» » » সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিমলার পত্র সমাপ্ত

সপ্তম পরিচ্ছেদ
বিমলার পত্র সমাপ্ত

“আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে, গড় মান্দারণের কোন দরিদ্রা রমণী আমার পিতার ঔরসে গর্ভবতী হয়েন। আমার মাতার যেরূপ অদৃষ্টলিপির ফল, ইঁহারও তদ্রুপ ঘটিয়াছিল। ইঁহার গর্ভেও একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে, এবং কন্যার মাতা অচিরাৎ বিধবা হইলে, তিনি আমার মাতার ন্যায়, নিজ কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা অর্থোপার্জন করিয়া কন্যা প্রতিপালন করিতে লাগিলেন। বিধাতার এমত নিয়ম নহে যে, যেমন আকর, তদুপযুক্ত সামগ্রীরই উৎপত্তি হইবে। পর্বতের পাষাণেও কোমল কুসুমলতা জন্মে; অন্ধকার খনিমধ্যেও উজ্জ্বল রত্ন জন্মে। দরিদ্রের ঘরেও অদ্ভুত সুন্দরী কন্যা জন্মিল। বিধবার কন্যা গড় মান্দারণ গ্রামের মধ্যে প্রসিদ্ধ সুন্দরী বলিয়া পরিগণিতা হইতে লাগিলেন। কালে সকলেরই লয়; কালে বিধবার কলঙ্কেরও লয় হইল। বিধবা সুন্দরী কন্যা যে জারজা, এ কথা অনেকে বিস্মৃত হইল। অনেকে জানিত না। দুর্গমধ্যে প্রায় এ কথা কেহই জানিত না। আর অধিক কি বলিব? সেই সুন্দরী তিলোত্তমার গর্ভধারিণী হইলেন।

তিলোত্তমা যখন মাতৃগর্ভে, তখন এই বিবাহ কারণেই আমার জীবনমধ্যে প্রধান ঘটনা ঘটিল। সেই সময়ে একদিন পিতা তাঁহার জামাতাকে সমভিব্যাহারে করিয়া আশ্রমে আসিলেন। আমার নিকট মন্ত্রশিষ্য বলিয়া পরিচয় দিলেন, স্বর্গীয় প্রভুর নিকট প্রকৃত পরিচয় পাইলাম।

যে অবধি তাঁহাকে দেখিলাম, সেই অবধি আপন চিত্ত পরের হইল। কিন্তু কি বলিয়াই বা সে সব কথা আপনাকে বলি? বীরেন্দ্রসিংহ বিবাহ ভিন্ন আমাকে লাভ করিতে পারিবেন না বুঝিলেন। পিতাও সকল বৃত্তান্ত অনুভবে জানিতে পারিলেন; একদিন উভয়ে এইরূপ কথোপকথন হইতেছিল, অন্তরাল হইতে শুনিতে পাইলাম।

পিতা কহিলেন, ‘আমি বিমলাকে ত্যাগ করিয়া কোথাও থাকিতে পারিব না। কিন্তু বিমলা যদি তোমার ধর্মপত্নী হয় তবে আমি তোমার নিকটে থাকিব। আর যদি তোমার সে অভিপ্রায় না থাকে—’

পিতার কথা সমাপ্ত না হইতে হইতেই স্বর্গীয় দেব কিঞ্চিৎ রুষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘ঠাকুর! শূদ্রী-কন্যাকে কি প্রকারে বিবাহ করিব?’

পিতা শ্লেষ করিয়া কহিলেন, ‘জারজা কন্যাকে বিবাহ করিলে কি প্রকারে?’

