☼ হুমায়ূন আহমেদ ☼
ময়ূরাক্ষী
চৌদ্দ
আমি ছাদ থেকে নিচে নামলাম।
একধরনের গাঢ় বিষাদ বোধ করছি। এই ধরনের বিষাদ হঠাৎ হঠাৎ আমাকে আক্রমণ করে, এবং প্রায় সময়ই তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। মহাপুরুষদের কি এমন হয়?
তাঁরাও কি মাঝে মাঝে বিষাদগ্রস্ত হন? হয়তো হন, হয়তো হন না। কোনো একজন মহাপুরুষের সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম। আমাদের কথাবার্তা তখন কেমন হতো? মনে মনে আমি কথোপকথনের মহড়া দিলাম। দৃশ্যটা এরকম—বিশাল বটবৃক্ষের নিচে মহাপুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি শীর্ণকায় কিন্তু তাঁকে বটবৃক্ষের চেয়েও বিশাল দেখাচ্ছে। তাঁর গায়ে শাদা চাদর। সেই চাদরে তাঁর মাথা ঢাকা। ছায়াময় বৃক্ষতল। তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে তাঁর জ্বলজ্বলে চোখের কালো মণি দৃশ্যমান। মহাপুরুষের কণ্ঠস্বর শিশুর কণ্ঠস্বরের মতো কিন্তু খুব মন দিয়ে শুনলে সেই কণ্ঠস্বরে একজন মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের শ্লেষাজড়িত উচ্চারণের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হলো। এই কথোপকথনের সময় তিনি একবারও আমার দিকে তাকালেন না। অথচ মনে হলো তাকিয়ে আছেন।
মহাপুরুষ : বৎস, তুমি কী জানতে চাও?
আমি : অনেক কিছু জানতে চাই। আপনি কি সব প্রশ্নের উত্তর জানেন?
মহাপুরুষ : আমি কোনো প্রশ্নের উত্তর জানি না। কিন্তু প্রশ্ন শুনতে ভালোবাসি। তুমি প্রশ্ন কর।
আমি : বিষাদ কী?
মহাপুরুষ : আমি জানি না।
আমি : আপনি কি কখনো বিষাদগ্রস্ত হন?
মহাপুরুষ : বিষাদ কী তা-ই আমি জানি না। কাজেই বিষাদগ্রস্ত হই কি হই না তা কী করে বলি? তুমি আরো প্রশ্ন কর। তোমার প্রশ্ন শুনে বড়ই আনন্দ বোধ হচ্ছে।
আমি : আনন্দ কী?
মহাপুরুষ : বৎস আনন্দ কী তা আমি জানি না।
আমি : আপনি জানেন এমন কিছু কি আছে?
মহাপুরুষ : না। আমি কিছুই জানি না। বৎস, তুমি প্রশ্ন কর।
আমি : আমার প্রশ্ন করার কিছুই নেই। আপনি বিদেয় হোন।
মহাপুরুষ : চলে যেতে বলছ?
আমি : অবশ্যই—ব্যাটা তুই ভাগ।
মহাপুরুষ : তুমি কি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ?
আমি : হ্যাঁ।
মহাপুরুষ : তাতে লাভ হবে না বৎস। তুমি বোধহয় জানো না, আমাদের মান-অপমান বোধ নেই।
কথোপকথন আরো চালানোর ইচ্ছা ছিল। চালানো গেল না। ফুপু এসে বললেন, এই, তুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছিস কেন?
আমি বললাম, কথা বলছি।
কার সঙ্গে বলছিস?
মহাপুরুষের সঙ্গে।
ফুপু অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই সবসময় এমন রহস্য করিস কেন? তুই আমাকে পেয়েছিস কী? আমাকেও কি বাদলের মতো পাগল ভাবিস? তুই কি ভাবিস বাদলের মতো আমিও তোর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করব?
আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলাম। ফুপু আমার সেই হাসি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললেন, তুই একটা বিয়ে কর। বিয়ে করলে সব রোগ সেরে যাবে।
বিয়ে করাটা ঠিক হবে না ফুপু।
ঠিক হবে না কেন?
যেসব রোগের কথা তুমি বলছ সেইসব রোগ কখনো সারাতে নেই। যে-কারণে মহাপুরুষেরা বিয়ে করেন না। আজীবন চিরকুমার থাকেন। বিয়ে করার পর যারা মহাপুরুষ হন তাঁরা স্ত্রী-সংসার ছেড়ে চলে যান। যেমন বুদ্ধদেব।
ফুপু হতচকিত গলায় বললেন, তুই আমাকে আপনি না বলে তুমি তুমি করে বলছিস কেন?
আমি তো সবসময় তাই বলি।
সে কী! আমার তো ধারণা ছিল আপনি করে বলিস।
জিনা ফুপু, আপনি ভুল করছেন। আমার খুব প্রিয়জনদের আমি তুমি করে বলি। আপনি যদিও খুব কঠিন প্রকৃতির মহিলা, তবু আপনি আমার প্রিয়জন। সেই কারণে আপনাকে আমি তুমি করে বলি।
এই তো এখন আপনি করে বলছিস।
কই না তো। তুমি করেই তো বলছি।
ফুপু খুবই বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে আমার খুব ভালো লাগে। সম্ভবত আমি মহাপুরুষের পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছি। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারছি।
রূপার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রও হচ্ছে বিভ্রান্তি। তাকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করতে পেরেছিলাম। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় শীতকালে।