» » ষষ্ঠ অধ্যায় : বেগম বৃত্তান্ত

বর্ণাকার

মুন্নি বেগম

যদিও এ গ্রন্থে স্বাধীন নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিবৃত্ত আমাদের আলোচ্য বিষয়, তাই মীরজাফর বা তাঁর বেগম মুন্নি আমাদের আওতায় ঠিক পড়ে না। তবু মুর্শিদাবাদের বেগম বৃত্তান্ত আলোচনা করতে গিয়ে মুন্নি বেগমকে বাদ দিলে তাতে কিছুটা অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। কারণ মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে মুন্নি বেগমের জীবনই বোধ হয় সবচেয়ে বর্ণময় ও রোমাঞ্চকর। মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি চতুর, কৌশলী, বুদ্ধিমতী, স্বার্থান্বেষী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্না ছিলেন। তাই তিনি মীরজাফরের বিবাহিতা স্ত্রী না হয়েও তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী শা’ খানমকে ম্লান করে দিয়ে মীরজাফরের প্রধানা বেগম হয়ে ওঠেন।1

মুন্নি বেগমের জীবন অনেকটাই সরদানার প্রখ্যাত রানী সমরুর মতো। গরিবের ঘরে জন্ম, দারিদ্রের মধ্যে শিশুকাল আর পরবর্তী জীবনে ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের চূড়ায়— যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে এসেছেন। সিকান্দ্রার কাছে বলকুণ্ডা নামের এক অখ্যাত গ্রামের এক গরিব বিধবার সন্তান তিনি। দারিদ্রের জন্য বিধবা মা ছোটবেলাতেই তাঁকে একজন আমিরের বিশু নামে এক ক্রীতদাসীর কাছে বিক্রি করে দেন। বিশু পাঁচ বছর দিল্লিতে ছিলেন এবং সেখানে মুন্নিকে নাচগানে তালিম দেন। কিছুদিনের মধ্যে মুন্নির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আনুমানিক ১৭৪৬ সালের আগস্ট মাসে নওয়াজিস মহম্মদ খান তাঁর দত্তকপুত্র এক্রামুদ্দৌল্লার বিয়ে উপলক্ষে মুন্নিসহ বিশুর নর্তকীর দলকে দশ হাজার টাকা দিয়ে মুজরো করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসেন। এরপর মুন্নি ও বিশুর দল ওখানেই থেকে যায় এবং আমির ওমরাহদের মনোরঞ্জন করতে থাকে। মীরজাফর মাসে পাঁচশো টাকা দিয়ে দলটিকে নিজের দরবারের জন্য নিয়োগ করলেন। কিন্তু নিজে মুন্নির রূপ ও গানে এতই মোহিত হয়ে পড়লেন যে তাঁকে নিজের হারেমে নিয়ে এলেন। আর মুন্নি সুকৌশলে মীরজাফরকে বশীভূত করে তাঁর প্রধানা বেগম হয়ে ওঠেন, যার ফলে মীরজাফর পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের পর তাঁর মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ থেকে যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ আত্মসাৎ করেছিলেন, তাঁর পুরোটারই অধিকারী হতে পেরেছিলেন।

