☼ হুমায়ূন আহমেদ ☼
ময়ূরাক্ষী
দশ
প্রায় দশদিন পর আস্তানায় ফিরলাম।
আস্তানা মানে মজিদের মেস—দি নিউ বোর্ডিং হাউস।
মজিদ ঐ বোডিং হাউসে দীর্ঘদিন ধরে আছে। কলেজে যখন পড়তে আসে তখন এই অন্ধ গহ্বর খুঁজে বের করে। নামমাত্র ভাড়ায় একটা ঘর। সেই ঘরে একটা চৌকি, একটা টেবিল। চেয়ারের ব্যবস্থা নেই কারণ চেয়ার পাতার জায়গা নেই।
মজিদের চৌকিতে একটা শীতল পাটি শীত গ্রীষ্ম সবসময় পাতা থাকে। মশারি ও খাটানো থাকে। প্রতিদিন মশারি তোলা এবং মশারি ফেলার সময় মজিদের নেই। তাকে সকাল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত নানান ধান্ধায় ঘুরতে হয়, প্রতিমাসে তিনটি মানিঅর্ডার করতে হয়। একটা দেশের বাড়িতে, একটা তার বিধবা বড়বোনের কাছে এবং তৃতীয়টি আবু কামাল বলে এক ভদ্রলোককে। এই ভদ্রলোক মজিদের কোনো আত্মীয় নন। তাকে প্রতিমাসে কেন টাকা পাঠাতে হয় তা মজিদ কখনো বলেনি। জিজ্ঞেস করলে হাসে। এইসব রহস্যের কারণেই মজিদকে আমার বেশ পছন্দ।
আমাকে মজিদের পছন্দ কিনা আমি জানি না। সে মানুষের সঙ্গে সম্পূর্ণ অনাগ্রহ নিয়ে মেশে। কোনো কিছুতেই অবাক বা বিস্ময় প্রকাশ করে না। সম্ভবত শৈশবেই তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় তাকে একবার একটা ম্যাজিক শো দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাচ এক যাদুকর জার্মান কালচারাল সেণ্টারে যাদু দেখাচ্ছেন। বিস্ময়কর কাণ্ডকারখানা একের-পর-এক ঘটে যাচ্ছে। একসময় তিনি তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে করাত দিয়ে কেটে দু-টুকরা করে ফেললেন। ভয়াবহ ব্যাপার। মহিলা দর্শকরা ভয়ে ‘উ উ’ জাতীয় শব্দ করছে। তাকিয়ে দেখি মজিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্ষীণ নাক ডাকার শব্দও আসছে। আমি চিমটি কেটে তার ঘুম ভাঙালাম। সে বলল, কী হয়েছে?
আমি বললাম, করাত দিয়ে মানুষ কাটা হচ্ছে।
মজিদ হাই তুলে বলল, ও আচ্ছা।
সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। অথচ আমি অনেক ঝামেলা করে দুটা টিকিট জোগাড় করেছি যাতে একবার অন্তত সে বিস্মিত হয়। আমার ধারণা, তাজমহলের সামনেও তাকে যদি নিয়ে যাওয়া হয় সে হাই চাপতে চাপতে বলবে, ও আচ্ছা, এটাই তাজমহল! ভালোই তো। মন্দ কী।
মজিদকে আমার একবার তাজমহল দেখানোর ইচ্ছা। শুধু দেখার জন্যে সত্যি সত্যি সে কী করে। বা আসলেই কিছু করে কিনা।
দশদিন পর মজিদের সঙ্গে আমার দেখা—সে একবার মাত্র মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। তার পরপরই পত্রিকা পড়তে লাগল। বছরখানিক আগের বাসি একটা ম্যাগাজিন। একবার জিজ্ঞেস করল না, আমার খবর কী? আমি কেমন। এতদিন কোথায় ছিলাম।
আমি বললাম, তোর খবর কী রে মজিদ?
