» » ময়ূরাক্ষী

বর্ণাকার

হুমায়ূন আহমেদ

ময়ূরাক্ষী

বার

বড়ফুপু অবাক হয়ে বললেন, তুই কোত্থেকে?

আমি বললাম, আসলাম আর কী। তোমাদের খবর কী?

পনেরোদিন পর উদয় হয়ে বললি, তোমাদের খবর কী? তোর কত খোঁজ করছি। গিয়েছিলি কোথায়?

মজিদের গ্রামের বাড়িতে। মজিদকে নিয়ে তার বাবার কবর জিয়ারত করে এলাম।

মজিদ আবার কে?

তুমি চিনবে না, আমার ফ্রেণ্ড। আমাকে এত খোঁজাখুঁজি করছিলে কেন?

বড়ফুপু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোকে খুঁজছি বাদলের জন্যে। ওকে তুই বাঁচা।

অসুখ?

তুই নিজে গিয়ে দেখ। ও তার পড়ার বইপত্র সব পুড়িয়ে ফেলেছে। এক সপ্তাহ পরে পরীক্ষা।

বল কী?

বাদলের ঘরে গিয়ে দেখি সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই পড়াশুনা করছে। পরিবর্তনের মধ্যে তার মাথার চুল আরো বড় হয়েছে। দাড়িগোঁফ আরো বেড়েছে। গায়ে চকচকে সিল্কের পাঞ্জাবি। বাদল হাসিমুখে আমার দিকে তাকাল।

আমি বললাম, খবর কী রে?

বাদল বলল, খবর তো ভালোই।

তুই নাকি বই পুড়াচ্ছিস?

সব বই তো পুড়াচ্ছি না। যেগুলি পড়া হচ্ছে সেগুলি পুড়িয়ে ফেলছি।

ও আচ্ছা।

বাদল হাসতে হাসতে বলল, মা-বাবা দুজনেরই ধারণা, আমার মাখা খারাপ হয়ে গেছে।

তোর কি ধারণা মাথা ঠিকই আছে?

হ্যাঁ, ঠিক আছে—তবে মাথায় উকুন হয়েছে।

বলিস কী?

মাথা ঝাঁকি দিলে টুপটাপ করে উকুন পড়ে।

বলিস কী?

হ্যাঁ, সত্যি। দেখবে?

থাক থাক, দেখাতে হবে না।

হিমুভাই, তুমি এসেছ, ভালোই হয়েছে—বাবাকে বুঝিয়ে যাও। বাবার ধারণা, আমার সব শেষ।

ফুপা কি বাসায়?

হ্যাঁ বাসায়।

কিছুক্ষণ আগেই আমার ঘরে ছিলেন। নানান কথা বুঝাচ্ছেন।

আমি ফুপার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তাঁর স্বাস্থ্য এই কদিনে মনে হয় আরো ভেঙেছে। চোখের চাউনিতে দিশেহারা ভাব। তিনি আমার দিকে বিষণ্ন চোখে তাকালেন। যে দৃষ্টি বলে দিচ্ছে—তুমিই আমার ছেলের এই অবস্থার জন্যে দায়ী। তোমার জন্যে আমার এই অবস্থা।

কেমন আছেন ফুপা?

ভালো।

রিনকি কোথায়? শ্বশুর বাড়িতে?

হ্যাঁ।

সন্ধ্যাবেলায় ঘরে বসে আছেন যে? প্র্যাকটিসে যাচ্ছেন না?

আর প্র্যাকটিস! সব মাথায় উঠেছে।

আমি ফুপার সামনের চেয়ারে বসলাম। মনে হচ্ছে আজও তিনি খানিকটা মদ্যপান করেছেন। আমি সহজ গলায় বললাম, ফুপা ঐ চাকরিটা কি আছে?

কোন্ চাকরি?

ঐ যে আমাকে বলেছিলেন, বাদলকে আগের অবস্থায় নিয়ে গেলে ব্যবস্থা করে দেবেন।

তুমি চাকরি করবে? নতুন কথা শুনছি।

আমি করব না, আমার এক বন্ধুর জন্যে।

ফুপা চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, বাদলের ব্যাপারটা আমি দেখছি। আপনি ওর চাকরিটা দেখুন।

বাদলের কিছু তুমি করতে পারবে না। ও এখন সমস্ত চিকিৎসার অতীত। বইপত্র পুড়িয়ে ফেলছে। ছাদে আগুন জ্বালিয়েছে। সেই আগুনের সামনে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, আর মাথা থেকে উকুন পড়ছে আগুনে। পটপট শব্দ হচ্ছে। ছি ছি, কী কাণ্ড! আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম। একবার ভাবলাম একটা চড় লাগাই, তারপর মনে হলো, কী লাভ?

ফুপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।

আমি হাসলাম।

ফুপা বললেন, তুমি হাসছ? তোমার কাছে পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হতে পারে। আমার কাছে না।

আমি বাদলের ব্যাপারটা দেখছি। আজই দেখছি, আপনি আমার বন্ধুর চাকরির ব্যাপারটা দেখবেন।

তোমার বন্ধু কি তোমার মতো?

না। ও চমৎকার ছেলে। সাত চড়ে রা নেই টাইপ।