েরি রঙের চাপ চাপ মেঘ রয়েছে। বাকি আকাশ পরিষ্কার। সামনে ক্ষেতের দিকে তাকাল সে। যে নএকর সমতল জমিটার চারদিকে আল রয়েছে, সেখানে ধানের চাষ হয়। ইতিমধ্যে দুবার হাল্কা ডিস্ক হ্যাঁরো বা তিন নম্বর লাঙলে চাষ পড়েছে। কিন্তু গত রাতের বৃষ্টিতে একটুও জল দাঁড়ায়নি। অজস্র ঘাস আর আগাছায় জঙ্গল হয়ে উঠেছে। বর্ষার রস পেয়ে উদ্ভিদজগত এখন বেপরোয়া। গোপালকিশোর একটু ভাবনায় পড়ল। কর্তা আসবার আগেই ওই আগাছা চাবড়াসুদ্ধ উল্টে ফেলা উচিত। পরের বৃষ্টিতে সেগুলো পচে স্বাভাবিক সারের কাজ করবে এবং জলও দাঁড়াবে।

খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল সে। ঘড়ি দেখল। এখন সওয়া পাঁচটা। মিঃ পাণিগ্রাহী আসবেনই কথামতো। কিন্তু তিনি ঘুম থেকে দেরিতে ওঠেন বরাবর। ভুবনেশ্বর থেকে রওনা দিলে সে বেলা নটার আগে নয়। অতএব গোপালকিশোর দৌড়ে গিয়ে চালাটায় ঢুকল। গেটের তালা খুলে কাঠের ফ্রেমটা সরাল। ট্রাকটারের পিছনে দুনম্বর হ্যাঁরো জুড়ল। তারপর স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে এল। সেই নিঃঝুম ধূসর, ভোরকে ট্রা-রা রা রা আওয়াজে উচ্চকিত করে তুলল সে।

উঁচু জায়গা থেকে নিচের ক্ষেতে ট্রাকটারটা পৌঁছলে গোপালকিশোর হাতলে চাপ দিয়ে পিছনের হ্যাঁরোর সার নামিয়ে দিল। চ্যাপ্টা এক সার দাঁত নরম বেলেমাটিতে বসে গেল। ঘাসগুলো কোথাও প্রায় এক ফুট থেকে দেড় ফুট উঁচু হয়ে উঠেছে। কোথাও ধনচে গাছ (ভালো সার হয়) ঝোপের মতো জাঁকিয়ে উঠেছে। গোপালকিশোর দেখল, একটা সাপ পড়ি কী-মরি করে পালাচ্ছে। তার একটা বদ্ধমূল সংস্কার আছে ছেলেবেলা থেকে। সাতসকালে প্রাতঃকৃত্যের আগে সাপ দেখে ফেললে প্রচণ্ড অমঙ্গল হয়।

মুহূর্তের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে স্টিয়ারিং ছেড়ে প্রণাম করল সে। সামনে ধনচে ঝাড়ের মধ্যে সাপটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর সাপটাকে খুঁজে বের করবার উদ্দেশ্যেই সে তাকাল আরও সামনের দিকে। সেই সময় তার চোখে পড়ল, জমির শেষপ্রান্তে আলের কাছে কী একটা বড়সড় পড়ে রয়েছে। প্রথমে ভাবল কাঠের গুঁড়ি, পরে মনে হলো রঙিন কিছু একটা কাপড়চোপড়ের মতো, এবং খানিকটা কালো। ঘাস ও আগাছার মধ্যে ডুবে থাকায় ত্রিশ-বত্রিশ মিটার দূর থেকে ঠিক বোঝা কঠিন। নাকি কোনও শেয়াল? উঁহু-শেয়াল অতটা জায়গা জুড়ে থাকতে পারে না। তাছাড়া শেয়াল হলে এতক্ষণ লেজ গুটিয়ে পালাত। তাহলে কি কারও গরু রাতে বেড়া গলিয়ে এসে পড়েছিল–উঁচু আল থেকে পড়ে ঠ্যাঙ ভেঙেছে?

দেখতে দেখতে ট্রাকটারটা আরও দশ মিটার এগিয়ে গেল। তখনও জিনিসটা কী বুঝতে পারছে না গোপালকিশোর। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। আরও পাঁচ মিটার..আরও দুই…আরও দুই…ফের দুই…একেবারে জিনিসটার সামনে সজোরে ব্রেক কষল সে। তার মুখ সাদা হয়ে গেল। কয়েকমুহূর্ত পাথরের মূর্তির মতো স্টিয়ারিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল গোপালকিশোর।

তারপর সংবিত ফিরে পেল। চকিত চোখে চারদিক দেখে নিল। কেউ কোথাও নেই।

সে লাফ দিয়ে নামল ট্রাকটার থেকে।

তার উল্টোদিকে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে একটি মেয়ে। ববছাট চুলগুলো ঘাস ও কাদায় মাখামাখি, হলুদ ঢিলে পাঞ্জাবির ওপর কালচে জংলা নকশা আর চাপ চাপ রক্ত। পরনে ক্রিমরঙা আঁটো স্ন্যাকস। এক পায়ে দুফিতের স্লিপার রয়েছে, অন্য পা খালি–স্লিপারটা ছিটকে একপাশে পড়ে রয়েছে। ঠিক ঘুমোবার ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে মেয়েটি।

যাই হোক, পিঠে রক্ত ও ক্ষতচিহ্ন দিয়ে জংলা ক্ষেতে কোনও মেয়ের ঘুমোতে আসা খুব সহজ ব্যাপার নয়। গোপালকিশোরের শরীর থরথর করে কাঁপছিল। মেয়েটির মুখ ঘাসের মধ্যে কাত হয়ে ডুবে রয়েছে। বৃষ্টিতে ভেজার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে আপাতদৃষ্টে। গোপালকিশোর বিভ্রান্ত হয়ে দৌড়তে থাকল হঠাৎ।

সেই ভোরে চন্দনপুর-অনসীর নির্জন রাস্তায় বোবায় ধরা মানুষের মতো গো গোঁ করে তাকে দৌড়তে দেখলে পাগল বলেই মনে হতো। অবশ্য এখানে পাগল কদাচিৎ দেখা যায়।

গোপালকিশোর ড্রাইভার মানুষ। কিন্তু জীবনে একবারও অ্যাকসিডেন্ট না করার রেকর্ড তার আছে। কোনও খুনখারাবিও তার বেয়াল্লিশ বছরের জীবনে চাক্ষুষ করেনি। সরল, অমায়িক, সাবধানী আর হিসেবী বলে তার সুনাম আছে। আজ সকালে এই প্রথম তারই ট্রাকটারের তিন মিটার দূরে একটি রক্তাক্ত লাশ সে আচমকা আবিষ্কার করেছে এবং তার জন্যে সেই বদমাশ সাপটাই নির্ঘাৎ দায়ী।

সে উদভ্রান্তভাবে বিড়বিড় করছিল, আমি চাপা দিইনি! আমার কোনও দোষ নেই, স্যার!

কোথায় যাচ্ছিল, তার খেয়াল নেই। পীচঢালা সরু পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরে সে দৌড়চ্ছিল। বিড়বিড় করছিল, আমি চাপা দিইনি…আমি চাপা দিইনি…