বলা বাহুল্য যে, জগৎসিংহের সে রাত্রে নিদ্রা আসিল না। শয্যা অগ্নিবিকীর্ণবৎ, হৃদয়মধ্যে অগ্নি জ্বলিতেছে। যে তিলোত্তমা মরিলে জগৎসিংহ পৃথিবী শূন্য দেখিতেন, এখন সে তিলোত্তমা প্রাণত্যাগ করিল না কেন, ইহাই পরিতাপের বিষয় হইল।

সে কি? তিলোত্তমা মরিল না কেন? কুসুমকুমার দেহ, মাধুর্যময় কোমলালোকে বেষ্টিত যে দেহ, যে দিকে জগৎসিংহ নয়ন ফিরান, সেই দিকে মানসিক দর্শনে দেখিতে পান, সে দেহ শ্মশানমৃত্তিকা হইবে? এই পৃথিবী – অসীম পৃথিবীতে কোথাও সে দেহের চিহ্ন থাকিবে না? যখন এইরূপ চিন্তা করেন, জগৎসিংহের চক্ষুতে দর দর বারিধারা পড়িতে থাকে; অমনি আবার দুরাত্মা কতলু খাঁর বিহারমন্দিরের স্মৃতি হৃদয়মধ্যে বিদ্যুদ্বৎ চমকিত হয়, সেই কুসুমসুকুমার বপু পাপিষ্ঠ পাঠানের অঙ্কন্যস্ত দেখিতে পান, আবার দারুণাগ্নিতে হৃদয় জ্বলিতে থাকে।

তিলোত্তমা তাঁহার হৃদয়-মন্দিরাধিষ্ঠাত্রী দেবীমূর্তি।

সেই তিলোত্তমা পাঠানভবনে!

সেই তিলোত্তমা কতলু খাঁর উপপত্নী!

আর কি সে মূর্তি রাজপুতে আরাধনা করে?

সে প্রতিমা স্বহস্তে স্থানচ্যুত করিতে সঙ্কোচ না করা কি রাজপুতের কুলোচিত?

সে প্রতিমা জগৎসিংহের হৃদয়মধ্যে বদ্ধমূল হইয়াছিল, তাহাকে উন্মূলিত করিতে মূলাধার হৃদয়ও বিদীর্ণ হইবে। কেমন করিয়া চিরকালের জন্য সে মোহিনী মূর্তি বিস্মৃত হইবেন? সে কি হয়? যতদিন মেধা থাকিবে, ততদিন অস্থি-মজ্জা-শোণিত-নির্মিত দেহ থাকিবে, ততদিন সে হৃদয়েশ্বরী হইয়া বিরাজ করিবে!

এই সকল উৎকট চিন্তায় রাজপুত্রের মনের স্থিরতা দূরে থাকুক, বুদ্ধিরও অপভ্রংশ হইতে লাগিল, স্মৃতির বিশৃঙ্খলা হইতে লাগিল; নিশাশেষেও দুই করে মস্তক ধারণ করিয়া বসিয়া আছেন, মস্তিষ্ক ঘুরিতেছে, কিছুই আলোচনা করিবার আর শক্তি নাই।

একভাবে বহুক্ষণ বসিয়া জগৎসিংহের অঙ্গবেদনা করিতে লাগিল; মানসিক যন্ত্রণার প্রগাঢ়তায় শরীরে জ্বরের ন্যায় সন্তাপ জন্মিল, জগৎসিংহ বাতায়নসন্নিধানে গিয়া দাঁড়াইলেন।

শীতল নৈদাঘ বায়ু আসিয়া জগৎসিংহের ললাট স্পর্শ করিল। নিশা অন্ধকার; আকাশ অনিবিড় মেঘাবৃত; নক্ষত্রাবলী দেখা যাইতেছে না, কদাচিৎ সচল মেঘখণ্ডের আবরণাভ্যন্তরে কোন ক্ষীণ তারা দেখা যাইতেছে; দূরস্থ বৃক্ষশ্রেণী অন্ধকারে পরস্পর মিশ্রিত হইয়া তমোময় প্রাচীরবৎ আকাশতলে রহিয়াছে, নিকটস্থ বৃক্ষে বৃক্ষে খদ্যোতমালা হীরকচূর্ণবৎ জ্বলিতেছে; সম্মুখস্থ এক তড়াগে আকাশ বৃক্ষাদির প্রতিবিম্ব অন্ধকারে অস্পষ্টরূপ স্থিত রহিয়াছে।

