» » সোনার ডমরু

বর্ণাকার

তিন

প্রণতি এতে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে পড়ল। কারণ লাশটা তার স্বামী নীতিশের। পকেটে আইডেন্টটি কার্ড ছিল। জনান্তিকে আমি কর্নেলকে বললুম– যা বলেছিলুম, হলো তো? রাত থেকেই আঁচ করেছিলুম, একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে।

কর্নেলের স্বরভঙ্গ। মুখে অসহায় মানুষের ভঙ্গি। করুণ হাসলেন মাত্র।

আমরা এখন বাংলোয় ফিরেছি। লাশ মর্গে চলে গেছে পুলিশের জিপে। সারা থেকে খবর পেয়ে একদল বিদ্যুৎকর্মী ও অফিসার এসেছিলেন। পুলিশের জেরায় নাস্তানাবুদ হয়ে গেছেন সবাই। বিহারের পুলিশ গা করে না তো করে না করলে বেজায় রকমের করে।

প্রণতি জেরার চোটে জেরবার। কোণঠাসা হয়ে নীরবে কান্নাকাটি করে যাচ্ছে সারাক্ষণ। আমার কষ্ট হচ্ছিল ওর অবস্থা দেখে। চক্রান্ত করে স্বামী হত্যার দায়ে গ্রেফতার করা হবে বলে শাসাচ্ছিলেন পুলিশের দারোগা ভদ্রলোক।

রাতের সেইসব ঘটনার কথা পুলিশকে আমি বলিনি। কর্নেল চোখ টিপে নিষেধ করেছিলেন।

কিন্তু বালির গর্তটা সম্পর্কে তীব্র কৌতূহল ছিল আমার। দারোগাবাবুকে জিগ্যেস করলে দ্রুত জবাব দিলেন, গর্ত করে লাশটা পুঁততে চেষ্টা করছিল খুনী। সম্ভবত কেউ এখানে গিয়ে পড়ায় সেটা পারেনি।

দুপুর বারোটার মধ্যে প্রণতিকে সত্যি সত্যি গ্রেফতার করে নিয়ে দারোগাবাবু সদলবলে প্রস্থান করলেন।

কিন্তু আশ্চর্য, প্রণতি আমাকে একবারও বলল না তাকে সাহায্য করতে। সে চুপচাপ চলে গেল।

বাংলো আবার নির্জন ও শান্ত হয়ে গেল। কর্নেল স্নান করলেন না আরও ঠাণ্ডা লাগবার ভয়ে। আমি স্নান করবার পর খাবার টেবিলে বসে বললুম– দারোগা ভদ্রলোক যেভাবে কেস দাঁড় করালেন, আমার খটকা থেকে গেল কর্নেল।আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট

কর্নেল তাকালেন।

বললুম– প্রণয়ী শমীককে নিয়ে এসে স্বামীকে ডেকে এনে খুন করাল প্রণতি এই হলো দারোগাবাবুর বক্তব্য। কিন্তু রাতে শমীকের সঙ্গে ঝগড়াঝাটির অর্থ কী? তাছাড়া শমীক বলছিল, এ জন্যে তুমিই দায়ি…

কর্নেল পকেট থেকে সেই চক পাথরটা বের করেছেন দেখে থেমে গেলুম। কর্নেল টেবিলে লিখলেন, খাওয়ার সময় মুখ বুজে থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। তৃপ্তির সঙ্গে খেতে হলে কথা বলা উচিত নয়। বদ্রীর রান্নাও অতি উপাদেয়।

ক্ষুব্ধভাবে খাওয়াটা সেরে নিলুম। ঠিক করলুম, বুড়ো গোল্লায় যাক–আমি একা ব্যাপারটাতে নাক গলাব এবং রহস্যের ফদাই করে ফেলব ওঁর নাকের ডগায়!

খাওয়ার পর আমার একটু দিবানিদ্রার অভ্যাস আছে। সেই ঘুম ভাঙল বিকেল চারটেয়। উঠে দেখি কর্নেল নেই। বদ্রী চা দিতে এসে বলল, কর্নেল সাহাব একঘণ্টা আগে বেরিয়ে গেছেন।

আনমনে বললুম– আচ্ছা বদ্রী, তোমার কী মনে হয় বলো তো?

বদ্রী বলল, কী কথা বলছেন স্যার, বুঝতে পারছি না।

মানে–ওই খুনের ব্যাপারটার?

বদ্রী একটু হাসল। আমি ছোটা আদমি স্যার। আমার কী মনে হবে?