১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মীরজাফরের মৃত্যু হয়। তাঁর স্ত্রী বব্বু বেগমের মুবারকউদ্দৌল্লা নামে এক পুত্র ও মুন্নি বেগমের দুই পুত্র ছিল—নজমউদ্দৌল্লা ও সইফউদ্দৌল্লা। মুন্নি বেগম কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের প্রচুর পরিমাণ ঘুষ দিয়ে নিজের পুত্র নজমউদ্দৌল্লাকে মসনদে বসবার ব্যবস্থা করলেন। কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিল মীরজাফর পুত্র মীরণের একমাত্র বৈধ পুত্রের নবাব হওয়ার ন্যায্য দাবি নস্যাৎ করে মুন্নি বেগমের ১৫ বছরের পুত্র নজমউদ্দৌল্লাকে নবাব করে দিল। কিন্তু নজমউদ্দৌল্লা জ্বর হয়ে ১৭৬৬ সালের ৮ মে মারা যান। এরপর তাঁর ছোটভাই নবাব হলেন। ১৭৭০ সালের মার্চ মাসে তারও অকাল মৃত্যু হয়। ফলে বন্ধু বেগমের ১২ বছরের পুত্র মুবারকউদ্দৌল্লা মসনদে বসেন। বলা বাহুল্য, তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই পুত্র নবাব থাকাকালীন মুন্নি বেগমের হাতেই ছিল সব ক্ষমতা, তিনিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। বব্বু বেগম একেবারে অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য হলেন।

কিন্তু মুবারকউদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর মুন্নি বেগমের ক্ষমতার অবসান হল। ক্ষমতায় থাকাকালীন মুন্নি বেগম নায়েব দেওয়ান ও ডেপুটি গভর্নর মহম্মদ রেজা খানকে বেশ অবজ্ঞা করেই চলতেন। এখন সুযোগ বুঝে রেজা খান তাঁর প্রতিশোধ নিলেন। কিছুটা তাঁরই প্ররোচনায় গভর্নর কার্টিয়ার আদেশ দিলেন যে এখন যেহেতু মুবারকউদ্দৌল্লাই নবাব, তাঁর মা বব্বু বেগমের হাতেই মুন্নি বেগমকে সব ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে— তাঁকে এখন বব্বু বেগমকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলে মানতে হবে। কিন্তু তাতে মুন্নি বেগম বিশেষ হতাশ হননি কারণ সুচতুর এই মহিলা জানতেন, একদিন না একদিন সুযোগ আসবেই, ধৈর্য ধরে শুধু অপেক্ষা করতে হবে। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন এসময়ের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন:

…whose [Munni Begam’s] extent of understanding nothing can be compared to, but the immense stock which is known to be possessed of in jewels and money, thought proper to take no notice of such an alteration; and although deeply wounded by such underhand deal ings, she thought it beneath her dignity to descend to an explanation; and she passed the whole over with a disdainful silence.

কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানির কর্মচারীদের রদবদল হল। ১৭৭২ সালের এপ্রিল মাসে কার্টিয়ারের জায়গায় গভর্নর হিসেবে যোগ দিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি কলকাতায় এসে লন্ডনের নির্দেশমতো নিজামতের তহবিল আত্মসাৎ ও তছরুপ করার অভিযোগে রেজা খানকে বন্দি করলেন। আর ওদিকে নবাবের নিজের মা বব্বু বেগমের হাত থেকে নিজামতের সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা আবার মুন্নি বেগমকে দেওয়া হল। মুন্নি বেগমের বয়স তখন ৫০। তাঁর সাম্মানিক ধার্য হল বছরে ১,৪০,০০০ টাকা আর তাঁর সাহায্যকারী মহারাজ নন্দকুমারের পুত্র রাজা গুরুদাসের বেতন বছরে ১,০০,০০০ টাকা। শোনা যায় যে মুন্নি বেগম হেস্টিংসকে প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে এ কাজ করিয়েছিলেন। এর মধ্যে হয়তো কিছুটা সত্য আছে কিন্তু এর পেছনে হেস্টিংসের অন্য মতলবও ছিল। লন্ডনে কোম্পানির পরিচালক সমিতির সিক্রেট কমিটিকে তাঁর লেখা একটা চিঠিতে সেটা পরিষ্কার:

The Begam as a woman, is incapable of passing the bounds assigned her; her ambition cannot aspire in higher dignity. She has no children to provide for, or mislead her fidelity; her actual authority rests on the Nawab’s life, and therefore cannot endanger it. It must cease with his minority, when she must depend absolutely on the Company for sup-port against her ward and pupil, who will then become her master. Of course her interest must lead her to concur with all the designs of the Company and to solicit their patronage.

