দুই
কিছুক্ষণ পরে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে ফের লনে পৌঁছলুম। ভারত চেয়ারগুলো ঠিকঠাক করে দিল। এখনও চাঁদ খুব ঝকমক করছে না। রাত্রি এখন আমাদের সঙ্গে। সে হাসিখুশি। পায়ের ওপর পা তুলে দোলাচ্ছে এবং দিগুকে কবিতা শোনাতে বলছে। সেই কবিতাটাই শুনতে চায় সে বারান্দা থেকে নাকি শুনছিল কিছুক্ষণ আগে। দিগু একটু কেসে রেকর্ড বাজানোর ভঙ্গিতে চাপা আবৃত্তি করে গেল
ধীরে বৃও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায় আজ
বিষাদের সুর বাজে, মৃত্যু অনুগামী।
উজ্জ্বলতাগুলি নিল কঠিন শামুক–
গোরস্থানে সংহত কফিনে…
হঠাৎ রাত্রি বাধা দিল, দিগম্বাবু! এ কিন্তু আচমকা রসভঙ্গ হলো–যাই বলুন। রাত্রি হেসে উঠল।
দিগু বলল, কেন বলুন তো? (আশ্চর্য, দিগুর চোখদুটও অত নীল কেন? জান্তব কেন?)
বেশ চলছিল। হঠাৎ শামুক গোরস্থান কফিন…এসব কী। যেন পূরবী-তে আচমকা ঝাঁপতালে মালকৌষের আক্রমণ!..রাত্রি মাঝে মাঝে কী চমৎকার সুস্থ ও স্বাভাবিক কথা বলছে! তার স্বামী দুঃখিত মুখে তাকালেন কি তার দিকে? মৃদু চাঁদের গোলাপী আভা ছাড়া আলো নেই–তাই সব দুঃখময় মনে হচ্ছিল।
দিগু বলল, একটা গোরস্থান দেখলুম ওখানে। তাই।
জেলাশাসক জানালেন, হ্যাঁ। দ্যাটস এ ট্রাজিক স্টোরি। ১৯৪২-এ এদিকে অগাস্ট আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ সরকার একদল সোলজার পাঠায়। তারা সেই ভয়ঙ্কর সমুদ্রবন্যায় মারা যায়। তারপর…..বলেই ঘাড় ঘুড়িয়ে কী দেখতে দেখতে ফের বললেন, আশ্চর্য! কর্নেলের গাড়ির শব্দ শুনলুম কতক্ষণ আগে, মনে হলো আলোও দেখেছি–অথচ এখনও আসছেন না তো!
রাত্রি সুস্থ। ও বলল, ওঁর যা অভ্যাস। কোনও বালিয়াড়ির চুড়োয় বসে চাঁদ দেখছেন।
এই সময় ফাঁক পেয়ে তাকে জিগ্যেস করলুম, মিসেস মজুমদার, ইয়ে–আপনি জানালার নিচে যে লোকটা দেখেছিলেন, তার পোশাক কী রকম?
নিশ্চয় ভুল করলুম। কারণ, অমনি রাত্রি ফের সুস্থতা হারাল। সে হি-হি-হি-হি করে এত জোরে হাসল যে চুল খুলে গেল। তার চশমা পড়ে গেল। সে দিগুর দিকে আঙুল তুলে অসংলগ্ন ভাবে বলে উঠল–এর মতো–ঠিক এই ভদ্রলোকের মতো! ওই পোশাক! ওইরকম চেহারা! আমি ওকে আর তাবলে ভয় পাচ্ছিনে। উ–আমি কি কচি মেয়ে? এবং তাতেও ক্ষান্ত হলো না। সে উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে আরও বলল–কী ভেবে এসেছ তোমরা? কী মতলব? এই ডি এম বাহাদুর! এদের অ্যারেস্ট করছ না কেন? এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্স কী জন্যে এসেছে জানো?
বিহ্বল বিব্রতমুখে টেবিলের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওর কাধ ধরে বললেন, প্লীজ, প্লীজ! রাত্রি, আর নয়। ছি ছি, এ কী করছ তারপর চেয়ার থেকে উঠে এসে ওকে ধরলেন। নিয়ে গেলেন বাংলোর দিকে। আমি প্রচণ্ড অপ্রস্তুত-মুখ নিচু করে বসে রয়েছি। দিগন্ত চাঁদ দেখছে। অমু রাগী-চোখে আমাকে লক্ষ্য করছে।
তারপর বিহ্বল এলেন। এসে বললেন, নেভার মাইণ্ড! হ্যালুসিনেশান তো সজ্ঞানে হয় না। তবে আশ্চর্য, ও প্রতিবারই জানালার নীচেকার লোকটার যা বর্ণনা দিচ্ছে, তার সঙ্গে দিগন্তবাবুর পোশাক বা চেহারার আশ্চর্য মিল!
