এগার
স্বীকারোক্তি
সমুদ্রতীরে আবার একটা বিকেল নেমেছে আজ। কিন্তু এ বিকেল বৃষ্টিধূসর। বিচ নির্জন। আকাশভরা ঘন মেঘ। মেঘ আর সমুদ্র সমানে গর্জন করছে।
থানার বড় ঘরটিতে বসে সুমন্ত তার জবানবন্দি দিচ্ছিল। কফেশন বা স্বীকারোক্তি বলাই ভাল। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তার এক পাশে। অন্যপাশে ডাঃ পট্টনায়ক।
…পানিগ্রাহীদার ভাড়াটে মেয়ে মিস শান্তার ঘর থেকে গতকাল দুপুরে আমি ড্রাগের প্যাকেটটা হাতাই। তারপর..
কর্নেল বললেন, কিন্তু কীভাবে?
সুমন্ত চোখ তুলে নামাল। আস্তে বলল, তাহলে গোড়া থেকে ভ্যানর-ভ্যানর করতে হয়।
এটা ইমপরট্যান্ট, সুমন্ত। অবশ্য বলা না বলা তোমার খুশি। আমরা আইনত তোমাকে চাপ দিতে পারিনে, ইউ নো দ্যাট।
পানিগ্রাহীদার প্ল্যান ছিল, ২২ জুলাই রাতে কোনও একসময় প্যাকেটটা মিস শান্তা ভারতবাবুকে রাখতে দেবে। তারপর সে সুযোগ মতো শেষরাতে কেটে পড়বে। পানিগ্রাহীদাকে আমরা গিয়ে খবর দিলে উনি ব্যবস্থামতো অফিসারদের নিয়ে হানা দেবেন হোটেলে। আমি আর তন্দ্রা–দরকার হলে সাক্ষীও দেব। এদিকে তখন মিস শান্তা উধাও হয়ে যাবে ইত্যাদি সব প্ল্যান। এ হচ্ছে পানিগ্রাহীদার বরাবরকার রীতি। সব ব্যাপারে বিরাট প্ল্যান করেন। ভেস্তে যায় শেষ অব্দি। এমন অজাযুদ্ধ ঋষিশ্রাদ্ধ গোছের জবড়জং প্ল্যান করলে তাই হয়। ইলেকশানে তো ও জন্যেই হেরেছেন। নির্বোধ বহু দেখেছি, এমন আর নেই। জলের মতো টাকা খরচ করে…
তুমি নিজের কথা বলো, সুমন্ত।
এই নির্বোধ বড়লোকটার ওপর আমার বরাবর ঘৃণা ছিল। তাই ওকে ঠকিয়ে টাকা নিয়েছি সবসময়। এটা পাপ মনে করিনে।
প্লীজ, প্লীজ!
মিস শান্তা দুপুরবেলা খাওয়ার পর ঘুমোচ্ছিল। গিয়ে ঘণ্টা টিপলুম। দরজা খুলল। অমনি বের করলুম ড্যাগারটা। ড্যাগারের সামনে সে চুপ করে গেল। প্যাকেটটা তক্ষুনি বের করে দিল। তাকে বললুম– যদি এক্ষুণি না কেটে পড়ো, তো বিপদ হবে। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে সামনেই সি সুইটে তন্দ্রার ঘরে ঢুকে গেলুম। দরজা খোলা ছিল–কারণ, আমি একটু আগে বেরিয়েছি। তন্দ্রা ব্যস্ত হয়ে উঠল। ওর প্রশ্নে উত্যক্ত হয়ে সংক্ষেপে সব জানালুম। তারপর…
একটা কথা। শান্তা তোমাকে চিনতে পারেনি?
না। ঘরে থাকার সময় ফিতে দিয়ে আটকানো বেলুন দুটো খুলে রাখতুম। শার্ট-প্যান্ট আর মুখোশ পরে ঢুকেছিলুম শান্তার ঘরে।
সুইটের দরজায় আইহোল আছে, সুমন্ত?
