☼ হুমায়ূন আহমেদ ☼
ময়ূরাক্ষী
আট
দুদিন পর আমি মামার সঙ্গে রওনা হলাম।
গন্তব্য ময়মনসিংহের হিরণপুর।
আমার বাবা অনেকবারই বলেছেন, আমার মামারা পিশাচশ্রেণীর। কাজেই তাঁদের সম্পর্কে আগে থেকেই একটা ধারণা মনের মধ্যে ছিল। আমি বড়মামা এবং অন্য দুই মামার আচার-আচরণে মোটেই অবাক হলাম না।
মামার বাড়ি উপস্থিত হবার তৃতীয় দিনের একটা ঘটনার কথা বলি। এই ঘটনা থেকে মামাদের মানসিকতার একটা আঁচ পাওয়া যাবে।
বড়মামার বাড়িতে তিনটা বিড়াল ছিল। এরা খুবই উপদ্রব করত। বড়মামার নির্দেশে বিড়াল তিনটাকে ধরা হলো। তিনি বললেন, হাদিসে আছে বিড়াল উপদ্রব করলে আল্লাহর নামে এদের জবেহ করা যায়। তাতে দোষ হয় না। দেখি বড় ছুরিটা বার কর। এই কাজ তো আর কেউ করবে না। আমাকে করতে হবে। উপায় কী!
মামা নিজেই উঠানে তিনটা বিড়ালকে জবাই করলেন। এর মধ্যে একটা ছিল গর্ভবতী।
ঐ বাড়িতে আমার তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। তিন মামা একসঙ্গে স্কুলঘরের মতো লম্বা একটা টিনের ঘরে থাকতেন। পুরো বাড়িতে ছেলেপুলের বিশাল দল। তাদের জগৎ ছিল ভিন্ন। একসঙ্গে পুকুরে ঝাঁপ দেয়া, একসঙ্গে সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসা, একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া। জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা, গোল্লাছুট খেলা। খাওয়াও হতো একসঙ্গে। এক মামী ভাত দিয়ে যাচ্ছেন, আর-এক মামী দিচ্ছেন একহাতা করে তরকারি, দুইহাতা ডাল। চামুচে যা উঠে আসে তাই। কেউ বলতে পারবে না আমাকে এটা দাও-ওটা দাও। বললেই চামচের বাড়ি।
আমাদের মধ্যে মারামারি লেগেই ছিল। এ ওকে মারছে। সে তাকে মারছে। সেসব নিয়ে কোনো নালিশও হচ্ছে না। নালিশ দেয়ায় বিপদ আছে। একজন নালিশ দিল, কার বিরুদ্ধে নালিশ, কী সমাচার ভালোমতো শোনাই হলো না। হাতের কাছে যে-কয়জনকে পাওয়া গেল পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলা হলো। সত্যিকার অপরাধী হয়তো শাস্তিও পেল না।
আমি এই বিশাল দলের সঙ্গে অবলীলায় মিশে গেলাম। সীমাহীন স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতা সচরাচর শিশুরা পায় না।
আমরা কী করছি না করছি বড়রা তা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাত না।
একজনের হয়তো জ্বর হয়েছে। সে বিছানায় শুয়ে কুঁ কুঁ করছে। কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। নিতান্ত বাড়াবাড়ি না হলে ডাক্তার নেই। মাসে একবার নাপিত এসে সবকটা ছেলের মাথা প্রায় মুড়িয়ে দিয়ে ধান নিয়ে চলে যাচ্ছে। কাপড়-জামারও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এ ওরটা পরছে। ও তারটা পরছে।
মামাদের বাড়ি থেকেই আমি মেট্রিক পাস করি। যে-বছর মেট্রিক পাস করি বড়মামা সেই বছরই মারা যান। তাঁর শত্রুর অভাব ছিল না। বলতে গেলে গ্রামের সবাই ছিল তাঁর শত্রু।
এক অন্ধকার বৃষ্টির রাতে একজন-কেউ মাছ মারবার কোঁচ দিয়ে বড়মামাকে গেঁথে ফেলে। বিশাল কোঁচ। মামার পেট এফোঁড়-ওফোড় হয়ে যায়। কোঁচের খানিকটা পিঠ ছেদা করে বের হয়ে থাকে।
উঠানে চাটাই পেতে মামাকে শুইয়ে রাখা হয়। দৃশ্য দেখার জন্যে সারা গ্রামের লোক ভেঙে পড়ে।
তাঁকে সদরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মহিষের গাড়ির ব্যবস্থা হলো। মামা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এতক্ষণ বাঁচব না। তোমরা আমাকে থানায় নিয়ে যাও। মরার আগে আমি কারা এই কাজ করেছে বলে যেতে চাই।
মামা কাউকেই দেখেননি তবু তিনি মৃত্যুর আগে আগে থানায় ওসির কাছে চারজনের নাম বললেন। তিনি বললেন, তাঁর হাতে টর্চ ছিল। তিনি টর্চ ফেলে ফেলে এদের দেখেছেন।
ওসি সাহেব মামার দেয়া জবানবন্দি লিখতে লিখতে বললেন—ভাই সাহেব, এই কাজটা করবেন না। ডেথ-বেড কনফেসন খুব শক্ত জিনিস। শুধুমাত্র এর ওপরই কোর্ট রায় দিয়ে দেবে। নির্দোষ কিছু মানুষকে আপনি জড়াচ্ছেন। এদের ফাঁসি না হলেও যাবজ্জীবন হয়ে যাবে।
মামা বললেন, যা বলছি সবই সত্যি। কোরান মজিদ আনেন। আমি কোরান মজিদে হাত দিয়া বলি—
ওসি সাহেব বললেন, তার দরকার হবে না। নিন, এখানে সই করুন। এটা আপনার জবানবন্দি।
মামা সই করলেন। মারা গেলেন থানাতেই। মরবার আগে মেঝো মামাকে কানে কানে বললেন—
এক ধাক্কায় চার শত্রু শেষ। কাজটা মন্দ হয় নাই।
চার শত্রু শেষ করার গাঢ় আনন্দ নিয়ে মামা মারা গেলেন। তবে মৃত্যুর আগে আগে মৌলানা ডাকিয়ে তওবা করলেন। তাঁকে খুবই আনন্দিত মনে হলো।
বড়মামী ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলেন, তাঁকে ডেকে বললেন, তওবা করে ফেলছি। এখন আর চিন্তা নাই। সব পাপ মাপ হয়ে গেল। সরাসরি বেহেশতে দাখিল হব। খামাখা কান্দ কেন? তওবা সময়মতো করতে না পারলে অসুবিধা ছিল। আল্লাহপাকের অসীম দয়া! সময় পাওয়া গেছে। কান্দাকাটি না করে আমার কানের কাছে দরুদ পড়। কোরান মজিদ পাঠ কর।
মামার মৃত্যুর পর আমি ঢাকা চলে এলাম। নতুন জীবন শুরু হলো বড়ফুপুর সঙ্গে।