দিগন্ত নার্ভাস হেসে বলল, কিন্তু আমি তো বরাবর এখানে আছি। পিছনে যাই-ই নি।
ডি এম বললেন, সেই হচ্ছে মজা। এক মিনিট–দেখাচ্ছি। ডাক্তারদের হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেই ভাবছিলুম কিছু করা যায় নাকি। আফটার অল, এ তো মানসিক ব্যাপার। দেন–হুঁ ইজ হার অলটাইম কম্পানিয়ান, তার পক্ষে অনেককিছু করা সম্ভব। আমি তাই হ্যাঁলুসিনেশানের ব্যাপারে পড়াশুনা আরম্ভ করলুম। আশ্চর্য লাগছে–এই একটু আগে মনে পড়ল, আমার কাছে একটা ভালো বই রয়েছে তার এক জায়গায় অবিকল জানলার নিচে একটা লোকের হ্যালুসিনেশান বর্ণনা করা হয়েছে। ভারত! আমার টেবিল থেকে সবচেয়ে মোটা বইটা নিয়ে এস তো।
ভারত তক্ষুনি এনে দিল। এবং একটা হারিকেনও। বিহ্বল পাতা উল্টে খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। আমি টেবিলে আদ্ধেকভরা অসমাপ্ত গ্লাসগুলোর দিকে তাকালুম। এবার একটু উত্তেজনার দরকার। কিন্তু কেউ খাচ্ছে না কেন?
বিহ্বল পড়া শুরু করলেন : বইটার নাম ফেনোমেনোলজি অফ পারসেপসান। লেখক মার্লো পোঁতি। এই যে, ৩৪২ পাতায়।
The hallucination is not a perception, but it has the value of reality, and it alone counts for the victim. The world has lost its expressive force and the hallucinatory system has usurped it. এরপর দেখুন ইয়েস, পেজ aptats 2115 63PS: Hallucination causes the real to disintegrate before our eyes, and puts a quasi-reality in its place. তারপর এই চরম জায়গা–যা অবিকল আমার মিসেস বলছে, She could see a man standing in the garden under her window and pointed to the spot, giving a description to the mans clothes and general bearing, was astonished when someone was actually placed in the garden at the spot in question, wearing the same clothes and the same feature. She looked carefully, and exclaimed, yes, there is someone but it is somebody else!
তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠলুম-আশ্চর্য তো!
সম্ভবত রাত্রি বইটা পড়েছে। সেটা স্বাভাবিক। ও ছিল ফিলসফির ছাত্রী। এ বইটা আসলে বুঝতেই পারছেন নাম শুনে একটা ফিলসফির বই। এবং এই অংশটা পড়েই শী ইজ কোয়াইট ইমপ্রেসড। মাথায় ঢুকে গেছে।
অমু আস্তে বলল–অ্যাণ্ড অ্যাটাকড উইথ হেল। হ্যাঁ চিয়ার্স! সে অধীর হয়ে গ্লাস তুলল।
সবাই তুললুম অসমাপ্ত গ্লাসগুলো। বিহ্বলও চিয়ার্স বলে নতুন দফায় শুরু করার ভঙ্গিতে গ্লাস তুলে ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেলেন।
সেই সময় দূরে গরগর গাড়ির শব্দ হচ্ছিল, চঁদটাও সোনালি হয়ে পড়েছিল কখন, একটা আচমকা জোরাল বাতাস এসে ল্যাম্প নিবিয়ে দিল, তারপর প্রথমে আমিই দেখলুম বিহ্বল মজুমদার পড়ে গেলেন খালি চেয়ারটার ওপর এবং নিঃশব্দে এবং সেই চেয়ারটাও ধুড়মুড় করে ওঁকে নিয়ে উল্টে পড়ল। ওঁর পা দুটো টেবিলের দিকে ছিটকে এল। জিনের সাদা বোতলটা উল্টে পড়ে গেল। তিনজনেই লাফিয়ে উঠলুম একসঙ্গে। মাত্র এক সেকেণ্ড। আমার হাতে লেগে নিভন্ত বাতিটা পড়ে ভাঙল।
