» » ময়ূরাক্ষী

বর্ণাকার

হুমায়ূন আহমেদ

ময়ূরাক্ষী

তিন

স্যার যেদিন মারা যান সেই রাত্রিতেই আমি প্রথম ময়ূরাক্ষী স্বপ্নে দেখি। ছোট্ট একটা নদী। তার পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। নিচের বালিগুলি পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর দুধারে দূর্বাঘাসগুলি কী সবুজ! কী কোমল! নদীর ঐ পাড়ে বিশাল ছায়াময় একটা পাকুড় গাছ। সেই গাছে বিষণ্ন গলায় একটা ঘুঘু ডাকছে। সেই ডাকে একধরনের কান্না মিশে আছে।

নদীর ধার ঘেঁষে পানি ছিটাতে ছিটাতে ডোরাকাটা সবুজ শাড়ি পরা একটি মেয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমি শুধু এক ঝলক তার মুখটা দেখতে পেলাম। স্বপ্নের মধ্যেই তাকে খুব চেনা, খুব আপন মনে হলো। যেন কত দীর্ঘ শতাব্দী এই মেয়েটির সঙ্গে কাটিয়েছি।

ময়ূরাক্ষী নদীকে একবারই আমি স্বপ্নে দেখি। নদীটা আমার মনের ভেতর পুরোপুরি গাঁথা হয়ে যায়। এরপর অবাক হয়ে লক্ষ্য করি কোথাও বসে একটু চেষ্টা করলেই নদীটা আমি দেখতে পাই। তার জন্যে আমাকে কোনো কষ্ট করতে হয় না, চোখ বন্ধ করতে হয় না, কিছু না। একবার নদীটা বের করে আনতে পারলে সময় কাটানো কোনো সমস্যা নয়। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা আমি নদীর তীরে হাঁটি। নদীর হিম-শীতল জলে পা ডুবিয়ে বসি। শরীর জুড়িয়ে যায়। ঘুঘুর ডাকে চোখ ভিজে ওঠে।

ঘুমুচ্ছেন নাকি?

আমি চোখ মেললাম। চারদিকে অন্ধকার। আরে সর্বনাশ! এতক্ষণ পার করেছি। ওসি সাহেব বললেন, যান, চলে যান। জাস্টিস সাহেবের বাসা থেকে টেলিফোন করেছিল। ওরা কোনো চার্জ আনবে না। You are free to go.

জাস্টিস সাহেব নিজেই টেলিফোন করেছিলেন?

না, তাঁর মেয়ে।

মেয়েটা কী বলল, দয়া করে বলবেন?

বলল, ধমক-ধামক দিয়ে ছেড়ে দিতে।

তাহলে দয়া করে ধমক-ধামক দিন। তারপর যাই।

ওসি সাহেব হেসে ফেললেন। পুলিশের যে একেবারেই রসবোধ নেই সেটা ঠিক না। আমি উঠে দাঁড়াতে দাড়াতে বললাম, মেয়েটা কি তার নাম আপনাকে বলেছে?

হ্যাঁ বলেছে। মীরা কিংবা মীরু এই জাতীয় কিছু।

আপনি কি নিশ্চিত যে সে জাস্টিস এম. সোবহান সাহেবের মেয়ে? অন্যকেউও তো হতে পারে। আপনি একটা উড়ো টেলিফোন কল পেয়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন, তারপর জাস্টিস সাহেব ধরবেন আপনাকে, আইনের প্যাঁচে ফেলে অবস্থা কাহিল করে দেবেন।

ভাই, আপনি যান তো। আর শুনেন, একটা উপদেশ দেই। পুলিশের সঙ্গে এত মিথ্যা কথা বলবেন না। মিথ্যা বলবেন ভালো মানুষদের কাছে। যা বলবেন তারা তাই বিশ্বাস করবে। পুলিশ কোনোকিছুই বিশ্বাস করে না। খোঁজখবর করে।

আপনি আমার সম্পর্কে খোঁজখবর করেছেন?

হ্যাঁ। সংবাদপত্রের অফিসগুলিতে খোঁজ নিয়েছি। জেনেছি, টুটুল চৌধুরী নামের কোনো ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক নেই।

আপনি কি আমার মুচলেকা-ফুচলেকা এইসব কিছু নেবেন না?

না। এখন দয়া করে বিদেয় হোন।

আপনারা গাড়ি করে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। আমি কি আশা করতে পারি না আবার গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে আসবেন?

কোথায় যাবেন? ফার্মগেট।

চলুন, নামিয়ে দেব।

আমি হাসিমুখে বললাম, আপনার এই ভদ্রতার কারণে কোনো একদিন হয়তো আমি আপনাকে ময়ূরাক্ষীর তীরে নিমন্ত্রণ করব।

ওসি সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি কী বললেন বুঝতে পারলাম না।

ঐটা বাদ দিন। সবকিছু বুঝে ফেললে তো মুশকিল। ভালো কথা, আপনি ডেইলি ক-প্যাকেট সিগারেট খান তা-কি জানতে পারি?

ওসি সাহেব বললেন, আপনি লোকটা তো ভালো ত্যাদড় আছেন। দুই থেকে আড়াই প্যাকেট লাগে।