প্রাণেশ্বর কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, ‘যখন বিবাহ করিয়াছিলাম, তখন জানিতাম না যে, সে জারজা। জানিয়া শুনিয়া শূদ্রীকে কি প্রকারে বিবাহ করিব? আর আপনার জ্যেষ্ঠা কন্যা জারজা হইলেও শূদ্রী নহে।’

পিতা কহিলেন, ‘তুমি বিবাহে অস্বীকৃত হইলে, উত্তম। তোমার যাতায়াতে বিমলার অনিষ্ট ঘটিতেছে, তোমার আর এ আশ্রমে আসিবার প্রয়োজন করে না। তোমার গৃহেই আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবেক।’

সে অবধিই তিনি কিয়দ্দিবস যাতায়াত ত্যাগ করিলেন। আমি চাতকীর ন্যায় প্রতিদিবস তাঁহার আগমন প্রত্যাশা করিতাম; কিন্তু কিছু কাল আশা নিষ্ফল হইতে লাগিল। বোধ করি, তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। পুনর্বার পূর্বমত যাতায়াত করিতে লাগিলেন। এজন্য পুনর্বার তাঁহার দর্শন পাইয়া আর তত লজ্জাশীলা রহিলাম না। পিতা তাহা পর্যবেক্ষণ করিলেন। একদিন আমাকে ডাকিয়া কহিলেন, ‘আমি অনাশ্রম-ব্রত-ধর্ম অবলম্বন করিয়াছি; চিরদিন আমার কন্যার সহ বাস ঘটিবেক না। আমি স্থানে স্থানে পর্যটন করিতে যাইব, তুমি তখন কোথায় থাকিবে?’

আমি পিতার বিরহাশঙ্কায় অত্যন্ত কাতর হইয়া রোদন করিতে লাগিলাম। কহিলাম, ‘আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে যাইব। না হয়, যেরূপ কাশীধামে একাকিনী ছিলাম, এখানেও সেইরূপ থাকিব।’

পিতা কহিলেন, ‘না বিমলে! আমি তদপেক্ষা উত্তম সঙ্কল্প করিয়াছি। আমার অনবস্থানকালে তোমার সুরক্ষক বিধান করিব। তুমি মহারাজ মানসিংহের নবোঢ়া মহিষীর সাহচর্যে নিযুক্ত থাকিবে।’

আমি কাঁদিয়া কহিলাম, ‘তুমি আমাকে পরিত্যাগ করিও না।’ পিতা কহিলেন, ‘না, আমি এক্ষণে কোথাও যাইব না। তুমি এখন মানসিংহের গৃহে যাও। আমি এখানেই রহিলাম; প্রত্যহই তোমাকে দেখিয়া আসিব। তুমি তথায় কিরূপ থাক, তাহা বুঝিয়া কর্তব্য বিধান করিব।’

যুবরাজ! আমি তোমাদিগের গৃহে পুরাঙ্গনা হইলাম। কৌশলে পিতা আমাকে নিজ জামাতার চক্ষুঃপথ হইতে দূর করিলেন।

যুবরাজ! আমি তোমার পিতৃভবনে অনেক দিন পৌরস্ত্রী হইয়া ছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে চেন না। তুমি তখন দশমবর্ষীয় বালক মাত্র; অম্বরের রাজবাটীতে মাতৃ-সন্নিধানে থাকিতে, আমি তোমার (নবোঢ়া) বিমাতার সাহচর্যে দিল্লীতে নিযুক্ত থাকিতাম। কুসুমের মালার তুল্য মহারাজ মানসিংহের কণ্ঠে অগণতিসংখ্যা রমণীরাজি গ্রথিত থাকিত; তুমি কি তোমার বিমাতা সকলকেই চিনিতে? যোধপুরসম্ভূতা ঊর্মিলা দেবীকে তোমার স্মরণ হইবে? ঊর্মিলার গুণ তোমার নিকট কত পরিচয় দিব? তিনি আমাকে সহচারিণী দাসী বলিয়া জানিতেন না; আমাকে প্রাণাধিকা সহোদরা ভগিনীর ন্যায় জানিতেন। তিনি আমাকে সযত্নে নানা বিদ্যা শিখাইবার পদবীতে আরূঢ় করিয়া দিলেন। তাঁহারই অনুকম্পায় শিল্পকার্যাদি শিখিলাম। এই যে কদক্ষরসম্বন্ধ পত্রী তোমার নিকট পাঠাইতে সক্ষম হইতেছি, ইহা কেবল তোমার বিমাতা ঊর্মিলা দেবীর অনুকম্পায়।

