» » কালো পাথর

বর্ণাকার

পাঁচ

পরিতোষবাবু বললেন, আপনি বেরিয়েছেন শুনে চলে যাচ্ছিলুম। পরম সৌভাগ্য যে দেখা হল। সকালে অনুর বডি মর্গ থেকে ডেলিভারি দিয়েছিল। দাহক্রিয়া করে বাড়ি ফিরে ওর জিনিসপত্র ঘাঁটতে বসেছিলুম। আমার ছেলে মনীশ বছর দুই আগে বাস অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। তারপর অনুও এভাবে গেল। কী পাপে ভগবান এমন শাস্তি দিলেন জানি না। তো যে জন্য এসেছি বলি–

পরিতোষবাবু পকেট থেকে একটা ভাজকরা কাগজ বের করে কর্নেলকে দিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ আগে অনুর ড্রয়ারে এটা পেয়েছি। এ চিঠি কে তাকে লিখেছে, জানি না। পুলিসের কাছে যাব ভাবছিলুম, হঠাৎ অনুর বন্ধু এল। তাকে তো আপনি চেনেন। সে বলল আগে আপনার কাছে যেতে। কারণ ভাবনার সন্দেহ, এর পেছনে প্রভাবশালী লোক আছে। তাই পুলিশ সুদীপ্তের কেসের মতো এই কেসটাও চেপে দেবে।

কর্নেল চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে চমকে উঠলেন। ইংরেজিতে টাইপ করা ছোট্ট চিঠি। সরলার্থ করলে দাঁড়ায় :

২৬ অক্টোবর বিকেল পাঁচটায় ফুলঝরিয়া লেকের পূর্বদিকে টিলায় গোর্পনে : গিয়ে অপেক্ষা করবে। সুদীপ্তের হারানো জিনিসটার খোঁজ দেব। ইতি, তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

কর্নেল বললেন, খুনী ওকে ফাঁদে ফেলেছিল। কিন্তু সুদীপ্তের হারানো জিনিস কী, সে সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?

পরিতোষবাবু বললেন, অনুর কাছে শুনেছিলুম মনে পড়ছে। সুদীপ্ত কী একটা নতুন মিশ্ৰধাতু আবিষ্কার করেছিল নাকি। একটা ফর্মুলার আকারে সেটা লিখে ব্রিফ কেসে রেখেছিল। ওর ল্যাবরেটরি থেকেই সেটা চুরি যায়।

এটা কতদিন আগের ঘটনা, জানেন?

এই তো গতমাসের। সুদীপ্ত যেদিন খুন হল, তার পরদিন অনু ওর মাকে বলছিল। আমার কানে এসেছিল কথাটা। তাই ওকে জিজ্ঞেস করলুম। অনু বলল, যে মিশ্ৰধাতু সুদীপ্ত আবিষ্কার করেছিল, তা নাকি যুগান্তকারী। অসম্ভব হালকা, অথচ ভীষণ শক্তিশালী। ওই দিয়ে মহাকাশযান তৈরি করা যাবে ভবিষ্যতে। সুদীপ্ত ওকে কথাটা গোপন রাখতে বলেছিল।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আর কিছু বলছিল মনে পড়ছে কি?

পরিতোষবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ–অনু বলেছিল, মিশ্ৰধাতুর একটা নমুনা তাকে দেখিয়েছে সুদীপ্ত। জিনিসটা দেখতে কালো পাথরের মতো! ওটার কোডনাম দিয়েছিল নাকি ব্ল্যাকস্টোনকালো পাথর!

কালো পাথর? কর্নেল চমকে উঠলেন এবার।

আজ্ঞে হ্যাঁ। তাই বলেছিল মনে পড়ছে। ব্ল্যাকস্টোন।

ঠিক আছে পরিতোষবাবু! আপনি তাহলে আসুন। আমি দেখছি, কী করা যায়। আর একটা কথা, এসব কথা আর কাউকে বলবেন না যেন। পুলিসকে যা বলার আমিই বলব।

পরিতোষবাবু কর্নেলের হাত ধরে বললেন, আমার বংশে বাতি দিতে কেউ রইল কর্নেল! এই অভিশপ্ত জীবনে অন্তত একটা সান্ত্বনা পাব, যদি অনুর খুনী ধরা পড়ে এবং শাস্তি পায়।

কর্নেল তাকে আশ্বাস দিয়ে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলেন।

তাহলে কালো পাথর-এর প্রকৃত রহস্য এটাই। ফুলঝরিয়া লেকের পূর্বদিকের টিলায় যে কালো পাথরটা দেখে এলেন, সেটার কোনো তাই রইল না। কিন্তু ওখানে যে জিনিসটা পোঁতা ছিল, সেটাই বা কি? কে তুলে নিয়ে গেল ওটা?