তারপর অমু ভারি গলায় ডাকল–মিঃ মজুমদার। মিঃ মজুমদার।
এরই মধ্যে নেশায় ভদ্রলোক টাল সামলাতে পারলেন না? আরও কয়েক সেকেণ্ড গেল। তখন দিগু লাফ দিয়ে এগিয়ে দুকাধ ধরে ওঠানোর চেষ্টা করল ভদ্রলোককে। পরক্ষণে ওঁর মুখে চাঁদের আলো পড়ায় আঁতকে উঠলুম। কষায় ফেনা বুজবুজ করছে। নাকের নিচে কালো দাগটা কিসের–ধাবমান ঠোঁটের দিকে? ও কি রক্ত? আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, রক্ত রক্ত! আর–আরও দেখলুম, চোখদুটো সাদা, ওল্টানো তারা, সে এক ভয়ঙ্কর মুখ।
দিগন্ত চেঁচিয়ে উঠল, ভারত ভারত! আলো লে আও, লাইট! ভারত যে ওড়িয়া, তা সে ভুলে গেছে নির্ঘাৎ।
আমাদের ওপর কার ছায়া পড়ল। আমরা মুখ ফিরিয়ে নোকটাকে দেখলুম। বিলিতি পোশাকপরা লোকটা..মুখে সাদা দাড়ি রয়েছে, মাথায় টাক চকচক করছে জ্যোৎস্নায়, হাতে একটা ছড়ি–এসে বললেন, মাই গুডনেস! মজুমদার! হোয়াট হ্যাপনড?
আমরা কী জবাব দেব? ইনিই তাহলে সেই কর্নেল সরকার–ছনম্বর খালি চেয়ারের লোকটি! হাঁটু দুমড়ে বসে কী সব পরীক্ষা করে মুখ তুলে আমাদের উদ্দেশে বললেন, হি ইজ ডেড। হোয়াট হ্যাপনড?
ডেড! একসঙ্গে তিনটি গলা চিড় খেল।.. মারা গেছেন! সে কী! তারপর একটু নড়ে চড়ে অমু আস্তে বলল, জানি না। গ্লাস থেকে জীনটুকু খেয়েই নাকি এমন হলো?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, রাত্রি! রাত্রি!
কিন্তু রাত্রি ঘর থেকে সেই মুহূর্তে আবার বুক ফেটে কেঁদে উঠল–সেই লোকটা এসেছে! জানালার নীচে সেই লোকটা।
কিন্তু আমরা কেউ এবার নড়ছি। ভারত দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে একটা হেরিকেন ল্যাম্প আনল। তখন বুড়ো মানুষটি ঠিক সামরিক ভঙ্গিতে বললেন, মাই ইয়ং ফ্রেণ্ডস! প্লীজ আপনারা এখান থেকে সরে আসুন। হিয়ার ইজ এ কেস অফ মার্ডার! আই জাস্ট স্মেল। ডোন্ট টাচ এনিথিং। ইস, একটু আগে এলে…ভারত! তুমি ড্রাইভারের সঙ্গে গাড়িতে চলে যাও–এক্ষুণি। কন্টিডিহি থানায় চলে যাও। আমার কথা বলবে। যা সব করার ওরাই করবে। মহিন্দর! এদিকে এস।
মার্ডার! আমরা নিমূর্তি একটু তফাতে ঘাসের মধ্যে পা ডুবিয়ে মড়াটা দেখতে থাকলুম–নাকি রাত্রির জন্য, নাকি ভয়ের জন্য, হতচেতন, শীতল এবং বাকশূন্য। চাঁদটা আবার গলে আঠায় ডুবে যেতে থাকল চিকনডিহির মাঠ। চটচটে জ্যোৎস্নায় কে যেন সুর করে সেই কবিতাটি পড়তে থাকল :
ধীরে বও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায়
আজ বিষাদের সুর বাজে, মৃত্যু অনুগামী।
পরে শুনেছিলুম, রাত্রিই আবৃত্তি করছিল তার ঘরে–একলা, কিন্তু কেন যেন বারবার দুট লাইনই কানে আসতে লাগল : উজ্জ্বলতাগুলি নিল কঠিন শামুক/গোরস্থানে সংহত কফিনে…