তিন
এই শরৎকালে বারাহিয়া এলাকায় বেড়াতে এসে হত্যারহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের এতটুকু ছিল না। কিন্তু চেঁকি স্বর্গে গেলেও তাকে ধান ভানতে হয় এটাই চেঁকির নিয়তি। ফুলঝরিয়া লেকের আশেপাশে সকালে একজাতের প্রজাপতি দেখেছিলেন। তাছাড়া লেকের পূর্বপ্রান্তে ঝর্ণার মোহানায় ছোট্ট জলাশয়ে ছিপ ফেলে বিকেলটা কাটানো লোভনীয় মনে হয়েছিল। কল্পনাও করেননি, তাঁর মাত্র একশো মিটার পেছনে এইভাবে একটা সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবে–নিয়তি যেন তার সঙ্গে একটা কদর্য পরিহাস করে বসল।
নিহত মেয়েটির নাম অনুরাধা সান্যাল। তার বাবা পরিতোষ সান্যাল স্থানীয় সরকারি শিল্পসংস্থার কর্মিদফতরের অফিস সুপারিন্টেন্টে। আর এক বছর পরে রিটায়ার করবেন। তার কাছে পুলিশ এমন কোনও সূত্র পায়নি, যাতে অনুরাধার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রণয়-প্রতিহিংসা বা এধরনের কোনও ব্যাপার আছে বলে মনে হবে। অনুরাধা নাকি সাদাসিধে আর মুখচোরা স্বভাবের মেয়ে ছিল। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে ডঃ কুসুমবিহারী রায়ের মেয়ে মঞ্জুশ্রী আর শান্তপ্রসাদজীর মেয়ে ভাবনা। তারাও পুলিশকে কোনও সূত্র দিতে পারেনি। মঞ্জুশ্রী যা বলেছে, তাতে সুমন ব্যানার্জীর অ্যালিবাই সঠিক সাব্যস্ত হয়েছে। তারা দুজনেই দেখেছিল, অনুরাধা দৌড়ে টিলা বেয়ে ওপাশে নেমে যাচ্ছে। শুধু এটুকু বোঝা যায়, কেউ তাকে তাড়া করে গিয়ে ছুরি মেরেছে। সুমনের বক্তব্য হল অনুরাধার ওভাবে দৌড়ানোটা তার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। তাই সে খোঁজ নিতে গিয়েছিল হন্তদন্ত হয়ে।
যে গর্তে অনুরাধার বডি পড়ে ছিল, তার চারপাশে মাটিতে ঘন ঘাস। তাই তাদের ছাপ পাওয়া অসম্ভব। টিলাটার ঢালু অংশে মাটি পাথুরে। আগের রাতে বৃষ্টি হলেও পায়ের বা জুতোর ছাপ পড়ার মতো নরম হয়নি মাটিটা। অন্তত পুলিসের চোখে পড়েনি কোনো ছাপ।
ইন্সপেক্টর শর্মাজী সকালে সেচ দপ্তরের বাংলোয় এসে কর্নেলকে এইসব কথা জানিয়ে গেছেন। তার সিদ্ধান্ত হল ফুলঝরিয়া লেকের ওদিকে খুনোখুনি না হলেও মেয়েদের প্রতি মস্তানদের দৌরাত্মের অভিযোগ ইতিপূর্বে পাওয়া গেছে। অনুরাধাকে সম্ভবত কোনো মস্তানই রেপ করার জন্য তাড়া করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে রাগের চোটে ছুরি মেরে পালিয়ে গেছে। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার দুবৃত্তরা খুব সহজেই ছুরি চালাতে ওস্তাদ।
সিদ্ধান্তটা তত টেকসই অবশ্য নয়। তবু পুলিশের নিজস্ব কিছু প্রবণতা ও পদ্ধতি আছে এসব কেসে। তাছাড়া আজকাল যথেষ্ট খুনোখুনির দরুন পুলিশ আগের মতো মাথা ঘামাতে চায় না। রুটিন ডিউটি সেরে নেয় মাত্র।
