» » সোনার ডমরু

বর্ণাকার

পাঁচ

 ঘুম ভেঙে গেল অতি পরিচিত কণ্ঠস্বরে-সুপ্রভাত ডার্লিং। আশা করি, সুনিদ্রা হয়েছে? শুনে লাফিয়ে উঠে বসলুম। বাইরে সোনালী রোদ ঝলমল করছে। আমার বৃদ্ধ বন্ধু খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন।

চেঁচিয়ে উঠলুম, স্বরভঙ্গ সেরে গেছে আপনার?

কর্নেল মধুর হেসে বললে, প্রাচীন আয়ুর্বেদকে অবহেলা কোরো না বস? যষ্ঠীমধু এবং নানাপ্রকার শেকড়বাকড় সহযোগে প্রস্তুত ওই রক্তবর্ণ বটিকাগুলি আমাকে এক কবিরাজ উপহার দিয়েছিলেন। এতকাল ব্যবহারের সুযোগ পাইনি। পেয়ে ব্যবহার করে দেখলুম, অতি অব্যর্থ। কাশি তো তখনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে স্বরভঙ্গও সেরে গেল। যাই হোক, ওঠো। চলো, আমরা নিচে রাস্তার ধারে খাবারের দোকানে গিয়ে গরম গরম কচুরি এবং চা সেবন করি গে! বদ্রী নেই–অতএব একটু কষ্ট করতেই হবে।

ঝটপট বাথরুম সেরে এসে দেখি, ঘুঘুমশাই তাঁর প্রজাপতি ধরা জাল, অত্যদ্ভুত ক্যামেরা, বাইনোকুলার ইত্যাদি কাঁধে ঝুলিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

দরজায় তালা এঁটে বেরিয়ে গেলুম দুজনে। টিলা থেকে ঢালু পিচের রাস্তায় নামতে নামতে বললুম– থানায় যাবেন না?

না ডার্লিং। আমার খাওয়াটা সেরে নিয়ে জঙ্গলের দিকে যাব।

বদ্রীর জবানবন্দীটা শোনার ইচ্ছে ছিল যে!

কর্নেল আমার একটা হাত ধরে বললেন, কী দরকার? সেটা তুমি আমার মুখেই শুনতে পারো।

আপনি জানেন সব?

আঁচ করেছিলুম কী ঘটতে পারে। কিন্তু স্বরভঙ্গ হয়ে গিয়ে অনিবার্য বিপদকে ঠেকাতে পারিনি।

আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম। বলেন কী!

কর্নেল আমাকে টানতে টানতে বললেন, আভাস পেয়েছিলুম। এ আমার এক সহজাত বোধ বলতে পারো। বদ্রীর হাবভাবে খুনীর আদর্শ ক্রমশ ফুটে উঠছিল। সেটাই প্রথমে আমার চোখে পড়ে। তাছাড়া সোনার ডমরু চুরির ঘটনা আগেই কলকাতায় থাকতে কাগজে পড়েছিলুম। খবরের কাগজের লোক হয়েও তুমি ব্যাপারটা জানো না, এতে আমার বিস্ময় নেই। কারণ ময়রার সন্দেশে রুচি থাকে না।

হাসতে হাসতে বললুম– ঠিক বলেছেন। তারপর?

কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, বদ্রীর মধ্যে আমার চির পরিচিত খুনীর আদর্শ আবিষ্কার করার পর তার দিকে নজর রাখা উচিত মনে হয়েছিল। তবে রাতে বদ্রী যখন খানা আনল, তখন তুমি একটা চিৎকার শুনেছিলে। ওটা শমীকের আর্তনাদ হতে পারে না। হিমালয়ের ভালুকের চিৎকার। বৃষ্টির রাতে বিরক্ত হয়ে ওরা চেঁচামেচি করে। যাই হোক, শমীক প্রণতির সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে গিয়ে বদ্রীর ঘরে গিয়েছিল রাত কাটাতে। বৃষ্টির মধ্যে যাবে কোথায় বেচারা? বদ্রী তাকে নিজের বিছানায় শুতে দেয়। খুব ভোরে আমি যখন বেরুচ্ছি, তখন বদ্রীর ওপর নজর রাখতে গিয়ে উঁকি মেরে তার ঘরে শমীককে দেখি। গেটের কাছে গিয়ে বদ্রীকে খুঁজছি, চোখ পড়ল সে হনহন করে সারাঙয়ের রাস্তায় চলেছে। তখন কিছু বুঝিনি। আমার ইচ্ছে ছিল ঝর্ণার ধারে জঙ্গলে গিয়ে প্রজাপতি ধরব গোটাকতক।

কর্নেল দম ছেড়ে ফের বললেন, তখন সূর্য উঠেছে। কিন্তু কুয়াশা রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় এই এক জ্বালা। সূর্য নেপালের পাহাড়ের আড়ালে থাকায় রোদ পৌঁছতে পারছে না। আমি অপেক্ষা করছি। রোদ না ফুটলে প্রজাপতির দেখা মিলবে না। ঘণ্টাখানেক পরে দেখি, এক ভদ্রলোক আর বদ্রী হনহন করে আসছে সারাঙ থেকে। ঝর্ণার কাছে এসে দুজনে দাঁড়াল। তারপর বদ্রী নিচে  জলের দিকে আঙুল তুলে তার খোট্টাই বুলিতে বলল, বাবা ডমরুনাথ আমাকে স্বপ্নে ওই জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছেন স্যার। ওখানেই চোর ওনার ডমরু পুঁতে রেখেছিল। সেই ডমরু আপনার কাছে আছে বাবুসাব। স্বপ্নে বাবা আমাকে বলেছেন।

বললুম– আপনি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন?

