☼ হুমায়ূন আহমেদ ☼
ময়ূরাক্ষী
ছয়
আমার টেলিফোন-ব্যাধি আছে। একবার টেলিফোনে কারো সঙ্গে কথা বললে, আবার অন্য কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে। রূপাদের বাসায় করলাম। রূপার বাবা ধরতেই বললাম, আচ্ছা, এটা কি রেলওয়ে বুকিং? রূপার বাবা বললেন, জি-না। আপনার রঙ নাম্বার হয়েছে। তখন আমি বললাম, জাস্ট ওয়ান মিনিট, রূপা কি জেগে আছে?
রূপার বাবার হাইপ্রেসার বা এই জাতীয় কিছু বোধহয় আছে। অল্পতেই রেগে গিয়ে এমন হৈচৈ শুরু করেন যে বলার না। আমার কথাতেও তাই হলো। তিনি চিড়চিড়িয়ে উঠলেন, কে? কে? এই ছোকরা, তুমি কে?
তিনি খুব হৈচৈ করতে লাগলেন। আমি রিসিভার রেখে দিলাম। রূপার বাবা নিশ্চয়ই সবাইকে ডেকে এই ঘটনা বলবেন। রূপা সঙ্গে সঙ্গে বুঝবে কে টেলিফোন করেছিল। সে হাসবে না রাগ করবে কে জানে। যেখানে রাগ করা উচিত সেখানে সে রাগ করে না, হাসে। যেখানে হাসা উচিত সেখানে রাগ করে।
আমি ওয়ান সেভেনে রিং করে জাস্টিস এম. সোবহানের বাসা চাইলাম। সম্ভব হলে মীরা বা মীরুর সঙ্গেও কথা বলা যাবে। কী বলব ঠিক করা হলো না। যা মনে আসে, তাই বলব। আগে থেকে ভেবেচিন্তে কিছু বলা আমার স্বভাবে নেই।
হ্যালো।
কে, মীরা?
হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?
আমার নাম টুটুল।
কে?
অনেকক্ষণ চুপচাপ কাটল। মনে হচ্ছে মীরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিচলিত। আমার মনে হয়, কথা বলবে কি বলবে না বুঝতে পারছে না।
ভুলে গেছেন? ঐ যে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন। কী করেছিলাম আমি বলুন তো?
কোত্থেকে টেলিফোন করছেন?
হাসপাতাল থেকে। পুলিশ মেরে আমার অবস্থা কাহিল করে দিয়েছে। রক্তবমি করছিলাম।
সে কী কথা, মারবে কেন!
পুলিশের হাতে আসামি তুলে দেবেন আর পুলিশ আসামিকে কোলে বসিয়ে মণ্ডা খাওয়াবে? আমি তো আপনাদের কোনোই ক্ষতি করিনি। গাড়িতে ডেকেছেন, উঠেছি। তাছাড়া আপনারা টুটুল টুটুল করছিলেন। আমার ডাকনামও টুটুল।
আপনি কিন্তু বলেছেন, আপনার নাম টুটুল নয়।
হ্যাঁ বলেছিলাম। কারণ, বুঝতে পারছিলাম আপনি অন্য টুটুলকে খুঁজছিলেন যার কপালে একটা কাটা দাগ।
ওপাশে অনেকক্ষণ কোনো কথা শোনা গেল না। অন্ধকারে ঢিল ছুড়েছিলাম। মনে হচ্ছে লেগে গেছে। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার! যা বলি প্রায় সময়ই তা কেমন যেন মিলে যায়। টুটুলের কপালের কাটা দাগের কথাটা হঠাৎ মনে এসেছিল। ভাগ্যিস এসেছিল!
হ্যালো, আপনি কোনো হাসপাতালে আছেন?
কেন, দেখতে আসবেন?
বলুন না কোন্ হাসপাতালে?
বাসায় চলে যাচ্ছি। ওরা বুকের এক্সরে করেছে। দুটা স্টিচ দিয়েছে। বলেছে ভর্তি হবার দরকার নেই।
আমি এক্ষুনি বাবাকে বলছি। থানায় টেলিফোন করবেন।
আমি শব্দ করে হাসলাম।
হাসছেন কেন?
