☼ হুমায়ূন আহমেদ ☼
ময়ূরাক্ষী
এক
এ্যাই ছেলে, এ্যাই।
আমি বিরক্ত হয়ে তাকালাম। আমার মুখভর্তি দাড়িগোঁফ। গায়ে চকচকে হলুদ পাঞ্জাবি। পরপর তিনটা পান খেয়েছি বলে ঠোঁট এবং দাঁত লাল হয়ে আছে। হাতে সিগারেট। আমাকে ‘এ্যাই ছেলে’ বলে ডাকার কোনোই কারণ নেই। যিনি ডাকছেন তিনি মধ্যবয়স্কা একজন মহিলা। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। তাঁর সঙ্গে আমার একটি ব্যাপারে মিল আছে। তিনিও পান খাচ্ছেন। আমি বললাম, আমাকে কিছু বলছেন?
তোমার নাম কি টুটুল?
আমি জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এই মহিলাকে আমি আগে কখনো দেখিনি। অথচ তিনি এমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আমি যদি বলি—‘হ্যাঁ আমার নাম টুটুল’, তাহলে ছুটে এসে আমার হাত ধরবেন।
কথা বলছ না কেন? তোমার নাম কি টুটুল?
আমি একটু হাসলাম।
হাসলাম এই আশায় যেন তিনি ধরতে পারেন আমি টুটুল না। হাসিতে খুব সহজেই মানুষকে চেনা যায়। সব মানুষ একই ভঙ্গিতে কাঁদে কিন্তু হাসার সময় একেক জন একেক রকম করে হাসে। আমার হাসি নিশ্চয়ই ঐ টুটুলের হাসির মতো না।
আশ্চর্যের ব্যাপার, এই ভদ্রমহিলা আমার হাসিতে আরো প্রতারিত হলেন। চোখমুখ উজ্জ্বল করে বললেন, ওমা, টুটুলই তো!
ভাবছিলাম তিনি আমার দিকে ছুটে আসবেন। তা না করে ছুটে গেলেন রাস্তার ওপাশে পার্ক-করা গাড়ির দিকে। আমি শুনলাম তিনি বলছেন, তোকে বলিনি ও টুটুল। তুই তো বিশ্বাস করলি না। ওর হাঁটা দেখেই আমি ধরে ফেলেছি। কেমন দুলে দুলে হাঁটছে।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তার এপাশে নিয়ে এলো। ড্রাইভারের পাশের সিটটা খালি। ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, টুটুল, উঠে আয়। আমি উঠে পড়লাম।
বাইরে চৈত্র মাসের ঝাঁঝাঁ রোদ। আমাকে যেতে হবে ফার্মগেট। বাসে উঠলেই মানুষের গায়ের গন্ধে আমার বমি আসে। কাজেই যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। খানিকটা লিফট পাওয়া গেলে মন্দ কী! আমি তো জোর করে গাড়িতে চেপে বসিনি! তাছাড়া—
আমার চিন্তার সুতা কেটে গেল। ভদ্রমহিলার পাশে বসে থাকা মেয়েটি বলল, মা, এ টুটুল ভাই নয়।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ঠিক আগের ভঙ্গিতে হাসলাম। যে হাসি দিয়ে মেয়ের মাকে প্রতারিত করেছিলাম, সেই হাসিতে মেয়েটিকে প্রতারিত করার চেষ্টা। মেয়ে প্রতারিত হলো না। এই যুগের মেয়েদের প্রতারিত করা খুব কঠিন। মেয়েটি দ্বিতীয়বার আগের চেয়েও কঠিন গলায় বলল, মা, তুমি কাকে তুলেছ? এ টুটুল ভাই নয়। হতেই পারে না। এ অন্য কেউ।
ড্রাইভার বারবার সন্দেহজনক চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বললাম, সামনে চোখ রেখে গাড়ি চালাও, অ্যাকসিডেন্ট হবে।
ড্রাইভার আমার গলা এবং কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। সম্ভবত তাকে কেউ তুমি করে বলে না। আমার মতো সাজপোশাকের একজন মানুষ অবলীলায় তাকে তুমি বলছে এটা তার পক্ষে হজম করা কঠিন।
মেয়ের মা বললেন, আচ্ছা, তুমি টুটুল না?