কর্নেলেরও মাথা ঘামাবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তার মাত্র একশো মিটার দূরত্বে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে, ওটাই তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সারারাত ভাল ঘুমোত পারেননি। বারবার মনে হয়েছে, এ যেন একটা সাংঘাতিক ধৃষ্টতার সামিল। সামরিক জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে তার অভিজ্ঞতাটি বিরাট। ইদানিং তিনি হত্যারহস্য ছেড়ে প্রকৃতি রহস্যে মন দিয়েছিলেন। অথচ নিয়তি প্রতি পদক্ষেপে তার সামনে একটা রক্তাক্ত মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে তার সঙ্গে কুৎসিৎ রসিকতা করে চলেছে।
কর্নেল বাংলোর বারান্দায় বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলেন, কোন পথ ধরে এগিয়ে যাবেন, অনুরাধার জীবনের ব্যাকগ্রাউণ্ড জানার জন্য কি তাদের বাড়িতে যাবেন, নাকি সেই টিলার কাছে গিয়ে আততায়ীর কোনও চিহ্ন খুঁজে বের করবেন। আজ সকালে ছুরিটা অবশ্য গর্তের জলের খুঁজে পেয়েছে পুলিস। কিন্তু জলে ধুয়ে গৈছে ছুরির বাঁটে আততায়ীর হাতের ছাপ এবং গন্ধ। তবে অন্য কোনও চিহ্ন কি মিলবে না যা আততায়ী সম্পর্কে একটু অন্তত আভাস দেয়!
বাংলোর গেট দিয়ে এক যুবতীকে আসতে দেখে কর্নেল তাকিয়ে রইলেন। যুবতীর মুখে অবাঙালী আদল। কোথায় দেখেছেন যেন। খুব সম্প্রতি দেখেছেন যুবতীটি বারান্দায় উঠে নমস্কার করে চমৎকার বাংলায় বলে উঠল, আপনিই কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?
কর্নেলের মনে পড়ল। কাল রাতে হাসপাতালের মর্গে অনুরাধার বাবা-মায়ের সঙ্গে ওকে দেখেছিলেন। ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। অনুরাধর মা ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। ওই মেয়েটিই তাহলে অনুরাধার বন্ধু ভাবনা।
কর্নেল বললেন, বসুন। আশা করি, আপনি অনুরাধার বন্ধু ভাবনা। আমাকে আপনি বলবেন না প্লিজ। মুখোমুখি বসে বলল। কাল রাতে অফিসারদের সঙ্গে আপনাকে দেখেছিলুম। একটু আগে ইন্সপেক্টর মিঃ শর্মার কাছে গিয়েছিলুম কিছু কথা বলতে। কিন্তু উনি আমার কথার গুরুত্ব দিলেন না। হাসতে হাসতে বললেন, সিয়াসেটিয়াসে আমি বুঝি না। এ কেসের সঙ্গে ওসবের কী সম্পর্ক? বরং আপনি সেচবাংলোয় কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে দেখা করুন। উনি ওইসব ব্যাপার বুঝবেন।
কর্নেল হাসছিলেন। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, সিয়াসে?
ভাবনা বলল, তার আগে প্লিজ বলুন, আপনি কি সেই বিখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কর্নেলসায়েব? কমাস আগে টাইমস অফ ইণ্ডিয়ায় আপনার একটা হিস্ট্রি পড়েছিলুম। শৰ্মাজী আপনার নাম বলার পর তা মনে পড়েছে। সেজন্য ছুটে আসছি।
ভাবনা, সিয়াসের ব্যাপারটা কি?
আমার গুড লাক, কর্নেল! ভাবনা একটু হাসবার চেষ্টা করল। আপনাকে মুখোমুখি দেখব এবং কথা বলব, স্বপ্নেও ভাবিনি! এখন আমার মনে হচ্ছে, সুদীপ্ত আর অনুরাধার খুনী শীগগির ধরা পড়বেই পড়বে। সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।
কিন্তু…..কর্নেল হাসলেন। তুমি রহস্যের জট আরও পাকিয়ে তুলছ, ভাবনা!