মেঘস্পৃষ্ট শীতল নৈশ বায়ুসংলগ্নে জগৎসিংহের কিঞ্চিৎ দৈহিক সন্তাপ দূর হইল। তিনি বাতায়নে হস্তরক্ষাপূর্বক তদুপরি মস্তক ন্যস্ত করিয়া দাঁড়াইলেন। উন্নিদ্রায় বহুক্ষণাবধি উৎকট মানসিক যন্ত্রণা সহনে অবসন্ন হইয়াছিলেন; এক্ষণে স্নিগ্ধ বায়ুস্পর্শে কিঞ্চিৎ চিন্তাবিরত হইলেন, একটু অন্যমনস্ক হইলেন। এতক্ষণ যে ছুরিকা সঞ্চালনে হৃদয় বিদ্ধ হইতেছিল, এক্ষণে তাহা দূর হইয়া অপেক্ষাকৃত তীক্ষ্ণতাশূন্য নৈরাশ্য মনোমধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। আশা ত্যাগ করাই অধিক ক্লেশ; একবার মনোমধ্যে নৈরাশ্য স্থিরতর হইলে আর তত ক্লেশকর হয় না। অস্ত্রাঘাতই সমধিক ক্লেশকর; তাহার পর যে ক্ষত হয়, তাহার যন্ত্রণা স্থায়ী বটে, কিন্তু তত উৎকট নহে। জগৎসিংহ নিরাশার মৃদুতর যন্ত্রণা ভোগ করিতে লাগিলেন। অন্ধকার নক্ষত্রহীন গগন প্রতি চাহিয়া, এক্ষণে নিজ হৃদয়াকাশও যে তদ্রূপ অন্ধকার নক্ষত্রহীন হইল, সজল চক্ষুতে তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। ভূতপূর্ব সকল মৃদুভাবে স্মরণ পথে আসিতে লাগিল; বাল্যকাল, কৈশোরপ্রমোদ, সকল মনে পড়িতে লাগিল; জগৎসিংহের চিত্ত তাহাতে মগ্ন হইল; ক্রমে অধিক অন্যমনস্ক হইতে লাগিলেন, ক্রমে অধিক শরীর শীতল হইতে লাগিল; ক্লান্তিবসে চেতনাপহরণ হইতে লাগিল; বাতায়ন অবলম্বন করিয়া জগৎসিংহের তন্দ্রা আসিল। নিদ্রিতাবস্থায় রাজকুমার স্বপ্ন দেখিলেন; গুরুতর যন্ত্রণাজনক স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন; নিদ্রিত বদনে ভ্রূকুটি হইতে লাগিল; মুখে উৎকট ক্লেশব্যঞ্জক ভঙ্গী হইতে লাগিল; অধর কম্পিত, বিচলিত হইতে লাগিল; ললাট ঘর্মাক্ত হইতে লাগিল; করে দৃঢ়মুষ্টি বদ্ধ হইল।

চমকের সহিত নিদ্রাভঙ্গ হইল; অতি ব্যস্তে কুমার কক্ষমধ্যে পাদচারণ করিতে লাগিলেন; কতক্ষণ এইরূপ যন্ত্রণা ভোগ করিতে লাগিলেন, তাহা নিশ্চিন্ত বলা সুকঠিন; যখন প্রাতঃসূর্যকরে হর্ম্য-প্রাকার দীপ্ত হইতেছিল, তখন জগৎসিংহ হর্ম্যতলে বিনা শয্যায়, বিনা উপাধানে লম্বমান হইয়া নিদ্রা যাইতেছিলেন।

