চার
কিছুক্ষণ পরে বাংলো থেকে সিধে নাক বরাবর হাঁটছিলেন কর্নেল। কাঁধে কিটব্যাগ, হাতে ছিপ আর প্রজাপতি ধরা জাল। ক্যামেরা আর বাইনোকুলার যথারীতি দুপাশে ঝুলছে। বাঁজা ডাঙা, ঝোপঝাড় পেরিয়ে একটা ক্যানেল। তারপর ভুট্টা অড়হরের ক্ষেত কিছুদূর। তারপর আবার টাড় জমি, পাথুরে মাটি, মাটি, টিলা। ফরেস্ট দফতরের লালিত শালবন। মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে চোখ রেখে পাখি দেখছিলেন। কোনও প্রজাপতি দেখলেই থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন। কিন্তু বড্ড ছটফটে ওরা। তাছাড়া এখন লেকের পূর্বপ্রান্তে ঝর্ণার কাছে পৌঁছনোর তাড়া আছে।
ডোবাটার কাছে পৌঁছে কাল যে পাথরে বসে ছিপ ফেলে ছিলেন, সেখানে ছিপ, কিটব্যাগ ইত্যাদি রাখলেন। জলে চার ফেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন। কালকের মতই নির্জন।
যে গর্তে অনুরাধা পড়েছিল, প্রথমে গেলেন সেখানে। জলটা এখনও লাল হয়ে আছে। মন খারাপ হয়ে গেল কর্নেলের। কাল একটাও মাঝ ধরতে পারেনি। কিন্তু বঁড়শির টোপ ধরে অনবরত টানাটানি করছিল এবং মনটা ওইদিকেই আটকে ছিল সারাটা সময়। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। এতটুকু টের পান নি।
উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে প্রকৃতি। গর্তটার চারপাশে ঘন ঘাস। মাটিটা সে রাতের বৃষ্টিতে নরম হয়ে আছে এখনও। কাল সন্ধ্যার মুখে আলো ছিল যথেষ্ট কম। একদফা চারপাশটায় খুঁজছিলেন, পায়ের ছাপ অথবা কোনও চিহ্ন যদি পাওয়া যায়। আলোর অভাবে খুঁজে পাননি। এখন প্রায় এগারোটা বাজে। ঘাসের তলায় একখানে এবং গর্তের ধারে কতকগুলো জুতোর ছাপ দেখা যাচ্ছিল। পরীক্ষা করে বুঝলেন, সবই পুলিসের জুতোর ছাপ। দুজনের পায়ে হাল্কা স্যান্ডেল ছিল লক্ষ্য করলেন। সে এখানে এসেছিল দক্ষিণ দিক থেকে–যেখানে কর্নেল বসে মাছ। ধরছিলেন। অনুরাধা এসেছিল কোন দিক থেকে? খুঁজতে খুঁজতে একখানে চোখ গেল। ঘাস দেবে গেছে এবং উপড়ে গেছে শেকড়সুদ্ধ। ধস্তাধস্তির চিহ্ন পরিষ্কার! এখানে হাঁটু সমান উঁচু গুল্মজাতীয় ঝোপগুলো হেলে আছে। ডাল ভেঙে গেছে। তারপর খানিকটা রক্তও দেখতে পেলেন। গর্ত থেকে দুমিটার তফাতে ছুরি মেরেছিল আততায়ী।
এখান থেকেই অনুরাধার গতিপথ খুঁজে পেলেন। দৌড়ে এলে ঘাস ছিঁড়ে ও উপড়ে যাবার কথা। ওর জুতো দুটো এখানেই কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছে পুলিশ। শৰ্মাজী বলছিলেন, গর্তটার কাছাকাছি পাওয়া গেছে।
তার মানে অনুরাধা জুতো খুলে দৌড়ত শুরু করেছিল। কিংবা তার মতলব টের পেয়ে প্রাণভয়ে ছুটে পালাচ্ছিল।
ঘাস ছাড়িয়ে পশ্চিমে টিলার দিকে এগোতেই অনুরাধার দৌড়ে আসার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল। মাটিটা পাথুরে এবং টিলার ঢাল থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে এসে একখানে নালা মতো হয়েছে। তাতে জল নেই। বালি জমে রয়েছে। বালির ওপর ডেবে যাওয়া জুতোর ছাপ অনেকগুলো। ছাপগুলো পরিষ্কার নয়। তবে কিছু ছাপ বেশি গভীর। কিছু কম। কম গভীরগুলো অনুরাধার, তাতে ভুল নেই। বেশি গভীরগুলো নিশ্চয় আততায়ীর।