হ্যাঁ–সেতো ছিল। কিন্তু আমি সুইচ টিপে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিলুম। শান্তা ঝটপট দরজা খুলেছিল। বয় কিংবা ভারতবাবু ভেবে থাকবে ও। ভারতবাবুর সঙ্গে খুব খাতির জমিয়েছিল তো।
রাইট। বলো।
তন্দ্রা প্যাকেটটা দেখে যেন লোভে পড়ে গেল। সে আমাকে শাসাতে থাকলটাকার ভাগ না দিলে পানিগ্রাহীর কানে তুলবে। তখন ওকথা ঠাট্টা ভেবেছিলুম। পরে ও্যখন সমানে ঘ্যানর-ঘ্যানর চালিয়ে গেল বুঝলুম ও সিরিয়াস। এক ফাঁকে একটা শাসানি চিঠি লিখে ফেলে রাখলুম দরজার পাশে।
সেই চিঠিটা–ডাইনী মেয়েরা!
হ্যাঁ। তাতেও বিশেষ ভয় পেল না তন্দ্রা। তখন সেই বহুরূপীটাকে ঠিক করলুম গোপনে।
আর মিস শান্তা কী করল?
খুব ভয় পেয়েছিল তো। একটু পরেই কেটে পড়েছিল প্রাণ বাঁচাতে। তাছাড়া পুলিসের খাতায় ওর দাগী নামও রয়েছে। দেখলুম, ভারতবাবুর মুখটা গম্ভীর। সব শালা খচ্চর! ভারতবাবু শান্তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল–ভাবা যায়?
তারপর?
সারা বিকেল তন্দ্রা আমাকে টাকা দাবি করতে থাকল। রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল। রাত সাড়ে নটায় শার্কের ওই কাণ্ডের পর বাংলোয় নিয়ে গেলুম ওকে–পালানোর ছলে। বললুম– ঠিক আছে–ভাগ দেব টাকার। কিন্তু তন্দ্রা প্যাকেটের অর্ধেক ভাগ দাবি করে বসল তখন। তন্দ্রার হিসট্রি আছে–সে ইচ্ছে করলে পুলিস বের করতে পারে। ও নানা ঘাটের জল খাওয়া মেয়ে। খুব সহজ নয়। জেদী। কুচুটে। খানকি তো বটেই। সেই সময় কথামতো কল্যাণী হাজির হলো। আমার প্ল্যান তো ওই গাড়োল পানিগ্রাহীদাটার মতো নয়। সিম্পল অ্যাণ্ড স্ট্রেইট। গাড়ির শব্দ হতেই পানিগ্রাহী এলেন তাহলে, এই বলে তন্দ্রা সিগারেটটা নিবিয়ে ফেলল। তক্ষুনি সবে ধরিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণে সব টের পেয়ে গেল। ওর চোখের সামনে প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে দরজা খুললুম। কল্যাণীকে ওটা দিয়ে দরজা থেকেই বিদায় করলুম। তারপর দরজা বন্ধ করে দেখি ও রাগে ফুঁসছে। লাফিয়ে এসে আমার চুল ধরল– কাকে দিলে, কে ওই মেয়েটি?…রিয়েলি কর্নেল, ওই ঢ্যামনামি দেখে তখন মাথায় আগুন ধরে গেল। এমন ভাব দেখাচ্ছে, যেন আমার সাতপাকে বাঁধা বউ। ক্রমশ ও ক্ষেপে গেল। অকথ্য গালিগালাজ শুরু করল। আমার প্রেমও চায়, টাকাও চায়–সেক্সের ব্যাপারেও হিংসে, আবার টাকার ব্যাপারেও লোভ। তন্দ্রা– এই তন্দ্রাটা কী, আমি বুঝে উঠতে পারছিনে এখনও। শেষে ও করল কী জানেন?…বিশ্বাস করুন, ওকে স্রেফ মারধোর করে বেঁধে রেখেই সোজা কল্যাণীদের বাড়ি চলে যেতুম–কিন্তু হঠাৎ ও হাত বাড়িয়ে টেবিলে পড়ে থাকা আমার ছোরাটা তুলে নিল। আমার আর সহ্য হলো না। ছোরাটা কেড়ে নিয়ে ওর চুল ধরে বেডরুমে ঢোকালুম। তারপর… সুমন্ত দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। … কিন্তু আমি সত্যি ভালবাসতুম ওকে। ও যে আমাকে স্রেফ টাকার লোভে ব্ল্যাকমেইল করে বসবে, আমি কল্পনাও করিনি।
সুমন্ত, প্লীজ!
