দুর্গের যে ভাগে দুর্গমূল বিধৌত করিয়া আমোদর নদী কলকল রবে প্রবহণ করে, সেই অংশে এক কক্ষবাতায়নে বসিয়া তিলোত্তমা নদীজলাবর্ত নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। সায়াহ্নকাল উপস্থিত, পশ্চিমগগনে অস্তাচলগত দিনমণির ম্লান কিরণে যে সকল মেঘ কাঞ্চনকান্তি ধারণ করিয়াছিল, তৎসহিত নীলাম্বরপ্রতিবিম্ব স্রোতস্বতীজলমধ্যে কম্পিত হইতেছিল; নদীপারস্থিত উচ্চ অট্টালিকা এবং দীর্ঘ তরুবর সকল বিমলাকাশপটে চিত্রবৎ দেখাইতেছিল; দুর্গমধ্যে ময়ূর সারসাদি কলনাদী পক্ষিগণ প্রফুল্লচিত্তে রব করিতেছিল; কোথাও রজনীর উদয়ে নীড়ান্বেষণে ব্যস্ত বিহঙ্গম নীলাম্বর-তলে বিনা শব্দে উড়িতেছিল; আম্রকানন দোলাইয়া আমোদর-স্পর্শ-শীতল নৈদাঘ বায়ু তিলোত্তমার অলককুন্তল অথবা অংসারূঢ় চারুবাস কম্পিত করিতেছিল।

তিলোত্তমা সুন্দরী। পাঠক! কখন কিশোর বয়সে কোন স্থিরা, ধীরা, কোমল-প্রকৃতি কিশোরীর নবসঞ্চারিত লাবণ্য প্রেমচক্ষুতে দেখিয়াছেন? একবার মাত্র দেখিয়া চিরজীবন মধ্যে যাহার মাধুর্য বিস্মৃত হইতে পারেন নাই; কৈশোরে, যৌবনে, প্রগলভর বয়সে, কার্যে, বিশ্রামে, জাগ্রতে, নিদ্রায়, পুনঃপুনঃ যে মনোমোহিনী মূর্তি স্মরণ-পথে স্বপ্নবৎ যাতায়াত করে, অথচ তৎসম্বন্ধে কখনও চিত্তমালিন্যজনক লালসা জন্মায় না, এমন তরুণী দেখিয়াছেন? যদি দেখিয়া থাকেন, তবেই তিলোত্তমার অবয়ব মনোমধ্যে স্বরূপ অনুভূত করিতে পারিবেন। যে মূর্তি সৌন্দর্যপ্রভাপ্রাচুর্যে মন প্রদীপ্ত করে, যে মূর্তি কোমলতা, মাধুর্যাদি গুণে চিত্তের সন্তুষ্টি জন্মায়, এ সেই মূর্তি। যে মূর্তি সন্ধ্যাসমীরণ-কম্পিতা বসন্তলতার ন্যায় স্মৃতিমধ্যে দুলিতে থাকে, এ সেই মূর্তি।

তিলোত্তমার বয়স ষোড়শ বৎসর, সুতরাং তাঁহার দেহায়তন প্রগলভ।বয়সী রমণীদিগের ন্যায় অদ্যাপি সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় নাই। দেহায়তনে ও মুখাবয়বে কিঞ্চিৎ বালিকাভাব ছিল। সুগঠিত সুগোল ললাট, অপ্রশস্ত নহে, অথচ অতিপ্রশস্তও নহে, নিশীথ-কৌমুদীদীপ্ত নদীর ন্যায় প্রশান্তভাব-প্রকাশক; তৎপার্শ্বে অতি নিবিড়-বর্ণ কুঞ্চিতালক কেশসকল ভ্রূযুগে, কপোলে, গণ্ডে, অংসে, উরসে আসিয়া পড়িয়াছে; মস্তকের পশ্চাদ্ভাগের অন্ধকারময় কেশরাশি সুবিন্যস্ত মুক্তাহারে গ্রথিত রহিয়াছে; ললাটতলে ভ্রূযুগ সুবঙ্কিম, নিবিড় বর্ণ, চিত্রকরলিখিতবৎ হইয়াও কিঞ্চিৎ অধিক সূক্ষ্মাকার; আর এক সূতা স্থূল হইলে নির্দোষ হইত। পাঠক কি চঞ্চল চক্ষু ভালবাস? তবে তিলোত্তমা তোমার মনোরঞ্জিনী হইতে পারিবে না। তিলোত্তমার চক্ষু অতি শান্ত; তাহাতে “বিদ্যুদ্দামস্ফুরণচকিত” কটাক্ষ নিক্ষেপ হইত না। চক্ষু দুটি অতি প্রশস্ত, অতি সুঠাম, অতি শান্তজ্যোতিঃ। আর চক্ষুর বর্ণ, ঊষাকালে সূর্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্বে, চন্দ্রাস্তের সময়ে আকাশের যে কোমল নীলবর্ণ প্রকাশ পায়, সেইরূপ; সেই প্রশস্ত পরিষ্কার চক্ষে যখন তিলোত্তমা দৃষ্টি করিতেন, তখন তাহাতে কিছুমাত্র কুটিলতা থাকিত না; তিলোত্তমা অপাঙ্গে অর্ধদৃষ্টি করিতে জানিতেন না, দৃষ্টিতে কেবল স্পষ্টতা আর সরলতা; দৃষ্টির সরলতাও বটে; মনের সরলতাও বটে; তবে যদি তাঁহার পানে কেহ চাহিয়া দেখিত, তবে তৎক্ষণাৎ কোমল পল্লব দুখানি পড়িয়া যাইত; তিলোত্তমা তখন ধরাতল ভিন্ন অন্যত্র দৃষ্টি করিতেন না। ওষ্ঠাধর দুখানি গোলাবী, রসে টলমল করিত; ছোট ছোট, একটু ঘুরান, একটু ফুলান, একটু হাসি হাসি; সে ওষ্ঠাধারে যদি একবার হাসি দেখিতে হবে তবে যোগী হও, মুনি হও, যুবা হও, বৃদ্ধ হও, আর ভুলিতে পারিতে না। অথচ সে হাসিতে সরলতা ও বালিকাভাব ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।