পুলিশ কি কখনো মারের কথা স্বীকার করে? কখনো করে না। আচ্ছা রাখি।
না না, রাখবেন না। প্লিজ রাখবেন না। প্লিজ।
আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। ঠিক তখন প্রবল বর্ষণ শুরু হলো। কালবোশেখি ঝড়। কালবোশেখি ঝড় সাধারণত চৈত্র মাসেই হয়। ঝড়ের নাম হওয়া উচিত ছিল কালচৈত্র ঝড়। দেখতে দেখতে অসহ্য গরম চলে গিয়ে চারদিক হিম-শীতল হয়ে গেল। নির্ঘাৎ আশেপাশে কোথাও শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজব কি ভিজব না মনস্থির করতে পারছি না।
রিনকি বের হয়ে এল বাবার ঘর থেকে। তাকে কেমন যেন শঙ্কিত মনে হচ্ছে। আমি বললাম, রিনকি, তুই একটু বসার ঘরে যা। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দিবি।
রিনকি বিস্মিত গলায় বলল, কেন?
তোর জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে।
রিনকি নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে কলিংবেল বাজল। আমার মনটাই অন্যরকম হয়ে গেল। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দেখা হোক দুজনের। দীর্ঘস্থায়ী হোক এই মুহূর্ত। রিনকি দরজা খুলেছে। না জানি তার কেমন লাগছে।
আমি বাদলের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। নদীটাকে আনা যায় কিনা দেখা যাক। যদি আনতে পারি ওদের দুজনকে কিছুক্ষণের জন্যে এই নদী ব্যবহার করতে দেব।
হিমুভাই!
তুই কি এখনো জেগে আছিস?
হুঁ। রাতে আমার ঘুম হয় না।
বলিস কী!
ঘুমের অষুধ খাই। তাতেও লাভ হয় না। দশ মিলিগ্রাম করে ফ্রিজিয়াম।
আজ খেয়েছিস?
না। আজ সারারাত তোমার সঙ্গে গল্প করব।
গল্প করতে ইচ্ছা করছে না। আয়, তোকে ঘুম পাড়িয়ে দি।
ঘুমুতে ইচ্ছা করছে না।
আজ ঘুমিয়ে থাক। কাল গল্প করব।
ঘুম আসবে না।
বললাম, ঘুম এনে দিচ্ছি। না-কি তুই আমার কথা বিশ্বাস করিস না?
কী যে বল! কেন বিশ্বাস করব না? তুমি যা বল তাই হয়।
বেশ, তাহলে চোখ বন্ধ কর।
করলাম।
মনে কর তুই হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিস। চৈত্র মাসের কড়া রোদ। হাঁটছিস শহরের রাস্তায়।
হ্যাঁ।
এখন তুই শহর থেকে বেরিয়ে এসেছিস। গ্রাম, বিকেল হচ্ছে। সূর্য নরম। রোদে কোনো তেজ নেই। ফুরফুর বাতাস। তোর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে।
হুঁ।
হঠাৎ তোর সামনে একটা নদী পড়ল। নদীতে হাঁটুজল। কী ঠাণ্ডা পানি! কী পরিষ্কার! আঁজলা ভরে তুই পানি খাচ্ছিস। ঘুমে তোর চোখ জড়িয়ে আসছে। ইচ্ছা করছে নদীর মধ্যেই শুয়ে পড়তে।
হুঁ।
নদীর ধারে বিশাল একটা পাকুড় গাছ। তুই সেই পাকুড় গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছিস। এখন শুয়ে পড়লি। খুব নরম হালকা দূর্বাঘাসের উপরে শুয়েছিস। আর জেগে থাকতে পারছিস না। রাজ্যের ঘুম তোর চোখে।
বাদল এবার আর হুঁ বলল না। কিছুক্ষণের মধ্যে তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। এই ঘুম সহজে ভাঙবে না।
কেউ যদি এটাকে কোনো অস্বাভাবিক বা অলৌকিক কিছু ভেবে বসেন তাহলে ভুল করবেন। পুরো ব্যাপারটার পেছনে কাজ করছে আমার প্রতি বাদলের অন্ধভক্তি। যে ভক্তি কোনো নিয়ম মানে না। যার শিকড় অনেকদূর পর্যন্ত ছড়ানো।
বাদল না হয়ে অন্য কেউ যদি হতো তাহলে আমার এই পদ্ধতি কাজ করত না। এই ছেলেটা আমাকে বড়ই পছন্দ করে। সে আমাকে মহাপুরুষের পর্যায়ে ফেলে রেখেছে। আমি মহাপুরুষ না।
আমি ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলি। অসহায় মানুষদের দুঃখকষ্ট আমাকে মোটেই অভিভূত করে না। একবার আমি একজন ঠেলাঅলার গালে চড়ও দিয়েছিলাম। ঠেলাঅলা হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে আমাকে রাস্তার ড্রেনে ফেলে দিয়েছিল। নোংরা পানিতে আমার সমস্ত শরীর মাখামাখি। সেই অবস্থাতেই উঠে এসে আমি তার গালে চড় বসালাম। বুড়ো ঠেলাঅলা বলল, ধাক্কা দিয়া না ফেললে আপনে গাড়ির তলে পড়তেন। আসলেই তাই। যেখানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক সেখান দিয়ে একটা পাজেরো জিপ টার্ন নিল। নতুন আসা এই জিপগুলির আচার-আচরণ ট্রাকের মতো। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, মরলে মরতাম। তাই বলে তুমি আমাকে নর্দমায় ফেলবে?