সখী ঊর্মিলার কৃপায় আরও গুরুতর লাভ হইল। তিনি নিজ প্রীতিচক্ষে আমাকে যেমন দেখিতেন, মহারাজের নিকট সেইরূপ পরিচয় দিতেন। আমার সঙ্গীতাদিতে কিঞ্চিৎ ক্ষমতা জন্মিয়াছিল; তদ্দর্শন শ্রবণেও মহারাজের প্রীতি জন্মিত। যে কারণেই হউক, মহারাজ মানসিংহ আমাকে নিজ পরিবারস্থার ন্যায় ভাবিতেন। তিনি আমার পিতাকে ভক্তি করিতেন; পিতা সর্বদা আমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিতেন।

ঊর্মিলা দেবীর নিকট আমি সর্বাংশে সুখী ছিলাম। কেবল এক মাত্র পরিতাপ যে, যাঁহার জন্য ধর্ম ভিন্ন সর্বত্যাগী হইতে প্রস্তুত ছিলাম, তাঁহার দর্শন পাইতাম না। তিনিই কি আমাকে বিস্মৃত হইয়াছিলেন? তাহা নহে। যুবরাজ! আশমানি নাম্নী পরিচারিকাকে কি আপনার স্মরণ হয়? হইতেও পারে। আশমানির সহিত আমার বিশেষ সম্প্রীতি ঘটিল; আমি তাহাকে প্রভুর সংবাদ আনিতে পাঠাইলাম। সে তাঁহার অনুসন্ধান করিয়া তাঁহাকে আমার সংবাদ দিয়া আসিল। প্রত্যুত্তরে তিনি আমাকে কত কথা কহিয়া পাঠাইলেন, তাহা কি বলিব? আমি আশমানির হস্তে তাঁহাকে পত্র লিখিয়া পাঠাইলাম, তিনিও তাহার প্রত্যুত্তর পাঠাইলেন। পুনঃ পুনঃ ঐরূপ ঘটিতে লাগিল। এই প্রকার অদর্শনেও পরস্পর কথোপকথন করিতে লাগিলাম।

এই প্রণালীতে তিন বৎসর কাটিয়া গেল। যখন তিন বৎসরের বিচ্ছেদেও পরস্পর বিস্মৃত হইলাম না, তখন উভয়েই বুঝিলাম যে, এ প্রণয় শৈবালপুষ্পের ন্যায় কেবল উপরে ভাসমান নহে, পদ্মের ন্যায় ভিতরে বদ্ধমূল। কি কারণে বলিতে পারি না, এই সময়ে তাঁহারও ধৈর্যাবশেষ হইল। একদিন তিনি বিপরীত ঘটাইলেন। নিশাকালে একাকিনী শয়নকক্ষে শয়ন করিয়াছিলাম, অকস্মাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইলে স্তিমিত দীপালোকে দেখিলাম, শিওরে একজন মনুষ্য।

মধুর শব্দে আমার কর্ণরন্ধ্রে এই বাক্য প্রবেশ করিল যে, ‘প্রাণেশ্বরী! ভয় পাইও না। আমি তোমারই একান্ত দাস।’

আমি কি উত্তর দিব? তিন বৎসরের পর সাক্ষাৎ। সকল কথা ভুলিয়া গেলাম– তাঁহার কণ্ঠলগ্ন হইয়া রোদন করিতে লাগিলাম। শীঘ্র মরিব, তাই আর আমার লজ্জা নাই–সকল কথা বলিতে পারিতেছি।

যখন আমার বাক্যস্ফূর্তি হইল, তখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুমি কেমন করিয়া এ পুরীর মধ্যে আসিলে?’

তিনি কহিলেন, ‘আশমানিকে জিজ্ঞাসা কর; তাহার সমভিব্যাহারে বারিবাহক দাস সাজিয়া পুরীমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলাম; সেই পর্যন্ত লুক্কায়িত আছি।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এখন?’

তিনি কহিলেন, ‘আর কি? তুমি যাহা কর।’

আমি চিন্তা করিতে লাগিলাম, কি করি? কোন্ দিক রাখি? চিত্ত যে দিকে লয়, সেই দিকে মতি হইতে লাগিল। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে অকস্মাৎ আমার শয়নকক্ষের দ্বার মুক্ত হইয়া গেল। সম্মুখে দেখি, মহারাজ মানসিংহ!

