চার
তারপর ঘণ্টা তিনেক কেটে গেছে। রাতের অন্ধকার পরিবেশকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। কর্নেল চুপচাপ শুয়ে একটা বই পড়ছে। আমি চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে আকাশপাতাল হাতড়ে এই যুগল হত্যাকাণ্ডের জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। দরজা বন্ধ করা আছে। হঠাৎ বাইরে পরপর দুবার গুলির শব্দ এবং চিৎকার ও তর্জনগর্জন শোনা গেল।
কর্নেল বই ফেলে উঠে পড়লেন এবং ঝটপট দরজা খুলে বেরুলেন। আমিও বেরুলুম।
রেরুতেই চোখে টর্চের আলো পড়ল।
আলো সরে যাওয়ার পর পুলিশের মূর্তি দেখে আচ্ছন্নতাটা মুহূর্তে কেটে গেল। একদঙ্গল সশস্ত্র পুলিশ বাংলোকে হুলস্থূল করে ফেলেছে। বদ্রীর ঘরের দিকে দৌড়ে গেলেন কর্নেল। পেছন-পেছন আমিও গেলুম। গিয়ে দেখি, তেরপলে জড়ানো একটা লাশের সামনে পুলিশ অফিসাররা দাঁড়িয়ে আছেন এবং বদ্রী হাঁটু চেপে ধরে বসে আছে। মুখটা বিকৃত। তার পায়ে রক্ত এবং আঙুলেও সেই রক্তের ছোপ। গুলি লেগেছে পায়ে, সেটা বোঝা গেল।
তার কাঁধ ধরে, একজন পুলিশ অফিসার তাকে ওঠাল। তারপর ওই আহত অবস্থায় হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল গেটের দিকে। বুঝলুম, খুনে শয়তানটাকে শ্রীঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তেরপল সরিয়ে লাশটা বের করা হলো। নীতিশবাবুর বয়সী এক যুবকের লাষ। তেমনি রক্তাক্ত। একেবারে জবাই করা অবস্থা।
তাহলে কাল রাতে যে চিৎকার শুনেছিলুম, তা কিসের এতক্ষণে বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু কেন বদ্রী এভাবে পরপর দুটো খুন করেছে? মাথা মুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না। যিনি বোঝেন, অর্থাৎ বুড়ো ঘুঘুমশাই স্বরভঙ্গ ধরিয়ে বসে আছেন। এককথায় যে আভাস দেবেন, আপাতত সে আশা নেই। কাগজকলম করে তাকে সবটা জানাতে হবে। কিন্তু সে তো সবকিছু চুকেবুকে গেলে, তবে।
এই হট্টগোলের মধ্যে রাণাসাহেবের কথা মনে পড়ে গেল।
ঘুরে প্রণতিদের ঘরের দিকে তাকালুম। আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, সদ্য পুলিশের ঝাঁক তাকে ঘিরে ফেলল। রাণাসাহেব বেজায় হম্বিতম্বি জুড়ে দিলেন ইংরেজি ভাষায়। কোনও কাজ হলো না। পুলিশ তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল গেটের দিকে। ওধারে পুলিশভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লাশটা তেরপল জড়ানো অবস্থায় নিয়ে গেল ভ্যানের দিকে। তারপর জনাতিনেক অফিসার এবং কর্নেল বারান্দায় উঠলেন। অনুসরণ করলুম তাদের।
আমাদের ঘরে রীতিমতো বৈঠক বসল। এক্ষেত্রে কর্নেলের একটা লম্বাচওড়া ভাষণ দেওয়ার কথা। কিন্তু তার স্বরভঙ্গ।
পকেট থেকে একটা মোড়ক বের করে টেবিলে রাখলেন কর্নেল। একজন অফিসার মোড়কটা খুলে সবিস্ময়ে বললেন, এই সেই সোনার ডমরু! এরই জন্যে এত খুনোখুনি!
হা, প্রায় ছ’ইঞ্চি লম্বা এবং আন্দাজ ইঞ্চি তিনেক চওড়া অর্থাৎ ব্যাসের একটা ডমরু। ডমরুটা সোনার। একটু ময়লা দেখাচ্ছে। আনাড়ি চোখে ওটা পেতলের বলে ভুল হওয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু এর সঙ্গে প্রণতির যোগাযোগ হলো কীভাবে?
অগত্যা জিজ্ঞেস করলুম পুলিশ অফিসারটিকে, ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন মশাই?
অফিসার তাঁর সঙ্গীদের দিকে এবং পরে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিয়ে বললেন, আপনি তো সাংবাদিক?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
জব্বর স্টোরি পেয়ে গেলেন মশাই! খাইয়ে দেবেন কিন্তু।
দেব। কিন্তু স্টোরিটা কী?