ঠেলাঅলা করুণ গলায় বলল, মাফ কইরা দেন। আর ফেলুম না।
আমি আগের চেয়ে রাগী গলায় বললাম, মাফের কোনো প্রশ্নই আসে না। তুমি কাপড় ধোয়ার লন্ড্রির পয়সা দেবে।
গরিব মানুষ।
গরিব মানুষ, ধনী মানুষ বুঝি না। বের কর কী আছে?
অবাক বিস্ময়ে বুড়ো আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি বললাম, কোনো কথা শুনতে চাই না। বের কর কী আছে। মাঝে মাঝে মানুষকে তীব্র আঘাত করতে ভালো লাগে। কঠিন মানসিক যন্ত্রণায় কাউকে দগ্ধ করার আনন্দের কাছে সব আনন্দই ফিকে। এই লোকটি আমার জীবন রক্ষা করেছে। সে কল্পনাও করেনি কারোর জীবন রক্ষা করে সে এমন বিপদে পড়বে। যদি জানত এই অবস্থা হবে তাহলেও কি সে আমার জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করত?
বুড়ো গামছায় মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, বুড়ো মানুষ, মাফ কইরা দেন।
টাকাপয়সা কিছু তোমার কাছে নেই?
জ্বে না। কাইলও কোনো টিরিপ পাই নাই, আইজও পাই নাই।
যাচ্ছ কোথায়?
রায়ের বাজার।
ঠিক আছে। আমাকে কিছুদূর তোমার গাড়িতে করে নিয়ে যাও। এতে খানিকটা হলেও উসুল হবে।
আমি তার গাড়িতে উঠে বসলাম। বৃদ্ধ আমাকে টেনে নিয়ে চলল। পেছন থেকে ঠেলছে তার নাতি কিংবা তার ছেলে। এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতায় তারা দুজনই মৰ্মাহত। পৃথিবী যে খুবই অকরুণ জায়গা তা তারা জানে। আমি আরো ভালোভাবে তা জানিয়ে দিচ্ছি।
রাস্তায় এক জায়গায় ঠেলাগাড়ি থামিয়ে আমি চা আনিয়ে গাড়িতে বসে বসেই খেলাম। তাকিয়ে দেখি, বাচ্চা ছেলেটির চোখমুখ ক্রোধ ও ঘৃণায় কাল হয়ে গেছে। যে-কোনো মুহূর্তে সে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। আমি তার ভেতর এই ক্রোধ এবং এই ঘৃণা আরো বাড়ুক তাই চাচ্ছি। মানুষকে সহ্যের শেষসীমা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সহজ কথা না। সবাই তা পারে না। যে পারে তার ক্ষমতাও হেলাফেলা করার মতো ক্ষমতা না।
বুড়ো রাস্তার উপর বসে গামছায় হাওয়া খাচ্ছে। তার চোখে আগেকার বিস্ময়ের কিছুই আর এখন নেই। একধরনের নির্লিপ্ততা নিয়ে সে তাকিয়ে আছে।
আমি চা শেষ করে বললাম, বুড়ো মিয়া, চল যাওয়া যাক। আমরা আবার রওনা হলাম। মোটামুটি নির্জন একটা জায়গায় এসে বললাম, থামাও, গাড়ি থামাও। এখানে নামব।
আমি নামলাম। পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ বের করলাম। আমার মানিব্যাগ সবসময়ই খালি থাকে। আজ সেখানে পাঁচশ’ টাকার দুটা চকচকে নোট আছে। মজিদের টিউশনির টাকা। মজিদ টাকা হাতে পাওয়ামাত্র খরচ করে ফেলে বলে তার টাকাপয়সার সবটাই থাকে আমার কাছে।
বুড়া মিয়া।
জি।