না।
মেয়েটি কঠিন গলায় বলল, তাহলে টুটুল সেজে গাড়িতে উঠে বসলেন যে? টুটুল সেজে গাড়িতে উঠতে যাব কেন? আপনার মা উঠতে বললেন। উঠলাম। মেয়েটি তীব্র গলায় বলল—ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি থামান তো। ইনাকে নামিয়ে দিন।
যা ভেবেছিলাম, তাই। এই ড্রাইভারকে সবাই আপনি করে বলে। ড্রাইভার মনে মনে হয়তো এরকম হুকুমের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে ফেলল। বড় সাহেবদের মতো ভঙ্গিতে বলল, নামেন।
গাড়ি থেকে জোর করে নামিয়ে দেবে—এটা সহ্য করা বেশ কঠিন। তবে এ জাতীয় অপমান সহ্য করা আমার অভ্যাস হয়ে আছে। আমাকে এবং মজিদকে একবার এক বিয়েবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। কনের এক আত্মীয় চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, জানেন, আমরা আপনাকে পুলিশে হ্যাণ্ডওভার করতে পারি। ভদ্রবেশী জোচ্চোরকে কীভাবে ঠাণ্ডা করতে হয় আমি জানি। সেই অপমানের তুলনায় গাড়ি থেকে বের করে দেওয়া তো কিছুই না।
ড্রাইভার রুক্ষ গলায় বলল, ব্রাদার নামুন।
সূর্যের চেয়ে বালি গরম একেই বলে। আমি ড্রাইভারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি ফার্মগেটে যাব। ঐখানে কোনো এক জায়গায় নামিয়ে দিলেই হবে।
আমরা ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছি না।
কোন দিকে যাবেন?
তা দিয়ে আপনার কী দরকার নামুন বলছি।
না নামলে কী করবেন?
আমি এইবার ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। আমার মনে ক্ষীণ আশা, ভদ্রমহিলা বলবেন, এই ছেলে যেখানে যেতে চায় সেখানে নামিয়ে দিলেই হয়। এত কথার দরকার কী? ভদ্রমহিলা তা করলেন না। তিনি অত্যন্ত অপ্রস্তুত বোধ করছেন। অপরাধী ভঙ্গিতে মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন। সম্ভবত তিনি মেয়েকে ভয় পান। আজকাল অধিকাংশ মায়েরাই মেয়েদের ভয় পায়।
ড্রাইভার বলল, নামতে বলছে, নামেন না।
আমি হুংকার দিয়ে উঠলাম, চুপ ব্যাটা ফাজিল। এক চড় দিয়ে চোয়াল ভেঙে দেব। আমাকে চিনিস? চিনিস তুই আমাকে?
ড্রাইভারের চোখমুখ শুকিয়ে গেল। বড়লোকের ড্রাইভার এবং দারোয়ান এরা খুব ভীতু প্রকৃতির হয়। সামান্য ধমকাধমকিতেই এদের পিলে চমকে যায়। আমার কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে ছোট্ট নোটবইটা চেপে ধরলাম। ভাবটা এরকম যেন কোনো ভয়াবহ অস্ত্র আমার হাতে। আমি ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বললাম, এই ব্যাটা, গাড়ি স্টার্ট দে। আজ আমি তোর বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।
ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট দিল। এই ব্যাটা দেখছি ভীতুর যম। বারবার আমার ব্যাগটার দিকে তাকাচ্ছে। আমি বললাম, সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালা হারামজাদা। অ্যাকসিডেন্ট করবি।
আমি এবার পেছনের দিকে তাকালাম। কড়া গলায় বললাম, আদর করে গাড়িতে তুলে পথে নামিয়ে দেওয়া, এটা কোন ধরনের ভদ্রতা?
