» » কালো পাথর

বর্ণাকার

ছয়

ডেড মাইন এলাকা ঢিবি খানাখন্দ আর জঙ্গল গজিয়ে দুর্গম হয়ে আছে। জিপ এখানে রেখে কর্নেল ইন্সপেক্টর শর্মাজী আর দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল ৩৪৭ নং পিটের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের আমলেই এইসব খনি পরিত্যক্ত হয়ে ছিল। তারপর থেকে আর মানুষজন এদিকে চলাফেরা করে না। শৰ্মাজী গত মাসে একবার মাত্র এসেছিলেন এখানে। সুদীপ্তের লাশ পড়েছিল যেখানে, সেই জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, এখান থেকে ৩৪৭ নং পিট সম্ভবত বেশি দূরে নয়। কর্নেল ম্যাপটা আবার দেখা যাক। না হলে খুঁজে বের করা কঠিন হবে।

ম্যাপ খুলে দেখা গেল, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন–এ জোনের ৩০০ একর খনি সেটা, আর একটু ডাইনে এগোতে হবে। কিছুটা গিয়ে ঘন কাঁটাবন পড়ল। পাশ কাটিয়ে বাঁদিকে ঘুরে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। শৰ্মাজী ছিলেন পেছনে। বললেন, কী হল কর্নেল?

কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন, চুপ!

একটা ঢিবির সামনে কয়েকটা পাথরের চাঁই পড়ে আছে। তার আড়ালে হুমড়ি খেয়ে বসে কেউ কিছু করছে। তার মাথাটা শুধু দেখা যাচ্ছে। চাপা খস্ খস্ ঠং ঠং শব্দও কানে এল। কেউ খোঁড়াখুঁড়ি করছে।

কর্নেলের ইশারায় শৰ্মাজী আর কনস্টেবল দুজন তিনদিক থেকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেল। কর্নেল একটু অপেক্ষা করছিলেন। ডাইনে ও বাঁয়ে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ঘুরে পুলিশের ছোট্ট দলটি ঢিবির পেছনে গেলে কর্নেল সোজা এগিয়ে গেলেন। তারপর পাথরের চাঁইগুলোর ওপর এক লাফে উঠে একটু কাশলেন।

একটা প্রকাণ্ড গর্তে জলকাদা আর ঘাসের ভেতর বসে একটা বেলচা দিয়ে খোঁড়াখুড়ি করছিল যে, তার জামাকাপড়ে যথেষ্ট কাদা লেগেছে। সে চমকে গিয়ে ঘুরল। তারপর কাঁচুমাচু হেসে উঠে দাঁড়াল।

অত্যন্ত ভদ্র চেহারার এক যুবক। কর্নেল অবাক হয়ে বললেন, কে আপনি! এখানে কী করছেন?

যুবকটি এবার পুলিশদেরও দেখতে পেয়ে আরও হকচকিয়ে গেল। শৰ্মাজী তার দিকে রিভলভার তাক করে গর্জে বললেন, উঠে এস! ওঠো বলছি।

যুবকটি বলল, কী দোষ করেছি আমি? আপনারা আমাকে মিছিমিছি–

কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকে দেখছিলনে। তার কথায় বাধা দিয়ে বললেন, কী নাম আপনার?

অরুণেন্দু মুখার্জি। ডঃ কুসুমবিহারী রায় আমার মামা হন।

শর্মজী ধমক দিয়ে বললেন, বিপদে পড়লে অনেকেই অনেকের ভাগ্নে হয়ে যায়! উঠে না এলে ঠ্যাং ভেঙে দেব গুলি করে।

অরুণেন্দু বিরক্তমুখে বেলচাটা নিয়ে গর্ত থেকে উঠে এল। তারপর বলল, অন্যায়টা কী করেছি, বুঝতে পারছি না, আমি যা করছিলুম, তাতে গভর্নমেন্টেরই লাভ হতো।

মিঃ শর্মাকে ইশারায় থামতে বলে কর্নেল জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার অরুণেন্দুবাবু? আপনি ভূতপ্রেত ছেড়ে হঠাৎ এখানে এসে জলকাদা ঘাঁটছেন কেন?

অরুণেন্দু কর্নেলকে দেখে নিয়ে বলল, ও! আপনিই তাহলে সেই কর্নেলসায়েব? ভাবনা আমাকে আপনার কথা বলছিল কিছুক্ষণ আগে। দাঁড়ান ওকে ডাকি আগে।

সে পাথরের চাঁইগুলোর উপর উঠে চেঁচিয়ে ডাকল, ভাবনা! ভাবনা!