হ্যাঁ। আমি তো মাত্র হাত বিশেক তফাতে একটা পাথরে বসে আছি। সামনে, ঝোপ থাকায় ওরা আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না।…

তারপর?

ভদ্রলোক অর্থাৎ নীতিশবাবু কেমন যেন ভয় পেয়ে গেছে মনে হল। : বললেন, তোমার স্বপ্নটা হয়তো ঠিক আছে। বাবা তার ডমরু ফিরে পাবেন। ওটা আমার কাছেই রয়েছে। চলো, আমার স্ত্রীকে সঙ্গে করে বাবার মন্দিরে উঠব। তার জিনিস তাকেই ফিরিয়ে দেব। তুমি ঠিকই বলেছ, ওটা আমার লুকিয়ে রাখা ঠিক হয়নি।

 কর্নেল চুপ করলেন। আমরা নিচের রাস্তায় একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি। ওঁকে চুপ করতে দেখে বললুম– তারপর কী হলো?

হঠাৎ দেখলুম, বদ্রী কোমরের কাছ থেকে একটা ভোজালি বের করে ওঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার স্বরভঙ্গ। চেঁচিয়ে উঠতে পারলুম না। সঙ্গে রিভলভারটাও আনিনি। তাছাড়া আমাকে ওদের কাছে পৌঁছতে হলে অন্তত আড়াইশো গজ দূরত্ব ঘুরে যেতে হয়। ঝর্ণার অন্য পারে মাথার দিকটায় আছি। আমি যেতে যেতে খুন হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। বদ্রী ওঁর জামাপ্যান্ট হাতড়াচ্ছে পাগল হয়ে। পেল না ডমরুটা। তখন বালি সরিয়ে লাশ পোঁতার চেষ্টা করল। আমার পক্ষে ওই দুর্গম আড়াইশো গজ পেরুতে যতটা সময় লাগে, তার আগেই এ পর্যন্ত ঘটে গেল। তখন মরিয়া হয়ে একটা পাথর ছুঁড়লুম। অমনি বদ্রী আমাকে দেখতে পেয়ে পালিয়ে গেল। যাই হোক, ডমরুটা আমি কুড়িয়ে পেলুম জলের ধারে।…কর্নেল পা বাড়ালেন।

বললুম– তারপরও বদ্রীকে কিছু বলেনি? পুলিশকেও কিছু জানাননি।

 কর্নেল হাসলেন।…আমার যা স্বভাব। খুনীর সঙ্গে কিঞ্চিৎ খেলা করা। তবে বদ্রীর মতো লোকের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ভুল করেছি। শমীককেও বাঁচাতে পারিনি। এদিকটা ভাবিইনি।

শমীককে কেন খুন করল বদ্রী?

শুধু শমীককে নয়। প্রণতিকেও খুন করত। প্রণতি দরজা আটকে ঘুমোচ্ছিল বলে।

কিন্তু কেন?

রাগ এবং আতঙ্ক ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? সম্ভবত খুন করে বাংলোয় ফিরে তার ঘরে শমীককে দেখামাত্র তার হননবৃত্তি ফের চাগিয়ে উঠেছিল। তবে একটা কারণ অনুমান করা যায়। সোনার ডমরুর ব্যাপারটা ওই তিনজনেই জানত। নীতিশ খুন হওয়ার পেছনে সোনার ডমরু চুরির ব্যাপার থাকতে পারে, প্রণতি ও শমীকের এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তারা পুলিশকে বলত। ওদিকে আমি বদ্রীকে খুন করতে দেখেছি। বদ্রীর মাথার ঠিক ছিল না তাই। পারলে আমাকেও শেষ করে ফেলত।…

বলে কর্নেল মুখ তুলে চারদিকটা দেখে নিলেন। ফের বললেন, আমি এমন ভাব দেখাচ্ছিলুম, যেন বদ্রীকে ভোরের কুয়াশার মধ্যে চিনতেই পারিনি! বদ্রীর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সে এটাই অনুমান করেছে। নইলে আমার এবং তারপর  তোমার ওপরও ভোজালি চালাতে দ্বিধা করত না। বাংলোয় এ কাজ নির্বিঘ্নে সেরে ফেলতে পারত।

আঁতকে উঠে বললুম– ছেড়ে দিন। চলুন চা-ফা-খাওয়া যাক।

কর্নেলের অনুমান যাই হোক, শমীককে খুন করার ব্যাপারটা রহস্যময় থেকে গেল আমার কাছে। কিন্তু আপাতত ও নিয়ে আর মাথা ঘামালুম না। ডমরুনাথের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি জাদুকর। ক্রমশ আমাকে সে আবিষ্ট করেছিল।…

বিকেলে রহস্যটা ফাঁস হলো শেষ পর্যন্ত। পুলিশ অফিসার মদনলাল এলেন বাংলোয়। তার কাছেই শুনলুম, বদ্রী কবুল করেছে সব। শমীককে সে খুন করত না। কিন্তু ঝর্ণাতলায় খুন করে এসে সে শমীকের মুখোমুখি পড়ে যায়। তখনও তার হাতে ভোজালি, কাপড়-চোপড়ে রক্ত। শমীক বিছানা ছেড়ে সবে উঠেছে তখন। জিজ্ঞেস করামাত্র মরীয়া হয়ে বদ্রী ওর গলায় কোপ বসায়। শমীক চিৎকার করে ওঠার সুযোগও পায়নি। তবে সাহস আছে বদ্রীর। এই বাংলোয় পুলিশ ধুন্ধুমার করছে, তার মধ্যে সে দিব্যি আরেকটা লাশ খাটিয়ার তলায় লুকিয়ে ভালমানুষ সেজে ঘুরে বেড়িয়েছে। তারপর রাতে পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে হাতে নাতে।