ভাবনা চারপাশ দেখে নিল। বাংলো নির্জন। কিচেনের দিকে চৌকিদারের বউ কাজে ব্যস্ত। তার এদিকে চোখ নেই। ভাবনা চাপা গলায় বলল, আজ সাতাশে অক্টোবর, চব্বিশে অক্টোবর সন্ধ্যায় আমি আর অনুরাধা সুদীপ্তের দিদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। সুদীপ্তের ওই বিধবা দিদি ছাড়া এক কেউ নেই। মাঝে মাঝে ওঁকে সাহায্য করতে যাই। সুদীপ্ত ওমাসে হঠাৎ মার্ডার হওয়ার
কে সুদীপ্ত?
ধাতু গবেষণা কেন্দ্রে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। একুশে সেপ্টেম্বর সকালে ওর ডেডবডি পাওয়া যায় পোডড়া খনি এলাকয়। পুলিশ এ পর্যন্ত কোনও কিনারা করতে পারেনি সে-কেসের।
তোমাদের সঙ্গে আলাপ ছিল তাঁর।
হ্যাঁ, অনুরাধার সঙ্গে সুদীপ্তের গোপন সম্পর্ক ছিল। সেটা শুধু আমিই জানতুম। অনুরাধার সঙ্গে ওর বিয়েও হয়ে যেত এতদিনে।
হুঁ, তারপর?
সুদীপ্তের দিদি বিশাখাদির সঙ্গে দেখা করে সাইকেলরিকশোয় ফিরে এসেছিলুম। পার্বতীতলার মোড়ে রিকশো ছেড়ে ভাবলুম, বাকি রাস্তা হেঁটে যাব। হাঁটতে, আমার ভাল লাগে। তখন অবশ্য রাত দশটা বেজে গেছে। অনুরাধা আমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকে। পার্বতীতলা থেকে একটুখানি পথ মাত্র। কিন্তু হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। তখন দৌড়ে মঞ্জুশ্রীদের বাড়ি ঢুকলাম। মঞ্জুশ্রী মানে–
বুঝতে পেরেছি। বলো।
মঞ্জুশ্রীর পিসতুতো দাদা অরুণেন্দুর সঙ্গে আলাপ হল ওদের বাড়িতে। সে সিয়াসের আসর করতে চাইল। ব্যাপারটা আমার জানার আগ্রহ ছিল। ওদের ডাইনিং টেবিলে আসর বসানো হল। অরুণেন্দু কেন জানি অনুরাধাকেই মিডিয়াম হতে রাজি করাল। আমাকে অবাক করে অনুরাধা রাজি হয়ে গেল। সিয়াসের আসর কীভাবে হয় জানতুম না। অরুণেন্দু বুঝিয়ে দিল।
ভাবনা সে রাতের ব্যাপারটা বর্ণনা করলে কর্নেল বললেন, অনুরাধা সুদীপ্তের নাম লিখেছিল?
লিখেছিল–মানে সুদীপ্তের আত্মা ভর করেছিল ওর মধ্যে। সেই লিখেছিল।
আর কী লিখেছিল?
অরুণেন্দু প্রশ্ন লিখছিল আর সুদীপ্তের আত্মা তার জবাব লিখছিল। একটু পরে হঠাৎ অনুরাধা অজ্ঞান হয়ে গেল। আসর ভেঙে গেল। কী লিখেছিল ওরা, আর দেখিনি। কাগজটা অরুণেন্দুর হাতেই ছিল। সে একটু পরে ওটা ওর মামা ডঃ রায়কে দিল। উনি রেখে দিলেন কাগজটা।
কাগজটা তাহলে তুমি দেখনি?
না।
বাড়ি ফেরার পর কোনও সময় অনুরাধাকে জিগ্যাসা করোনি কিছু?
