» » ময়ূরাক্ষী

বর্ণাকার

হুমায়ূন আহমেদ

ময়ূরাক্ষী

চার

বড়ফুপুর বাসায় দুপুরে যাবার কথা।

উপস্থিত হলাম রাত আটটায়। কেউ অবাক হলো না। ফুপুর বড়ছেলে বাদল আমাকে দেখে উল্লসিত গলায় বলল, হিমুদা এসেছ? থ্যাংকস। অনেক কথা আছে, আজ থাকবে কিন্তু। আই নিড ইওর হেল্প।

বাদল এবার ইণ্টারমিডিয়েট দেবে। এর আগেও তিনবার দিয়েছে। সে পড়াশোনায় খুবই ভালো। এস.এস.সি-তে বেশ কয়েকটা লেটার এবং স্টার মার্কস পেয়েছে। সমস্যা হয়েছে ইণ্টারমিডিয়েটে। পরীক্ষা শেষপর্যন্ত দিতে পারে না। মাঝামাঝি জায়গায় তার একধরনের নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যায়। তার কাছে মনে হয় পরীক্ষার হল হঠাৎ ছোট হতে শুরু করে। ঘরটা ছোট হয়। পরীক্ষার্থীরাও ছোট হয়। চেয়ার-টেবিল সব ছোট হতে থাকে। তখন সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে আসামাত্রই দেখে সব স্বাভাবিক। তখন সে আর পরীক্ষার হলে ঢোকে না। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি চলে আসে।

দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেবার সময় অনেক ডাক্তার দেখানো হলো। অষুধপত্র খাওয়ানো হলো। সেবারও একই অবস্থা। এখন আবার পরীক্ষা দেবে। এবারে ডাক্তারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পীর-ফকির। বাদলের গলায়, হাতে, কোমরে নানান মাপের তাবিজ ঝুলছে। এর মধ্যে একটা তাবিজ না-কি জিন-কে দিয়ে কোহকাফ নগর থেকে আনানো। কোহকাফ নগরীতে না-কি জিন এবং পরীরা থাকে। আমার বড়ফুপা ঘোর নাস্তিক ধরনের মানুষ এবং বেশ ভালো ডাক্তার। তিনিও কিছু বলছেন না।

বাদলেরও দেখি আমার মতো অবস্থা দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে হুলস্থুল। লম্বা লম্বা চুল। সে খুশি-খুশি গলায় বলল, হিমুদা, আমি পড়াশোনা করছি। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমার ঘরে চলে আসবে।

পড়াশোনা হচ্ছে কেমন?

হেভি হচ্ছে। একই জিনিস তিন-চার বছর ধরে পড়ছি তো, একেবারে ঝাড়া ঝাড়া হয়ে গেছে। হিমুভাই, তুমি এমন ডার্ক হলুদ পাঞ্জাবি কোথায় পেলে?

গাউছিয়ায়।

ফাইন দেখাচ্ছে। সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী লাগছে—সন্ন্যাসী উপগুপ্ত, মথুরাপুরীর প্রাচীরের নিচে একদা ছিলেন সুপ্ত।

যা, পড়াশোনা কর। আমি আসছি।

কী আর পড়াশোনা করব। সব তো ভাজা ভাজা।

তবু আরেকবার ভেজে ফেল। কড়া ভাজা হবে।

বাদল শব্দ করে হেসে উঠল। সেই হাসি হেচকির মতো চলতেই থাকল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এই ছেলের অবস্থা দেখি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এতক্ষণ ধরে কেউ হাসে?

ফুপু গম্ভীরমুখে খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে দুপুরে প্রচুর আয়োজন ছিল। সেই সব গরম করে দেয়া হচ্ছে। পোলাওয়ে টক-টক গন্ধ। নষ্ট হয়ে গেছে কিনা কে জানে? আমার পেটে অবশ্যি সবই হজম হয়ে যায়। পোলাওটা মনে হচ্ছে হবে না। কষ্ট দেবে।

ফুপু বললেন, রোস্ট আরেক পিস দেব?

দাও।

এত খাবারদাবারের আয়োজন কী জন্যে একবার জিজ্ঞেস করলি না?

আমি খাওয়া বন্ধ করে বললাম, কী জন্যে?

আত্মীয়স্বজন যখন কোনো উপলক্ষে খেতে ডাকে তখন জিজ্ঞেস করতে হয় উপলক্ষটা কী? যখন আসতে বলে তখন আসতে হয়।

একটা ঝামেলায় আটকে পড়েছিলাম। উপলক্ষটা কী?

রিনকির বিয়ের কথা পাকা হলো।

বাহ্, ভালো তো।

ফুপু গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমি খেয়েই যাচ্ছি। টক গন্ধ পোলাও এত খাওয়া ঠিক হচ্ছে না, সেটাও বুঝতে পারছি। তবু নিজেকে সামলাতে পারছি না। যা হবার হবে। ফুপু শীতল গলায় বললেন, একবার তো জিজ্ঞেস করলি না কার সঙ্গে বিয়ে, কী সমাচার।

তোমরা নিশ্চয় দেখেশুনে ভালো বিয়েই দিচ্ছ।

তুই একবার জিজ্ঞেসও করবি না? তোর কোনো কৌতূহলও নেই?

আরে কী বল, কৌতূহল নেই! আসলে এত ক্ষুধার্ত যে কোনোদিকে মন দিতে পারছি না। দুপুরে খাওয়া হয়নি। ছেলে করে কী?

মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।

বল কী! তাহলে তো মালদার পার্টি।

ফুপু রাগী গলায় বললেন, ছোটলোকের মতো কথা বলবি না তো, মালদার পার্টি আবার কী?

পয়সাঅলা পার্টি, এই বলছি।

হ্যাঁ, টাকাপয়সা ভালোই আছে।

শর্ট না তো? আমার কেন জানি মনে হতো—একটা শর্ট টাইপের ছেলের সাথে রিনকির বিয়ে হবে। ছেলের হাইট কত?

ফুপুর মুখটা কালো হয়ে গেল। তিনি নিচু গলায় বললেন, হাইট একটু কম। উঁচু জুতা পরলে বোঝা যায় না।

বোঝা না গেলে তো কোনো সমস্যাই নেই। তাছাড়া বেঁটে লোক খুব ইন্টেলিজেন্ট হয়। যত লম্বা হয় বুদ্ধি তত কমতে থাকে। আমি এখন পর্যন্ত কোনো বুদ্ধিমান লম্বা মানুষ দেখিনি। সত্যি বলছি।

ফুপুর মুখ আরো অন্ধকার হয়ে গেল। তখন মনে পড়ল—কী সর্বনাশ! ফুপা নিজেই বিরাট লম্বা। প্রায় ছ-ফুট। আজ দেখি একের-পর-এক ঝামেলা বাঁধিয়ে যাচ্ছি।

তুই যাবার আগে তোর ফুপার সঙ্গে কথা বলে যাবি। তোর সঙ্গে নাকি কী জরুরি কথা আছে।

নো প্রবলেম।

আর রিনকির সঙ্গে কথা বলার সময় জামাই লম্বা কি বেঁটে এ জাতীয় কোনো কথাই বলবি না।

বেঁটে লোকেরা যে জ্ঞানী হয় এই কথাটা ঠিক কায়দা করে বলব?

তোর কিছুই বলার দরকার নেই।

ঠিক আছে ঠাণ্ডা পেপসি-টেপসি থাকলে দাও। তোমরা তো কেউ পান খাও না। কাউকে দিয়ে তিনটা পান আনাও তো।