বলুন।
তাহলে তুমি পোশাক বদলেছিলে–
রক্ত লেগে গিয়েছিল, তাই। ওভাবে পানিগ্রাহীদার কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
ছোরাটা টেবিলে কোত্থেকে এল?
বেডরুম থেকে এনে রেখেছিলুম। বিছানায় রাখা ছিল বালিশের নিচে।
কেন এনেছিলে?
সুমন্ত জবাব দিল না।
সুমন্ত, কখন ছোরাটা বেডরুম থেকে এনেছিলে?
ঘরে ঢোকার পরই।
তখন মোমবাতি জ্বেলেছিলে?
না। একটু পরে সিগারেট ধরিয়ে জ্বেলেছিলুম।
তাহলে তোমার মাথায় খুনের মতলব ছিলই, সুমন্ত অস্বীকার করো না।
জানি না। যখন ওটা আনি, খুন করব বলে আনিনি। বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছে।
বিশ্বাস করলুম না–দুঃখিত, সুমন্ত। কারণ আমি যুক্তিবাদী।…কর্নেলের, কণ্ঠস্বর গম্ভীর হলো। তার চোখদুট জ্বলজ্বল করতে থাকল।…তুমি তন্দ্রার প্রথম রিঅ্যাকশন হোটেলে লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গে খুনের সিদ্ধান্তে এসেছিলে। প্রবীর বহুরূপীকে তুমি যা করতে বলেছিলে, তার পিছনে তোমার ওই সিদ্ধান্তের চাপ ছিল। ওই শো-বিজনেস! নিছক ভয় দেখিয়ে তাকে চুপ করানোর জন্য নয়। তন্দ্রা যে অত সহজে চুপ করবে না–কিংবা তখনকার মতো করলেও পরে সুযোগ মতো মিঃ পানিগ্রাহীর কাছে সব ফাঁস করে দেবে, এই ছিল তোমার ধারণা। তাকে তো তুমি ভালই চিনতে। তাই যখনই লক্ষ্য করলে যে তন্দ্রা তোমার অসহযোগী, তুমি তোমার অভিজ্ঞতা অনুসারে ধরে নিলে, তন্দ্রা বরাবর অসহযোগী থেকে যাবে–
ডাঃ পট্টনায়ক বলে উঠলেন, যতক্ষণ না সুমন্ত ওকে ক্যাশ অর কাইণ্ডস কোনও ভাগ দিচ্ছে।
ঠিক। সেটাই হচ্ছে তন্দ্রার রিঅ্যাকশন বা অসহযোগিতামূলক মনোভাবের প্রেমিস। তুমি একা সব হাতাতে চেয়েছিলে সুমন্ত। আধুনিক সমাজের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লোভটাকার প্রতি লোভ, যে লোভ হাঙরের মতো প্রতিটি মানুষকে গ্রাস করে চলেছে, তার খপ্পরে তুমি আর তন্দ্রা অনেক আগেই পড়েছ। তাই যে মুহূর্তে এক ভাগীদারকে আচমকা মাথা তুলতে দেখলে, তুমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে। এই ভাগীদারটি কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে, তাও জানা ছিল তোমার। সুতরাং তুমি একটি নাটকীয় মোডস অপারেণ্ডির পথ ধরলে। হাঙরের রাতের ঘটনা সকালে রটতে দেরি হবে না, সবাই জানবে কোনও মুখোশপরা খুনী দুজনকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে একজনকে খুন করেছে। তোমার অ্যালিবাই (অজুহাত) ভীষণ শক্ত–যেহেতু নিজেও তার সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছ, দৌড়ে পালিয়েছ। চমৎকার। পরিকল্পনা! তোমার পরিকল্পনার আরও চমকপ্রদ এবং যুক্তিসিদ্ধ অংশ হচ্ছে, তোমার পরবর্তী কার্যকলাপ। পরে তুমি টের পেলে যে প্রবীর হরবোলা হচ্ছে পরিকল্পনার একটা মারাত্মক দুর্বল গ্রন্থি। তাহলে কি প্রবীরকে সরাতে হবে? কিন্তু প্রবীরের পাত্তা কখন আবার কোথায় পাওয়া যাবে, ঠিক ছিল না। সে কাজ সময়সাপেক্ষ। সেই সময় তোমার মাথায় খেলে গেল আরেক প্রকল্প। মিঃ পানিগ্রাহীর ভারতকে ঢিট করার পরিকল্পনার মতো বিশাল আশ্রয়কক্ষ থাকতে কেন ফের খুনের ঝুঁকি নিতে যাওয়া? তাই তুমি মাল নিয়ে কেটে পড়লে না তক্ষুনি। পানিগ্রাহীর সহায়তায় খুনের দায় ভারতের ঘাড়ে চাপাবে ঠিক করলে। এতে পানিগ্রাহীর লাভ আছে–ভারতবাবু ঢিট হবেন। তুমি পানিগ্রাহীর সহযোগিতায় নামলে কোমর বেঁধে। তুমি থেকে গেলে।
পট্টনায়ক বললেন, কিন্তু ছোরাটা আমার গাড়িতে রাখল কেন ও?