করেছিলুম। ও বলেছিল, কিছু জানে না। কী লিখেছিল ওর মনে নেই।
সুদীপ্তের মৃত্যুর পর অনুরাধা ওর সম্পর্কে এমন কিছু কি বলেছিল তোমাকে, যাতে তোমার ধারণা হয়েছিল যে সে কিছু জানত?
ভাবনা একটু ভেবে বলল, না তো। এমন কী কাকে ওর সন্দেহ হয় তাও বলেনি। কিন্তু ….
কিন্তু?
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, অনুরাধা হয়তো কিছু জানত। আমাকে বলেনি।
কেন মনে হচ্ছে?
কাল দুপুরে অনুরাধা আমাকে ফোন করে বলেছিল, বিকেলে ফুলঝরিয়া লেকে বেড়াতে যাবে। আমি ওর সঙ্গে যাব কি না। আমি বললুম– গাড়ি ছাড়া যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু বাবাকে গাড়ির কথা বললে জিগ্যেস করবেন কোথায় যাচ্ছি। ফুলঝরিয়ার নাম শুনলে কিছুতেই যেতে দেবেন না। ট্যাক্সি করে যাওয়া যায়। কিন্তু ফেরার সময় ট্যাক্সি পাব না। রিকশোও পাব না। হাঁটতে হবে। তাই ওকে বারণ করলুম। অনুরাধা ঠিক আছে বলে ফোন ছেড়ে দিল। তো ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পরে ওদের বাড়ি গিয়ে শুনলুম ও এইমাত্র বেরিয়ে গেছে। আমি ভাবতেই ও একা ফুলঝরিয়া চলে গেছে। কিন্তু এখন অবাক লাগছে, কেন ফুলঝরিয়া যেতে চেয়েছিল অনুরাধা?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজে হেলান দিলেন। তারপর বললেন, সিয়াসের আসরের ব্যাপারটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, বুঝতে পারছি। কেন তা তুমি ওই ব্যাপারটাই বলতে গিয়েছিলে শৰ্মাজীর কাছে। অথচ তুমি বলছ, সুদীপ্তের আত্মাই অনুরাধার শরীরে ভর করেছিল।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কর্নেল! একবার মনে হচ্ছে, অনুরাধা ইচ্ছে করেই দুষ্টুমি করেছিল। আবার মনে হচ্ছে, তাহলে ও হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল কেন? অথচ খালি সন্দেহ হচ্ছে, ওর খুন হয়ে যাওয়ার পেছনে যেন সিয়াসের ব্যিাপারটার কোনও যোগাযোগ আছে।
কী যোগাযোগ থাকতে পারে ভাবছো?
এক হতে পারে, অনুরাধার হাত দিয়ে সুদীপ্তের আত্মা এমন কিছু লিখেছিল, যা তার খুনীকে ধরিয়ে দেবে। আর এক হতে পারে, অনুরাধা দুষ্টুমি করে–তার মানে, অভিনয় করে আসরের কাউকে কোনও হিন্ট দিতে চাইছিল।
অর্থাৎ সে জানত কে খুন করেছে সুদীপ্তকে?
ধরুন, তাই।
তাহলে তো বলতে হয়, খুনী ওই আসরেই উপস্থিত ছিল?
ভাবনা চমকে উঠল। আসরে তো ছিল সুমন ব্যানার্জি, অরুণেন্দু, মঞ্জুশ্রী আর আমি। অরুণেন্দু কলকাতায় থাকে। বেড়াতে এসেছে। আমি সুদীপ্তকে খুন করি নি। আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। মঞ্জুশ্রীও তাই। বাকি রইল সুমন। কিন্তু সুমন কেন সুদীপ্তকে খুন করবে? তাছাড়া সুমন অত্যন্ত নিরীহ ছেলে। খুব ভদ্র।
কাগজটা ডঃ রায় নিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। ভাবনা জোরের সঙ্গে বলল। কিন্তু উনিই বা কেন সুদীপ্তকে খুন করবেন? সুদীপ্ত তো ওঁরই অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। মঞ্জুর সঙ্গে প্রথমে সুদীপ্তেরই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সুদীপ্ত রাজি হয়নি। কিন্তু তাই বলে তাকে মেরে ফেলবেন? এ একেবারে অসম্ভব।
তাহলে স্বীকার করতে হয়, সত্যি সুদীপ্তের আত্মা এসেছিল। কিন্তু খুনীকে ধরিয়ে দেবে এমন কোনও সূত্র লিখেছিল সেই কাগজটাতে–এর প্রমাণ কী? তুমি তো দেখনি ওটা। কাজেই ওতে কী ছিল না দেখা পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় কি?