আমি তাকে জেরার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতে চিৎকার শুনেছিলুম, তুমি বললে এখানে নাকি এমন চিৎকার রাতবিরেতে শোনা যায়। এটা বিশ্বাস হচ্ছে না বদ্রী।

বদ্রী চোখ বড় করে বলল, হ্যাঁ স্যার। আমি প্রায়ই শুনতে পাই। বাবা ডমরুনাথের চেলারা অমন করে চেঁচায়। তাই রাতবিরেতে আমি দায়ে না ঠেকলে। বেরুই নে।

আচ্ছা বদ্রী, শমীকবাবু ভোরে কখন বেরিয়েছিলেন, তুমি দেখেছ?

বদ্রী ঘাড় নাড়ল।

 এইসময় বাইরে কেউ ভারি গলায় ডাকল-বদ্রী দাস! বদ্রী দাস।

বদ্রী যেন চমকে উঠল। ঝটপট বেরিয়ে গেল। দরজার  পর্দা তুলে উঁকি মেরে দেখলুম একজন লম্বা-চওড়া গড়নের ভদ্রলোক লনে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা স্যুটকেস! বদ্রী তাকে সেলাম দিয়ে স্যুটকেসটা নিল।

তারপর আমাকে অবাক করে প্রণতিরা যে ঘরে ছিল, সেই ঘরের দরজা খুলে দিল। চাপা গলায় বলল, খুব সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছে রাণাসাহেব!

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে চোখ টিপে বললেন, শুনেছি। চেপে যাও এখন।

ওই ঘরে প্রণতির কিছু জিনিসপত্র তখনও রয়ে গেছে। বদ্রীর জিম্মায় আছে। পুলিশের অনুমতি না নিয়ে ওঘরে বদ্রী এই রাণাসাহেবকে ঢোকাল, এটাই অবাক লেগেছে।  পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলুম। বদ্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর বারান্দায় গেলুম। রাণাসাহেবের ঘরের দরজা বন্ধ। বদ্রী হনহন করে নেমে যাচ্ছে টিলা থেকে। একটু পরে সে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমার মনে রীতিমতো উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে। রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে গেল যে!

আমি পা টিপেটিপে ওই দরজার কাছে গেলুম এবং কান পেতে রইলুম। ভেতরে চাপা কী একটা শব্দ হচ্ছে। বাক্স গোছানোর মতো। শব্দটা থামলে মনে হলো রাণাসাহেব দরজা খুলতে আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে সরে এলুম। লনে গিয়ে সিগারেট ধরালুম।

কিছুক্ষণ পরে রাণাসাহেব বেরিয়ে গটগট করে আমার পাশ দিয়ে চলে গেলেন। আমাকে গ্রাহ্যও করলেন না। টিলা থেকে নেমে রাস্তায় উঠলেন ভদ্রলোক। তারপর ডমরু পাহাড়ের দিকে যেতে দেখলুম তাঁকে। পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির। নিচে থেকে স্বাস্থ্যবান তীর্থযাত্রীদের জন্য নাক বরাবর সোজা একটা সিঁড়িও উঠে গেছে মন্দিরের দিকে। রাণাসাহেব সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পুজো দিতে যাচ্ছেন নাকি?

বিকেলের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। পশ্চিমের পাহাড়ের পেছনে সূর্য নেমে গেছে। কুয়াশা ঘনিয়েছে। রাণাসাহেবের মূর্তি অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এদিকে বদ্রীও ফিরছে না! গেল কোথায় সে?

এইসময় আচমকা আমার কাঁধে টুপ করে একটা ঢিল পড়ল। পেছন ফিরে দেখি ওপাশে বদ্রীর ঘরের পেছনে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন গোয়েন্দা প্রবর কর্নেল সায়েব। হাসতে গিয়ে সংযত হলুম। কর্নেল ইশারায় ডাকছেন। মুখে ব্যস্ততা, ধূর্ততা ও ভীষণ গাম্ভীর্যের ছাপ।

কাছে যেতেই ইশারায় বদ্রীর ঘরের জানালার দিকে কিছু দেখালেন। চাপা গলায় বললুম– কী ব্যাপার? আপনি এখানে কী করছেন?