একটু দূরে জঙ্গলের ভেতর থেকে সাড়া এল, যাচ্ছি!

ছেড়ে দাও! চলে এস এখানে!

ডানদিকের ঘন ঝোপজঙ্গল থেকে জলকাদা মাখা ভাবনাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তার হাতেও একটা খন্তা এবং কোমরে আঁচল জড়ানো। চুলেও যথেষ্ট কাদা লেগেছে। সে কর্নেলদের দেখেই অপ্রস্তুত হেসে থমকে দাঁড়াল।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, এস ভাবনা! বুঝতে পারছি, তুমি এ বুড়োর ওপর ভরসা না করে নিজেই গোয়েন্দাগিরি করতে নেমেছে।

ভাবনা এসে ক্লান্তভাবে বসে পড়ল পাথরে। তারপর বলল, অরুদা, তুমিই বলল ব্যাপারটা। আমি হাঁপিয়ে গেছি।

অরুণেন্দু বলল, আপনি আর ভাবনা সকালে যখন মোহান্তজীর কাছে গেলেন, তখন আমি বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলুম। সিয়াসের আসরে সুদীপ্তের আত্মা মোহান্তজী কথাটা লিখেছিল। সেই থেকে মোহান্তজীর ওপর চোখ রেখেছিলুম। আমার সঙ্গে তো ওঁর বহুদিনের আলাপ। যাই হোক, আপনারা চলে গেলেন মোহান্তজীর তাড়া খেয়ে, তার একটু পরে দেখি, মোহান্তজী ওঁর চ্যালা দুটোকে কী বলছেন। বলার পর ভোলা নামে চ্যালাটা একটা খুরপি নিয়ে বেরিয়ে গেল মন্দিরের পেছন দিকে। ভোলাকে ফলো করলুম। ফুলঝরিয়া লেকের পূর্বদিকে টিলার ঢালে একটা মস্তবড় কালোপাথর আছে। সেখানে ভোলা খোঁড়াখুঁড়ি করে কী একটা জিনিস বের করল। তারপর সেটা লাল একটা কাপড়ে বাঁধছে, এমন সময় দেখি আপনি টিলার নিচে লাফালাফি করছেন। তখন তো চিনি না আপনাকে। তাই

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ–পরীক্ষা করছিলুম বালিতে দৌঁডুলে কতটা পা দেবে যায়।

আমি ভেবেছিলুম পাগলটাগল হবে। অরুণেন্দু হাসল।তো আপনাকে দেখতে পেয়েই ভোলা পালিয়ে গেল। ওকে ফলো করে আবার মন্দিরে চলে এলুম। আড়াল থেকে দেখলুম, মোহান্তজী ভোলাকে আবার কী নির্দেশ দিচ্ছে। এবার ভোলা আর রামু দুজনেই বেরুল মন্দিরের পেছন দিয়ে। ভোলার হাতে লাল কাপড়ে বাঁধা সেই জিনিসটা। ওদের ফলো করে দেড় মাইল এলাকায় এলুম। কিন্তু এখানে এসে ওদের হারিয়ে ফললুম। ঝোপের আড়ালে গুঁড়ি মেরে অনেক খুঁজলুম ওদের। কিছুক্ষণ পরে দেখি, দুজনে জলকাদা মেখে ভূত হয়ে বেরুচ্ছে এই ঢিবির কাছ থেকে। ওরা চলে যাওয়ার পর খুব খোঁজাখুঁজি করেও জিনিসটা কোথায় পুঁতে রেখে গেল বুঝতে পারি নি। বাড়ি ফিরলুম তখন প্রায় বারোটা বাজে। স্নান-খাওয়া সেরে আমার মামাতো বোন মঞ্জুশ্রীকে বললুম– ব্যাপারটা। তারপর বললুম– তুমি যদি ঢিবির ওপর উঠে চারদিকে নজর রাখো, আমি আশেপাশে গর্তগুলো খুঁজে দেখব। মঞ্জুশ্রী ভীষণ ভীতু। ও যাবে না। শেষে বলল, দাঁড়াও, তাহলে ভাবনাকে ডেকে দিই। ও খুব সাহসী মেয়ে। একটু পরে ভাবনাকে ও ডেকে নিয়ে এল। ভাবনা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হল। অরুণেন্দু একটু দম নিয়ে ফের বলল, আসার পথে এই হাল্কা বস্তাদুটো একটা বস্তি থেকে ভাড়া করে আনলুম। কারণ ভাবনা বলল, তুমি একদিকে আমি আরেক দিকে খোঁজখুঁজি করব। মাঝে-মাঝে ঢিবিতে উঠে গিয়ে লক্ষ রাখব। আমার এতে আপত্তি ছিল কিন্তু। দেখলে তো ভাবনা, যদি কর্নেলসায়েবদের বদলে মোহান্তজীর চ্যালারা এসে হাজির হতো, কী সাংঘাতিক বিপদে না পড়তুম।