এতদিনে এই প্রথম কর্নেলের বদলে রহস্য ফাঁসের ব্যাপারটা পুলিশের কাছ থেকে নোট করতে হলো আমাকে। কিন্তু পুলিশ যে স্টোরি দেয়, তা আইন বাঁচিয়েই দেয় এবং তাতে সব জট খোলা থাকে না, অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানা আছে। কিন্তু আপাতত এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আমার বন্ধুর স্বরভঙ্গ থেকে আরোগ্য লাভ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
সম্প্রতি কিছুদিন আগে বাবা ডমরুনাথের মন্দির থেকে এই সোনার ডমরু চুরি যায়। ডমরুটা খুব প্রাচীন। নেপালের রাজাদের অর্ঘ্য বাবা ডমরুনাথের শ্রীচরণে।
রাণাসাহেবের একটা চোরাচালানী গ্যাং আছে এ তল্লাটে। প্রবাবশালী লোক বলে তার গায়ে হাত দেওয়া যায়নি। অথচ পুলিশের সন্দেহ ছিল একাজ ওঁর গ্যাঙেরই।
বদ্রী ওঁর গ্যাঙের লোক। বদ্রীই চুরি করেছিল ডমরু। প্রণতির স্বামী নীতিশ আসলে সারাঙড্যামের ইরিগেশন ইঞ্জিনিয়ার। ওই ঝর্ণাটা নিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারের একটা প্রকল্প আছে। তার সার্ভে করতে গিয়ে ঝর্ণার ওখানে বালির তলায় সে সোনার ডমরুটা আবিষ্কার করে। স্ত্রীকে ব্যাপারটা লিখে জানায়। প্রণতি এসে গেলে দুজনে মিলে ওটা বাবা ডমরুনাথকে প্রত্যর্পণ করার কথাও লেখে।
শমীক প্রণতির পিসতুতো দাদা-টাদা নয়, পুরনো প্রেমিক। নীতিশ ব্যাপারটা একটু আধটু আঁচ করেছিল। কিন্তু বিশেষ গা করত না। ডমরুনাথে পৌঁছে দিতে এসেছিল শমীক, প্রণতির অনুরোধেই। প্রণতি তাকে কথায় কথায় সোনার ডমরুর। কথাও বলেছিল।
এখানে পৌঁছনোর পর প্রেমিক শমীক তার পুরনো প্রেমিকাকে স্বামীর কাছে যাবার আগে এই একটা রাত প্রচণ্ডভাবে কাছে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রণতি বেঁকে বসে। শমীকের সঙ্গে একঘরে রাত কাটাতে রাজি নয়। অথচ উপায় ছিল না। বৃষ্টি পড়ছিল। অমন দুর্যোগে সারাঙ যাবে কীভাবে? তাই এই বাংলোয় আশ্রয় নিতেই হয়েছিল শেষপর্যন্ত। তারপর শমীক প্রেমনিবেদন শুরু করে। প্রণতি বাধা দেয়। ঝগড়াঝাটি শুরু হয়। তখন শমীক ক্ষেপে গিয়ে বলে, তোমার স্বামী চোর। বাবা ডমরুনাথের সোনার ডমরু চুরি করেছে। ওকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেব।
সম্ভবত বদ্রী আড়ি পেতে ব্যাপারটা শুনেছিল। এই হলো প্রণতির জবানবন্দী।
ঝগড়াঝাঁটি চরমে উঠলে শমীক রাগ করে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে যায়। তারপর একটা কিছু ঘটেছিল। ওই সময় বদ্রী তাকে নিজের ঘরে স্বচ্ছন্দে খুন করে। কেনই বা খুন করল, কেন শমীক তার ঘরে গেল–এখনও বোঝা যাচ্ছে না। বদ্রীর জবানবন্দী আদায় করলে বোঝা যাবে।
ওদিকে নীতিশই বা ঝর্ণার ধারে খুন হলো কেন, তাও বোঝা যাচ্ছে না।
কর্নেল প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে তার লাশ দেখতে পান। লাশটা খুনী পুঁতে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তার প্রমাণ ওই অসমাপ্ত গর্ত। কর্নেল গিয়ে পড়ায় সে পালিয়ে যায়। কর্নেল ঘুরতে ঘুরতে একটু তফাতে স্বচ্ছ জলের মধ্যে সোনার ডমরুটা আবিষ্কার করেন। বোঝা যায়, নীতিশের হাতে ওটা ছিল এবং খুনী তার ওপর হামলা করার সময় ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। খুনী আর ওটা খুঁজে পায়নি–অথবা খোঁজার সময়ও পায়নি।
কেন নীতিশ ডমরুটা নিয়ে এত ভোরে ওখানে এসেছিল?
আমার প্রশ্ন শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, বদ্রীর জবানবন্দী না আদায় করলে অনুমান করা যাচ্ছে না কিছু। তাছাড়া সারাঙে এখনও তদন্ত করছেন আমাদের অফিসার।
বললুম– আমি প্রণতি ও শমীকের ঝগড়া শুনেছিলুম। শমীক বলছিল, তুমি নিজেই এজন্যে দায়ী…
কর্নেল পকেট থেকে চকপাথর বের করছেন দেখে থেমে গেলুম। কর্নেল লিখলেন টেবিলে : ওটা পুরনো কথা তুলে প্রেমিক-প্রেমিকার কলহ। অর্থাৎ প্রণতি নিজেই নীতিশের সঙ্গে বিয়ের জন্যে দায়ি। ওসব কথার সঙ্গে এ ঘটনার সম্পর্ক নেই।
পুলিশ অফিসাররা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কর্নেল ও আমাকে বিদায় সম্ভাষণ করে চলে গেলেন।
বললুম– আপনার স্বরভঙ্গের আর সময় ছিল না? কেলেংকারি বটে!
কর্নেল করুণমুখে হাসলেন শুধু।…