ভাবনা আস্তে বলল, আমার সন্দেহ যাচ্ছে না। আপনি একবার যাবেন আমার সঙ্গে ডঃ রায়ের কাছে?
কর্নেল, বললেন, চলো, যাই।…
ডঃ কুসুমবিহারী রায় কর্নেলের পরিচয় পেয়ে খুব আগ্রহের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাইলেন। কাগজটা তক্ষুনি এনে দিলেন কর্নেলকে। বললেন, ভাবনা খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। ওর সঙ্গে আমি একমত। আমিও ঠিক একই সন্দেহে ভুগছি। কিন্তু পুলিশকে আগ বাড়িয়ে এ ব্যাপারটা জানাতে যাইনি। কারণ আশা করি, বুঝতেই পারছেন। পুলিশ বড় আনপ্রেডিক্টেবল! উল্টে আমাদের কাউকে জড়িয়ে বসবে হয়তো। তবে ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব চিন্তাভাবনা করেছি। এর একটা আশকারা হওয়া দরকার। দীপ্তেন্দু আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিল–অনুরাধাও।
কর্নেল কাগজটা দেখছিলেন। পেন্সিলে লেখা। ৩৪৭ নং পিট, কালো পাথর, মোহান্তজী। বললেন, এই কথাগুলো অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন কি!
ডঃ রায় চিন্তিতমুখে বললেন, খনি এরিয়ার ম্যাপ দেখে বুঝতে পেরেছি, ওটা একটা ডেড মাইন। জায়গাটা আট কিলোমিটার দূরে ফুলঝরিয়া লেকের পশ্চিম দিক দিয়ে যে হাইওয়ে গেছে, সেই রাস্তায় ডেড মাইন এলাকায় যাওয়া যায়। সবই অ্যাবাণ্ডাণ্ড মাইন। মুখ সিল করা আছে। দেখাচ্ছি আপনাকে।
বলে উনি ভেতরের ঘর থেকে একটা ম্যাপ নিয়ে এলেন। সেটা টেবিলে ছড়িয়ে এলাকাটা দেখিয়ে দিলেন। এই হল পিট নং ৩৪৭। এই দেখুন, লেখাই আছে। মুখটা পাথর আর কংক্রিটের চামড়া দিয়ে সিল করা আছে। এটা ছিল অভ্রের খনি।
কর্নেল বললেন, আর কালো পাথর?
কালোপাথর তো বারাহিয়া ব্লকের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এর অর্থ কী বুঝতে পারিনি।
মোহান্তজী?
ডঃ রায় বলার আগেই ভাবনা বলে উঠল, কেন? পার্বতীমন্দিরের মোহান্তজী!
ডঃ রায় বললেন, হ্যামন্দিরের সেবায়েত উনি। উনি ছাড়া আর এ এরিয়ার তো কোনো মোহান্তজী নেই। কিন্তু মোহান্তজী তো বুড়ো মানুষ। মন্দিরেই থাকেন প্রায় সারাক্ষণ। ওঁর নাম কেন লিখল–অনুরাধা লিখুক অথবা দীপ্তরে আত্মাই লিখুক–কিছুতেই মাথায় আসছে না।
আপনার ভাগ্নে অরুণেন্দু আছেন কি?