বিস্তারে আবশ্যক কি? বীরেন্দ্রসিংহ কারাগারে আবদ্ধ হইলেন। মহারাজ এরূপ প্রকাশ করিলেন যে, তাঁহাকে রাজদণ্ডে দণ্ডিত করিবেন। আমার হৃদয়মধ্যে কিরূপ হইতে লাগিল, তাহা বোধ করি বুঝিতে পারিবেন। আমি কান্দিয়া ঊর্মিলা দেবীর পদতলে পড়িলাম, আত্মদোষ সকল ব্যক্ত করিলাম; সকল দোষ আপনার স্কন্ধে স্বীকার করিয়া লইলাম। পিতার সহিত সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারও চরণে লুণ্ঠিত হইলাম। মহারাজ তাঁহাকে ভক্তি করেন; তাঁহাকে গুরুবৎ শ্রদ্ধা করেন; অবশ্য তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিবেন। কহিলাম, ‘আপনার জ্যেষ্ঠা কন্যাকে স্মরণ করুন।’ বোধ করি, পিতা মহারাজের সহিত একত্র যুক্তি করিয়াছিলেন। তিনি আমার রোদনে কর্ণপাতও করিলেন না। রুষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘পাপীয়সি! তুই একেবারে লজ্জা ত্যাগ করিয়াছিস!’

ঊর্মিলা দেবী আমার প্রাণরক্ষার্থ মহারাজের নিকট বহুবিধ কহিলেন, মহারাজ কহিলেন, ‘আমি তবে চোরকে মুক্ত করি, সে যদি বিমলাকে বিবাহ করে।’

আমি তখন মহারাজের অভিসন্ধি বুঝিয়া নিঃশব্দ হইলাম। প্রাণেশ্বর মহারাজের বাক্যে বিষম রুষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘আমি যাবজ্জীবন কারাগারে থাকিব, সেও ভাল; প্রাণদণ্ড নিব, সেও ভাল; তথাপি শূদ্রী-কন্যাকে কখন বিবাহ করিব না। আপনি হিন্দু হইয়া কি প্রকারে এমন অনুরোধ করিতেছেন?’

মহারাজ কহিলেন, ‘যখন আমার ভগিনীকে শাহজাদা সেলিমের সহিত বিবাহ দিতে পারিয়াছি, তখন তোমাকে ব্রাহ্মণকন্যাকে বিবাহ করিতে অনুরোধ করিব, বিচিত্র কি?’

তথাপি তিনি সম্মতি হইলেন না। বরং কহিলেন, ‘মহারাজ, যাহা হইবার, তাহা হইল। আমাকে মুক্তি দিউন, আমি বিমলার আর কখনও নাম করিব না।’মহারাজ কহিলেন, ‘তাহা হইলে তুমি যে অপরাধ করিয়াছ, তাহার প্রায়শ্চিত্ত হইল কই? তুমি বিমলাকে ত্যাগ করিবে, অন্য জনে তাহাকে কলঙ্কিনী বলিয়া ঘৃণা করিয়া স্পর্শ করিবে না।’

তথাপি আশু তাঁহার বিবাহে মতি লইল না। পরিশেষে যখন আর কারাগার-যন্ত্রণা সহ্য হইল না, তখন অগত্যা অর্ধসম্মত হইয়া কহিলেন, ‘বিমলা যদি আমার গৃহে পরিচারিকা হইয়া থাকিতে পারে, বিবাহের কথা আমার জীবিতকালে কখন উত্থাপন না করে, আমার ধর্মপত্নী বলিয়া কখন পরিচয় না দেয়, তবে শূদ্রীকে বিবাহ করি, নচেৎ নহে।’

আমি বিপুল পুলকসহকারে তাহাই স্বীকার করিলাম। আমি ধন গৌরব পরিচয়াদির জন্য কাতর ছিলাম না। পিতা এবং মহারাজ উভয়েই সম্মত হইলেন। আমি দাসীবেশে রাজভবন হইতে নিজ ভর্তৃভবনে আসিলাম।