মজিদ এ প্রশ্নের উত্তর দিল না। অপ্রয়োজনীয় কোনো প্রশ্নের উত্তর সে দেয় না।
তোর আজ টিউশনি নেই? ঘরে বসে আছিস যে?
আজ শুক্রবার।
তখন মনে পড়ল ছুটির দিনে যখন হাতে তার কোনো কাজ থাকে না, তখনই সে ম্যাগাজিন জোগাড় করে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ঘুমায়, আবার জেগে উঠে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়, কিছুক্ষণ পর আবার ঘুমিয়ে পড়ে। জীবনের কাছে তার যেন কিছুই চাওয়ার বা পাওয়ার নেই। চার-পাঁচটা টিউশনি, মাঝেমধ্যে কিছু খুচরা কাজ এবং প্রুফ দেখার কাজেই সে খুশি। বিএ পাস করার পর কিছুদিন সে চাকরির চেষ্টা করেছিল। তারপর—ধুর আমার হবে না এই বলে সব ছেড়েছুঁড়ে দিল।
আমি একবার বলেছিলাম, সারাজীবন এই করেই কাটাবি নাকি? সে বলল, অসুবিধা কী? তুই তো কিছু না করেই কাটাচ্ছিস।
আমার অবস্থা ভিন্ন। আমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই, তাছাড়া আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি, তুই তো কিছু করছিস না।
মজিদ কিছুই বলল না। আমি ভেবেছিলাম, একবার হয়তো জিজ্ঞেস করবে কিসের এক্সপেরিমেন্ট, তাও করল না। আসলেই তার জীবনে কোনো কৌতূহল নেই।
রূপাকে অনেক বলে-কয়ে একবার রাজি করেছিলাম যাতে সে মজিদকে নিয়ে চিড়িয়াখানা থেকে ঘুরে আসে। আমার দেখার ইচ্ছা একটি অসম্ভব রূপবতী এবং বুদ্ধিমতী মেয়েকে পাশে পেয়ে তার মনের ভাব কী হয়। আগের মতোই সে কি নির্লিপ্ত থাকে, না জীবন সম্পর্কে খানিকটা হলেও আগ্রহী হয়।
আমার প্রস্তাবে রূপা প্রথমে খুব রাগ করল। চোখ তীক্ষ্ণ করে বলল, তুমি নিজে কখনো আমাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় গিয়েছ? চিনি না জানি না একটা ছেলেকে নিয়ে আমি যাব। তুমি আমাকে পেয়েছ কী?
সে যতই রাগ করে, আমি ততই হাসি। রূপাকে ঠাণ্ডা করার এই একটা পথ। সে যত রাগ করবে আমি তত হাসব। আমার হাসি দেখে আরো রাগবে। আমি আরো হাসব। সে হাল ছেড়ে দেবে। এবারো তাই হলো। সে মজিদকে নিয়ে যেতে রাজি হলো। আমি এক ছুটির দিনে মজিদকে বললাম, তুই চিড়িয়াখানা থেকে ঘুরে আয়। পত্রিকায় দেখলাম জিরাফ এসেছে।
মজিদ বলল, জিরাফ দেখে কী হবে?
কিছুই হবে না। তবু দেখে আয়।
ইচ্ছা করছে না।
আমার এক দূর-সম্পর্কের ফুপাতো বোন—বেচারির চিড়িয়াখানা দেখার শখ। সঙ্গে কোনো পুরুষমানুষ না-থাকায় যেতে পারছে না। আমার আবার জন্তু-জানোয়ার ভালো লাগে না। তুই তাকে নিয়ে যা।
মজিদ বলল, আচ্ছা।
আমার ধারণা ছিল রূপাকে দেখেই মজিদ একটা ধাক্কা খাবে। সেরকম কিছুই হলো না। রূপা গাড়ি নিয়ে এসেছিল। মজিদ গম্ভীর মুখে ড্রাইভারের পাশে বসল।
রূপা হাসিমুখে বলল, আপনি সামনে বসেছেন কেন? পেছনে আসুন। দুজন গল্প করতে করতে যাই। মজিদ বলল, আচ্ছা।
পেছনে এসে বসল। তার মুখ ভাবলেশহীন। একবার ভালো করে দেখলও না তার পাশে যে বসে আছে সে মানবী না অপ্সরী।
ফিরে আসার পর জিজ্ঞেস করলাম, কেমন দেখলি?