কর্নেল বালির ওপর দিয়ে এলেন একবার। তারপর নিজের জুতোর ছাপ পরীক্ষা করলেন। আততায়ীর দেহের ওজন তার চেয়ে কিছু কম। লোকটা তার চেয়ে বেঁটে। জুতোর দৈর্ঘ্য দেখে মনে হয় তার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি হতে পারে না। কর্নেলের উচ্চতা সওয়া ছফুট।
কোথাও-কোথাও টিলার ঢালের ওপর অনুরাধার জুতোর ছাপের ওপর আততায়ীর জুতোর ছাপ পড়েছে। সেই ছাপগুলো কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট। একটা প্রকাণ্ড পাথর ঘুরে ছাপগুলো ওপরে উঠেছে। পাথরটার কাছে গিয়ে কর্নেল থমকে দাঁড়লেন। পাথরটার কোণার দিকে টাটকা গর্ত খোঁড়ার চিহ্ন। এমন কী, একটা ছোট্ট খুরপিও পড়ে আছে।
দেখামাত্র মনে হল, এইমাত্র কেউ গর্তটা খুঁড়ছিল। তাকে আসতে দেখে পালিয়ে গেছে।
কর্নেল ব্যস্তভাবে ওপরে উঠতে থাকলেন। ফুট দশেক ওঠার পর চ্যাটালোত একটা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে ওধারের ঢাল ও নিচের লেকের দিকে তাকালেন। কাছাকাছি কাউকে দেখতে পেলেন না। দূরে পার্কে এবং ওয়াটার পাম্পিং স্টেশনের ওখানে কিছু লোক আছে। যে গর্ত খুঁড়ছিল, সে সম্ভবত নিচের বড় বড় পাথরের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। মিনিট দশেক চোখে বাইনোকুলার রেখে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। তারপর গর্তটার কাছে নেমে এলেন।
আবার থমকে দাঁড়ালেন। গর্তের ওপর এবং এই ঢালে আরও নানা সাইজের কালোপাথর পড়ে আছে। কিন্তু কোনটাই এত কালো নয়।
তাহলে কি এটাই সেই কালোপাথর?
গর্তের কাছে হুমড়ি খেয়ে বসলেন কর্নেল। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে এতক্ষণে চোখে পড়ল, যে গর্ত খুঁড়ছিল, সে তাকে দেখে পালিয়ে যেতেও পারে বটে, কিন্তু যে জন্য খুঁড়ছিল, তা পেয়ে গেছে। কারণ গর্তটার তলায় আন্দাজ আট ইঞ্চি লম্বা এবং ইঞ্চি ছয়েক চওড়া কী একটা জিনিস ছিল। তার তলার ছাপটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। মাটিটা বৃষ্টিতে যথেষ্ট নরম। কারণ সে রাতের বৃষ্টির জল টিলার ওপর দিকে থেকে গড়িয়ে এসে এই কালো পাথরে বাধা পেয়ে মাটিটাকে গভীর ভাবে ভিজিয়ে দিতে পেরেছিল।
কোনও চৌকো জিনিস এখানে পোঁতা ছিল। ছোট্ট বাক্সের মতো কোনও জিনিস।
খুরপিটার বাঁটে হাতের ছাপ পাওয়া যাবে। সেটা সাবধানে মাথার দিকে ধরে তুলে নিলেন কর্নেল। তারপর ঢাল বেয়ে নেমে ঝর্ণার ডোবাটার ধারে ফিরলেন।
কিন্তু ছিপ ফেলার চেয়ে যা দেখে এলেন, সেটাই জরুরী হয়ে উঠেছে। কর্নেল সব গুটিয়ে নিয়ে ফিরে চললেন বাংলোয়। ইন্সপেক্টর শর্মার সঙ্গে শীগগির আলোচনা করা দরকার।
আধঘণ্টার মধ্যে বাংলোয় ফিরে গেটের মুখে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল। তিনি তাকে দেখে নমস্কার করে বললেন, আপনিই কি কর্নেলসায়েব? ভাবনা আমাকে আপনার কাছে আসতে বলল। আমি অনুরাধার বাবা।