কিন্তু মুন্নি বেগমের এই সৌভাগ্য বেশি দিন স্থায়ী হল না। দু’বছর পরে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত হলেন বটে কিন্তু যে নতুন কাউন্সিল হল, তাতে তিনজন সদস্যই হেস্টিংস-বিরোধী। তারা মুন্নি বেগমকে অপসারণ করে আবার বব্বু বেগমকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। এতে হেস্টিংস খুবই মর্মাহত হন। মুন্নি অবশ্য বরাবরই হেস্টিংসের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন এবং তাঁর বিপদে আপদে সবসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। হেস্টিংসও অবশ্য তাঁর প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকী ১৭৮৩ সালে ভারতবর্ষ ছাড়ার আগে তিনি লন্ডনের পরিচালক সমিতির কাছে মুন্নি বেগমের প্রশংসা করে এবং বৃদ্ধ বয়সে তিনি যেন একটু আরামে থাকতে পারেন তাঁর জন্য ওঁর ভাতা যেন বাড়িয়ে দেওয়া হয়, সে অনুরোধ জানান। মুন্নি বেগমের একটি আর্জিও এ চিঠির সঙ্গে পাঠানো হয়। তাতে অবশ্য খুব একটা ফল হয়নি—মুন্নি বেগমের মাসিক ভাতা ঠিক হল ১২,০০০ টাকা। সেটা এবং নিজের সঞ্চিত ধনভাণ্ডার দিয়ে সত্যিকারের বেগম ও রানির মতোই তিনি মুর্শিদাবাদে জীবন কাটাতে লাগলেন। তাঁকে কেউ ভালবাসত না কিন্তু নবাব থেকে সবাই তাঁকে ভয় করত।

মুন্নি বেগম আনুমানিক ৯৭ বছর বয়সে ১৮১৩ সালের ১০ জানুয়ারি মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির মোট মূল্য ছিল ১৫ লক্ষ টাকার ওপর। জাফরাগঞ্জে মীরজাফরের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয়। মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের দক্ষিণপূর্বে চক মসজিদ মুন্নি বেগম তৈরি করিয়েছিলেন। এটাই মুর্শিদাবাদের বৃহত্তম মসজিদ। নবাব সুজাউদ্দিনের প্রাসাদ চেহেল সুতুনের ধ্বংসাবশেষের ওপর এটি তৈরি হয় ১৭৬৭ সালে। মুন্নি বেগমকে কোম্পানির জননী আখ্যা দেওয়া হয়। তাঁর স্বামী নবাব মীরজাফরের মৃত্যুর পর তিনি যখন শোকে মুহ্যমান তখন লর্ড ক্লাইভ নাকি তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে, ‘আমি মৃত নবাবকে বাঁচিয়ে তুলতে পারব না কিন্তু আপনাকে আন্তরিকভাবে জানাচ্ছি যে আমি এবং এখানকার আমার ইংরেজ সহকর্মীরা আমাদের আপনার সন্তান বলেই মনে করি, আপনাকে আমরা আমাদের জননী বলে জানি।’ বস্তুতপক্ষে ক্লাইভ এবং হেস্টিংস দুজনেই মুন্নি বেগমকে বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখতেন এবং তাঁর প্রতি যথেষ্ট সদয় ছিলেন। সত্যি বলতে গেলে মুন্নি বেগমের জীবনের মতো বারবার এমন উত্থানপতন, এমন বৈচিত্র্যে ভরা বর্ণময় জীবন মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে দেখা যায়নি। তাই আজও তাঁর স্মৃতি অমলিন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. এর পরের অংশটি মূলত B. N. Banerjee, Begams of Bengal এবং সিয়র অবলম্বনে লেখা। তাই সূত্রনির্দেশ ও টীকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।