মঞ্জুশ্রী বলল, অরুদা একটু আগে বেরিয়েছে। কোথায় গেছে বলে যায়নি।
ডঃ রায় একটু হাসলেন। ওঁর ওই অভ্যাস! টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো। এখানে এসে একদণ্ড ঘরে বসে থাকতে চায় না। ভূতপ্রেতের খোঁজেই হয়তো ঘুরে বেড়ায়।
মীনাক্ষী বললেন, নিশ্চয় মোহান্তজীর কাছে গিয়ে বসে আছে। মোহান্তজীও যে ওর দোসরা ভূতের ওঝা!
ডঃ রায় হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ–মোহান্তজী বস্ত এরিয়ার সব ভূতপ্রেতের একচেটিয়া মালিক। বস্তর মেয়েদের নাকি প্রায়ই ভূতে ধতে। ওঁর পোষা প্রেত কিংবা পিশাচ ভূতটাকে তাড়িয়ে দেয়।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কাগজটা আর এই ম্যাপটা আমি একদিনের জন্য রাখতে চাই, ডঃ রায়। আপত্তি আছে কি?
না, না। রাখুন। ডঃ রায় ঘড়ি দেখে বললেন, আমাকেও এখনই অফিসে যেতে হবে। আবার দেখা হবে। এ বাড়িতে আপনার অবারিত দ্বার। তাছাড়া আমি চাই, সুদীপ্ত আর অনুরাধার খুনী ধরা পড়ুক। পুলিস হোপলেস! আপনি আমার কাছে সর্বপ্রকার সহযোগিতা পাবেন–আই অ্যাসিওর ইউ।…
রাস্তায় গিয়ে ভাবনা বলল, কর্নেল মোহান্তজীর কাছে যাবেন একবার?
চলো, যাই।
ভাবনা পা বাড়িয়ে বলল, ওই দেখা যাচ্ছে বটগাছের ভেতর মন্দিরের চুড়ো। কাছেই।
মন্দির এলাকা বেশ বড়। পাঁচিল ঘেরা প্রাঙ্গণ। একটা আটচালা আছে প্রাঙ্গণে। ওপাশে কয়েকটা একতলা ঘর। জরাজীর্ণ অবস্থা। মন্দিরটার চেহারা বেশ পরিচ্ছন্ন। পেছনে বিশাল বটগাছ আছে। মন্দিরের ভেতর একাদশ শতাব্দীর পার্বতীমূর্তি। পাশের একতলা ঘরের বারান্দায় খাটিয়া পেতে দাড়িজটাজুটধারী এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তিনিই মোহান্তজী। ভাবনাকে দেখে বললেন, আয় বেটি আয়।
ভাবনা প্রণাম করে শুধু কর্নেলের নাম জানিয়ে বলল, ইনি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন মোহান্তজী!
কর্নেল নমস্কার করলেন। মোহান্তজী খাটিয়ার ওধারে একটা চারপায়া দেখিয়ে বললেন, বৈঠিয়ে জী! বৈঠিয়ে!
কর্নেল বসে বললেন, আপনি কত বছর এ মন্দিরে আছেন মোহান্তজী?
এ মন্দিরে আমরা পুরুষানুক্রমে সেবাইত।
আপনার বয়স কত হল?
আশি-পঁচাশি হবে। মালুম নেই।
আচ্ছা মোহান্তজী, সত্যিই কি ভূতপ্রেত বলে কিছু আছে?
মোহান্তজী একটু অবাক হলেন যেন। বললেন, মনুষ্যাত্মা অমর কর্নেলসাব। যতদিন না জীবাত্মা ব্রহ্মলোকে পরমাত্মার সঙ্গে বিলীন হচ্ছে, ততদিন তার মুক্তি নেই। মানুষের মৃত্যু হওয়ার পর কিছুদিন তার জীবাত্মার মধ্যে ইহলোকের সব সংস্কার থেকে যায়। যতদিন সেটা থাকে, ততদিন সে প্রেত। ততদিন মায়া কাটাতে পারে না আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবদের। তাদের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়।
আপনি দীপ্তেন্দু মিত্রকে নিশ্চয় চিনতেন?
মোহান্তজী ভুরু কুঁচকে বললেন, কে?