ওসমান আসিয়া তাঁহাকে উঠাইলেন। রাজপুত্র নিদ্রোত্থিত হইলে, ওসমান তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া তাঁহার হস্তে একখানি পত্র দিলেন। রাজপুত্র পত্র হস্তে লইয়া নিরুত্তরে ওসমানের মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। ওসমান বুঝিলেন, রাজপুত্র আত্ম-বিহ্বল হইয়াছেন। অতএব এক্ষণে প্রয়োজনীয় কথোপকথন হইতে পারিবে না, বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “রাজপুত্র! আপনার ভূশয্যার কারণ জিজ্ঞাসা করিতে আমার কৌতূহল নাই। এই পত্র-প্রেরিকার নিকট আমি প্রতিশ্রুত ছিলাম যে, এই পত্র আপনাকে দিব; যে কারণে এতদিন এই পত্র আপনাকে দিই নাই, সে কারণ দূর হইয়াছে। আপনি সকল জ্ঞাত হইয়াছেন। অতএব পত্র আপনার নিকট রাখিয়া চলিলাম, আপনি অবসরমতে পাঠ করিবেন; অপরাহ্নে আমি পুনর্বার আসিব। প্রত্যুত্তর দিতে চাহেন, তাহাও লইয়া লেখিকার নিকট প্রেরণ করিতে পারিব।”

এই বলিয়া ওসমান রাজপুত্রের নিকট পত্র রাখিয়া প্রস্থান করিলেন।

রাজপুত্র একাকী বসিয়া সম্পূর্ণ সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হইলে, বিমলার পত্র পাঠ করিতে লাগিলেন। আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া অগ্নি প্রস্তুত করিয়া তাহাতে নিক্ষেপ করিলেন। যতক্ষণ পত্রখানি জ্বলিতে লাগিল, ততক্ষণ তৎপ্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। যখন পত্র নিঃশেষ দগ্ধ হইয়া গেল, তখন আপনা আপনি কহিতে লাগিলেন, “স্মৃতিচিহ্ন অগ্নিতে নিক্ষেপ করিয়া নিঃশেষ করিতে পারিলাম, স্মৃতিও ত সন্তাপে পুড়িতেছে, নিঃশেষ হয় না কেন?”

জগৎসিংহ রীতিমত প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিলেন। পূজাহ্নিক শেষ করিয়া ভক্তিভাবে ইষ্টদেবকে প্রণাম করিলেন; পরে করজোড়ে ঊর্ধ্বদৃষ্টি করিয়া কহিতে লাগিলেন, “গুরুদেব! দাসকে ত্যাগ করিবেন না। আমি রাজধর্ম প্রতিপালন করিব; ক্ষত্রকুলোচিত কার্য করিব; ও পাদপদ্মের প্রসাদ ভিক্ষা করি। বিধর্মীর উপপত্নী এ চিত্ত হইতে দূর করিব; তাহাতে শরীর পতন হয়, অন্তকালে তোমাকে পাইব। মনুষ্যের যাহা সাধ্য তাহা করিতেছি, মনুষ্যের যাহা কর্তব্য তাহা করিব। দেখ গুরুদেব! তুমি অন্তর্যামী, অন্তস্থল পর্যন্ত দৃষ্টি করিয়া দেখ, আর আমি তিলোত্তমার প্রণয়প্রার্থী নহি, আর আমি তাহার দর্শনাভিলাষী নহি, কেবল কাল ভূতপূর্বস্মৃতি অনুক্ষণ হৃদয় দগ্ধ করিতেছে। আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়াছি, স্মৃতিলোপ কি হইবে না? গুরুদেব! ও পদপ্রসাদ ভিক্ষা করি। নচেৎ স্মরণের যন্ত্রণা সহ্য হয় না।”

প্রতিমা বিসর্জন হইল।

তিলোত্তমা তখন ধূলিশয্যায় কি স্বপ্ন দেখিতেছিল? এ ঘোর অন্ধকারে, যে এক নক্ষত্র প্রতি সে চাহিয়াছিল, সেও তাহাকে আর করবিতরণ করিবে না। এ ঘোর ঝটিকায় যে লতায় প্রাণ বাঁধিয়াছিল, তাহা ছিঁড়িল; যে ভেলায় বুক দিয়া সমুদ্র পার হইতেছিল, সে ভেলা ডুবিল।