ভালোই।
কথা হয়েছে রূপার সঙ্গে?
হুঁ।
কী কথা হলো?
মনে নেই।
আচ্ছা, রূপার পরনে কী রঙের শাড়ি ছিল বল তো?
লক্ষ্য করিনি তো।
আমি মজিদের সঙ্গে অনেক সময় কাটাই। রাতে তার সঙ্গে এক চৌকিতে ঘুমাই। তার কাছ থেকে শিখতে চেষ্টা করি কী করে আশেপাশের জগৎ সম্পর্কে পুরোপুরি নির্লিপ্ত হওয়া যায়। সাধু-সন্ন্যাসীরা অনেক সাধনায় যে স্তরে পৌঁছেন মজিদ সে স্তরটি কী করে এত সহজে অতিক্রম করল তা আমার জানতে ইচ্ছা করে।
আমার বাবা তাঁর খাতায় আমার জন্যে যেসব উপদেশ লিখে রেখে গেছেন তার মধ্যে একটার শিরোনাম হচ্ছে—নির্লিপ্ততা। তিনি লিখেছেন :
নির্লিপ্ততা
পৃথিবীর সকল মহাপুরুষ এবং মহাজ্ঞানীরা এই জগৎকে মায়া বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। আমি আমার ক্ষুদ্র চিন্তা ও ক্ষুদ্র বিবেচনায় দেখিয়াছি আসলেই মায়া। স্বামী ও স্ত্রীর প্রেম যেমন মায়া বই কিছুই নয়, ভ্রাতা ও ভগ্নির স্নেহ-সম্পর্কও তাই। যে-কারণে স্বার্থে আঘাত লাগিবা মাত্র স্বামী-স্ত্রীর প্রেম বা ভ্রাতা-ভগ্নির ভালোবাসা কর্পূরের মতো উড়িয়া যায়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীর সর্ব বিষয়ে পুরোপুরি নির্লিপ্ত হইতে হইবে। কোনোকিছুর প্রতিই তুমি যেমন আগ্রহ বোধ করিবে না আবার অনাগ্রহও বোধ করিবে না। মানুষ মায়ার দাস। সেই দাসত্ব-শৃঙ্খল তোমাকে ভাঙিতে হইবে। মানুষের অসাধ্য কিছুই নাই। চেষ্টা করিলে তুমি তা পারিবে। তোমার ভিতরে সেই ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা বিকাশের চেষ্টা আমি তোমায় শৈশবেই করিয়াছি। একই সঙ্গে তোমাকে আদর এবং অনাদর করা হইয়াছে। মাতার প্রবল ভালোবাসা হইতেও তুমি বঞ্চিত হইয়াছ। এই সমস্তই একটি বড় পরীক্ষার অংশ। এই পরীক্ষায় সফলকাম হইতে পারিলে প্রমাণ হইবে যে ইচ্ছা করিলে মহাপুরুষদের এই পৃথিবীতে তৈরি করা যায়।
যদি একটি সাধারণ কুকুরকেও যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, সেই কুকুর শিকারি কুকুরে পরিণত হয়। একজন ভালোমানুষ পরিবেশের চাপে ভয়াবহ খুনীতে রূপান্তরিত হয়। যদি তাই হয় তবে কেন আমরা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী মানব সম্প্রদায় তৈরি করিতে পারিব না?