ভদ্রমহিলা বা তার মেয়ে দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না। ভয় শুধু ড্রাইভার একা পায়নি—এরা দুজনও পেয়েছে। মেয়েটাকে শুরুতে তেমন সুন্দর মনে হয়নি। এখন দেখতে বেশ ভালো লাগছে। গাড়ি-চড়া মেয়েগুলি সবসময় এত সুন্দর মনে হয় কেন? তবে এই মেয়েটার গায়ের রং আরেকটু কম ফরসা হলে ভালো হতো। চোখ অবশ্যি সুন্দর। এমনও হতে পারে, ভয় পাওয়ার জন্যে সুন্দর লাগছে। ভীত হরিণীর চোখ যেমন সুন্দর হয়, ভীত তরুণীর চোখও বোধহয় সুন্দর হয়। ভয় পেলেই হয়তো-বা চোখ সুন্দর হয়ে যায়।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, গাড়িতে খানিকটা ঘুরব। জাস্ট ইউনিভার্সিটি এলাকায় একটা চক্কর দিয়ে তারপর যাব ফার্মগেট।
কেউ কোনো কথা বলল না।
আমি বললাম, গাড়িতে কোনো গান শোনার ব্যবস্থা নেই? ড্রাইভার, ক্যাসেট দাও তো।
ড্রাইভার ক্যাসেট চালু করে দিল। ভেবেছিলাম কোনো ইংরেজি গান বোধহয় বাজবে। তা না। নজরুল গীতি।
হায় মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মম
ডক্টর অঞ্জলী ঘোষের গাওয়া। এই গানটা আমার পছন্দ, রূপাদের বাসায় শুনেছি। গানটায় আলাদা একধরনের মজা আছে। কেমন জানি কাওয়ালি-কাওয়ালি ভাব।
গাড়ি আচমকা ব্রেক কষে থেমে গেল। আমি কিছু বোঝার আগেই ড্রাইভার হুট করে নেমে গেল। তাকে যতটা নির্বোধ মনে করা হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে সে তত নির্বোধ নয়। সে গাড়ি থামিয়েছে মোটরসাইকেলে বসে থাকা একজন পুলিশ সার্জেন্টের গা ঘেঁষে। চোখ বড় বড় করে কী সব বলছে। অঞ্জলী ঘোষের গানের কারণে তার কথা বোঝা যাচ্ছে না।
পুলিশ সার্জেন্ট আমার জানালার কাছে এসে বলল, নামুন তো।
আমি নামলাম।
দেখি ব্যাগে কী আছে।
আমি দেখালাম।
একটা নোটবই। দুটা বল পয়েন্ট, শীষ ভাঙা পেনসিল। পাঁচ টাকা দিয়ে কেনা এক প্যাকেট চিপস।
পুলিশ সার্জেন্ট ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি এর বিরুদ্ধে কোনো ফরমাল কমপ্লেইন করতে চান? ভদ্রমহিলা তাঁর মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েটি বলল, অবশ্যই চাই। আমি জাস্টিস এম. সোবহান সাহেবের মেয়ে। এই লোক আমাদের ভয় দেখাচ্ছিল। মাস্তানি করছিল।
আপনাদের কমপ্লেইন থানায় করতে হবে। রমনা থানায় চলে যান।
এখন তো যেতে পারব না। এখন আমরা একটা কাজে যাচ্ছি।
কাজ সেরে আসুন। আমি একে রমনা থানায় হ্যাণ্ডওভার করে দেব। আসামির নাম জানেন তো?
না।
পুলিশ সার্জেন্ট আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এ্যাই, তোর নাম কী?
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সে শুরুতে আমাকে আপনি বলছে, এখন সুন্দর একটা মেয়ের সামনে তুই করে বলছে!
এ্যাই তোর নাম বল।
আমি উদাস গলায় বললাম, আমার নাম টুটুল।
পুলিশ সার্জেন্ট ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ভুল নাম দিচ্ছে—যাই হোক, এই নামেই বুকিং হবে। হারামজাদারা ইদানীং সেয়ানা হয়েছে। কিছুতেই কারেক্ট নাম বলবে না। ঠিকানা তো বলবেই না।
বিশাল কালো গাড়ি হুশ করে বের হয়ে গেল। ফার্মগেটে যাওয়া আমার বিশেষ দরকার—ইন্দিরা রোডে আমার বড়ফুপুর বাসায় দুপুরে খাওয়ার কথা। সেই খাওয়া মাথায় উঠল। সার্জেন্ট আমাকে ছাড়বে না। রমনা থানায় চালান করবে, বলাই বাহুল্য। জাস্টিসের নাম শুনেছে। বড় কারোর নাম শুনলে এদের হুঁশ থাকে না।
আমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে ফেললাম। হাজতে থাকতে হলে সঙ্গে সিগারেট থাকা ভালো। আমার ধারণা ছিল সার্জেন্ট তাঁর মোটরসাইকেলের পেছনে আমাকে বসিয়ে থানায় নিয়ে যাবে। তা করল না। আজকাল পুলিশ খুব আধুনিক হয়েছে। পকেট থেকে ওয়াকিটকি বের করে কী বলতেই পুলিশের জিপ এসে উপস্থিত। অবিকল হিন্দি মুভি।
সম্পূর্ণ নিজের বোকামিতে দাওয়াত খাবার বদলে থানায় যাচ্ছি। মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা। আশ্চর্যের ব্যাপার, খারাপ হচ্ছে না। বরং মজা লাগছে। অঞ্জলী ঘোষের গানের পুরোটা শোনা হলো না এইজন্যে অবশ্যি আফসোস হচ্ছে। হায় মদিনাবাসী বলে চমৎকার টান দিচ্ছিল।