— ভাবনা বলল, আমি ঝোপের আড়ালে ছিলুম। আমাকে দেখতে পেত না। আমি আড়াল থেকে ঢিল ছুঁড়ে ওদের ভয় পাইয়ে দিতুম দেখতে। ওদের ভূতের ভয় কি আর নেই?

সে খিলখিল করে হেসে উঠল। মিঃ শর্মা এদিক ওদিক ঘুরে কী দেখছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, আরে। এটাই তো দেখছি পিট নম্বর ৩৪৭। ওই তো ঢিবির তলায় কাঠের ফলকে লেখা আছে।

ফলকের ওপর ঘাস হাত বাড়িয়ে আছে। তবু পড়া যায়। অরুণেন্দু বলল, ফলকটা চোখে পড়েনি আমার। তবে অনুমান করেছিলুম এটাই ৩৪৭ নম্বর পিট।

কর্নেল গর্তটা ঘুরে ঢিবির নিচে ফলকটার কাছে গেলেন। তারপর জায়গাটা পরীক্ষা করে বললেন, কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে সিল করা ছিল বটে কিন্তু স্ল্যাবটা উপড়েছিল মনে হচ্ছে। মিঃ শর্মা, আসুন তো। খন্তা দিয়ে স্ল্যাবটা ওপড়ানো যায় নাকি দেখি। ওপরের দিকটায় সূক্ষ্ম ফাটল দেখতে পাচ্ছি।

কনস্টেবল দুজন রাইফেল রেখে এগিয়ে গেল মিঃ শর্মার নির্দেশে। দুজনে খস্তাদুটো দিয়ে চাড় দিতেই বিরাট কংক্রিটের চাবড়া সরে কাত হয়ে পড়ল। ভেতড়ে সুড়ঙ্গের মতো প্রকাণ্ড হ। কর্নেল কিটব্যাগ থেকে টর্চ বের করে ঝুঁকে গেলেন সুড়ঙ্গের ভেতরে। তারপর টর্চ জ্বেলে বললেন, হু লালকাপড় বাঁধা জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি। আরও একটা কী দেখা যাচ্ছে যেন।

কর্নেল গুঁড়ি মেরে ভেতরে ঢুকে গেলেন। একটু পরে সুড়ঙ্গের মুখে ফিরে এসে বললেন, মিঃ শর্মা। ধরুন।

প্রথমে লালকাপড়ে বাঁধা জিনিসটা, তারপর একটা ব্রিফকেস–পুরনো, ইষৎ তোবড়ানো।

কর্নেল বেরিয়ে এলেন। লালকাপড়ের গিঁট খুললে বেরিয়ে পড়ল কাদামাখা একটা কালো চৌকো পাথর–অত্যন্ত হাল্কা ওজন। আন্দাজ আটইঞ্চি চওড়া এবং চার ইঞ্চি মতো পুরু। পার্বতীমন্দিরের চুরি যাওয়া সেই উল্কাপাথরের বেদীটাই বটে।

ব্রিফকেসটা অনেক চেষ্টায় খোলা হল। তার ভেতর প্যাকেট করা একগাদা কাগজ–দুর্বোধ্য সব আঁকজোক, নকশা, অঙ্ক, জ্যামিতি। একটা মোড়ক থেকে বেরুলো কয়েক টুকরো কালো অসম্ভব হাল্কা চাকতির মতো জিনিস। অরুণেন্দু ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছিল উত্তেজনায়। বলল, এসব কী?

কর্নেল বললেন, দীপ্তেন্দু মিত্রের ব্রিফকেস। সম্ভবত তার আবিষ্কৃত সেই আশ্চর্য মিশ্র ধাতুর ফর্মুলা আর নমুনা আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। এই ব্রিফকেসটা চুরি গিয়েছিল তার ল্যাবরেটরি থেকে।

মিঃ শর্মা বললেন, আর এখানে নয়। এখনই মোহান্তজীকে গ্রেফতার করতে হবে।…