কিছুক্ষণ পরে জিপের শব্দে কর্নেল দেখলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর শর্মাজী আসছেন।

মিঃ শর্মা এসে হাসতে হাসতে বললেন, পার্বতীমন্দিরের মোহান্তজী আমার কাছে নালিশ করতে গিয়েছিল একটু আগে। আমাদের গোয়েন্দা নাকি ওকে উত্যক্ত করতে গিয়েছিল। যে বর্ণনা দিল, বুঝলুম আপনি ছাড়া আর কেউ নন। বিশেষ করে কেশরলাল শান্তপ্রসাদজীর মেয়ে ভাবনাও যখন সঙ্গে ছিল।

কর্নেল অবাক হয়ে বললেন, মোহান্তজীর কী ব্যাপার বলুন তো মিঃ শর্মা?

পার্বতীমন্দিরের ভেতরে যে মূর্তিটি আছে তার তলায় একটা ছোট্ট বেদী ছিল। ওটা নাকি উল্কা পাথর, নিশ্চয় খুব দামী জিনিস। মোহান্তজীর দুই ষণ্ডামার্কা চ্যালা আছে ভোলা আর রামু। স্বভাবত তাদের সন্দেহ করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা জেরার চাপে বলেছিল, পাথরের বেদীটা নাকি রিসার্চ সেন্টারের সুদীপ্ত মিত্রকে বেচেছে। সুদীপ্ত মিত্র তার কদিন আগে খুন হয়ে গেছেন। ডেড মাইন এলাকায় ওঁর বডি পাওয়া গিয়েছিল। পেছন থেকে কেউ ছুরি মেরেছিল। যাইহোক, তার বাড়ি সার্চ করে পাথরের বেদীটা আমরা পাইনি।

কিন্তু কালো পাথরের কথা শুনে মোহান্তজী ক্ষেপে যান কেন?

রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে মাঝে মাঝে আমাদের লোক গিয়ে ওঁকে জেরা করে। প্রথম প্রথম অত চটতেন না। পরে ভীষণ চটে যান। বারাহিয়ার প্রভাবশালী লোকেদের ধরে উনি পুলিশের জেরা করতে যাওয়া ঠেকিয়েছেন।

হাসতে লাগলেন মিঃ শর্মা। কর্নেল বললেন, তার মানে মোহান্তজীর প্রতি আপনাদের সন্দেহ আছে বেদী চুরির ব্যাপারে?

নিশ্চয় আছে। আমার অন্তত দৃঢ় বিশ্বাস, মোহান্তজীই ওটা কাউকে বেচেছেন।

আপনি কি জানেন, সুদীপ্তবাবু একটা আশ্চর্য মিশ্ৰধাতু আবিষ্কার করেছিলেন?

মিঃ শর্মা অবাক হয়ে বললেন, না তো। কে বলল আপনাকে?

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট আবার জ্বেলে ধোঁয়ার ভেতর বললেন, তাহলে সবটাই এবার বলা দরকার আপনাকে। মন দিয়ে শুনুন।…

আগাগোড়া সবটা শোনার পর মিঃ শর্মা গম্ভীর মুখে বললেন, আমি ভেবেছিলাম সাধারণ কেস–এই শিল্প এলাকায় যা আকছার হয়। আসলে আপনার পথে কতকগুলো সুবিধে আছে–অন্তত যে দুটো কেস প্রতাপগড়ে থাকার সময় দেখেছি। আপনার পদ্ধতিও অবশ্য আলাদা। তাছাড়া আজকাল লোকে বিশ্বাস করে পুলিসের কাছে মুখ খুলতে চায় না। লোকের দোষ কী? রাজনীতির চাপে পুলিসও তেমনি বিপর্যস্ত।

কর্নেল বললেন, খুরপির বাঁটে হাতের ছাপটা তুলতে ফরেন্সিক ডিপার্টমেন্টে আজই পাঠিয়ে দিন। একটু তাগিদ দিয়ে কাজটা করতে হবে। আর আজই ডেড মাইন এলাকায় ৩৪৭ নং পিটের ওখানে যাওয়া যাক। বিকেল তিনটেয় বেরুব। আপনি তার আগে আগেই আসুন।

মিঃ শর্মা চিন্তিত মুখে বললেন, ঠিক সময়ে এসে আপনাকে নিয়ে যাব। কিন্তু একটা কথা আমার মাথায় এল এই মাত্র। ফুলঝরিয়ার টিলায় যে গর্তটা দেখেছেন, সেই উল্কাপাথরের বেদীটা লুকোনো ছিল না তো? গর্তের তলায় যে ঘাটের কথা বললেন, তার সঙ্গে চুরি যাওয়া বেদীর মাপটা কিন্তু মিলে যাচ্ছে।

তাহলে এখানে বেদীটাই লুকোনো ছিল!

মিঃ শর্মা উঠলেন। নাঃ! আর ভাবলে মাথা ঘুলিয়ে যাবে। হাসতে হাসতে বললেন আপনি লাঞ্চ সেরে নিন। দুটো বাজে প্রায়। আমি পৌনে তিনটের মধ্যে এসে পড়ছি। তারপর উনি খবরের কাগজে জড়ানো খুরপিটা সাবধানে তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।…