তিলোত্তমার শরীর সুগঠন হইয়াও পূর্ণায়ত ছিল না; বয়সের নবীনতা প্রযুক্তই হউক বা শরীরের স্বাভাবিক গঠনের জন্যই হউক, এই সুন্দর দেহে ক্ষীণতা ব্যতীত স্থূলতাগুণ ছিল না। অথচ তন্বীর শরীর মধ্যে সকল স্থানই সুগোল আর সুললিত। সুগোল প্রকোষ্ঠে রত্নবলয়; সুগোল বাহুতে হীরকমণ্ডিত তাড়; সুগোল অঙ্গুলিতে অঙ্গুরীয়; সুগোল ঊরুতে মেখলা; সুগঠন অংসোপরে স্বর্ণহার, সুগঠন কণ্ঠে রত্নকণ্ঠী; সর্বত্রের গঠন সুন্দর।

তিলোত্তমা একাকিনী কক্ষবাতায়নে বসিয়া কি করিতেছেন? সায়াহ্নগগনের শোভা নিরীক্ষণ করিতেছেন? তাহা হইলে ভূতলে চক্ষু কেন? নদীতীরজ কুসুমবাসিত বায়ুসেবন করিতেছেন? তাহা হইলে ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম হইবে কেন? মুখের এক পার্শ্ব ব্যতীত বায়ু লাগিতেছে না। গোচারণ দেখিতেছেন? তাও নয়, গাভীসকল ত ক্রমে ক্রমে গৃহে আসিল; কোকিল-রব শুনিতেছেন? তবে মুখ এত ম্লান কেন? তিলোত্তমা কিছুই দেখিতেছেন না, শুনিতেছেন না, চিন্তা করিতেছেন।

দাসীতে প্রদীপ জ্বালিয়া আনিল। তিলোত্তমা চিন্তা ত্যাগ করিয়া একখানা পুস্তক লইয়া প্রদীপের কাছে বসিলেন। তিলোত্তমা পড়িতে জানিতেন; অভিরাম স্বামীর নিকট সংস্কৃত পড়িতে শিখিয়াছিলেন। পুস্তকখানি কাদম্বরী। কিয়ৎক্ষণ পড়িয়া বিরক্তি প্রকাশ করিয়া কাদম্বরী পরিত্যাগ করিলেন। আর একখানা পুস্তক আনিলেন; সুবন্ধুকৃত বাসবদত্তা; কখন পড়েন, কখন ভাবেন, আর বার পড়েন; আর বার অন্যমনে ভাবেন; বাসবদত্তাও ভাল লাগিল না। তাহা ত্যাগ করিয়া গীতগোবিন্দ পড়িতে লাগিলেন; গীতগোবিন্দ কিছুক্ষণ ভাল লাগিল, পড়িতে পড়িতে সলজ্জ ঈষৎ হাসি হাসিয়া পুস্তক নিক্ষেপ করিলেন। পরে নিষ্কর্মা হইয়া শয্যার উপর বসিয়া রহিলেন। নিকটে একটা লেখনী ও মসীপাত্র ছিল; অন্যমনে তাহা লইয়া পালঙ্কের কাষ্ঠে এ ও তা “ক” “স” “ম” ঘর, দ্বার, গাছ, মানুষ ইত্যাদি লিখিতে লাগিলেন; ক্রমে ক্রমে খাটের এক বাজু কালির চিহ্নে পরিপূর্ণ হইল; যখন আর স্থান নাই, তখন সে বিষয়ে চেতনা হইল। নিজ কার্য দেখিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন; আবার কি লিখিয়াছেন, তাহা হাসিতে হাসিতে পড়িতে লাগিলেন। কি লিখিয়াছেন? “বাসবদত্তা,” “মহাশ্বেতা,” “ক”, “ঈ”, “ই,” “প”, একটা বৃক্ষ, সেঁজুতির শিব, “গীতগোবিন্দ”, “বিমলা”, লতা, পাতা, হিজি, বিজি, গড়–সর্বনাশ, আর কি লিখিয়াছেন?

“কুমার জগৎসিংহ”

লজ্জায় তিলোত্তমার মুখ রক্তবর্ণ হইল। নির্বুদ্ধি! ঘরে কে আছে যে লজ্জা?

“কুমার জগৎসিংহ।” তিলোত্তমা দুইবার, তিনবার, বহুবার পাঠ করিলেন; দ্বারের দিকে চাহেন আর পাঠ করেন; পুনর্বার চাহেন আর পাঠ করেন, যেন চোর চুরি করিতেছে।

বড় অধিকক্ষণ পাঠ করিতে সাহস হইল না, কেহ আসিয়া দেখিতে পাইবে। অতি ব্যস্তে জল আনিয়া লিপি ধৌত করিলেন; ধৌত করিয়া মনঃপুত হইল না; বস্ত্র দিয়া উত্তম করিয়া মুছিলেন; আবার পড়িয়া দেখিলেন, কালির চিহ্ন মাত্র নাই; তথাপি বোধ হইল, যেন এখনও পড়া যায়; আবার জল আনিয়া ধুইলেন, আবার বস্ত্র দিয়া মুছিলেন, তথাপি বোধ হইতে লাগিল, যেন লেখা রহিয়াছে–

(“কুমার জগৎসিংহ”।)