দীপ্তেন্দু মিত্র–যে গতমাসে খুন হয়ে গেছে!
মোহান্তজী তীক্ষ্ণ দৃষ্টে কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, সে আপনার আত্মীয়?
হ্যাঁ। কর্নেল কপট গাম্ভীর্যে বললেন। কিছুদিন যাবৎ দীপ্তেন্দুকে খুব স্বপ্নে দেখছি।
হুঁ, স্বপ্নেও মনুষ্যাত্মা দেখা দেয় আত্মীয় স্বজনকে।
দীপ্তেন্দু স্বপ্নে আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলেছে। বুঝতে পারছি না। তাই আপনার কাছে এলাম।
ঝুট! প্রায় গর্জন করলেন মোহান্তজী। নড়ে বসলেন। খাঁটিয় মচমচ করে কেঁপে উঠল। ফের বললেন, সব ঝুট! ডাহা মিথ্যা! আপনি পুলিসের গোয়েন্দা। বেটি ভাবনা, এ কাকে আমার কাছে এনেছিস?
ভাবনার দিকে রক্তরাঙা চোখে মোহান্তজী তাকালে। ভাবনা বিব্রতভাবে বলল, না না। ইনি পুলিসের গোয়েন্দা নন, মোহান্তজী!
আলবত গোয়েন্দা। বলে মোহান্তজী কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। আপনি চলে যান এখান থেকে। আপনার কোনও কথার জবাব দেব না আমি।
কর্নেল অবাক হবার ভঙ্গি করে বললেন, এ কী বলছেন মোহান্তজী? আমি গোয়েন্দা হতে যাব কোন দুঃখে? সুদীপ্ত প্রায়ই আমাকে কালো পাথরের কথা বলে। আমি শুনলুম, আপনি প্রেসিদ্ধ। তাই আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি।
মোহান্তজী আরও আগুন হয়ে বললে, নিকাল যাইয়ে আপলোগ! তারপর পেছন ফিরে ডাকলেন, এ ভোলা! এ রামু! জলদি ইধার আ তো!
ভাবনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কর্নেল! মিছিমিছি অপমানিত হয়ে লাভ নেই। চলুন।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন মোহান্তজী, চলি চাহলে, আবার দেখা হবে।
মোহান্তজী গর্জন করে আবার ভোলা ও রামুকে ডাকতে লাগলেন। মন্দিরের পেছনথেকে দুট ষণ্ডামার্কা লোক উঁকি দিচ্ছিল। ভাবনা ফিসফিস বলে উঠল, ওরা খুব খারাপ লোক। চলে আসুন, কর্নেল।
বাইরের রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল একবার ঘুরলেন। মোহান্তজী তাঁদের দিকে আঙুল তুলে সেই ভোলা ও রামুকে কিছু বলছেন। লোকদুটোর চেহারা দেখে বোঝা যায়, ওরা গুণ্ডা প্রকৃতির। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, কী বুঝলে ভাবনা?
ভাবনা একটু হাসল। মোহান্তজী কালোথর শুনে এমন সাংঘাতিক রেগে গেলেন কেন, কে জানে!
অনুরাধা এ রহস্যের সঠিক চাবিকাঠিটা রেখে গেছে। শুধু এটুকুই বলতে পারি।
ঠিক বলেছেন, কর্নেল! কালোপাথর জিনিসটা যাই হোক, সুদীপ্ত আর অনুরাধা খুন হওয়ার সঙ্গে তার সল্ট আছে। ওকে অ্যারেস্ট করলে সব বেরিয়ে পড়বে।
আপনি শৰ্মাজীকে বলুন ব্যাপারটা।
বলব। আরও একটু এসে কর্নেল বললে, কি আছে। আমি এবার চলি, ভাবনা। আপাতত এ নিয়ে তুমি কারুর সঙ্গে আলোচনা কোরো না। আর শোনো, সাবধানে থেকো। যথাসময়ে আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
ভাবনা তাদের বাড়ির রাস্তা ধরল। কর্নেল চললেন বাংলার পথে ….