সুমন্ত আস্তে বলল, আপনার বাড়ি এসে থাকব ভেবেছিলুম। কর্নেলের সঙ্গে তাই আসছিলুমও। ইচ্ছে ছিল, কল্যাণীর সাহায্যে ওটা সুযোগ মতো ভারতবাবুর হোটেলে পাচার করব।
কর্নেল মৃদু হাসলেন, অ্যামবিশাস প্ল্যান! সুমন্ত পানিগ্রাহীর কাছে আজ চুলটুল কেটে খুব আশা নিয়ে গিয়েছিল, প্রথম উদ্দেশ্য : ভারতবাবুর দিকে পানিগ্রাহীকে যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতিতে লেলিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য : পানিগ্রাহী যদি পিছিয়ে যান, কিংবা উল্টে ওকেই সন্দেহ করে বসেন তাহলে ব্ল্যাকমেইল।–
সবাই চমকে উঠল–ব্ল্যাকমেইল!
হ্যাঁ, তাই। পানিগ্রাহীর নার্কোটিকস পাচারের প্ল্যান ফাঁস করে দেবার শাসানি মাথায় ছিল সুমন্তর। এবং দরকার হলে খুনের সম্পূর্ণ দায় তার ঘাড়ে চাপানো হতো। সুমন্ত প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হবে বলে ভয় দেখাতে পারত। সুমন্তর তখন তো তুঙ্গে বৃহস্পতি। নির্বোধ পানিগ্রাহীকে দিয়ে যা খুশি করার মওকা মিলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রকৃতির সবকিছুতে, কী বস্তু কী প্রাণীজগতে একটা অদ্ভুত পদ্ধতি কাজ করছে। আমরা নিজের দাঁতেই নিজেদের কবর খুঁড়ি।
মিঃ আলি এবং একটি ছোটোখাটো পুলিসদল রেনকোট পরে ঘরে ঢুকল। আলির হাতে একটা বড় কিটব্যাগ। বললেন, ড্রাগের প্যাকেট, তন্দ্রার ব্যাগ, পার্স। সবকিছু এর মধ্যে রয়েছে। বাংলোর উত্তরে বটতলায় পাথরচাপা ছিল কিটব্যাগটা খুঁজতে অসুবিধে হয়নি। রক্তমাখা গেঞ্জি আর বেলবটম প্যান্টটাও ওখানে লুকানো ছিল।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, সুমন্তকে ধন্যবাদ।
সুমন্ত লাফিয়ে উঠল–গেট আউট, গেট আউট, ইউ ওল্ড ফুল! সেপাইরা তক্ষুনি ওকে ধরে ফেলল। কর্নেল আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলেন। পিছনে সুমন্তর কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন।
বারান্দায় রেনকোট আর টুপিটা পরে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নামলেন কর্নেল।
এখন তিনি অন্য মানুষ। বিচে এসে ভয়ঙ্কর গর্জনকারী প্রাকৃতিক শক্তিটিকে বাঁয়ে রেখে জীবনমৃত্যুময় অস্তিত্বের কোলসের তলায় নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ এক বৃদ্ধ চলেছেন উদ্দেশ্যহীনভাবে। তিনি ভাবছেন, মানুষ প্রবৃত্তির কাছে এত অসহায়! অথচ সুমন্ত কাঁদছে। সব হত্যাকারীই কাঁদে–কেউ মনের তলায় অবচেতনায়, কেউ প্রকাশ্যে। কিন্তু তাকে কাঁদতে হয়। এটাই তার অস্তিত্বের মানুষী ভাব।…