তুমি আমার জীবন রক্ষা করেছ। কাজটা খুব ভালো করনি। যাই হোক, করে ফেলেছ যখন তখন তো আর কিছু করার নাই। তোমাকে ধন্যবাদ। দেখি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে কেমন লাগে। তোমাকে আমি সামান্য কিছু টাকা দিতে চাই। এই টাকাটা আমার জীবন রক্ষার জন্যে না। তুমি যে কষ্ট করে রোদের মধ্যে আমাকে টেনে টেনে এতদূর আনলে তার জন্যে। পাঁচশ’ তোমার, পাঁচশ’ এই ছেলেটার।
বুড়ো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।
আমি কোমল গলায় বললাম, এই রোদের মধ্যে আজ আর গাড়ি নিয়ে বের হয়ো না। বাসায় চলে যাও। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম কর।
বুড়োর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
ব্যাপারটা এরকম ঘটবে আমি তাই আশা করছিলাম। বাচ্চা ছেলেটির মুখে ক্রোধ ও ঘৃণার চিহ্ন এখন আর নেই। তার চোখ এখন অসম্ভব কোমল। আমি বললাম, এই, তোর নাম কী রে?
লালটু মিয়া।
প্যান্টের বোতাম লাগা বেটা। সব দেখা যাচ্ছে। লালটু মিয়া হাত দিয়ে প্যান্টের ফাঁকা অংশ ঢাকতে ঢাকতে বলল, বোতাম নাই।
তাহলে তো সব সমস্যার সমাধান। হাত সরিয়ে ফেল। আলো হাওয়া যাক।
লালটু মিয়া হাসছে।
হাসছে বুড়ো ঠেলাঅলা। তাদের কাছে এখন আমি তাদেরই একজন। বুড়ো বলল আব্বাজি আসেন, তিনজনে মিল্যা চা খাই। তিয়াশ লাগছে।
পয়সা কে দেবে? তুমি? আমার হাতে কিন্তু আর একটা পয়সাও নেই।
বুড়ো আবার হাসল।
আমরা একটা চায়ের দোকানের দিকে রওনা হলাম। নিজেকে সেই সময় মহাপুরুষ বলে মনে হচ্ছিল। আমি মহাপুরুষ নই। কিন্তু এই ভূমিকায় অভিনয় করতে আমার বড় ভালো লাগে। মাঝে মাঝে এই ভূমিকায় আমি অভিনয় করি, মনে হয় ভালোই করি। সত্যিকার মহাপুরুষরাও সম্ভবত এত ভালো করতেন না।
আমি অবশ্যি এখন পর্যন্ত কোনো মহাপুরুষ দেখিনি। তাঁদের চিন্তাভাবনা কাজকর্ম কেমন তাও জানি না। মহাপুরুষদের কিছু জীবনী পড়েছি। সেইসব জীবনীও আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। টলস্টয় তেরো বছরের একজন বালিকাকে ধর্ষণ করেছিলেন। সেই ভয়াবহ ঘটনা তিনি স্বীকার করেছেন। আমরা সবাই তো আমাদের ভয়ঙ্কর পাপের কথা স্বীকার করি না।
আমার মতে, মহাপুরুষ হচ্ছে এমন একজন যাকে পৃথিবীর কোনো মালিন্য স্পর্শ করেনি। এমন কেউ কি সত্যি সত্যি জন্মেছে এই পৃথিবীতে?
ঘুমুতে চেষ্টা করছি। ঘুমুতে পারছি না। অসহ্য গরমে ঘুমুতে আমার কষ্ট হয় না, কিন্তু আজকের এই ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুম আসছে না। শীত-শীত লাগছে। খালিগায়ে থাকার জন্যে লাগছে। খালিগায়ে থাকার কারণ আমার পাঞ্জাবি এখন বাদলের গায়ে।
শুয়ে শুয়ে ছেলেবেলার কথা ভাবতে চেষ্টা করছি। বিশেষ কোনো কারণে নয়। ঘুমুবার আগে কিছু-একটা নিয়ে ভাবতে হয় বলেই ভাবা।