অনিচ্ছায়, পরবল-পীড়ায় তিনি আমাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। এমন অবস্থায় বিবাহ করিলে কে স্ত্রীকে আদর করিতে পারে? বিবাহের পরে প্রভু আমাকে বিষ দেখিতে লাগিলেন। পূর্বের প্রণয় তৎকালে একেবারে দূর হইল। মহারাজ মানসিংহকৃত অপমান সর্বদা স্মরণ করিয়া আমাকে তিরস্কার করিতেন, সে তিরস্কারও আমার আদর বোধ হইত। এইরূপে কিছুকাল গেল; কিন্তু সে সকল পরিচয়েই বা প্রয়োজন কি? আমার পরিচয় দেওয়া হইয়াছে, অন্য কথা আবশ্যক নহে। কালে আমি পুনর্বার স্বামিপ্রণয়ভাগিনী হইয়াছিলাম, কিন্তু অম্বরপতির প্রতি তাঁহার পূর্ববৎ বিষদৃষ্টি রহিল। কপালের লিখন! নচেৎ এ সব ঘটিবে কেন?

আমার পরিচয় দেওয়া শেষ হইল। কেবল আত্মপ্রতিশ্রুতি উদ্ধার করাই আমার উদ্দেশ্য নহে। অনেকে মনে করে, আমি কুলধর্ম বিসর্জন করিয়া গড় মান্দারণের অধিপতির নিকট ছিলাম। আমার লোকান্তর হইলে, নাম হইতে সে কালি আপনি মুছাইবেন, এই ভরসাতেই আপনাকে এত লিখিলাম।

এই পত্রে কেবল আত্মবিবরণই লিখিলাম। যাহার সংবাদ জন্য আপনি চঞ্চলচিত্ত, তাহার নামোল্লেখও করিলাম না। মনে করুন, সে নাম এ পৃথিবীতে লোপ হইয়াছে। তিলোত্তমা বলিয়া যে কেহ কখন ছিল, তাহা বিস্মৃত হউন।—”

ওসমান লিপিপাঠ সমাপ্ত করিয়া কহিলেন, “মা! আপনি আমার জীবন রক্ষা করিয়াছিলেন, আমি আপনার প্রত্যুপকার করিব।”

বিমলা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “আর আমার পৃথিবীতে উপকার কি আছে? তুমি আমার কি উপকার করিবে! তবে এক উপকার—”

ওসমান কহিলেন “আমি তাহাই সাধন করিব।”

বিমলার চক্ষু প্রোজ্জ্বল হইল, কহিলেন, “ওসমান! কি কহিতেছ? এ দগ্ধ হৃদয়কে আর কেন প্রবঞ্চনা কর?”

ওসমান হস্ত হইতে একটি অঙ্গুরীয় মুক্ত করিয়া কহিলেন, “এই অঙ্গুরীয় গ্রহণ কর, দুই এক দিন মধ্যে কিছু সাধন হইবে না। কতলু খাঁর জন্মদিন আগতপ্রায়, সে দিবস বড় উৎসব হইয়া থাকে। প্রহরিগণ আমোদে মত্ত থাকে। সেই দিবস আমি তোমাকে উদ্ধার করিব। তুমি সেই দিবস নিশীথে অন্তঃপুরদ্বারে আসিও; যদি তথায় কেহ তোমাকে এইরূপ দ্বিতীয় অঙ্গুরীয় দৃষ্ট করায়, তবে তুমি তাহার সঙ্গে বাহিরে আসিও; ভরসা করি, নিষ্কণ্টক আসিতে পারিবে। তবে জগদীশ্বরের ইচ্ছা।”

বিমলা কহিলেন, “জগদীশ্বর তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন, আমি অধিক কি বলিব।”

বিমলা রুদ্ধকণ্ঠ হইয়া আর কথা কহিতে পারিলেন না।

বিমলা ওসমানকে আশীর্বাদ করিয়া বিদায় লইবেন, এমন সময়ে ওসমান কহিলেন, “এক কথা সাবধান করিয়া দিই। একাকিনী আসিবেন। আপনার সঙ্গে কেহ সঙ্গিনী থাকিলে কার্য সিদ্ধ হইবে না, বরং প্রমাদ ঘটিবে।”

বিমলা বুঝিতে পারিলেন যে, ওসমান তিলোত্তমাকে সঙ্গে আনিতে নিষেধ করিতেছেন। মনে মনে ভাবিলেন, “ভাল, দুই জন না যাইতে পারি, তিলোত্তমা একাই আসিবে।”

বিমলা বিদায় হইলেন।