কর্নেল আমাকে হিড়হিড় করে টেনে জানালার কাছে নিয়ে গেলেন। টালির চাল চাপানো এই লম্বাটে ঘরের একদিকে কিচেন, অন্যদিকে বদ্রীর থাকার ব্যবস্থা। পেছনের জানালাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। সম্ভবত এ বুড়োরই কারচুপি খড়খড়ির ফাঁকে লাঠি ঢুকিয়ে ছিটকিনি তুলে জানালাটা খুলে কিছু দেখছিলেন।

উঁকি মেরে কিছু নজরে পড়ল না। ভেতরে আবছা অন্ধকার। জিজ্ঞেস করলুম, কী?

কর্নেল অসহায়তার ভঙ্গিতে মাথাটা দোলালেন। তারপর জানালাটা বাইরে থেকে টেনে আটকে দিয়ে আমার হাত ধরে টানলেন।

ভীষণ টান। পরক্ষণে আমাকে দৌড় করিয়ে ছাড়লেন। নিজেদের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে টের পেলুম, বদ্রী ফিরে আসছে। তখন এভাবে পালিয়ে আসার কারণ বুঝতে পারলুম। বুড়োর কি সারা শরীরে অজস্র চোখ আছে?

ভেতরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন কর্নেল। তারপর পকেটের সেই চকপাথর বের করে টেবিলে খস খস করে যা লিখলেন, পড়ে দেখে আমি শিউরে উঠলুম। শরীর হিম হয়ে গেল।

কর্নেল লিখেছেন : বদ্রীর ঘরে একটা লাশ আছে।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম ওঁর মুখের দিকে। এ কি সাংঘাতিক ব্যাপার! তাহলে কি আমরা এখানে এসে এক রক্তপাগল খুনীর পাল্লায় পড়ে গেছি? আর এ লাশটাই বা কার হতে পারে? কর্নেল গুম হয়ে বসে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন।

একটু পরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলুম, কার লাস? শমীকবাবুর নাকি?

কর্নেল মাথাটা দোলালেন।

আরও ঘাবড়ে গিয়ে বললুম– সর্বনাশ! কিন্তু আপনি টের পেলেন কীভাবে?

কর্নেল লিখলেন : প্রশ্ন নয়। চুপচাপ থাকো। বদ্রীকে কফি দিতে বলল।

আমার আর সাহস হচ্ছিল না বেরুতে এবং বদ্রীর মুখোমুখি দাঁড়াতে। ভোজালির কোপ ঝাড়লেই হলো। ব্যাটা যে এমন সাংঘাতিক খুনী কে জানত! অমন অমায়িক হাসিখুশি চেহারা। আর পেটে এই সাংঘাতিক হননেচ্ছা!

ইতস্তত করছি দেখে কর্নেল থামলেন। স্বরভঙ্গ না হলে দারুণরকমের রসিকতা করতেন, সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা গেল।

দরজায় উঁকি মেরে ডাকলুম, বদ্রী! বদ্রী!

ওপাশ থেকে সাড়া এল, যাই স্যার!

কফি চাই বদ্রী! জলদি।

আচ্ছা! বদ্রী জবাব দিল।

বাইরে  আলো জ্বলে উঠল একটু পরে। ইতিমধ্যে আমি চাপা গলায় জনৈক রাণাসাহেবের আগমন ও বদ্রীর সঙ্গে তার কথোপকথন জানিয়ে দিলুম কর্নেলকে। কর্ণেল নিরুত্তর এবং নির্বিকার।

আবার লাশটার কথা ভাবতে থাকলুম। আশ্চর্য, দুপুরঅব্দি এ বাংলোয় পুলিশের সমাগম ছিল। কত জেরা, কত খোঁজখবর হলো। অথচ কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, ওপাশে বদ্রীর ঘরের ভেতর আরেকটা লাশ লুকোনো রয়েছে!

বদ্রী কফি নিয়ে এল। কিন্তু মুখটা ভারি গম্ভীর। জিজ্ঞেস করল, রাতে কি খানার বন্দোবস্ত করতে হবে?

ওর হাতে খেতে আমার বাধছিল। ভাগ্যিস কর্নেল ইশারায় জানিয়ে দিলেন, তবিয়ত ঠিক নেই। কিছু খাবেন না। আমিও বলে দিলুম, শরীর খারাপ। খাব না।

বদ্রী দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো কিছু আঁচ করতে চাইল। তারপর চুপচাপ বেরিয়ে গেল।

ফিসফিস করে বললুম– কর্নেল! পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল না কি?

 কর্নেল ঘড়ি দেখে মাথাটা রহস্যজনক ভঙ্গিতে দোলালেন শুধু।…